“এক যে আছে বন, তার নাম সোঁদরবন। সে বনে কতো রকমের গাস। সুন্দরি, গরান, গেঁওয়া, ধুধুল, শণ, নলখাগড়া, গোলপাতা। বনে কত রকমের পশু পাখি, কি সোন্দর ডাগর ডোগর সিত্রা হরিণ, ঝাঁক বাঁধি ঘুরতিসে। বনের গাছে গাছে ফোটে ফুল, মউমাসির দল বাসা করে। চাক বানায়, চাক ভরে আসে খাঁটি মধু। আমরা মৌয়ালের দল সে চাক কাটি নে আসি মধু। মধু বড়ো সহজে না মিলে বাপ! যেতে হয় গহিন বনে। সেখেনে পদে পদে বেপদ। পান থিক্যা চুন খসলি অঁক তুইল্যা মিত্তু। কেন বলদিনি? আরে, এও জানো না! সুন্দরবন হইল জলে কুমির ডাঙ্গায় বাবা-দের আস্তানা। সে বাবার নাম ধরা বারণ। জয় বাবা রায়মঙ্গল, জয় মা বনবিবি!”
কপালে দু হাত জড়ো করে পেন্নাম ঠুকত তুলসীর মা। যাদবপুরের আমাদের ভাড়াবাড়ির চিলেকোঠায় বসে এমন কতো গল্প শুনে শুনে কেটেছে আমার দিনগুলো। তখন আমার নিতান্ত শিশুবেলা। তুলসীর মা’র বলা বন জঙ্গলের গল্প গোগ্রাসে গিলে রাত্তিরে স্বপ্ন দেখতাম বনবিবির মত সুন্দরবনের রাজা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পিঠে চড়ে আমি সারা বন দাপিয়ে বেড়াচ্ছি!
বছর দুয়েক আগে সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগ এসে গেছিল। উদ্দেশ্য ছিল শুধু সুন্দরবনের ভয়াল রূপ দেখাই নয়, বনের আশেপাশের গ্রাম গুলোতে ঘুরে ফিরে মানুষের দিনযাপনের নক্সিকাঁথার বুনন দেখব, এটাও ছিল বাসনা।
বেরোবার মুখে মা বল্লেন, —“হ্যাঁ রে, তোর তুলসীর মাকে মনে আছে?”
স্মৃতির অলিন্দ পথে ভেসে এল কালকোলো এক দোহারা চেহারা। “ছদ্দি, ছদ্দি” নাম ধরে আমাকে ডাকত, আর আমার যাবতীয় বিচ্ছুপনার ঘুষিঘুষো একটি নিখুঁত পাঞ্চিং ব্যাগের মতই সহ্য করত।
“হ্যাঁ, মনে আছে, কিন্তু তার কথা কেন?” যাত্রার ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললাম।
“সুন্দরবনের কোন এক গ্রামে বাসা ছিল ওর, কী বেশ নাম বলেছিল, কুলতলি নাকি!”
আমি অত মন দিলাম না মা’র কথায়। হপ্তা খানেকের ট্যুর, দরকারি জিনিষপত্র হাতের কাছে যেন পাই, এই ভেবে গোছানোর কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাকে বললাম, “ট্যুর ম্যানেজার কুলতলি গ্রামের মৈপীঠ গ্রামের কথা বলছিলেন বটে! মোটামুটি পাঁচ-ছ খানা গ্রাম কভার করার ইচ্ছে, দেখা যাক, কতটা কী হয়! তাছাড়া এত বছর পরে আর তার খোঁজ কি পাব! তুমিই তো বলেছিলে তার আগে পিছে নেই তেমন কেউ!”
মা বললেন, “সুন্দরবনের নাম শুনে ওর কথা মনে পড়ে গেল! যতদূর জানতাম ওর কে এক ভাইপো আছে, তবে নাম জানি না বাপু।”
আমি আলতো গলায় বললাম, “কী ব্যাপার মা! হঠাৎ তুলসীর মা’র খোঁজে উঠে পড়ে লাগলে! আমি তখন ছোট হলেও এটুকু বেশ মনে আছে, মাঝে মাঝেই তোমার সঙ্গে তুলসীর মা’র কিন্তু শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই বেঁধে যেত।”
মা হেসে বললেন — “তা কী করব বল! তখন আমার মর্নিং স্কুল, তুই ছোট। সংসারের উনকোটি কাজ! তোকে কোথায় সে সামলাবে, না, তার আবার মাঝে মাঝে উঠত জঙ্গল বাই, তখন তার মন উচাটন, কাজে ঢিলেমি, মুখ হাঁড়ি! আসলে দেশের নেশা ওদের রক্তে। শহরে এসে ওদের হাল হয় জল হীন মীনের মতন। তুই পারলে একবার খোঁজ করিস, যা হোক তা হোক, এক সময় তোর জন্য অনেক করেছে সে।”
তুলসীর মা সুন্দরবনের বাদা বন থেকে কি ভাবে যে শহর কলকাতায় আমাদের বাসাবাড়ীতে এসেছিল তা আমার ঠিক জানা নেই। শোনা যায় সব খুইয়ে পেটের দায়ে সে শহরে এসেছিল।
আমার মত দস্যি বাচ্চাকে কব্জা করার ভালো অস্ত্র শানিয়েছিল সে। সুযোগ পেলেই নাওয়া খাওয়ার মতন এই দুটি জটিল কর্মকাণ্ডের সময় সে ধরত ছেলেভুলানোর সহজ রাস্তা। সে রাস্তার দু’ধারে তো বটেই, আঁকেবাঁকেও কত নাম না জানা সুন্দর সুন্দর গল্প।
সুন্দরবন যাওয়ার রাস্তাঘাট এখন অনেক সহজ সুন্দর হয়েছে। রায়মঙ্গল, পিয়ালি, বিদ্যাধরী, মাথাভাঙ্গা, এক একটা সব ডাকাবুকো নদী। একুল ওকুল ছাপান। ভট ভট ভট ভট করে কতো যে স্টিমার, গাদাবোট, মাছুরেদের নৌকো, প্রমোদবিহারের জলযান চলেছে তার আর ইয়ত্তা নেই।
টুরিস্টের দল হাতে চায়ের ফ্লাস্ক আর বোঁচকায় আলু পরোটা বেঁধে হুড়মুড় করে ঘাটে ঘাটে নামছে, হা হা হি হি হাসছে, আর ‘বাঘ কৈ! বাঘ কৈ!’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে। যেন জঙ্গলে নয়, চিড়িয়াখানায় এসেছে। বাঘ তাদের মামাবাড়ির আবদারটি সেজে হেঁতালের বনে ঘাপটি দিয়ে আছে, ভাগ্না ভাগ্নির দল গেলেই দন্তপাটি মেলে বেরিয়ে আসবে!
তিতিবিরক্ত হয়ে নদীর চড়ে কেবল বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ দেখেই সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার বলরাম বাবুকে বললাম — “এখানে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঘোরার বাবস্থা করুন।”
বলরাম বাবু বললেন, “নিশ্চয়ই!” তাই পরদিন দুপুরের সূর্যের তাপ কমতে না কমতেই আমরা এসেছি কুলতলির মৈপীঠ গ্রামে।
গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ জেলে, মউলে, নয়তো কাঁকড়া মারার দল। এদের ঘর পড়শি সোঁদরবনের কেঁদো বাঘ। আলাপ হল ছিনাত সাঁইদারের সাথে। “ কী করেন?” জানতে চাইলে বললেন — “আমরা জাত মৌয়াল, মধুর জোগাড় করাই মোদের কাজ।”
“কী রকম আমদানি হয়?”
আমার প্রশ্ন শুনে হাসলেন। “তা হয় বৈকি! এক এক লপ্তে বারো কিলো অব্দি মধু পাইসি।”
কথার মাঝে সাঁইদার গৃহিণী গরম গরম পরোটা মধু মাখিয়ে এনে বললেন, “খাইয়া দেখেন!”
ছিনাথ থালার দিকে চেয়ে বললেন — “এইটা হইল সবচেয়ে ভালো মানের। খোলসি ফুলের পদ্মমধু। মানের দিক থেকে ভালো আসে গরান আর গর্জন ফুলের বালিহার মধু। আর আসে মরশুমের এক্কেরে শেষের দিকে কেওড়া আর গেঁওয়া ফুলের মধু, তবে স্বাদে বড়ো ফিকা!”
“মধু সংগ্রহ তো চাট্টিখানি কথা না। বাঘের দেখা পেয়েছেন?”
আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে ছিনাথ বললেন, “এই যেমন দুরে আপনি বসে আসেন তদ্দুর থেকে তারে দেখসি।”
মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল — “বলেন কী?”
শুনে ছিনাথ বললেন, “আর কি? সোন্দরবনের বাঘ হইল জগত সেরা। তার উপর আসে তেনার গোঁয়ার, গুমোর। যারে নিবে বলে বাসবে, তারে নিয়ি সারবে!”
গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। গ্রামগঞ্জে যেমন হয় আর কি, আমার শহুরে পোশাক পরে ছিনাথেরর উঠনে বসে চা খাওয়া দেখতে গুটি কয়েক নারী পুরুষ জড়ো হল। তাদেরই এক জন খুব স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলে — “হাঁ, হা, বাঘ আসে! ধরিও নে যায় আমাদের! ঘুসপেটিয়াদের কে পসন্দ করে বলেন? বাদা বনে আমরা যাই প্যাটের তরে, তা সে কথা বাবা রায়মঙ্গলের বুঝার ত কথা নয়!”
বুঝলাম বাঘের নাম নিতে ডরায় এই মানুষগুলো, বাঘ এদের জীবনে জনাব রায়মঙ্গল! অবাক হলাম জঙ্গল আর তার বাসিন্দা হিংস্র বাঘকে এরা যথাযোগ্য খাতির করে কথা বলছে। খামকা দোষারোপ না করে নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য নিজেদেরই দায়ী করছে।
গ্রামের রাস্তা দিয়ে বেলা শেষের গরু বাছুর গোয়ালে ফিরছে, তাদের পায়ের খুরে উড়ছে গোধুল। ফিরছে ছেলে মেয়ে কচিকাঁচার দল। তাদের কারো কারো পরনে স্কুলের পোশাক, কেউ বা কাঁখে মাথায় মস্ত মস্ত এনামেলের হাঁড়িতে মীন ভরে ঘরের পানে চলেছে। পেট চালাতে এই শিশু কিশোরের দল তাদের মায়েদের সাথে সারাদিন নোনা জলে ডুবে ডুবে মীন ধরে। কোমর কাদায় ডুবে চড়ের গর্ত থেকে কাঁকড়া ধরে হাঁড়িতে।
দূরের মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। পাড়ার চা বিস্কুটের দোকানের সামনে পাতা কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চিতে গোটা কয়েক গাল তোবড়ান জীবন যুদ্ধের সৈনিক, মাটির ভাঁড়ে পটোল বিস্কুট ডুবিয়ে চা খাচ্ছে। কৈ, তাদের মুখে চোখে দেখি না তো অভাব অভিযোগের দারুণ ভ্রুকুটি কুটিলতা ! তবে কি এই কথাই সত্য, যে ‘এ জগতে হায়, সেই বেশী চায়, আছে যার ভুরি ভুরি?’
“একটু যদি কিছু বলেন, আপনাদের অভিজ্ঞতার গল্প, শুনতাম, জানতে পারতাম আপনাদের জীবনের কথা।”
শুনে কালো কালো চেহারার হাড় জিরজিরে মানুষগুলো সাদা সাদা দাঁত বের করে হাসে। “আমাদের জেবনের আবার গল্প কী? আমরা প্যাটের দায়ে জঙ্গলে যাই। আগে আগে তাও চাষবাস কিসু হতো। এখন পেরায় জল ঝড়ের জন্যি জোয়ারের জল আসি গেরামের ক্ষেতিবাড়ি সব সব্বনাশ করি দিসে।”
ছিনাথের সঙ্গে আরও কিছু গল্প করে সেদিনের মতন হোটেলে ফিরতে হল। ম্যানেজারবাবু অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছিলেন, “সন্ধ্যে হয়ে আসছে, লঞ্চ ধরার জন্য বাঁধের উপর দিয়ে অনেক খানি যাওয়া। এবার উঠলে হয়!” ইত্যাদি… অতএব ওঠা গেল। ঠিক হল কাল ছিনাথের ঘরে আমি দুপুরের ভাত খাব, আর তাঁর কিছু ভয়াল ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনব।
আজ দুপুর থেকেই আকাশের মুখ কালো মেঘে ঢাকা ছিল। প্ল্যান মাফিক ছিনাথের ঘরে পৌঁছলাম যখন, তখন বৃষ্টি পড়ছে রীতিমত জোরে। সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে আজ, এই গভীর সাঁঝে, এখনও। আধ ঘণ্টা হল হোটেলে ফিরে আমার ডাইরি খুলে লিখতে বসেছি। সত্যি! মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য কি নির্মম জীবিকার পথ বেছে নিতে হয়, ছিনাথের ঘরে গিয়ে আজ তা বুঝেছি।
জন্ম থেকেই ছিনাথ জানতেন তাঁর জন্মস্থান গোলাপের পাপড়ি বিছান নয়, বরং উল্টোটা, হিংস্র নখ দাঁত বের করা। কঠিন প্রকৃতি, ভয়াল জীবজন্তু, নোনা ভরা মাটি, দুর্বিষহ বন্যা, সাইক্লোন ঝড়… কী নেই? এই বাদা বনের মানুষগুলো তাই যেন ইস্পাতের মত কঠিন। বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন, শুধু পরনের কাপড়, দু বেলা দু মুঠো ভাত আর মাথার উপর একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তাই জোটাতেই এদের হিমসিম অবস্থা। তার উপর চব্বিশ ঘণ্টা আছে ভয়, মৃত্যুর ভয়!
আজ ছিনাথ ওর পরনের শার্ট খুলে দেখালেন ঘাড়ে, কানের গোড়ায় শুকনো ক্ষতের গভীর গর্তগুলো। শিউরে উঠলাম। “আমি জন্মইস্তক বাপ মা মরা। আমারে কোলে কাঁখে বড়ো করসিল আমার খুড়া খুড়ি। খুড়া আসিল মৌয়াল দলের সর্দার। মউ যাত্রায় তার কথা শ্যাষ কথা। দলের সবার জেবনের ভার খুড়া বইত নিজের কান্ধে। সোঁদোরবনের খাঁড়ি জঙ্গল হাতের তালুর মত সিন্ত খুড়া। তার দলে থাকত পাস, স’ জনার মৌয়াল। তবে এমুন যে সেয়ানা খুড়া সে পজ্জন্ত সমঝে চলত আমার খুড়িরে।” খুব আনমনা গলায় বলে চলছিলেন ছিনাথ।
“খুড়ির বাপ আসিল সাতক্ষীরা গেরামের ডাকসাইটে মৌয়াল। ছেলেবেলায় খুড়ি বাপের পোঁ ধইরা জঙ্গলে জঙ্গলে যাইত। পাঠসালে কিসু পড়াও করসিল খুড়ি। বনের কোথা গেলে মধু পাওয়া যাবে, খুড়ি বাতাসে গন্ধ শুঁকে বলি দিতি পারত। শুধু তাই না, খুড়ির সিল মন্তর তন্তরের বিদ্যা। খুড়ি বাঘ বন্দী মন্তর জানতো।”
শুনে আমার অসম্ভব কৌতূহল হল। আমি ছিনাথকে বললাম, “সে কেমন মন্ত্র ছিনাথ?”
ছিনাথ বললেন — “মৌয়ালদের দলের কিসু নীতিনিয়ম আসে। এক এক দলে থাকেন একজন কৈরা বাউলে। তাদের কাজ বড়ো ভারি। তবে শুনেন, সোঁদোরবনের বাঘ কয়েক শ’ বছর ধইরা কেমন কৈরা এই নোনা মাটির জল জঙ্গলে বাইচ্যাঁ আসে, তা একবার ভাবসেন? নোনা জল, হাঁটু ডোবা কাদা, সুচের মত খাঁড়া খাঁড়া গাছের মূল, যা পায়ে বিঁধলে জান যায়, এত সব সামলাইয়া বাঘ এখানে দাপট দিয়া আসে! ক্যাবল তার চতুর বুদ্ধির জোরে। তার সাথে পাল্লা দেওয়া মুখের কথা কি!
“আগেই বলসি, আমার খুড়ির নাক খান আসিল খাসা। গন্ধ শুঁইক্যা বনের হালচাল ধরতি পারত। খুড়ি জোয়ারের জলে ফুলের ভাসা রেণু দেইখা, পুরুষ মউমাছির উড়ন চরণ, গাছের পাতায় তাদের বিষ্ঠা দেইখ্যা আন্দাজ দিতি পারত কাসে পিঠায়ে কৈ গেলে নাদুস নুদুস চাক পাওয়া যাতি পারে। পসন্দ মত ঘাটে নাও ভিড়াইয়া, আগে কিসু খাওয়ানের লাগে। গুড়, মুড়ি, চিড়া, শুকনা যা জোটে। খালি পেট বাদায় নামা নিষেধ।
হপ্তা দুই ঘর ছাইর্যা ক্যাবল ভাইসা থাকা। বনবিবির থানে পূজা চড়াইয়া, নায়ের গলুই পূজার সিন্দূর মাখাইয়া ‘মা মনসার নামে আল্লা আল্লা বলো, বাবা ফকিরের নামে হরি হরি বলো’ কইর্যা রওনা দেওয়া। তবে, ‘কি হয়, কি হয়’ কইর্যা মনে সব্বদা ভয়।”
“জঙ্গলের মাটিতে নাবি, লাইন দিয়া এক এক জনা চলতি হয়। সবাই বাদায় নাবে না। একজন থাকে নাইয়ে। বাউলে বাঘবন্দি মন্তরের বাণ এমুন মাইর্যা দ্যেয় যে, বাঘের নড়নসড়নের আর উপায়ই থাকে না। বাদা বনে মৌয়ালদের চক্ষু থাকে গাছের উপরি। আর এখানেই বান্ধে যত গোল। রায়মঙ্গলের প্রিয় জাগা হেঁতালের বন। ঘাপটি মাইরা খুনি চক্ষে যারে একবার বাইছা নিবে, তার আয়ু শ্যাষ। একটি সালের ভুল, বাঘ তারে নিবই।
“বাউলে জানে বাঘবন্দির মন্তর। খুড়ি আসিল আমাদের দলের গুনিন বাউল। তাই আমাদের সাথে সেও নোনা গাঙে ভাসি থাকত মাস মাস।” কথার পৃষ্ঠে কথায় ছিনাথের খুড়ির হাল জানতে চাইলে দেখলাম তিনি কেমন যেন গুম মেরে গেলেন। তারপর আর কথা জমল না তেমন।
ছিনাথ সাঁইদারের বৌ সাধ্যমতো আপ্যায়ন করেছিলেন। গরম ভাতে সিম বিচি দিয়ে খেসারির ডাল, বাদাবনের খাঁড়ির নোনা জলের টাটকা পার্শে মাছের ঝাল আর কেওড়া ফলের টক।
আমাকে হাত মুখ ধোয়ার জল হাতে ঢেলে দিতে দিতে পাছু ফিরে চকিত দেখে বৌ বললেন, “ওর নিজির জেবনের চে বড়ো ছিল ওর খুড়ো। খাওন দাওন, কাজ করম হাতে ধইর্যা সব শিখাইসিল আমার খুড়শউর ওরে। চক্ষের সামনি দিয়া বাঘ মুখে করি তুলে নে গেল খুড়ারে। যে খুড়ি মায়ের মত ভালোবাসতো সে ওরে দুষি ঠাওরাইয়া ঘর ছাইর্যা গেল। সেই দাগা ও ভুলতে পারে নাই। এই বন ওরে দিসেও যেমনি নিসেও কেড়ে কিসু কম না। আপনে কিসু মনে কইরেন না। আপনে আমাদের ঘরে অতিথি হইয়া আমাদের মান দিলেন, তাই ঘরের কথা কিসু কইলাম।”
কোনও কথা না বলে সাঁইদার বৌয়ের হাতে জোর করে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে হোটেলে ফেরার লঞ্চে উঠে বসলাম।
ছিনাথের সাথে কথোপকথনে আজ আমি জীবনের একটা ভারি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা পেলাম। জীবনযুদ্ধে ধর্মের কোনও সীমারেখা নেই। এই সহজ সরল মানুষগুলো কি অনায়াসে মা মনসার নামে ‘আল্লা আল্লা’ আর বাবা ফকিরের নামে ‘হরি হরি’ ডেকে তাদের জীবনরক্ষার ভার এঁদের হাতে তুলে দিয়েছে!
ম্যানেজারবাবু রোজ কাকভোরে ঘুম থেকে তুলে আমাকে স্টিমারে চড়িয়ে, সারেং মাষ্টারকে অনেক খোসামোদ করে বাদা বনের চর, খাঁড়ি, বিশাল নদী বক্ষ, সব ঘুরিয়েও গোটা কয়েক বাঘের টাটকা পায়ের ছাপ, চিত্রা হরিণের দল, বাঁদরের কিঞ্চিত বাঁদরামি, দুটি মাঝারি গোছের কুমিরের ঝটপটি আর অপূর্ব সুন্দর কিছু বনের পাখি ছাড়া তেমন কিছুই দেখাতে পারলেন না। এদিকে রোমাঞ্চের টানে আমার মানিব্যাগের ঘনত্ব দিন দিন কমছে, দিনও ফুরিয়ে আসছে। অগত্যা বেশ একটু রেগে মেগেই ওনাকে বললাম, “দেখুন, কোনও মৌয়ালদের সাথে জঙ্গলে অভিযানের ব্যাবস্থা করতে পারেন কি না!”
শুনে কাঁচুমাচু হয়ে তিনি বললেন, “গরমের মাস হল মধু মাস মেডাম! এই শীতের মুখে মধু কোথায়?”
আমি কটমট করে চাইলে তিনি হাতজোড় করে বললেন, “বন দপ্তর থেকে পারমিট জোগাড় করা যাবে না মেডাম!”
পরদিন ভোরে উঁচু বাঁধের উপর পায়চারি করছি, দেখি লঞ্চ ঘাটের দিক থেকে আলপথ ধরে হনহনিয়ে আসছেন ছিনাথ। তাঁকে কেন জানি না একটু উদ্বিগ্ন লাগল। তিনি হাঁটার তালে আমাকে খেয়াল করেননি, আমি হেঁকে বললাম — “ছিনাথ! এই ভোর ভোর কোথায় যান?”
তিনি চলতে চলতে বললেন — “আর কইয়েন না, আমার ভাইপো হাসপাতালে ভর্তি আসিল, খপর আইসে তার হাল মোটে ভালো না, তাই সদরে যাচ্ছি। এই গেরামে আমার এক স্যাঙাতের বাড়ী। দেখি তারে সাথে নিতি পারি কি না!”
“আমি আসবো?” মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। দেখলাম ছিনাথ যেন মেঘ না চাইতে জল পেলেন। গদগদ হয়ে বললেন, “আপনি যাবেন?” রওয়ানা হয়ে পড়লাম। স্টিমার ধরে নামলাম কুলতলি থানার নলগড়ায়। সেখান থেকে বাসে চেপে বসলাম। ছিনাথ বললেন, ক্রোশ তিনেকের পথ।
“রতন আমার নিজির পোলার থে কিসু কম না। আমার খুড়াতুত ভাই তুলসীর একমাত্তর ছেলে।”
তুলসী নামটা শুনে চমকালাম। মা বলেছিল বটে এই কুলতলির কোথাও বাসা ছিল তুলসীর মা’র। আমি এখানে এসে অব্দি তার কথা ভুলেই বসে আছি! নিজের উপর বিরক্ত হলাম। ছিনাথকে তক্ষুনি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। শুধু জানতে চাইলাম রতনের ব্যামোটা কী!
ছিনাথ মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যামো ফ্যামো কিস্যু না। বাদাবনে গিয়া এই বেপদ! গরম কাল মধুর মাস। এ বচ্ছর রতন সেয়ানা হওয়ায় আমাদের সাথে গিছিল। খুড়ির মোটে ইচ্ছে ছেল না রতন মৌয়ালের কাজ করে, কিন্তু ছোঁড়ার জিদ! উঃ, সেইদিনের কথা আজও মনে পড়লি আমার হাত পা খিল দিয়া ওঠে।”
বাস ছাড়তে তখন কিছু দেরী। প্যাসেঞ্জার না ভরলে ছাড়বে না! অগত্যা রাস্তার ধারে চা দোকানে দু’ জনে বসলাম দুটো মাটির ভাঁড়ে চা নিয়ে। মনের অদম্য কৌতূহল চেপে ছিনাথকে কেবল এইটুকু জিজ্ঞেস করলাম, “আঘাত কি অনেকটা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছিনাথ বললেন, “তা আর নতুন কথা কি? বাঘের হামলা কমের উপর হয়?” তারপর চায়ে হাল্কা চুমুক দিয়ে বললেন, “বাঘ হাতীর মত দল বাঁধি ঘোরে না। একা থাকে। বাঘের খান দুই তিন বাঘিনী থাকতি পারে একই ইলাকায়, তবু এক এক জঙ্গলের সীমানায় বাঘ মুতে রেখে নিজিদের অধিকার জানাই দ্যেয়।
“আমার কাসে খপর সিল এবার যে জঙ্গলে যাইব, বাঘ সিখান থিক্যা দিন দুইয়েক আগে খাঁড়ি সাঁতরাইয়া জঙ্গলের অন্য পাড়ে গ্যাসে। তবু সাবধানের মার নাই ভায়ব্যা আমরা মৌয়ালের দল তক্কে তক্কে সিলাম। দিন ভালোই শুরু হইসিল। বাদায় নামি জঙ্গলের ভিতর সেঁদায় দেখি মাঝখানে নেড়া জমি। কয়েক হাত দুরে একখান পোড়া ইঁটার মন্দির। তার পিসনে বালির চর। নেড়া জমির ধারে একখান গরান গাছের মগডালে ঝুলতাসে এক নাদুস চাক! আমরা কাজে লাইগ্যা গেলাম। গোলপাতার শুকনা গোছা বাইন্দ্যা রতন মশাল জ্বালাইসিল। মশালের ধুঁয়া খাইয়া মউমাছি উইড়া গ্যালে কালো কুচকুচে চাক এক্কেরে সাদা। পুরা চাক আমরা কখনো কাটি না। চাকের যেখানে মধু আসে সেই জাগা টুক কাটি, হাঁড়ি পেতে চাকের নীচে ধরার লাগে। টুপটুপ কইর্যা মধু পড়ে। ঐ ভাঙ্গা চাকেই মউমাছিরা ফের মধু বানায়।
“একবার মশাল জ্বালাবার পর আমাদের আর দেরী করলে চলে না। বাঘ ধুঁয়া দেইখ্যা বুঝতে পারে জঙ্গলের কোথায় মানুষ আসে। তাই চাক কাটার পর আমরা জোর কদমে রওয়ানা দি নায়ের দিকে। গোলগাল চাক পাইয়া সবার মনে আনন্দ। ঐ এক পলের আনমনা হইসি, ভীষণ সীৎকার দিয়া বিজলির মত আসড়াইয়া রতনের উপর আসি পড়ল এক বাঘিনী। ভাঙ্গা মন্দিরের ইঁটের খাঞ্জে লুকায় সিল। রতনকে পাছু ফির্যা উবু হইয়া হাঁড়িতে মধু ভরতি দেখিয়া ওরেই বাসসে।
“সোঁদরবনের বাঘ পেছন থিকা হামলা দিতে ভালবাসে। ঘাড়ে কামড় দিয়া একেবারে ঘাড় মটকাবার চেষ্টা করে। বাঘ একদম সামনে আসি পড়লি হাতের অস্তর আর কাম করে না। তবু আমরা যার কাসে যা ছিল — দা, কুড়াল, লাঠি, বরসি — লইয়া পালটা ‘খপরদার!’ সীৎকার কইর্যা দাঁড়ায়ে গেলাম। রতনের বুকে এক পা গাঁইথ্যা সে আগুণ চোখে আমার পানে চাইয়া রইল, সীৎকারটা আমি দিসি কিনা! আমিও তার চক্ষে চক্ষু রাখি বুক ফুলাইয়া খাড়া রইলাম। জানি যদি এক পলের ভয় দেখাই, পেছন পানে দৌড় লাগাই, তো রতন আজ শ্যাষ।
“আচমকা হানায় রতনের হাত থিক্যা মশাল খান ছিটকাই পরসিল, কিন্তু নেবে নাই। আমি দুশমনের চক্ষু থিকা চক্ষু না সরাইয়া সে মশাল তুলি দিলাম সুঁড়ে। বনবিবির আশিব্বাদে মশাল লাগল গিয়া সোজা তার মুখে। বন কাঁপাই হুঙ্কার দিয়া রতনকে ছাড়ি দি, এক লাফে পলায়ে গেল বনে। রতনের বুকে ক্ষত হইসিল ভারি। রক্ত বাহাইসিল খুব। তবে জান বাসি গেল, এইবার বনবিবির দয়া।”
ছিনাথ কপালে হাথ ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল আমার আন্দাজ একদম ঠিক। লোহার বেডে যে যুবক শুয়ে আছে, তুলসীর মা’র মুখ খানা যেন বসানো।
আমি কোনও বাড়তি কৌতূহল দেখালাম না, তাদের পরিবারের গোপন শোক দুঃখের প্রতি সন্মান জানাতে। রতনের আরও রক্তের প্রয়োজন ছিল। তার ব্যবস্থা করে হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, রতনের একটা রীব বোন ফ্রাকচার হয়েছে, অপারেশান লাগবে।
রতন অস্ত্রোপচারের জন্য একটু সুস্থ হলে সেটা করা যেতে পারে শুনে আমি ডাক্তারবাবুকে বললাম, “খরচ খরচা যা লাগে ভাববেন না, রতনকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়াটাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।”
বলা বাহুল্য ছিনাথ একেবারে আমার পায়ে পড়ে যান আর কি! তাঁকে তুলে ধরে বললাম,“কী করছেন? আপনাদের মত বীরদের এমন কাজ মানায় না।”
ছিনাথের চোখ ভরে এল জল। এই জলের ধারায় দু কুল উপচান নোনা নদীর স্রোত। মন বড্ড মোচড়াল। “খাবেন কিছু?” জিজ্ঞেস করতে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিলেন ছিনাথ। কাছেই এক ভাতের হোটেলে কলাপাতায় গরম গরম ভাত আর পাকা রুই পোনার ঝাল নিয়ে খেতে বসলাম।
ধরা গলায় ছিনাথ বললেন, “আপনে স্বর্গের কোনও পরী কি দেবী হবেন, যে এই বেপদের সময় কোথা থেকে এলেন! শুন্সিলাম আমাদের বাঘের হাতে পেরান গেলি সরকার থে ট্যাকা দ্যেয়। আমার খুড়া মরল, ভাই মরল, একটা নয়া পইসা পাইনি। খুড়ার শোকে খুড়ি হইসিল পাগলপারা। উঃ! উঃ! কতবচ্ছর হই গেল, আজও জলসবির মত মনে আসে সব।”
ভাতের গরাস চিবিয়ে ছিনাথ বললেন, “কী কইবো আপনারে, আজ এত বছর হই গেল আমি খুড়ারে ভুলতে পারি নাই। কি দাপট, মনের বল, সারাক্ষণ হৈ হৈ করত খুড়া। মানুষের বেপদে আপদে বুক দিয়া পড়তো। তার কিনা অমন মিত্তু?”
আমি নীরব শ্রোতা হয়ে রইলাম। খানিক চুপ থেকে ছিনাথ বললেন — “সি বার সিল অন্যবারের চাইতে এক্কেবারে আলাদা। চৈত্র পুরে বোশেখ হলে কি হয়! রোদের তাপ হল্কা মারতিসে যেন লোহার শলা! বনবিবিরে পূজা দিয়া, নায়ের গলুইয়ে ডাবের জল ঢালি, সিন্দূর টিপ আঁকি দিই আমরা চার পাঁচ জনার দল বের হয়ে পড়লাম, খুড়ি দলের বাউলে। খাঁড়ি নদীতে ঘুরতাসি পেরায় চোদ্দ পনর দিন। মধু যেন উপচে পরত্যাসে বনে। বাতাসে ম’ ম’ করতিসে মধুর গন্ধ। গাছে গাছে ভরা ফুল। হাঁড়ি, সুতির গামছা, দা কাটারি লইয়া আমরা নাইয়ে উজান বাইয়া চলছি। ভোরের দিকে জোয়ারের টানে চললি খাটনি বেশি হয় নে, বনের গভীরে ঢুকে যাওয়া যায়। পুরা খাল ভরতি ঘণ্টা দুই তিন লাগব। খালের দুই পারে কেওড়ার বন, সুন্দরী গাছ কিসু আসে। উজানের সময় বনে ঢোকার আর এক ফাইদা। বাঘের ডর থাকে কিসু কম। বাঘ হউক বা মানুষ, নোনা জল কার পসন্দ বলেন ? ভাঁটার সময় বাঘ তাই শিকার ধরতি বেরয়।
“খালের পাশে পাশে কেওড়ার বন কিসু আসে, আসে সুন্দরী গাস। আর হেঁতালের বন। বাঘের বড়ো পিয় জাগা হেঁতালের বন। তবে কি জানেন, উজানের সময় বাঘের ডর অতো না থাকলি কি হবে, সোঁদোরবনের বাঘ তো বটে! এঁরে বিশ্বাস নাই। মাঝে মাঝে শিকার কম পড়লি তেনার প্যাট ভরনের লাইগ্যা মধু খাওনের দরকার পরে। এখুন মউমাছির বিশ হুল থে বাঁচা যায় ক্যামনে! ফাজিল বাঘ করে কি, খাঁড়ির চড়ের থিকথিকা কাদায় পইর্যা গড়াগড়ি দ্যেই সব্বাঙ্গে কাদা মেখে রোদে শুকায়, তারপর গাছে চড়ি মউচাক ভেঙে মধু খায়।
এমুন যার বুদ্ধি, তার সঙ্গে মুকাবিলা কত্তে আমাদের কতো সাবধান হইতে হয় ক’ন! সব্বদা বনবিবিরে স্মরণ করতি হয়, কিন্তু বনবিবি সব্বদা সাথে থাকেন কৈ!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ছিনাথ। “আমাদের নাইয়ে হাঁড়ি কলসি উপচে আসে মধু। এবারকার কামাই ভালো হইস্যে দেখে সবার মন ফুরফুরে। ঠিক সিল আমরা কালই ভোর ভোর জোয়ারের উজান বাইয়া গেরামের দিকে রওয়ানা দিবো। আমাদের নাও খাঁড়ির থিক্যা কিসু দুরে বাঁইন্ধ্যা নাইয়ে রান্নাবারি করতেসে খুড়ি। তুলসী, আমি আর খুড়া তামাক টানতাসি। ‘হেঁইও মাঝি! কে রও!’ ডাক সুইন্যা দেখি আমার ন্যাংটাকালের দোসর কালু মিয়াঁ। থাকে কিসু দুরের গেরামে। মধুর মাসে কালু মৌয়াল আর বাকি সময় মাস মারে। কালু খুব ডাকাবুকা। দু’ দু’ বার রায়মঙ্গলের মুখ থিকা লড়াই কইর্যা বাসসে। তাকত খুব। ‘হেঁইও’ — পালটা হাঁক দিলুম। ‘অ! সাঁইদার তমরা?’ কালু বললে — ‘মংলার জঙ্গলে যদি যাইতে পারো তো যাও, বনের গাছে গাছে এবার ট্যাকার ভাণ্ড ঝুলি আসে।’
“আমাদের কাসে খোপর সিল এক নরখাদক চান্দপাই, সাতক্ষীরা, মংলা, শ্যামনগর গেরামগুলোতে খুব উথপাৎ মাচাচ্ছে। খুড়ি এক কথায় যাওনের চিন্তা বাতিল কইর্যা দিল।”
“তবু গেলে?” জানতে চাইলাম। ছিনাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, “নিয়তি টাইনলে কার কী করার থাকতি পারে?চলেন, বাস ধইর্যা বেলাবেলি গেরামে ফিরতে হইব। সুধা বড়ো চিন্তায় থাকে আজকাল।”
সুধা, সাঁইদারের বৌ। যে আমাকে সেই দুপুরে এই পরিবারের কি যেন এক অশনি সঙ্কেত দিতে গিয়েও দিতে পারেননি। মন বলল, আজ হয়তো সাঁইদার নিজেই খুলে দেবেন সেই বিষকুম্ভের মুখ। মনে মনে চিন্তা করলাম আমি আজ এই জখমি মানুষটাকে খোঁচাব না। ব্যাথার স্মৃতি রোমন্থন করতে শুধু বেদনা নয়, হিম্মতেরও দরকার হয়।
বাসে বসে ছিনাথ সারাক্ষণ মুখ আঁধার করে থাকলেন। আমিও ঘাঁটালাম না তাকে। স্টিমার ঘাটে এসে নদীর হাওয়া তাঁর মুখে চোখে লাগলে, নদীর সোঁদা গন্ধ নাকে টেনে বললেন, “এই জাগা ছাড়ি থাকতে পারবুনি কোথাও। এখেনে পতি পদে বেপদ, মিত্তু, তাও! আমার খুড়ি আমার উপর রাগ করি তেজ দেখায়ে, চলে গিসল শহরে। কলকেতায় এক বাড়ীতে বাচ্চা দেখার কাজ করতো।”
আমি দম চেপে নিঃশব্দে বসে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে ছিনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এক এক সময় জীবন এত নাট্যময়! ভাবা যায় না!
“থাকতি পারল না।” বললেন ছিনাথ। “জঙ্গলের নেশা একবার যার রক্তে লাগি যাই, জঙ্গল তারে নিজির কাসে টানি আনে। শহর থিক্যা ফির্যা খুড়ি আমার উপর মান করি এ বাসায় থাকত না। বাঁধের ঐ পারে, গোলপাতার ঘর সেয়ে একাই থাকত। বুক জলে নেবে মাস, চড়ের কাদার গর্তে কাঁকড়া এই সব ধরত। আমারে সে তার সব্বনাসের কারণ ভাবত। মনে তার সুখ ছেল না।”
গলার স্বর বুজে আসে ছিনাথের। “এসব গেরামে অনেক আজে বাজে নিয়ম আসে। বেধবাদের মানুষ জ্ঞান করে না। আমি যখন বনে বনে থাকি, সুধা কপালে সিন্দূর দেয় না, কপালে টিপ দেয় না। বনবিবির থানে পড়ি থাকে। সেই যে আপনারে মধু রুটি, মাছ ভাত খাওয়াইয়াসিল, আমি বনে থাকলি, সে আপনারে ঘরে ঢুকতিই দিত না। ঐ সময় আতিথ্য চলে না। বন থিক্যা আমরা ভালোই ভালোই ফিরলি তবে আবার এয়ো সেজে সংসারের হাল ধরতি পারে। আর বাঘ বেধবাদের তো সারা জেবনটাই যম জন্তন্না। আমার খুড়ি, অতো সাহস, অতো যার মন্তরের গ্যানগুন, তারেও লোকে হেলা করি ফেলে রাখসিল গাঁয়ের কোনে। মচ্ছব, পূজা পার্বণে, তারে ডাক দিত না কেউ, খুড়ার অকাল মিত্তুর জন্যি তারে অপয়া ঠাউরেসিল লোক।”
আমি নিঃশব্দে নদীর ঢেউ দেখতে থাকলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল তুলসীর মা’র বলিরেখা পরা মুখখানি। শহরে সে ছিল নিতান্ত একজন কাজের ঝি, অথচ এই নির্ভেজাল, বোকাসোকা চেহারার আড়ালে সে যে কতো গুণী, সাহসী, অক্ষর জানা একজন মানুষ ছিল, তার খোঁজ আমরা রাখিনি। তার নিজের ভরা সংসার, দৈনন্দিনের রোমাঞ্চকর অভিযান, তার নিজের পেষা, মানুষের তার উপর ভরসা আস্থা, না জানি কতো সে উপভোগ করত! সে সব খুইয়ে তাকে শহরে এসে বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট মোছা আর না জানি কী করতে হয়েছে! বিশ্ব সংসারে এমন কত মানুষ আছে, যাদের গুণ খালি চোখে না বুঝে আমরা প্রতিনিয়ত তার অসম্মান করে চলেছি!
“খুড়ির পায়ে কতো কেঁদেছি, মাফ চেয়েছি, খুড়ি আসলনি। আমারে চিরকালের জন্যি দুষি কইর্যা বছর দশেক হইল সগ্যে গ্যাসে।” শার্টের আস্তিনে চোখ মুছলেন ছিনাথ।
“আপনি কি নিজেকে দোষী ভাবেন, ছিনাথ?” আমি ধীরে শুধাই। বুঝতে পারি, কি যেন এক নীরব যন্ত্রণায় প্রতি নিয়ত ক্ষয় হচ্ছে ছিনাথের অন্তরাত্মা। ছিনাথ ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “লোভ, দিদি, লোভ! এক লোভের বশে সারখার হই গেল গোটা সমসারটা।”
“আমাকে বলুন ছিনাথ, বলে হাল্কা হন।”
“আমি বলব কি দিদি? আমি যে ভুলতে চাই সব।” ছিনাথের গলা ধরে আসে।
আমি ছিনাথকে নিজের পরিচয় দেব কি দেব না ভাবছি, ছিনাথ বললেন — “সেদিন নাইয়ে আমাদের মধ্যি কিসু মন কশাকশি লাগল। খুড়ি বললে বেশি লোভ ভালো হয় নে। খুড়া আমার পক্ষ নিল। শুধু তাই না, আমরা খুড়িকে ‘মেয়ে মানুষের বুদ্ধি’ বলি গাল দিতিও কসুর করলাম না। তুলসীর ছিল খুড়ি অন্ত পেরান, সে বেচারা মাঝে পইড়া একবার এদল একবার খুড়িকে সামলাইতে লাগল। রাতভর তক্ক বিতক্কের পরে ঠিক হইল আমরা মংলায় যাব। প্রতিবারের মত খুড়া কাকভোরে নাও ছাইর্যা দিল। উজানের টানে দুপুর দুপুর আমরা মংলা পৌঁসে গেলাম। চড়ের কাছাকাছি আসতে দেখি উঁচু গাছের ডালে টাটকা গামছার টুকরা হাওয়ায় প্রেতাত্মার মত দোল খাস্যে। আমাদের মুখ শুকায়ে গেল।”
“কেন?” আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।
“ঐ গামছার টুকরা খুব অলুক্ষউনে। আমরা বলি ঝামটি। কোনও অভাগা মৌয়াল বাঘের হাতে পেরান দিলে তার লাশ না পাইয়া সাথিরা একটা গামছার টুকরা গাছের মগডালে বাইন্ধ্যা দিয়া যায়, অপরকে সাবধান করার জন্যি, যে ভাইসব, এই জাগায় বাঘের হাতে পেরান গেসে! খুড়ি ঝামটি দেইখ্যা গম্ভীর গলায় বললে, ‘পান্তা খাইয়া যাও সব।’ খুড়া রসিকতা কইরা খুড়ির মান ভাঙ্গাতে বলল, ‘ঘুর্যা আইস্যা খামু অনে। আইজ তর মন্তরের জোর দেখুম।’ আর আমরা কেউ কিসু কইলাম না। বগা, খুড়ির মন্তর চ্যালারে নাওয়ে রাখি, বনবিবিরে স্মরণ কইর্যা আমরা নাইম্যা গেলাম। খুড়ির শলা মত বনের পছিম পারে বড়ো হিজলগাছে অনেক চাক পাইলাম। গামলা, হাঁড়ি ভরে গেল চাকে। খুড়া আহ্লাদে ডগমগ। বছরটা কিসু আরামে যাইব, এই ভাইব্যা আমাদের মন ভরপুর। কে জানে যে তখন থিক্যাই এক জোড়া খুনে চোখ আমাদের সব কাণ্ড দেখসে, নজর রাখসে, নিজির শিকার বাছি নেসে, মওকার অপেক্ষায় থাকসে!”
একটু চুপ করে ঢোঁক গেলেন ছিনাথ। “নরখাদকের ভয়ে আমরা জঙ্গল থিক্যা দুরে খাঁড়ির মুখে নাও রাখসিলাম। রাত্তিরে নাও চালান মানা। কুমির কামট, সাপ আসে জলে। খুড়ি আমাদের সেদিন জমিয়ে রাঁধছিল বটে একখান কুচোমাছের চচ্চড়ি! গলুইয়ে বসি খুড়া তামাক টানসিল। খুড়ি নায়ের অপর পারে বইস্যা মাছ সাঁতলাইতাছে। আমি আর তুলসী প্যাঁজ রসুন বাটসি। বগাও আসে। কি এক রসিকতায় খুড়ি বললে, ‘এ বার এত কামাই হল, আমার গা ভরা সোনা চাই।’ খুড়া হেসে বললে, ‘ঐ তো গায়ের সিরি, তয় সোনা!’ খুড়ি হেঁকে বললে, ‘কী কইলে?’ খুড়া চুপ।
“বার দুই জিগাবার পর উত্তর না পেয়ে, খুড়ি যেমনি গলা বাড়ায়ে বলসে, ‘কি? মুখে কথা নেই ক্যান?’ দেখে দানবের মত বিরাট এক বাঘ থাবা গাড়সে খুড়ার কান্ধে। এক পলকের চাওয়া ঐ রাক্ষুসে চক্ষে। লাল ভাঁটার আগুন যেন। সে যে কি ভয়ানক চাউনি বাঘের, দেখলি পরে মানুষের দাঁত কপাটি দিয়া জান শ্যাশ! নিমিষের মধ্যি খুড়ার মাথা মুচড়াইয়া মুখে করি নে পেল্লায় এক লাফ দি পড়ল খাঁড়িতে, বিজলির বেগে খাঁড়ি পেরুই ঢুকে গেল বনে। এত কিসু ঘটি গেল আমাদের পলক পড়তি না পড়তি! ভাবেন!
“আমাদের চমক ভাঙ্গার আগেই কিন্তু খুড়ি হেঁসো হাতে জলে লাফায়ে নামসিল। বাঘের পেছন পেছন সাঁতার দিয়া ঢুকসিল বনে। আমরাও ততক্ষণে বনে ঢুকসি খাঁড়ি সাঁতরাইয়া। মিশকালো আঁধার বন। মশাল জ্বালছি কোনমতে। গোটা জঙ্গল থম থম করতিসে। ‘খুড়া, খুড়া’, ‘বাবা, বাবা গো’ ডাক দিয়া দিয়া যত ভেতর পানে যাই, চক্ষের জলে বুক ভাসাই, না সেই নরখাদক বাঘ, না খুড়া!”
খানিক দম নেন ছিনাথ। “অনেক সময় বাঘ শিকার তক্ষুনি তক্ষুনি খায় না। মাটিতে গর্ত কইর্যা পুঁইত্যা রাখে। সেই আশায় আশায় আমরা তিনজন বনের কতো ভিতরে যে চলে গেসি তার ঠিকানা নাই। কতক পরে হেঁতালের ঘন ঝোপের আড়ালে দেখি ছিন্ন ভিন্ন পড়ে আছে খুড়ার পরনের গামছা খান। দেখ্যা বুক যেন ফাইট্যা গেল। শোক যে মানাব, সেই ভয়াল জাগায় আর এক পল কারো থাকার সাহস হইল না। পরদিন ভোরে পাষাণ বুক কইর্যা খুড়ার গামছার ঝামটি বাদার চরে গাছের ডালে বাঁধি আমরা গেরামে ফিরে গেলাম।
“তুলসীর মুখ চেয়ে খুড়ি তবু খানিক বাঁচত, কিন্তু সেই বছরে শীতের গোড়ায় খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে গিয়া তারেও মুখে তুলি নে গেল বাঘ। আমি ঝাঁপায়ে পরসিলাম, আমারে কান্ধে থাবা মাইরা কাদায় এমুন গাঁথি দিল, নড়নের উপায় থাকলো না। তুলসীরে বাসসিল, ওরেই নিল। আমারে বাসলে, আমি মইর্যা বাসতাম।”
বেরিয়ে আসা কান্না গলায় আটকে ছিনাথ বললেন, “জানেন, আমাদের তুলসীর বড়ো বাসনা আসিল খুড়ির থিক্যা মধু মন্তর শিখ্যা বাঘের মত সারা শরিরে কাদা মাইখ্যা মউচাক ভাঙ্গি টাটকা মধু খাবে, বদলে তার কাদা মাখা আধ খান দেহ আমরা বনের ভিতর ক্রোশ খান দুরে গিয়া পাইলাম। খুড়ির মাথা গেল। আমার উপর তেজ দেখাইয়া সেও ঘর ছাইর্যা গেল। আমাদের সোনার সমসার টুকরা হইয়া গেল। তবু আজও বাদা বনে যাই, ঘরে ফিরব কিনা জানি না, তাও যাই। বাঘের থিক্যা ক্ষুদা বড়ো। তার থিক্যা বড়ো সন্মান। চাকরগিরি করি পেট পালা আমার দিয়ে হবে না, দিদি।”
কাল ফেরার পালা আমার। ইঁট, কাঠ, সিমেণ্টের জঙ্গলে। না, ছিনাথকে আমার পরিচয় দিয়ে তুলসীর মা’র শহুরে জীবনের অনাদরের অধ্যায়কে উস্কে দিতে আর ইচ্ছে করল না। ছিনাথ তার খুড়িকে যেমন দেখতে চাইত — ডাকাবুকা, বাঘ আর মউমাছির যম, এমন সব মন্তরের অধিকারিণী, আত্মসন্মান সম্পন্ন স্বাধীন এক নারী, সেই জায়গাটা ঘেঁটে দিতে সাহস হল না।
তুলসীর ইচ্ছে ছিল মধুমন্তর শিখে বাঘের মত দাপট দেখিয়ে সুন্দরবনের জলে জঙ্গলে ঘুরবে। তার সেই ইচ্ছের সাথে আমার ছেলেবেলায় বনবিবি সেজে বনের অলিন্দে অলিন্দে ঘোরার স্বপ্ন… সার্থক হয়ে উঠুক রতনের সুস্থ হয়ে ওঠার মধ্যে।
আমার সাধ্য মত কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে এলাম ছিনাথকে। আর দিলাম আমার কলকাতার ঠিকানা, ফোন নম্বর। রতনের অস্ত্রোপচারের সময় আবার আসব কথা দিয়ে স্টিমারে উঠলাম।
বাদাবনের জঙ্গল রেখার আড়ালে সূর্য পাটে বসার তোরজোড় করছে দেখলাম। ছিনাথ এসেছিল ঘাটে। সভ্য জগতের দিকে এগোতে এগোতে ভাবলাম, মান আর হুঁশ খুইয়ে কদ্দিন আর মানুষের ভাণ করব আমরা?
দু’পা নোনা জলের তফাতে ঐ যে পড়ে রইল বন্য জগত আর তার মানুষগুলো, তাদের জীবন থেকে না হোক, অন্তত চক্ষু থেকে নোনা জলের ধারা মুছিয়ে দেবার দায়িত্ব নেবে এমন মানুষ কোথায়!