শুভ মুহুরত

 

আমার স্বামী ওনাকে মাম্মিজি বললেও আমি বলতাম আণ্টিজী। সুযোগ অনেক ছিল নাম জেনে নেওয়ার, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আজকালকার মত টিভি জারনালিজিমের চূড়ান্ত রমরমা নয়। অষ্টপহর অসংখ্য চ্যানেলের দিবারাত্তির কচকচি তখনো পরিমিত। তবে টিভি জারনালিজিমের কারিশ্মা বেড়েছে, বেড়েছে জাঁকজমক। আমার স্বামীও সুযোগ বুঝে সংবাদপত্রের চাকরি ছেড়ে নতুন কাজ খুঁজে নিয়েছে এক নামকরা টিভি চ্যানেলে। 

সেখানে গিয়ে দেখা গেল ওর পুরনো দিনের পরিচিত ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড সুজিত শ্রীবাস্তব ওর বস! মাঝে কয়েক বছর যোগাযোগ তেমন না থাকলেও পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মত পুরনো বন্ধুত্ব বেড়ে উঠল বহরে।  

“ইউপি-র লোক বুঝলে! ইলাহাবাদে পৈত্রিক বাড়ি। ক্ষুরধার মেধা, প্রচণ্ড আনপ্রেডিকটেবল, অসাধারণ বাগ্মী!” চায়ে চুমুক দিয়ে আরাম কেদারায় গা ঢেলে বললে স্বামী। আমিও চা খেতে খেতে মুচকি হেসে বললাম “বাব্বা! একই অঙ্গে এত গুণ!” স্বামী দ্বিরুক্তি না করে বললে, “আলাপ হলেই বুঝবে!”  

তা আলাপ হল বৈকি! হৈ হৈ করে এক শনিবারের সন্ধ্যায় সস্ত্রীক হাজির হলেন সুজিতজী, হাতে চাঁদনি চকের বিখ্যাত হালয়াই ঘণ্টেওয়ালা সুইট স্টলের জিভে জল আনা সোহনহালুয়া পাপড়ি আর বাদাম বরফি! কিছু কিছু মানুষ আছেন না, যারা নতুন পরিচয়ের প্রথম বাধো বাধো ভাবটাকে এক ফুঁতে উড়িয়ে দিয়ে আন্তরিকতার শোরগোল ফেলে বড্ড আপন করে নেন, দেখা গেল সুজিতজী সেই সব মানুষের দলে। আমার হাতের সামান্য চিঁড়ের পোলাও খেয়ে যেন অমৃত খেয়েছেন এমন “বাঃ বাঃ” করতে লাগলেন। স্ত্রী শ্রুতিকে মজা করে বললেন, “কুছ শিখ ভী লো!”  

বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা গেল আমি ‘সুজিতজী’র বদলে সুজিত ভাইয়া বলে ডাকছি, আমার মেয়ের মুখেভাতে সুজিতজী মামা হয়ে প্রথম অন্ন খাইয়ে দিচ্ছেন, রাখীর দিন আমি পাচ্ছি চমৎকার সালওয়ারস্যুট আবার ভাইদুজে ওনার কপালে মঙ্গল ফোঁটা দিয়ে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াচ্ছি। 

শুধু তাই নয়, দেখা গেল আমার প্রবাস জীবনের ছোট বড় সমস্যা, বিপদ আপদে তিনি হাজার কাজের ভিড়েও একবার এসে দাঁড়াচ্ছেন, উপদেশ, পরামর্শ, কখন বা নিছক সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, “জিন্দেগী যব ভারী পড়নে লগি তো নীচে কি তরফ দেখনা চাহিয়ে। বহত সে লোগ তুমসে ভী বহত জ্যাদা দুখ ঔর কষ্ট মে হ্যাঁয়।”

সুজিত ভাইয়া নিজের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতেন না, কেবল মা’র কথা বলার সময় তাঁর চোখ মুখ আলো হয়ে উঠত। “আমি আর দাদা তখন খুব ছোট যখন  বাবা মারা যান, মা অনেক ঝড় ঝক্কি সামলে বড় করেছেন আমাদের,” বলতেন ভাইয়া। আমার স্বামীর কাছেই শুনলাম সুজিত ভাইয়ার মা ইলাহাবাদের হাইকোর্ট জাজ। 

সে বছর আমার বাড়ীর লক্ষ্মীপূজার খিচুড়ি প্রসাদ খেতে খেতে সুজিত ভাইয়া বললেন, “দেয়ালীর দিন আমার ফ্লাটে এবার তোমাদের স্পেশাল দাওয়াত!” কী ব্যাপার? না, ইলাহাবাদ থেকে মা আসছেন ওনার কাছে। ভাবলুম বেশ হল। এতদিন ভদ্রমহিলার  নানা গুণ আর প্রাণ প্রাচুর্যের কিছু কিছু কথা শুনেছি ভাইয়ার কাছে, এবার আলাপের সুযোগ হবে।

সুজিত ভাইয়ার ফ্লাটে ঢুকতেই থুতনিতে চুমো খেয়ে আদর করলেন যে মহিলা, সোফায় আরাম করে বসে এবার তাঁকে ভালো করে দেখলাম। ছোটখাটো দোহারা চেহারা, উজ্জ্বল গায়ের রং। কুচকুচে কালো চুলে বয়েসের আন্দাজ পাওয়া ভারি মুশকিল। চোখমুখে একটা বলিষ্ঠ ভাব। কথাবার্তা মজলিশি ধরনের, ভারি আন্তরিক চাল। হাসতে ভালবাসেন। আমার মেয়েকে আদর করে বললেন, “ম্যায় তুমহারি এক নানী হুঁ।” 

যত্ন করে খাওয়ালেন আণ্টিজী। সাদাসিধে রান্না। খুব খানিকটা ঘিয়ে লঙ্কা আদা জিরে ফোড়নে অড়হর ডাল, সাদা সাদা নরম পনিরের মাখা মাখা সব্জি আর ঘি লাগানো হাতে গড়া রুটি। এত ঘিয়ের বাড়াবাড়িতে আমার দোনামনা দেখে বললেন, “বেটা, ঘি-টা খাবে। ওতে শরীরের কোনও লোকসান হয়না।”  

আণ্টিজীর ব্যক্তিত্বে স্মার্টনেস আর সাবেকিয়ানার এক সুন্দর মিশেল লক্ষ করলাম। বার বার করে নেমন্তন্ন করলেন ইলাহাবাদ যাবার জন্য। গল্প, হাসি, আড্ডায় কি ভাবে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।  

কয়েক মাস পরে কাকতালীয় ভাবে আমাদের ইলাহাবাদ যাবার সত্যি সত্যি সুযোগ এসে গেল। একটা সর্বভারতীয় গীতাপাঠ প্রতিযোগিতায় জিল্লা লেভেলে প্রথম হয়ে আমাদের মেয়ে সেমিফিনালে পৌঁছল।এই স্তরের পরীক্ষা ইলাহাবাদে হবে জানতে পেরে আমরা আণ্টিজীকে ফোন করলাম। শুনে হৈ হৈ করে বললেন, “আরে, একদম চলে এস। আমার বাড়ীতেই উঠবে। আমি বিটিয়ারানিকে ঠিক পৌঁছে দেব প্রতিযোগিতার দিন।”  

দিল্লী থেকে মেল ট্রেন ধরে বিকেল বিকেল পৌঁছে গেলাম ইলাহাবাদ। স্টেশনের বাইরে এসে একটা সাইকেল রিক্সা নিয়ে আণ্টিজীর ঠিকানা বলাতে সে শশব্যাস্ত হয়ে বলল, “জজ সাহেবা কী কোঠি? জরুর! বৈঠিয়ে!” 

বড় বড় থামওলা সাদা রঙের বাড়ীটার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছি, হন্তদন্ত হয়ে ভেতর বাড়ী থেকে আণ্টিজী বেরিয়ে এলেন, “আজ একটা জরুরি কেস না থাকলে আমিই যেতুম স্টেশনে! অসুবিধে হয় নি তো  কোনও?”

ভেতর বাড়ীতে ঢুকে দেখলাম বিরাট চকমেলান উঠোন, এপাশে সারি সারি ঘর আর উঠোনের উল্টো দিকে আউটহাউস। ঘরের মধ্যে আণ্টিজীর একটা বেডরুম, একটা খাবার ঘর, রসুই, আর একটা ঘর বোধয় সুজিত  ভাইয়া এলে থাকেন। আর একটা বন্ধ দরজা ঘর দেখিয়ে বললেন, “আমার পূজা ঘর।” 

আমাদের থাকার ব্যাবস্থা আউটহাউসে — হল, বিরাট ঘর, অ্যাটাচ বাথরুম। বিছানাপত্র, আলমারি, টেবিল চেয়ারে সাজানো। আমার নজর কাড়ল কি সুন্দর সুন্দর কাপড়ের পুতুলে সাজানো দেরাজখানি।  

হাতমুখ ধুয়ে একেবারে রাতের খাবার খেতে চলে গেলাম মূলবাড়ীতে। খাবার ঘরের টেবিল চেয়ার তো বটেই অন্যান্য আসবাব দেখলাম বেশীর ভাগই কালো আব্লুশ কাঠের চকচক করছে পালিশ। ঘরগুলোতে কেমন যেন স্মৃতির ঝরণার ধারে ফুটে থাকা এক গোছা বুনো ফুলের মত  মন কেমন করা গন্ধ। সেই সাদামাঠা রান্না, ঘিয়ের মনমাতানো আস্বাদ। 

প্রতিযোগিতার দিন সে এক কাণ্ড! সময় মত বেরিয়েও উদ্যোক্তাদের ঠিকানা ঠিক মত খুঁজে পেতে আণ্টিজীর বেশ বেগ পেতে হল। গঙ্গার ধার দিয়ে চার চক্কর খাওয়ার পর আণ্টিজী যখন বললেন, “ওহ! ইলাহাবাদ কত বদলে গেছে! বাড়ী আর কোর্ট করে করে আমি তো বুঝতেই পারিনি!” শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। সময় মত না পৌঁছলে ওরা মেয়েকে ডিসকোয়ালিফাএড করে দেবে এই ভেবে আমার মুখ চুন হয়ে গেল। 

আমার মুখ দেখে আণ্টিজী হেসে বললেন, “এত অল্পে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে জিন্দেগী জিয়েগি কৈসে?”  কিঞ্চিত রাগ হল শুনে। উনি কি পরিস্থিতির গুরুত্বটা বুঝতে পারছেন না? সামান্য সময়ের এদিক ওদিকের জন্য এত বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেলে মেয়ের জেতার আর কোনও আশাই তো থাকবে না! 

সারা রাস্তা গম্ভীর মুখে বসে রইলাম। হাবে ভাবে আমি যে ভীষণ বিরক্ত তা বোঝাতে ছাড়লাম না। 

হায়, তখন কি আর জানতাম কত বড় ক্ষতির পাহাড় বুকে বেঁধে, একটা উচ্ছল স্রোতস্বিনীকে জীবনের নিষ্ঠুর চোরাবালির গর্তে হারিয়ে যাবার সাক্ষী হয়ে বেঁচে রয়েছেন তিনি! স্বয়ং জীবনদেবতা যার শিক্ষাগুরু তাঁকে আমার মত আহাম্মক লাভ ক্ষতির হিসেব কি বোঝাবে?

সেদিনের প্রতিযোগিতায় মেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে মেডেল পেল শহরের মেয়রের হাত থেকে। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা প্রয়াগে গেলাম পুণ্য অর্জন করতে। 

সন্ধ্যেবেলায় পরিতৃপ্ত মনে বাড়ী ফিরে দেখি শহরের মেয়র বসে দরকারি বাক্যালাপ করছেন আণ্টিজীর সাথে। 

স্বামী চাপা গলায় বললেন, “মহিলার এত প্রতিপত্তি অথচ এক ফোঁটা অহংকার নেই, দেখেছ?” 

সকালে আমার ব্যাবহারের জন্য কিছু লজ্জিত হলাম। আমাদের দেখে আণ্টিজী ভেতরে ডাকলেন। নানা কথা হতে লাগল। এক ফাঁকে মেয়র আণ্টিজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কর্মযোগী বলতে যা বোঝায় এই মহিলা তার বেমিসাল উদাহরণ!” আণ্টিজী তাড়াতাড়ি আমার ও আমার মেয়ের প্রশংসা করতে  লাগলেন, কথাবার্তার ফাঁকে কোথাও যেন ওনাকে আজ ভারি অন্যমনস্ক আর ক্লান্ত লাগল। 

পরদিন সকালের ট্রেন, তাই রাত না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে গেলাম। অত জলদি ঘুমানোর অভ্যেস নেই বলে এপাশ ওপাশ করে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলে রাখা জলের জগ থেকে জল গড়িয়ে খেতে গিয়ে জালনা দিয়ে দেখি এক আকাশ চাঁদের আলো গায়ে  মুখে মেখে আণ্টিজী উঠোনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখটা আকাশ পানে, যেন কিছু খুঁজছেন! 

গাটা ছমছম করে উঠল সেই ব্যাকুল খোঁজার দৃশ্য দেখে। কী এমন হারানিধি হারিয়েছেন যে গহিন নিস্তব্ধ রাতের আকাশে অমন সর্বহারার মত তাকিয়ে আছেন? 

পায়ে পায়ে ঘর থেকে উঠোনে নেমে ওনার কাছে এলাম, এমন তদ্গত যে আমাকে দেখতেই পেলেন না। অগত্যা গায়ে আলতো হাত ছুঁইয়ে ডাকলাম, “আণ্টিজী…”  

আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, “ঘুমাওনি?” 

বললাম, “ঘুম আসছে না!” 

অদ্ভুত সুরে বললেন, “বেটা,তুমি তোমার প্রিয়জনদের নীহারিকা মণ্ডলের ভেতরেই আছ, তবু কেন নিশ্চিন্তের ঘুম আসছে না? জীবনের সবচেয়ে অমুল্য ধন তো আছে তোমার কাছে, জীবনের সেরা পরিতৃপ্তির ঘুম ঘুমনোর এটাই তো সময়!”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে তেমনি হাসি মুখে বললেন, “বেশ, ভেতরে চলো, দুটো কথা বলা যাক তাহলে!” 

আমার মনের অপরাধ বোধ তীব্র হল। কৈ, সকালে আমি যে অমন বেয়াড়াপনা দেখালাম তার জন্য তিনি তো মুখ ভার করলেন না! গুটি গুটি ওনার পিছু পিছু ভেতর বাড়ীতে এলাম। আণ্টিজী এক বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। এটা তো ওনার পূজার ঘর!

হাত দিয়ে আস্তে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে আমি। ঢুকে আমার সর্ব স্বত্বায় কাঁপুনি লাগল। ঘরের তিন দিকের দেয়াল জোড়া কালো কাঠের পেল্লায় মন্দির। আর সেই মন্দিরে বিরাজ করছেন তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। তাঁদের ছবি এবং পট অপূর্ব ফুলের মালায় বিভূষিত। মন্দিরের গায়ে লাল নীল সবুজ আলোর মালা। ধুপ দীপ। আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এমন মন্দির কোন গৃহস্থ বাড়ীতে থাকে? এমনটি তো কোনও বড় বড় দেবস্থলেও দেখা যায় না! এক সাথে এত বিচিত্র দেবদেবীর সহাবস্থান!

আমার দিকে পেছন ফিরেই বললেন, “আমাকে বিরাট বড় ভক্ত ভাবছ তো! ভেবো না। আমি ভক্ত নই। ভক্ত হবার কোনও গুণই নেই আমার।”  

“কিন্তু তাহলে এই সব?” আশ্চর্য হয়ে মন্দিরগুলোর দিকে হাত দেখিয়ে বলি। 

“এনারা সবাই আমার বিবাদী পক্ষ! বাদী হিসেবে অনেক বছর আগে একটা মামলা রুজু করেছিলাম।” 

সত্যি বলতে কি এবার আণ্টিজীর কথাবার্তা আমার খুব হেঁয়ালি ঠেকল। আমি হতভম্ব হয়ে কাঠের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। ওই পূজা ঘর, ধুপ দীপ। মালা, আলো, রাতের নিস্তব্ধতা মিলে মিশে আমার চিন্তা শক্তি গ্রাস করে নিল। 

আণ্টিজী বিগ্রহরাজি থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “শুনবে সেই মামলার গল্প? বোসো, ওই আসনটা পেতে নিয়ে বোসো,” বলে নিজেও একটা আসন পেতে বসলেন। 

“আজ থেকে বছর কুড়ি আগেকার কথা। এই বাড়ীর চকমেলান উঠোনটা আলোয় আলোয় ভরে থাকত। পরীর রূপের আলোয়, তার মিষ্টি হাসি আর ঝরনার মত কলকলানিতে মেতে থাকত এই বাড়ীর আনাচ কানাচ।

রূপে লক্ষী আর গুণে সরস্বতী আমার একমাত্র মেয়ে, পরী। সুজিত, আমার বড় ছেলে অভীক, এরা তখন কতটুকুই বা বড়, তবু আমার কোল আলো করে পরী যখন এলো, দাদাদের পাকামি দেখে কে! বোনের আদর যত্ন, দেখাশোনা করতে দুভাই এক পায়ে খাঁড়া থাকত। কমলেশ, মেরে পতি, হামেশা খুব ব্যস্ত। উকিল মানুষ, ইলাহাবাদ ছাড়াও নানা জায়গায় যেতে হতো তাঁকে।… পরী শুধু লেখাপড়ায় নয়, গান বাজনাও করতো। খুব ভালবাসত পুতুল গড়তে।”

আমার মনে পড়ল আণ্টিজীর দেয়াল কুলুঙ্গি আর যেখানে যত বুকসেলফ বা আলমারি আছে তার মধ্যে সাজানো কাপড়ের তৈরি ছোট বড় কত না পুতুল সাজানো  আছে! জিজ্ঞেস করব করছি করে আর করা হয়নি।এখন সুযোগ পেয়ে বললাম, “বাড়ীর সব পুতুল তাহলে পরীর হাতের?”  

“হ্যাঁ, অবসর পেলেই মেয়ের ওই এক শখ ছিল, বসে বসে পুতুল বানাবার।” হাসলেন আণ্টিজী। 

“বাঃ, ভারি সুন্দর শখ তো! দেখা হলে বলব পরীকে!” আমিও হেসে বললাম। 

আণ্টিজী খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “তা কী করে হবে? মামলার নিষ্পত্তি না হলে এসব কিছুই হবে না!”

অবাক হয়ে বললাম, “কিসের মামলা, আণ্টিজী? কী হয়েছে পরীর? সে কোথায় এখন?” 

আণ্টিজী মৃদু হেসে বললেন, “বেটা তোমার ধৈর্য বড় কম! সকালে এ কথা বললাম বলে তুমি আমার উপর রেগে গেলে, কি জানো, জীবনে এই  ধৈর্যগুণটা না থাকলে যত বড় গুণের আধার হও না কেন, শান্তি পাবে না।” 

লজ্জিত হলাম এবার। “আণ্টিজী মুঝে মাফ কর দিজিয়ে” বলতেই উনি “আরে বেটা, কুছ নেহি, কোই নেহি” বলে আবার সেই তদ্গত সুরে বলতে লাগলেন — “সেবার আমাদের সবার খুব আনন্দ। কমলেশের একমাত্র ভাঞ্জার শাদি! কমলেশ খুব বড় একটা মামলার কাজ হাতে নিয়েছে। ফাইনাল শুনানি শুক্কুরবার, দুপুর দুপুর তার কোর্টের কাজ হয়ে গেলে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ব। ছেলেরা তখন প্রাইমার‍্ী স্কুলে যায়, মেয়েকে সকাল সকাল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে সুটকেস বাক্স সব গুছাচ্ছি, ছেলেরাও তৈরি। কমলেশ ফোন করে জানাল ‘ম্যায় আ রহা হুঁ, তৈয়ার রহেনা!’   

“তব সে ম্যায় তৈয়ার বৈঠি হুঁ, পর কমলেশ নেহি আয়া!” আণ্টিজী ধীর গলায় বললেন। 

“মানে?” আমি তাজ্জব! 

“ম্যায় যব বেনারসি সারি ওঢকে গজরা লাগাকে পল পল ইন্তিজার করতি রহি উনকি, উনহোনে মুঝসে উতনা হী দুর চলা যাতা রহা। তৈরি হয়ে সেজেগুজে বসে আছি তো আছিই। কমলেশের ছোট ভাই হন্তদন্ত হয়ে ফোন করল —  ‘কোর্ট মে কমলেশ কা হার্ট অ্যাটাক আয়া, সিটি হসপিটাল আ যাও!’  

“বেটা, আমি সেই ভাগ্যবতীদের একজন যারা সুহাগন আর বৈধব্য বরণ করেছে একই রকম বেশে। বেনারসি, ফুল মালা, জেবর গায়ে!” 

আমি প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছি, কাহিনীও শুনেছি, কিন্তু এমন পাষাণ গলান কাহিনী শুনে আমার অন্তর ব্যথায় ভরে গেল। 

আণ্টিজী বলতে  লাগলেন, “তখন আমি সামান্য এক গৃহবধূ, তিন তিনটে শিশু সন্তান। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শোক পালনেরও সময় পাইনি। সংসার সামলে আইন পড়া শুরু করলাম। ক্রমে কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু হল। উপার্জনের রাস্তা এলো। দিন কেটে যেতে লাগল গঙ্গা মাইয়ার স্রোতের মত। এমন দিনে বেনারসের আদি বাসিন্দা সীতারাম চতুর্বেদীজী ফোনে জানালেন বড় ছেলের জন্য তাঁরা পাত্রী খুঁজছেন। ‘আমরা পরীর কথা ভাবছিলাম!’ সীতারামজী বললেন। সিতারামজী কমলেশের পুরনো মক্কেল বলেই শুধু নয়, পারিবারিক বন্ধু বলেই পরিচিত। বেনারসের অভিজাত ব্যবসায়ী। সীতারামজী বললেন পরীকে পেলে ওদের আর কিছুই চাই না, পরী শুধু যে নিজের মতন থাকবে তাই নয়, চাইলে আরও লেখাপড়াও করতে পারে, ওরাই দায়িত্ব নিয়ে সব করবে। 

“আমার কাছে পরী বোঝা হয়ে ছিল না, বরং উল্টো।ও এত বেশী অমূল্য ছিল যে সীতারামবাবুদের বাড়ী থেকে সম্বন্ধ এলে আমি এক রকম নিশিন্ত হলাম। চেনা বাড়ী, চেনা ঘর।এমনকি দামাদজীকেও চোখের সামনেই বড়  হতে দেখা! আমি রাজি হয়ে গেলুম। ধুমধাম সে শাদি হয়ে গেল পরীর। সে তখন সদ্য হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়েছে। অমন মেয়ে যেখানেই যাবে নিজের গুণে আলো হয়ে ছড়াবে, এ তো জানাই ছিল।” 

একটু হেসে বললেন আণ্টিজী — “আমার জীবন তখন ঠিক যেন ওই প্রয়াগের মোহনার মতন — বিস্তৃত, শান্ত। ঈশান কোনের অশনি মেঘ আমি দেখব কী করে?” বলে আণ্টিজী চুপ করে থাকলেন। 

আমার মনে এবার কেমন কু ডাকল। সাবধানে বললাম, “আণ্টিজী, পরী কোথায়?” 

কোন অতল তল থেকে উনি যেন ভেসে উঠে বললেন — “পরীরা যেখানে থাকে !” 

আহত সুরে বললাম, “কী করে এমন হল আণ্টিজী?” উনি তেমনি ভাসা ভাসা সুরে বললেন, “বিশ্বাস করবে কি না জানি না, আমরা সত্যি জানি না!” 

বিশ্বাস হল না। এমন যে মেয়ে, রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, এমন যার আদর কদর, তার এমন কী হল যে তাকে জীবনের মোহ কাটিয়ে অকালে অচিনপুরের পরী হয়ে যেতে হল, আর তার আত্মার আত্মীয় যারা, তারা কিছু টের পেল না? 

“বিয়ের পর পরী সে বছর দেওয়ালীতে ইলাহাবাদ এসেছিল। তখন তার মুখে চোখে কোনও মেঘ দেখিনি। দামাদজীর আচরণে পাইনি কোন অসঙ্গতি। তবে বাপমরা মেয়ে তো, আমার অসুবিধের কথা ভেবে অনেক কিছুই হয়তো চেপে যেত! এখান থেকে ওরা ফিরে গেল ভাইদুজ কাটিয়ে, তার এক মাসের মধ্যে সীতারামজীর ফোন এলো, পরী হাসপাতালে, তার নাকি বাচ্চা হবে। শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আর কি! যে বুকের ধনকে পরের বাড়ী এই ভেবে পাঠালাম যে তার আদর যত্ন হবে, বাড়ীর বৌ নয়, মেয়ে হিসেবে রাজ করবে, আর তারা তো কথাও দিয়েছিল পরীকে তারা পড়াবে, হেসে খেলে নিজের বাড়ীর মতই থাকবে সে ওখানে! এই কি তার মা হবার বয়েস, না শরীর?  

“দেখা গেল বাস্তবে সীতারামবাবু মুখে যত বড় বড় কথা বলুক না কেন, হকিকত এটাই যে পরের মেয়ে কখনো  বাড়ীর মেয়ে হতে পারে না। বাড়ীর বৌয়ের তকমা গায়ে সেঁটে বসলে, তার আশা স্বপ্ন, হাসি গান, 

রঙ্গিন প্রজাপতির মতন দিনগুলোর কচি ডানা মুচড়ে ভেঙে দিতে এদের হাত কাঁপে না। ‘পরী আপকো দেখনা চাহতি হ্যায়’ শুনে আমি যে বেশে ছিলাম, সেই বেশেই বের হয়ে গেলাম। সারাটা পথ উজিয়ে এসে শুনলাম  পরীর আর তর সয়নি তার বাবুজীর কোলে সেই ছোট্ট বেলার মত ঝাঁপিয়ে চলে যাবার জন্য।” 

ঘটনার স্রোত কোনদিকে যাচ্ছে, আন্দাজ করছিলাম, তবু যেন শেষের কথাগুলো মেনে নিতে পারছিলাম না।  

“কমলেশকে আমার জীবন থেকে যে ভাবে কেড়ে নিয়েছিল, আমি চুপ ছিলাম,” মন্দিরের বিগ্রহদের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন আণ্টিজী। “ফুলের মতন মেয়েটাকে হারিয়ে আমি এখানে, এই বিচার ঘরে বাদী হয়ে ফরিয়াদ করেছিলাম ওই তেত্রিশ কোটি বিবাদীদের নামে। যাদের এত বছর ধরে একাগ্র হয়ে জীবনের প্রত্যেকটা ছোট বড় সুখ দুঃখে স্মরণ করেছি, কৃতজ্ঞ থেকেছি, তারাই কি না আমার ভরসা, আশা, বিশ্বাস, স্বপ্নের বুকে ছুরি চালিয়ে দিল? অতটুকু মেয়ে কার কী ক্ষতি করেছিল বলতে পারো? তাই সময় পেলেই এই বিচার কক্ষে আসি, সওয়াল করি, কিন্তু  মহামান্য আদালত জবাব তো দেননা!” আণ্টিজী পাথরের সুরে বললেন।  

ওনার হাত দুটো চেপে ধরে বলি, “আণ্টিজী, কাকে বিবাদী করে রেখেছেন, আর কার কাছেই বা ন্যায় বিচার চাইছেন? দুইই যে এক!”

“না!” তীব্র হয়ে বললেন আণ্টিজী। “এই যে মূর্তিদের দেখছ, ফুল, মালা, আলোয় সাজিয়ে রোজ আমি এদের আমার আদালতে সন্মানের সাথে তুলি। সওয়ালের পর সওয়াল করি, উত্তর আসে না। বিবাদীদের আমার প্রাণ থাকতে বেকসুর খালাস হতে দেব না আমি, পরীর কাছে মুখ দেখাব কি করে?” 

আমার গলা বুজে আসে। বলি, “কে আপনাকে জবাব দেবে, আণ্টিজী? যিনি দিতে পারতেন তাঁকেই তো আপনি বিবাদীর কাঠগড়ায় তুলে রেখেছেন।” 

আণ্টিজী চুপ থেকে কিছু পরে বললেন, “তুমি কি ভাবছ জবাব আসবে বাইরের কোনও অলৌকিক শক্তি থেকে? তা নয়। আমার পরীর ব্যাপারে আমি আর বাইরে ভরসা রাখি না। জবাব আসবে খোদ এখান থেকে…” বলে নিজের বক্ষঃস্থল দেখালেন আণ্টিজী। “দ্য ফাইনাল আন্সার উইল কাম উইদিন মাইসেলফ! তদ্দিন আমার এই আদালতের কারবাই চলতে থাকবে। যদি এই জীবনে সুবিচার না পাই, আই উইল ক্যারি মাই আপিল টু মাই নেক্সট বার্থ!”

মুখ গোঁজ করে ছেলেমানুষি বায়নায় নয়, আণ্টিজী প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন অত্যন্ত প্রত্যয়ের সাথে। আমার গা ছমছম করে উঠল। আমি ওনাকে হাত ধরে টেনে তুলে বললাম, “আচ্ছা, বেশ, এখন উঠুন! অনেক রাত্তির গড়াল, শোবেন না?” 

দেখলাম পূজাঘরের বাতি বোজালেন না। দরজা ভেজিয়ে লম্বা বারান্দায় এসে দেখি চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে উঠোনে, বারান্দায়… বারান্দার শোকেস থেকে সারি সারি কাপড়ের পুতুলগুলো চাঁদের আলো গায়ে মেখে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে। আর দেরাজের উপর দেয়ালে ফোটো ফ্রেমে বন্দী এক অসামান্যা রূপসী চাঁদের আলো মুখে মেখে জুঁই ফুলের মতন হাসছে। 

সেবার কী মন নিয়ে যে ইলাহাবাদ থেকে ফিরেছিলাম তা আর কহতব্য নয়। কিন্তু আশ্চর্য হলাম আমরা দিল্লী ফেরার ঠিক হপ্তা দুয়েকের মাথায় সুজিত  ভাইয়ার ফোন পেয়ে। আজকাল ভাইয়া আগের মতন ফোন টোন খুব একটা করেন না। কানাঘুষোয় খবর, ভাইয়ার নাকি শ্রুতির সাথে ডিভোর্স হতে পারে। আমরা এমন একটা সংবেদনশীল কারণ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতেও পারিনি, তাই দু তরফেই কথাবার্তা তেমন হত না। এসবের মাঝেই সুজিত  ভাইয়া ফোন করে বললেন আণ্টিজী নাকি দিল্লী এসেছেন কি এক ডায়াগনোসিসের কারণে। 

এই সুস্থ সবল দেখে এলাম যে মানুষটিকে তার হঠাৎ কী হতে পারে ভেবে কুল কিনারা পেলাম না।

যাই হোক, পরদিনই মেয়েকে আমার এক বান্ধবীর বাড়ীতে রেখে আমরা দু’জন গেলাম আণ্টিজীকে দেখতে। সুজিত  ভাইয়া থাকেন ধউলাকুঁয়ার কাছে। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবছিলাম আণ্টিজীর কথা। পরীর কথা। আশ্চর্য এই যে সুজিত  ভাইয়া কখনও গল্প করেননি পরীর কথা! হয়তো তার কথা এমন হাটে বাজারে বলার জন্য নয়, তাই বলেননি।

গম্ভীর মুখে দরজা খুলে ভাইয়া বললেন, “ভেতরে এসো।” তারপর দু গ্লাস জল এনে দিলেন। শান্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললেন, “ইটস আ সিম্পটম অফ ক্যান্সার!” আমার পায়ের তলায় মাটি দুলে উঠল। আণ্টিজীর  বিবাদী পক্ষ মোক্ষম চাল চালল তাহলে! 

আণ্টিজী আমার আত্মীয় নন ঠিকই, কিন্তু জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের ইমারতের উপর তৈরি হয় না। এই মহিলার জীবনের রঙ্গমঞ্চে এক হার না মানা যোদ্ধার ভূমিকা আমার মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অভিমান জেহাদের রূপ নিয়েছিল বটে, অথচ সেই জেহাদে ছিল না কোন অসন্মান। তাঁর সুবিচার পাবার প্রচেষ্টা কী তীব্র অথচ কী সত্যও। কোথাও একবারের জন্যও মনে হয়নি, এ কী অদ্ভুত ছেলেমানুষি! 

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি একটা চাদর মুড়ি দিয়ে নিস্পন্দে শুয়ে আছেন বিছানায়। চোখ দুটো এক হাতের কনুই ভেঙে ঢাকা। হলুদ রঙের হাল্কা আলো ছড়িয়ে আছে ঘরে । আমার আলতো পায়ের শব্দে হাত সরালেন চোখ থেকে। বললেন, “এসো।” 

আমি সহজ সুরে বললাম, “এ কী রকম অন্যায়, আণ্টিজী? এরই মধ্যে অসুখ করে বসলেন?” 

আণ্টিজীর চোখ দুটো ঝিকমিকিয়ে উঠল। হাসি মুখে বললেন, “বেটা, শুধু সুজিতের এই ভারি দিনগুলো আমার যাবার পথে বড্ড বান্ধা দিচ্ছে।” 

আমি ছেলেভুলানো সুরে বললাম, “আপনি কী বলছেন? কে যেতে দিচ্ছে আপনাকে? কোথায় যাবেন আপনি?” 

আণ্টিজী বললেন, “আমার শুভ মুহুরত এসে গেছে আমি জানি। বেটা, আই অ্যাম সো হ্যাপি! আজ কুড়ি বছর ধরে এমন একটা পল যায়নি আমি পরীকে আমার বুকে আবার জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় তার মুখ ভরিয়ে দিতে চাইনি। মাফি মাঙ্গতে চাইনি।” 

আণ্টিজী কিন্তু ভালো হয়ে গেলেন। অপারেশান সফল হল। মা’কে বাড়ীতে আনলেন সুজিতজী, কিন্তু শ্রুতির সঙ্গে তখন বিচ্ছেদ পাকা হয়ে গেছে।

হাসপাতালে আমরা আণ্টিজীকে কিছু বলিনি এসব, তবু আমাদের দেখে ধীরে ধীরে বললেন, “আমার বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র বারা সাল কী। কিন্তু ঐ বারো বছরেই আমি পুরো পুরো জিন্দেগী জীয়ে নিয়েছি। আমার মন কমলেশের সঙ্গের দিনগুলোর স্মৃতিতে পূর্ণ হয়ে আছে। জীবনে কখনো মনেই হয়নি ওর থেকে আরও কী কী পেলে তবে আমি তৃপ্ত হতাম!” আমরা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

ন’ মাস মতন লাগল আণ্টিজীর পুরো সুস্থ হতে । আমি দেখা করতে গেলে আমাকে বলতেন সুজিত  ভাইয়ার ব্যাপারে ওনার দুশ্চিন্তার কথা। ইলাহাবাদ বাড়ীর গাছপালা, বাগিচার কী হাল হয়েছে এসব নিয়ে খুব ভাবতেন। আমি লক্ষ করতাম উনি সযত্নে পরীর প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতেন।  

সুজিত  ভাইয়ার কাছে মাঝে মধ্যে খবর পেতাম, উনি ভালোই আছেন, রিটায়ার লাইফ এবার সত্যি সত্যি উপভোগ করছেন। “মাম্মিজি অব ফির সে ওহ সব চীজ করনা শুরু কিয়া জো বরসোঁ পেহেলে করতি থী। আচার, পাঁপড় বনানা, মতিচুর কী লাড্ডু , জ্যাম জেলি আজকাল সব ঘর মেঁ বনতে হ্যায়।” সুজিত  ভাইয়ার গলায় স্বস্তির স্বর। খুশি হতাম শুনে। “উপরসে, আসপাস কি ঝুগগি ঝোপড়ি সে বচ্চে আতেঁ হ্যায় পঢ়নে কে লিয়ে।” সুজিত  ভাইয়া হেসে বললেন।

আমরা যে যার জীবনের ছন্দে চলেছি। একদিন স্বামী অফিস থেকে হাসি মুখে ফিরে বললেন, “তোমার সুজিত  ভাইয়ার তো আবার শুভ বিবাহ! যাবে নাকি ইলাহাবাদ বরযাত্রী হয়ে?”

মেয়ে কানপুরের। ঘরোয়া, সুশীল। আমাদের বিয়েতে যাওয়া না হলেও ফটোতে আণ্টিজীকে কি পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছিল। বিয়ের পর সুজিত  ভাইয়া দিল্লীর পাট তুলে ইলাহাবাদ চলে গেলেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আণ্টিজীর আঙিনায় বাল গোপাল এসে হাজির!

আমার মনে হল এতদিনে বুঝি আণ্টিজী বিবাদী পক্ষকে মাফি দিয়ে একটু শান্তি পাবেন মনে। আবার তাঁর জীবনপাত্র সুধায় ভরে দিচ্ছেন জীবনদেবতা।  

হায়, তাঁকে চেনা যদি অতো সহজ ছিল, তবে আজ হয়তো তাঁকে নিয়ে আমি স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে বসতাম না। জীবন যখন দু হাত ভরে তাঁকে দিতে এসেছিল, তখনি কি হেলা ভরে জীবনের দয়ালু হাত ছাড়িয়ে নিলেন আণ্টিজী! কোনও মায়া, এক ফোঁটা মোহ তাঁর পথ আগলাতে পারল না! 

রোজকার মত সূর্য উদয়ের আগে উঠলেন। নাস্তার সব্জি কাটা, বাগানের দেখাশুনা, আকাশে মেঘ দেখে উঠোন থেকে শুকনো কাপড়গুলো পর্যন্ত নিজেই তুললেন। বৌমাকে দেখতে বললেন ফ্রিজে কী কী আছে, মাসকাবারি কী লাগবে তার হিসেব করতে। সুজিত  ভাইয়া দাল পাকোয়ান খেতে ভালবাসেন, বললেন কাল রাত্তিরে সুজিত  ফিরলে তিনি নিজেই বানাবেন। তারপর পূজা ঘরে ঢুকলেন। 

আণ্টিজীর বৌমার মুখে ঠিক যেমনটি শুনেছিলাম সেটাই লিখি। “পূজা ঘর থেকে মা বেরলেন যখন তাঁর মুখ টকটকে লাল। আমি তো ভয়ে সারা, ইনি আবার সেদিনই বাড়ী নেই। কাজের জন্য ইলাহাবাদের বাইরে। কী করব বুঝতে না পেরে এনাকে ফোন করলাম। আমাকে মা বকতে লাগলেন ওনাকে ব্যস্ত করার জন্য। হঠাৎ  চেয়ারে কেমন এলিয়ে গেলেন। আমি ভালো বুঝলাম না। চাকরকে দিয়ে ওনাকে আবার ফোন লাগালাম। সিটি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসার জন্য ফোন করলাম। বেশ বুঝতে পারছি বুকে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু মা কিছুতেই স্বীকার করবেন না। 

“অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা এসেছে দেখে তাদের জল খেতে দিলেন নিজের হাতে। তাঁরা যত বলে আপনি স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ুন, মা আমাকে তত বোঝাতে থাকেন ওনার ঘরের দেরাজে কোন পুরনো লেপ কম্বল  কোথায় আছে, সেটাকে রোদ খাওয়ানোর দরকার, মাসকাবারির লিস্ট যেন ফেলে না রাখি, খোকার ঠাণ্ডার ধাত, কালো জিরে, আর লসুন সরসোঁ কি তেলে উবালকর যেন মালিশ দিই, এই সব। 

“ইনি বাড়ী না থাকায় আমি কিছুতেই মা’কে অ্যাম্বুলেন্সে শোয়াতেই পারছি না। যেন সংসারের উনকোটি কাজের ফিরিস্তি  মা’র মাথায় তখনি চেপে বসেছে। মা’কে মনে হচ্ছিল যেন বিশ সাল কমে গেছে উমর। যেন অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নয়, ফিটন চড়ে গঙ্গা দর্শনে যাবেন! ছটফট করে সারা বাড়ী ঘুরে, আলমারি ঘরের চাবি আমার কোমরে গুঁজে, শেষে স্ট্রেচারে টানটান হয়ে শুয়ে বললেন —  ‘আঃ।’ তারপর চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললেন। আমি ওনার কাছে গিয়ে বললাম, ‘মা, কিছু ভাববেন না, উনি রওয়ানা হয়ে পড়েছেন, আপনি ভালো হয়ে যাবেন।’  

“মা তাকালেন না, জবাবও দিলেন না। গাড়ি ছেড়ে দিল। পরে আমরা জানলাম মার শেষ কথা ছিল ওই ‘আঃ’। আমি মা’কে যখন সান্ত্বনার আশ্বাস শোনাচ্ছি, মা তখন পাড়ি দিয়েছেন বহু দূরে। কেন এমন হল বলুন তো? মা’র যেন হঠাৎ করে যাবার তাড়া পড়ে গেল, এত তাড়া যে ছেলের মুখটা পর্যন্ত দেখে যাবার ফুরসত হল  না!” 

আমি বিড়বিড় করে বললাম, “আবার শুভ মুহুরত এসে গিয়েছিল যে, এবার আর কিছুতেই আণ্টিজী তাকে বিফলে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। বারবার পরীকে ডানা মেলে উড়ে যেতে দেওয়া চলে কি!” 

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

1 comment
Add Your Reply