[দ্রষ্টব্য: এই গল্পে কুরুক্ষেত্রে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাবার জন্য অনেকটা দায়ী লেখিকার বন্ধুত্রয় সংযুক্তা বোস গোস্বামী, অভিষেক গাঙ্গুলি এবং প্রসেনজিৎ চৌধুরী। গল্পের সব চরিত্রগুলি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে কারোর সঙ্গে কোনোরকম সামঞ্জস্য নেহাতই আকস্মিক নয়, লেখিকার এবং তাঁর বন্ধুদের মানস প্রসূত।]
১
ভরত আর শত্রুঘ্ন যখন তাদের মামাবাড়ির আদর খাচ্ছে তখন বশিষ্ঠ মুনি সেখানে কাবাব মে হাড্ডির মত পৌঁছল। সমন! এক্ষুনি ফিরতে হবে অযোধ্যায়। প্রথমে ভরত ভাবল বুঝি বড়দার শ্রীঅভিষেক। কিন্তু তাহলে তো গোটা মামাবাড়ী নিমন্ত্রিত হতো, হৈ হৈ ধুম পড়ে যেত। উদ্বিগ্ন ভরত চিন্তিত মনে শত্রুঘ্নকে নিয়ে অযোধ্যার পথে রওয়ানা দিল।
অযোধ্যায় প্রবেশ করেই ভরত বুঝল ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। পথঘাট শ্রীহীন, বাড়িঘর মলিন, তোরণদ্বারে হলুদ বাসন্তী গাঁদা ফুলের মালা নেই, ঘটের আমপাতাগুলো শুকনো। কালবিলম্ব না করে ভরত সারথিকে নির্দেশ দিল, “ওহে! স্ট্রেইট মা’র কাছে চল!”
ভিতরে গিয়ে ভরত দেখল কৈকেয়ীর আলুথালু বেশ, রোজকার সাজবাহার নেই। ভরতকে দেখেই একগাদা অনেক কিছু বলে উঠল যার মুণ্ডু মাথা ভরত কিছুই বুঝল না। গতিক সুবিধের না দেখে দুই ভাই ছুটল বশিষ্ঠ মুনির কাছে।
মুনি বললে, “বাছা, যা হবার নয়, তাই হয়েছে। দশরথের হার্ট প্রব্লেম তো আজকের নয়, শ্রবণ কুমারের কাছে অভিশাপের দাগা খেয়ে অব্দিই তার হৃদয় বড় দুর্বল। এখন হয়েছে কী, তোমার আর বড়দার অযোধ্যার কন্সটিটুইয়েন্সির দাবিদাওয়া নিয়ে কৈকেয়ী যে এমন সিলি একটা কাণ্ড ঘটাবে, তা কে ভেবেছিল?”
শুনে ভরতের আক্কেল গুড়ুম! পিতাশ্রী নেই? তাও কি না মায়ের জন্য! এখন বড়মার কাছে মুখ দেখাবে কী করে? শত্রুঘ্ন দাদার দিকে আড়ে আড়ে চেয়ে বুঝল থমথমে ঝড় আসছে! দাদা আবার ফেসবুকে ভীষণ অ্যাক্টিভ। কে কোথা থেকে এই স্ক্যাণ্ডেলের পরদা ফাঁস করে দাদার ইমেজের চচ্চড়ি বানাবে তার কোন ঠিকানা আছে?
“লোকসমাজে আর মুখ তুলে তাকাতে হবে না!” গজগজ করতে করতে দুই ভাই ছুটল বড়মার কাছে।
কৌশল্যা চিরকালের শান্ত মানুষ। ভরতকে দেখে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন, “বাবা, একই দিনে স্বামী আর ছেলে হারাব এমন কখন ভাবিনি! এক কাপড়ে তোমার বড়দা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে, বউদিও গেছেন, ঊর্মিলা আর সুমিত্রার বুক খালি করে লক্ষণটাও সঙ্গে গেল, আমরা কেউ কিছু করতে পারলুম না! যাক, যা হবার হয়ে গেছে, এ কুবুদ্ধি তোমার মা’র মাথা থেকে বেরয়নি, তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়েও না, পিতার অন্ত্যেষ্টি কাজে মন দাও গে যাও!”
কৈকেয়ীর ঘরের বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে উবু হয়ে বসে জুবুথুবু মন্থরা ভয়ে কেঁচো। মনে হাজার চিন্তা তার! আমার কী দোষ মা! বুড়োটাকে একটু খেলিয়ে তুলতে মেজো বৌকে একটু কানভাঙানি দিছি বই তো নয়! কিন্তু বুড়া যে বৌএর কাছে খিল্লি খেয়ে একদম পটল তুলে বসবে তা কে জানতো? এখন মেজো বৌ সব দোষ তার কুঁজো পিঠে চাপাচ্ছে! মন্থরা মনে মনে ভেংচায়, “আরে, তুই কি কচি খুকি না কি রে? তোরে আমি সেই কলকেতার মনুমেণ্ট থে নাফাতে বললে তুই নাফাবি? নিজের সোয়ামির বুকের খ্যামতা বোঝার ক্ষ্যামতা নাই, সে আসে কি না আমারে দুষতে!”
এমন সময় ভরত ঘরে ঢুকে “মা, মা, কোথায়?” বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলে কুঁজি বুড়ি ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। ঘরের ভিতর কথার তলোয়ার দিয়ে ভরত কৈকেয়ীকে সাঁই সাঁই কোপ মারতে লাগল। ভরতের এক একটা বাক্যবাণে কৈকেয়ী কেঁপে কেঁপে উঠছে, আর বাইরে বসে মন্থরা ভাবছে, কুঁজের উপর কিল পড়লে কতটা ব্যাথা নাগতে পারে রে বাপ! যেই ভাবা সেই কাজ! শিলাবৃষ্টির মত মন্থরার কুঁজে কিলাবৃষ্টি শুরু হল। তার গগনভেদী চিৎকারে ভরতের ইমেজ কিছুটা হলেও উদ্ধার হল!
ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কৈকেয়ী পুবের ঝরোখার সামনে এসে দাঁড়াল। রোজকার মত ওই তো বয়ে চলেছে সরযুর সবজেটে ঘোলা জল। নদীপথে বনিকদের ছোট বড় নৌকো, স্ত্রী পুরুষ স্নান তর্পণ সারছে, শিশুরা আজও রোজকার মত জল খেলায় মত্ত। দুপুরের সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে সরযুর বুক।
“হ্যাঁ, মানছি চিরকালই আমি একটু ড্রামাকুইন, ছোট থেকে যা চেয়েছি, পেয়েছি!” কৈকেয়ী চিন্তা করে দেখলে। “দীর্ঘকাল সন্তানহীন থাকার পর আমার বাবা অশ্বপতি আমাকে আর দাদাকে সূর্যের আশীর্বাদে পান, তাই পিতার প্রশ্রয়ে আমি হয়ত কিঞ্চিত বদমেজাজিও বটে, কিন্তু তাই বলে আমাকে মার্ডারার বলা ছেলের কি উচিত হল? কোন ক্ষেতের মূলী পেটে ধরেছিলুম? নিজের ভাল তো পাগলেও বোঝে রে! সেই কোন কাল থেকে স্বামীকে সেবা শুশ্রূষা করে দশ আনা ছ আনা প্যাঁচে ফেলে ছেলের ভবিষ্যৎ পাকা করতে উঠে পড়ে লাগলুম, আর সেই ছেলে কিনা আমাকেই গাল পেড়ে বড়দাকে ফিরিয়ে আনতে চললেন! মরণ! সব ঐ বড়জার চক্রান্ত!”
২
রাম যখন সবে মাত্র মশা মারার ক্রিমটা হাতে পায়ে মেখে রাত পাজামাটা গলিয়েছে, দরজায় টোকা পড়ল। সীতা সেই যে সন্ধ্যেবেলায় একটা আলু কুমড়োর ঘ্যাঁট বানিয়ে ফেসবুকে ফৌত হয়েছে, তার আর বাহ্যজ্ঞান নেই। বড়লোকের বেটি, বড়লোকের বৌ, ঝোঁকের মাথায় “ওয়াও, এ তো কাইণ্ড অফ সাফারি গো, আমিও যাব, আমিও যাব” বলে নেত্য করে এখন জরুর পস্তাচ্ছে! আর লক্ষণটাও বলিহারি, কোথায় দরজা খুলে দেখবি, তা নয়! দরকারে যদি তোদের নাইই পাব তো লেজুড় ধরে এলি কেন বাপ!”
“কে? দাঁড়াও বাপু দাঁড়াও, আসছি!” বলে দরজা খুলে রাম দেখে ভরত! “অ, তুমি! ভেতরে এসো! তা কী ব্যাপার বল?”
কাঁচুমাচু মুখে ভরত বললে, “দাদা, আমি এসবের কিছুই জানতাম না। যা হয়েছে, হয়েছে। এখন ঘরে চল।”
কথার মাঝে হুড়মুড়িয়ে ঘরে এল লক্ষণ। “দাদা, এন্ত্রকুইনলটা কি আনা হয়েছে?” তারপর ভরতের দিকে চোখ পড়াতে সে বাঁকা হেসে বললে, “বৌদির হাতের ঘ্যাঁটটা ঠিক সহ্য হয়নি।”
শুনেই রামের পিত্তি চটে গেল। এক ধাক্কায় বাপ স্বর্গবাসী হল, পাকা আমের মত ঝুলন্ত রাজপাট হাত ফস্কে গেল, এখন এই বন বাদাড়ে বাপের প্রতিজ্ঞার সত্য পালন করতে হবে, আর এই মহান ব্রতে কারা সব সাথিদার দেখ!
রাম রাগ করে বললে, “তাও তো আলুটা কুমড়োটা মা সাথে দিসলেন বুদ্ধি করে, নইলে এই বন বাদাড়ে খেতে কী শুনি? সীতা তো তেজ দেখিয়ে বাড়ীর খাবার ছোঁবেন না বলে বেরিয়ে এলেন! আর বৌদির রাঁধা কুমড়োর কিছু দোষ নয়, তুমি খেয়েছ গাণ্ডেপিণ্ডে!”
ভরত রামকে শান্ত করে বললে, “দাদা, তুমি থাকতে আমি পাওয়ারে এলে ঢী ঢী পড়ে যাবে যে! নেক্সট ইলেকশানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারব আমরা! প্লীজ, তুমি ফিরে চল!”
রাম কুটীরের মধ্যে হাত পিছনে করে পায়চারি করতে করতে ভাইএর কথা শুনে মন্দ মন্দ হাসল। তারপর গলা ঝেড়ে বললে, “বোকার মত কথা বোলো না ভরত! এ এক রকম শাপে বর হয়েছে। কোনও মতে চোদ্দ বছর কাটিয়ে দিতে পারলে আমাদের চোদ্দ গুষ্ঠির গোটা ফিউচার সোনায় মোড়া, বুঝলে? পাবলিক সেণ্টূ খেয়েই ভোটটি দেয়। তাই যত কষ্টই হোক, এ ছুঁচো আমাদের গিলতেই হবে!”
হঠাৎ “ছুঁচো? কোথায় ছুঁচো? কোথায় ছুঁচো?” বলে সীতা ঘরময় ছুটাছুটি শুরু করে দিল।
ভরত বৌদিকে বললে, “আঃ বৌদি! কী হচ্ছে কী! তুমি না ব্ল্যাক বেল্ট!”
সীতা ঝাঁজিয়ে বললে, “ব্ল্যাক বেল্ট তো কি? ও বিদ্যা আমি ছুঁচো মারতে শিখিনি!” তারপর খাটিয়ার উপর দু পা তুলে বসে বললে, “ছুঁচোয় আমার ভীষণ ভয়!”
কোনমতে বৌদিকে শান্ত করে ভরত দাদাকে বলল, “তবে দাদা তোমার জুতোজোড়া দাও, পাওয়ার চেয়ারে ওদের বসিয়ে তোমার ডাইন্যাসটি সিম্বলাইজ করব!”
“ভাল বাটা কোম্পানির জুতা ছিল রে! এটাও নিয়ে নিবি!” বলে থুতনি চুলকাতে চুলকাতে রাম দোনামোনা করে জুতোজোড়া দিয়েই দিলে ভরতের হাতে। মনে মনে অবিশ্যি ভাইয়ের কুটবুদ্ধির তারিফ না করে পারল না।
পরদিন অযোধ্যার আকাশ বাতাস মাইকের গানে ভরে উঠল —
“ভাইয়ের পায়ের জুতাজোড়া মাথায় তুলে নে রে ভাই!
দীনদুঃখী ভাই যে মোদের, জুতা ছাড়া কিছুই নাই।।
সেই জুতার মায়াও ছাড়তে পারে, এমনি বীর আমার ভাই,
রাজভোগ আর সিংহাসনের তাই কোনও টান নাই রে নাই!”
দিন চলে যায় নিজের নিয়মে, রাত আসে, চলেও যায়। রাম দিনের বেশির ভাগ সময় শরীর চর্চা আর আগামী পঞ্চদশ বর্ষের রাজপাটের পরিকল্পনার জাল বিছানোর ফন্দি ফিকির নিয়ে ব্যস্ত থাকে। খবর পায় যে ভরতের বুদ্ধিতে তার জুতাজোড়ার আরাধনায় অপজিশান পার্টি চরম মুক্কা খেয়েছে।
সীতা রাঁধে বাড়ে আর সুযোগ পেলেই রামকে ধরে মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তির ফেসবুক আপডেটের বাড়াবাড়ির নিন্দা মন্দ করে। “ছি ছি ছি! তুমি তো যোগী বেশে জঙ্গলে মঙ্গল করছ, আর তোমার ভোগী ভাইরা তাদের বৌদের ভরে ভরে গহনা দিয়ে মোড়াচ্ছেন! বিশ্বাস না হয়, এই দেখ, মাণ্ডূর গলায় কানে এই নতুন কর্ণিকা, বালি, কুন্দন… হিরে পান্না রুবির রত্নাবলী এসব তো দেখে আসিনি!”
কখনো বা সীতা শ্রাবণের ঘনঘোর মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবে শ্রাবণের অপূর্ব সুন্দর অযোধ্যা নগরীর কথা। কামিনী কেয়া ফুলের গন্ধে আমোদিত এখন অযোধ্যার পথঘাট। জল্ভেজা স্নিগ্ধ সবুজ গাছপালায় সেজে উঠেছে মণি পর্বত, তার গাছে গাছে হয়ত ঝুলনা বাঁধা সারা। মোটা মোটা গোড়ের মালায় সাজানো ঝুলনাগুলোয় চেপে বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় দুলছে অযোধ্যার রমণীরা। শ্রাবণ ঝুলা মেলায় কত লোক! কি আনন্দ! কত মনিহারি কাঁচের চুড়ি, মুক্তার মালা!
মেলা শেষ হলে মাণ্ডূ আর শ্রুতকীর্তি ফেসবুকে ছবির বন্যা ভাসাবে, আর তার ভাগ্যে কি না বসে বসে শুধু ঘ্যাঁট রাঁধা? মুখ ভারি করলেই রামের এক কথা — “সবুরে মেওয়া ফলে গিন্নী! দেখো, এই বনবাস আমাদের জীবনে কেমন সোনার রাজহাঁস হয়ে প্যাঁকপ্যাঁকায়!”
কুটীরের চারদিকে লক্ষণ কিছু কিছু ক্ষেতিবারি করেছে। কলাটা মুলোটা হয়। এক দিন সে রামের কাছে এসে মহা হুলুস্থুলু বাঁধিয়ে বললে, “দাদা, এ জঙ্গলে আমরা ছাড়াও আরও কেউ আছে এ আমি শিওর! দু দিন আগে দেখলুম পুঁই ডাঁটাটা লকলক করছে, আর আজ বেমালুম হাওয়া?”
“হুম,” রাম শুনে চিন্তিত হল। তবে কি অপজিশানের কেউ ফেউ ছেড়েছে, গোপনে তাদের উপর নজরদারি করতে! ভাইকে সেসব না বলে, রাম বলল, “ঠিক আছে, একটু তক্কে তক্কে থাকো।”
তক্কে তক্কে থাকা বিফলে গেল না লক্ষণের। পরদিনই এক দশাসই চেহারার পালোয়ানকে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে রে রে করে তেড়ে গেল লক্ষণ। সে ব্যাটাও কম যায় না, মাসেল ফুলিয়ে বলল, “দেকুন মসায়, ওসব পুঁই ফুঁই চুরির কথা বলে আমার মটকা গরম করবেন না। হ্যাঁ, হতো টেস্টি চিকেন চাঁপ তো বুঝতুম!”
রেগে লক্ষণ জিজ্ঞেস করলে, “অ্যাঁয়, তুই কে রে লবাবপুত্তুর?”
সে মেঘের গলায় বললে, “আমি ভীমসেন!”
৩
হস্তিনাপুর ভারতের আর এক মহা সমৃদ্ধ নগরী। রাজ ক্ষমতায় সমাসীন দুর্যোধন আর তার ভাই দুঃশাসন গভীর চিন্তায় মগ্ন। দুঃশাসন বললে, “অজ্ঞাতবাসের ফাণ্টুসি বহুত হয়েছে দাদা! মালগুলো কোন জঙ্গলে ঘাপটি মেরে আছে সে তো আমরা জানিই। তুমি হুকুম দাও তো মাল খালাস করে আসি? হস্তিনাপুরের জমির দর দিন দিন বাড়ছে! এসব মান্ধাতা আমলের প্রাসাদ ফ্যাসাদ বেচে দিয়ে ফাস্টোকেলাস পালেসিয়াল বাংলো বানাব! রথ-গ্যারাজ, সুইমিং পুল, পাব কর্নার, আহহ, এই তো জীবন!”
দুর্যোধন গ্রামভারী চালে বললে, “সবই তো বুঝলুম, কিন্তু ওই যে কেলো করে বসে আছে আমাদের শকুনি মামাটি! যেমন নাম তেমনি বুদ্ধি! পাশা খেলায় হেরে গেলে তখনি দিতে হতো ঝাড় বংশ সাফ করে! না, বনবাসে পাঠাও! এই এক ফ্যাশন হয়েছে, চাপ খেতে আর চাপ দিতে হলে লাগাও বনবাস! এখন একবার যখন চুক্তি হয়েছে চুনৌতি তো লড়তে হবেই! নইলে সলিসিটার কেষ্ট কি আর ছেড়ে কথা কইবে?”
দুঃশাসন ষড়যন্ত্রের গলায় বললে, “তুমি শুধু ওই কেষ্ট কুমারকে একটু চোখে চোখে রেখো দাদা। বাকি আমার উপর ছেড়ে দাও। ওই কেষ্টা ব্যাটার জন্য সেবার দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কেসটা পুরো ক্যাঁচাল মেরে গেল!”
হাত নেড়ে ভাইকে থামায় দুর্যোধন। “আঃ, ওসব আলোচনা থাক না, আমার জীবনের সবচেয়ে গাঢ় অধ্যায়!”
“কী বলছ দাদা!” ফুঁসে উঠল দুঃশাসন, “পোঙা মারা গেল আমার, আর তোমার গাঢ় অধ্যায়!”
ভাইকে আড়চোখে দেখে মেজাজ পরখ করে দুর্যোধন বললে, “আমরা তো প্রথমে ওর চালাকি ধরতেই পারিনি! হপ্তাখানেক বাদে বঙ্গদেশের কোন এক কাঞ্জিলাল মশায়ের মেসেজ পেয়ে সব খোলসা হল!”
মাথা নিচু করে বসে দুঃশাসন বলল, “ধড়িবাজ কি কম! হাতে পেলে সব শালাকে কিমা বানাব।” হাতের মুঠি শক্ত করল দুঃশাসন ।
“কী যেন লিখেছিল কাঞ্জিলালবাবু?” দুর্যোধন জানতে চাইলে দুঃশাসন অবাক হয়ে বলল, “তুমি ভুলতে পারলে? আজও ওই অপমানের কথা ভাবলে আমার গায়ে রাগে জ্বর আসে দাদা!”
ভাইকে থামিয়ে দুর্যোধন বললে, “আহা! সে সব থাক, কী লেখা ছিল তাই বলো!” দুর্যোধন জানে পুরনো চাল যেমন ভাতে বাড়ে, পুরনো রাগ তেমনি প্রতিশোধের তলোয়ারে শান দেওয়ায়।
“মেসেজটা আসে আমারই কাছে।” দুঃশাসন গম্ভীর গলায় বলে। “তাতে লেখা ছিল — মহাশয়, আপনাদের পরমাত্মীয় শ্রীকেষ্ট কুমার আমার দোকান থেকে প্রায় কুড়ি মিটারের ভাল জাতের রেশম ধুতি অর্ডার করিয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে বলিয়াছিলাম, ‘কুড়ি মিটার তো অনেক আজ্ঞে!’ তাতে তিনি বলিলেন, ‘হা কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ! বলতে বলতে শ্রীমান দুঃশাসন ক পাক ঘুরবে তার আমি কি জানি হে? কাপড় টানাটানির মাঝখানে সাপ্লাই বন্ধ হলে চলবে না। তাতে আমার নাম ডুববে। দাম যা লাগে বিল পাঠিয়ে দেবেন শ্রীমান দুঃশাসনেরই নামে অমুক ঠিকানায়।’” বলতে বলতে দুঃশাসনের গলা বুজে আসে।
“আর তারপর তো ইতিহাস!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে দুর্যোধন।
হে পাঠক, আমি যদি ‘সময়’ হই, এই ফাঁকে আপনাদের জ্ঞাতব্যে সেরে ফেলি সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য।
দ্যূতক্রীড়ায় গো হারান হেরে প্রাসাদ, জমি, ধন রত্ন সব হারিয়ে যুধিষ্ঠিরের তখন খেলায় বাজি রাখার মত কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সব হারালে কি হবে, গোঁয়ার তো কম না, অতএব বাজি রাখা হল দ্রৌপদীকে! দুর্যোধন দুঃশাসন ভেবেছিল এমন অপমান করবে ভরা সভা মাঝে দ্রৌপদীকে যে পাণ্ডবদের আর মুখ তুলে চাইতে হবে না !
শকুনির চালাকির সঙ্গে পাল্লা দিতেই পারছিল না যুধিষ্ঠির। বাজি হেরে বসল আবার। টেনে আনা হল দ্রৌপদীকে। দুঃশাসন যখন তাকে যথেচ্ছ অপদস্থ করে শেষে শাড়ী ধরে টান দিতে গেল, গোটা সভা যখন চোখ কান মুখ ঢেকে ফেলে আর কি! তখনি কি থেকে কি হয়ে গেল! “হৈ- ঐ- ঐ- ঐ হঃ, হ্যা রারারা — চু উ উ উ কিত কিত কিত কিত” বলে বিকট আওয়াজ তুলে দ্রৌপদী শাড়ীর আঁচল গাছকোমর করে হা ডু ডু স্টাইলে দু পা ফাঁক করে কোমর ঝুঁকিয়ে দু হাত বুকের কাছে ক্রস করে রেখে পজিশন করে দাঁড়ালো। ব্যাপার দেখে সবার তো চক্ষু চড়কগাছ! গান্ধারী পর্যন্ত সবুর করতে না পেরে দু একবার চোখের পট্টি ফাঁক করার চেষ্টা করছে! ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, চোখে এবং চেতনায়, সে বার বার হাত হাতড়ে বলে, “কী হচ্ছে? অ্যাঁ? আমি রাজা ধৃতরাষ্ট্র জানতে চাচ্ছি কী হচ্ছেটা কী এখানে!”
কী যে হচ্ছিল সেখানে তার খবর কে দেবে? সবার মুখেই তখন কুলুপ। কেবল দুঃশাসন তার ধুতির কাছা কোঁচার মুঠো ধরে সভাময় ছোটাছুটি করছে! সবাই বিস্ফারিত চোখে দেখছে দ্রৌপদী হিংস্র হাতে বার বার দুঃশাসনের কাছা ধরে টান মেরে খুলছে। কাছা লুটিয়ে আছাড় খেয়ে দুঃশাসন পরিত্রাহি “বাঁচাও বাঁচাও” চেঁচাতে লাগল! কিন্তু হায়! কাকস্য পরিবেদনা! লাট্টুর মত পাক খেয়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠে দ্রৌপদী ঝাঁপিয়ে পড়ল দুঃশাসনের পেটের উপর! সবাই তটস্থ হয়ে দেখল দ্রৌপদী দুঃশাসনের কাছার শেষ প্রান্তটুকু হাতে ধরে গর্জাচ্ছে “চিচিং ফাঁক, চিচিং ফাঁক” বলে, আর দুঃশাসন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, আমার পুরুষত্ব ভূলুণ্ঠিত” বলে কোঁকাচ্ছে।
শেষমেশ অবিশ্যি শ্রীকৃষ্ণকেই এগিয়ে আসতে হল। কাঞ্জিলালবাবুর রেশম কাপড় ফরফরিয়ে বেরতে লাগল শ্রীকৃষ্ণের তর্জনী থেকে। দুঃশাসনের লজ্জা রক্ষা হল। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই ঘটনার পরে দুই ভাইয়ের রমণীতে আর রুচি রইল না।
হাতের মুঠো পাকিয়ে দুঃশাসন বললে, “ওই কেষ্টটার দয়ার উপর নির্ভর করে চলবে পাণ্ডবদের মত নির্বোধের দল। আমি ওর ওই করুণার উপহাস আর নিতে পারছি না দাদা। আমি চাই যুদ্ধ হোক! কেষ্টকে আমাদের পরিবারের সলিসিটার বলে বাবা কাকারা সম্মান দেখাতে পারে, আমার কাছে ওসবের কোনও দাম নেই। সব শালাকে যুদ্ধে যদি কিমা…”
দুর্যোধন হাত তুলে ভাইকে থামায়। যথেষ্ট তাতানো গেছে। যুদ্ধের আগে এমন চণ্ড মেজাজই চাই। উদাত্ত গলায় দুর্যোধন বললে, “তোমার কিমা বানানোর রেসিপিকে নীল সেলাম, নীল সেলাম! যাক, শোন,পাণ্ডবদের উপর নজরদারি ডবল করো, ব্যাটাদের হাঁচি কাশির সব খবর আমার চাই।”
৪
ভীম ভবানীর দৌলতে রাম পরিবারের সাথে যুধিষ্ঠির পরিবারের কিছু কিছু পরিচয় হয়েছে। ও বেচারারাও ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মাঝে মধ্যে দুই পরিবারের সদস্যরা ইতিউতি বেড়িয়ে আসে, রান্নার দেওয়া থোয়া হয়। দ্রৌপদীর রান্নার হাতখানা খাসা। ভীমের আবার মুখে ভেজ রোচে না, তাই পশু পাখির খোঁজে সে এদিক ওদিক ঘোরে। ভীমের আজকাল মনে হয় কেউ বা কারা যেন অষ্টপহর তাদের উপর নজর রেখে চলেছে!
রামবাবুকে এই অস্বস্তির কথাটা পাড়বে বলে এক বিকেলে রামবাবুর কুটীরের কাছে গিয়ে ভীমসেন দেখে সে এক বিষম কাণ্ড! এক সুন্দরী মহিলা পিং পং বলের মত একবার রামের কাছে গিয়ে বলছে, “আমায় বিয়ে করো।” রাম তাকে ঠেলে দিচ্ছে লক্ষণের কোর্টে, “আমার চেয়ে ওর সিক্স প্যাক বেশী, তুমি ওকেই ধরো।”
আবার লক্ষণ রামকে দেখিয়ে বলছে, “রাম পুরুষ শ্রেষ্ঠ!” সে মহিলা তখন রামের দিকে ঢলে ঢলে এগোলে রাম বলছে, “আচ্ছা আহাম্মক যা হোক! বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় জানো না?”
ভীমের ভারি আহ্লাদ হল এসব দেখেশুনে। একঘেয়ে জঙ্গুলে জীবনে আছেটাই বা কী! রগড় বেশ জমেছে, হঠাৎ কোত্থেকে আলোকসামান্য রূপ নিয়ে অর্জুন এসে হাজির! ব্যাস আর যায় কোথা, রমণী অর্জুনের বাহু ধরে ঝুলে পড়ল!
গোলমাল শুনে ভিতর থেকে সীতা বেরিয়ে এল। তাকে দেখে অর্জুন মধুর হেসে সম্ভাষণ করলে। রমণী গেল ক্ষেপে! সে আগুপিছু না ভেবে সীতার দিকে তেড়ে গেলে লক্ষণ একটি বাক্যও খরচা না করে মহিলার নাকটা কুচ করে দিল কেটে! কাটা নাকের ডগা ধরে মহিলা তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিল, “ওরে, আমার নাক কেটে দিল রে, ওরে লাউডগার মত কার নাকের ডগা কাটলি রে তুই পামর, জানিস? আমি সসাগরা পৃথিবীর সবচেয়ে তাকতবর রাবণের বোন, শুপি, ওরফ শূর্পণখা! তোদের বংশ নির্বংশ না করিচি তো আমার নামটা আমি নিজের হাতে কাটব রে-এ-এ।”
রাবণকে তার বৌ মন্দোদরী মাছের একটা নতুন প্রিপারেশান খাওয়াচ্ছিল, তখনি নাক চেপে হাজির হল শূর্পণখা। দাদার কাছে কেঁদে কেশে সে যা ব্যক্ত করল শুনে রাবণের পিত্তি জ্বলে গেল। এত বড় আস্পদ্দা, তার বোনের নাকের ডগা কেটে নিলো? এ কি কাল পড়ল, অ্যাঁ? মহিলা সুরক্ষা বলে কিছু রইল না?
রাবণ প্রতিশোধের আশায় কালবিলম্ব না করে দণ্ডকারণ্যে হাজির হল। রামের কুটীরের চারপাশে ক’দিন ঘুর ঘুর করতে লাগল। কুটীরের ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে থেকে রাবণ বুঝে গেল রামপত্নীর সোনার গয়নার উপর ভারি টান। অতএব মারীচকে তলব দিয়ে আনানো হল। সে সোনার হরিণ সেজে সীতার চোখের সামনে ঘুর ঘুর, ঘুর ঘুর করতে লাগল। রাবণ বা মারীচ জানতেও পারল না যে শুধু সীতা নয়, সোনার হরিণের দিকে নজর পড়েছে ভীমেরও। হরিণের চাঁপ খাওয়ার জন্য ভীম পাঁয়তারা কষতে থাকল।
একদিন সীতা দেখল সোনার হরিণটা ভয় ভেঙে তাদের উঠনে চরছে! সীতা রামকে বায়না ধরে বলল, “আস্ত গোটা একটা সোনার হরিণ আমাদের উঠনে চরছে গো! আমাকে প্লীজ ধরে এনে দাও! বিয়ের পরে সেরকম গয়নাগাঁটি কিছুই তো দাওনি!”
রামের পৌরুষে মুক্কা লাগল। তীর ধনুক নিয়ে সাঁ করে রাম বেরিয়ে এল। রামকে দেখে হরিণটা দিল এক ছুট! রামও তার পিছু ধাওয়া করল, ঝোপের আড়ালে ছিল ভীম, সেও তাদের পিছনে পিছনে ছুটল।
মারীচের কাছে খবর ছিল শুধু রামকে ঘুরিয়ে মারার, কিন্তু কোথথেকে এক দামড়া পালোয়ানও হাজির হয়েছে দেখে মারীচের মনোযোগ নষ্ট হল।
রামের ধনুকের গুঁতো খেয়ে আগাপাস্তলা নধর হরিণটাকে মানুষ হয়ে যেতে দেখে ভীমের মাথা খারাপ হয়ে গেল। “এ কী করলেন রামবাবু ! অমন নধর হরিণ চাঁপ খানা বরবাদ করে দিলেন?”
রাম নিজেও ব্যাপার দেখে কম ভ্যাবাচ্যাকা খায়নি। দুজনকে আরও ভেবলে দিয়ে হরিণরূপী মানুষটা বলে উঠল, “শোন রে লোভীর দল, আমি বহুরূপী মারীচ। আমাকে তোদের পেছনে ফিট করেছে রাবণ। তোরা লঙ্কায় হাত দিয়েছিস না? এবার জ্বলে পুড়ে মরবি!” এই বলে হঠাৎ করুণ সুরে “লক্ষণ, লক্ষণ, কোথা আছ ভাই? বাঁচাও বাঁচাও!” বলে হুবহু রামের গলা নকল করে ডাকতে ডাকতে দম ছেড়ে দিল।
ভীমসেন চিন্তিত হয়ে রামকে বললে, “এ তো ইম্পস্টারি মশায়! এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়। তাই ভাবি সব সময় আমার কেন মনে হতো কেউ যেন পেছনে দুরবিন সেঁটে রেখেছে। চলুন চলুন! কেটে পড়া যাক! নয়ত মিথ্যে ফোরজারি কেসে ফাঁসবেন এই বলে দিলুম!” বলে ভীম আর দাঁড়ায় না।
মারীচের ওই ডাকটাই ছিল সিগনাল। রাবণ জানত ওই ডাক শুনে সীতা লক্ষণকে বনের ভেতরে পাঠাবেই আর সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
রামের বিপদ হয়েছে ভেবে সীতা লক্ষণকে ঠেলে পাঠাল। জঙ্গলে বৌদিকে একা ছেড়ে গেলে দাদা কেলাতে পারে ভেবে লক্ষণ একটু দোনামোনা করছিল, তাতে বৌদি ক্ষেপে গিয়ে জ্বালিকাঠি কথা শোনাতে লাগল। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে তীর দিয়ে একটা লক্ষণরেখা টেনে বোঝাতে গেছে, “বৌদি, দয়া করে এই রেখার বাইরে যেও না।” চোখ পাকিয়ে বৌদি বললে, “সিরিয়াসলি? যত সব বস্তা পচা মেল ইগো! আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ!”
রাবণের এত সব জানার কথা না, ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সে দেখল ভ্রুকুটি কুটিল মুখে লক্ষণ ছুটে বেরিয়ে গেলে সীতা দোর দিল। সুযোগ বুঝে একবার হেঁড়ে গলায় যেই বলেছে, “আলেখ নিরঞ্জন” খচাং করে দরজা খুলে সীতা মুখ নেড়ে বললে, “কী চাই? উফ, এর নাম জঙ্গল! এক মিনিট শান্তিতে থাকার উপায় নেই?”
থতমত খেয়ে রাবণ তুতলে বলে, “ইয়ে মানে বলছিলুম কি, যদি মানে কিছু…”
“কী মানে মানে করছেন? কোন দলের চামচা আপনি অ্যাঁয়? কী? মতলবটা কী?”
“চামচা? দল? মতলব? কি বলছেন বউদিদি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!” সীতার ধাতানি শুনে রাবণের জিভ জড়িয়ে যায়।
সীতা হাত নেড়ে রাবণকে কাছে ডাকে, “এদিকে আয়, আয় বলছি!”
রাবণ গুটি গুটি এগোলে সীতা হুঙ্কার দিয়ে বললে, “শোন ব্যাটা, আমি টাঈকোণ্ডূতে ব্ল্যাক বেল্ট। একটা মিথ্যে বলেছিস কি নক আউট করে দেব। এখানে কেন এসেছিস শুনি? তোকে ক’ দিন থেকেই আমি ঘুর ঘুর করতে দেখেছি। সত্যি বলবি না দেব এক ‘অপ ছাগি’?”
রাবণ মুখ শুকিয়ে বললে, “সসাগরা পৃথিবীর রাজা রাবণ আমি, আর আপনি আমাকে ছাগি বললেন দিদিভাই?”
সীতা হেসে বলল, “ধুর পাগল! তোকে ছাগি বলতে যাব কোন দুঃখে? টাঈকোণ্ডূতে কোরিয়ান ভাষায় লাথি হল ছাগি, বুঝলি?”
“যে আজ্ঞে!” রাবণ সম্ভ্রমের সাথে জানায়। সীতা কৌতূহলী হয়ে গল্প জুড়ে দেয় রাবণের সাথে। “লঙ্কার রাজা তুই, বললি না? আচ্ছা, লঙ্কা জায়গাটা কেমন? মানে, ভাবছিলাম তোর সাথে একটু ঘুরে এলে কেমন হয়! এই একঘেয়ে বনবাদাড় আর আমার ভাল লাগছে না রে!” সীতা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আরে এ তো মেঘ না চাইতেই জল! একবার এই ধূমাবতীকে কব্জা করে লঙ্কায় নিয়ে ফেলতে পারলে এর কারাতের সব তেল বের করে দোবো। সীতার প্রস্তাব শুনে রাবণ তো পুলকিত। “আজ্ঞে, চলুন না, বৌদি, আপনার খুব ভাল লাগবে! বুক চিতিয়ে পড়ে আছে চারধারে সমুদ্র। তাতে কত টাটকা মাছ, গলদা চিংড়ি খাওয়াব আপনাকে! তাজা কাঁকড়ার রগরগে লাল ঝোল… কী? জিভে জল আসছে না? আরে বৌদি, আসতে বাধ্য! আমি বলি কি, দাদারা আসার আগে চলুন রওয়ানা দিয়ে পড়ি। আপনি আধুনিক স্মার্ট মেয়ে, দাদার পারমিশানের থোড়াই কেয়ার করেন? একটা চিঠি লিখে দরজায় লটকে দিন, আর সুপার হলিডে ডেশটীনেশানের মজা নিন!”
সীতা ভেবে দেখল আইডিয়া তো মন্দ নয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সীতা আরামসে উঠে বসল রাবণের সুপার ফাস্ট রথে। ছোট থেকে স্বাধীন চিন্তায় বড় হওয়া সীতার চোখে এটা এমন কিছু গর্হিত কাজ বলে মনে হল না ।
হায় ! রাবণ যদি জানত, যে সসাগরা পৃথিবীর রাজা বলে তাঁর এত গর্ব, সেই পৃথিবীর কন্যা সীতা কী ভাবে তার বুকের চাঙড় ওপড়াবে তাহলে সীতাকে রথে এত আহ্লাদ করে তুলে মনে মনে মুগুর ভাঁজা করতে করতে লঙ্কার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাত না!
৫
লক্ষণকে দেখে রাম তো অবাক! “এই অচিন বন বাদাড়ে বৌদিকে একা ফেলে চলে এলে?”
লক্ষণ দাদাকে পরিষ্কার শুনিয়ে দিল, “তাঁর আমাকে দরকার নেই দাদা! উফ! আমাদের এই তীর ধনুকের চেয়ে তাঁর মুখের বাণ বেজায় শানানো এটা আজ বুঝে গেছি!”
নিজের বৌকে অন্যে কি চেনাবে! অগত্যা দুই ভাই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরল। দরজায় এক কুচি কাগজে সাঁটা কটা মাত্র কথা — “শুনছো! এখানে বড্ড বোরিং! তোমরা যাবার পরে রাবণবাবু এসেছিলেন। ভারি চমৎকার মানুষ। ওনার ইনভিটিশানে চললাম লঙ্কা। উনি তোমাদেরও নেমন্তন্ন করে গেছেন, কাম শার্প এণ্ড জয়েন মি বেবি!”
চিঠির টুকরো রামের মাথায় বাজের মত পড়ল। মনে পড়ল মারীচের অভিশাপ। “হায়! হায়!” করে রাম থেবড়ে বসল দাওয়ায়। “এ কী হল লক্ষণ! না বুঝে সীতা কী ভীষণ বিপদে জড়িয়ে পড়ল! তাছাড়া ঘর পালান বৌএর সংবাদ একবার যদি চাউর হয়, আমার সোনার ইমেজে যে পাঁকের দাগ লাগবে, সেটা ধোবে কোন স্লা… সরি!”
চাণক্য বলে গেছেন, রাজদ্বারে, শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে সেই প্রকৃত বান্ধব। রামের শূন্য কুটীর আর ভাঙ্গা মন জোড়া দিতে পাণ্ডবরা এই দুঃসময় পাশে এসে দাঁড়ালো। যুধিষ্ঠির রামকে নিজে এসে দেখা করে বললেন, “মহাশয়, মন ছোট করবেন না। আমরা আছি তো না কি! এই আমাদেরই দেখুন, সব থাকতে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর আমার তো ছুঁচো গেলার দশা! কি কুক্ষণে যে পাশা খেলেছিলুম, দিবা রাত্তির বৌএর মুখনাড়া খেতে খেতে প্রাণ গেল। বিবাহ, বৌ, এসব মশাই আর কিচ্ছু না, জানেন তো, বারো হাত কাঁকুরের তেরো হাত বিচি, কাঁঠালের চাইতে বড় মুচি! সব ধোঁকা।”
যুধিষ্ঠিরের বড় বড় কথা এই বিপদের সময় লক্ষণের ভাল লাগল না। সে ফস করে বলে দিল, “যাই বলুন, দোষ কিন্তু আপনার কম নয় মশাই! কথায় বলে জুয়ার নেশা সর্বনাশা, কী বল দাদা?”
উপযাচক হয়ে সাহায্য করতে আসা মানুষকে অবজ্ঞা করা উচিত নয় ভেবে রাম মুখ বুজেই থাকল। যুধিষ্ঠির লক্ষণকে তেরছা নজরে দেখে রামকে বললে, “তবে কাজের কথা কিছু বলি শুনুন। রাবণ না কি যেন নাম, ওই পরস্ত্রী চোরটার, বৌদিকে যদি কোনও লোকসান পৌঁছায়, একবার শুধু খবর দেবেন। ভীমসেন ওর জন্য একাই একশ।”
যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা কয়ে রামের মনটা কিছু ঠাণ্ডা হয়েছে। রামও কথা দিয়েছে দুর্যোধনদের সাথে পাণ্ডবদের যদি যুদ্ধ হয় তাহলে রাম লক্ষণ তো বটেই, রামের আরও দুই ভাই, গোটা দল, যুধিষ্ঠিরের পেছনে দাঁড়াবে।
রাম বা যুধিষ্ঠির কেউই জানতে পারল না যে তাদের কোন গোপন পরামর্শই আর গোপন নয়। দুর্যোধনের ফেউ ঘুরছে সর্বত্র। রামের সঙ্গে আঁতাত বাঁধার খবর দুর্যোধনের কানে পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে মামা শকুনিকে দণ্ডকারণ্যে স্পেশাল মিশনে পাঠানো হল।
এক পড়ন্ত বিকেলে উদাস মুখে রাম দাওয়ায় বসে ভাবছে, গিয়ে অব্দিই সীতার না কোনও মেসেজ, না খবর! সব ঠিক আছে কি না এই আশঙ্কায় রামের মন উতলা। হতচ্ছাড়া রাবণটাও ঘাপটি দিয়ে আছে। শত্রুপক্ষের মনে কী চলছে বোঝার উপায় নেই। লক্ষণ ক্রমাগত বলে চলেছে, “দুগগা বলে বেরিয়ে পড়ি চল, দাদা!”
কিন্তু রাবণের সম্বন্ধে যা শুনেছে রাম, তাতে তৈরি না হয়ে অতদুরের পথ পাড়ি দেওয়া কতটা নিরাপদ হবে কে জানে? সীতার অবিবেচনায় ভীষণ রেগে উঠল রাম। আবার এও মনে হল হয়ত সীতা কোনও বিপদে পড়েছে! অস্থির হয়ে দাওয়া ছেড়ে সবে ঘরে ঢুকেছে, দেখে উঠনের দরমার গেট ঠেলে একটা লোক পা টেনে টেনে ঢুকছে।
“কে মশাই আপনি? একেবারে ঢুকে আসছেন যে বড়?” রাম বাইরে এসে বললে। লোকটাকে দেখেই কেমন চোর চোর লাগে।
পা-টা টেনে দাওয়ায় উঠে সে বললে, “আসতেই হল মশাই! ভদ্রঘরের মানুষ বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদে পড়েছেন, অবজ্ঞা করতে তো পারি না!”
রামের কেমন সন্দেহ হল। কোন বিপদের কথা বলছে লোকটা? জানল কি করে! মিটিমিটি হেসে লোকটা যেন মনের কথা পড়ে ফেলে বললে, “অধমের নাম শকুনি। ওই যে একটু আগে যুধিষ্ঠির এসে বড় বড় কথা বলে গেল, আমি ওদেরই মামা। তা মশাই বুঝি আমার ভাগ্নার সব কথা বিশ্বাস করে বসে আছেন না?” মুখে চুক চুক আওয়াজ করে আবার বলতে লাগল, “আরে মশাই, নিজের ভাগ্না বলে চোখ উলটে থাকবে এমন বান্দা শকুনি নয়! আচ্ছা, ওদের সাথে মেশার আগে আপনার এট্টূ মনে হল না, যে পরিবারে পাঁচ স্বামী মিলে এক বৌ রাখে, তাদের কালচারটা কী হতে পারে? আর এই তো আপনার ঘরের বৌ পালিয়েছে, সে কি আমার জানার কথা? বলুন! কিন্তু জানি তো! কে বা কারা এটা রটাচ্ছে এবার ভাবুন!”
বৌ পালানোর প্রসঙ্গ উঠলে রাম একটু মিইয়ে গেল। এই লোকটা যা যা বলছে শুনতে খারাপ লাগলেও মিথ্যে তো নয়! তাহলে এতদিন পাণ্ডবরা শুধু বন্ধুত্বের ভড়ং করে গেল?
“ভাবুন, রামবাবু, ভাবুন! সত্যি যদি রাবণের কব্জা থেকে বৌ ছাড়াতে চান, তাহলে পাণ্ডব নয়, কৌরবদের সাহায্য চেয়ে নিন!”
শকুনি বিদেয় হলে রাম তুমুল দোলাচলে পড়ল। এমন সময় মোবাইল বাগিয়ে ছুটে এল লক্ষণ — “দাদা, শিগগির ধরো, সিগনাল কেটে গেলে হয়েছে!”
বেজার মুখে রাম বললে, “কে আবার?”
লক্ষণ উত্তেজনায় চেঁচায় — “আরে, এই সেই রাস্কেল রাবণটা!” শুনেই এক লাফে ফোন কেড়ে রাম বললে, “হ্যালো!”
ওপার থেকে কেমন একটা মিয়নো কাঁদো কাঁদো গলা ভেসে আসে। ঠিক মত শুনতে না পেয়ে রাম “হ্যালো, হ্যালো” বলে চেঁচাতে থাকে।
কাঁদো কাঁদো স্বর এবার গলা ঝেড়ে বলে, “মশাই, হ্যালো হ্যালো কি করছেন? অ্যাঁ? বলি কী পদার্থের তৈরি আপনি? আপনার বৌ ইলোপ হয়েছে আজ হপ্তা খানেক হল, আর আপনার কোনও হুঁশ নেই?”
রাবণের এক তরফা আক্রমণে রাম ভড়কে গিয়ে বললে, “ইয়ে, মানে, ভাবছিলুম!”
“ভাবছিলেন? এতদিন ধরে শুধু ভাবছিলেন! বাঃ! দেখুন মশাই, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না, আজ বাদে কাল দুটো দিন আর সইব। আপনার বৌ আপনি ফেরত নিয়ে যান!”
রাম ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে, কী হয়েছে বলবেন তো!”
রাবণ গলা ছেড়ে হেঁকে বললে, “হয়েছে মশাই আমার সব্বোনাশ আর আপনার পৌষমাস! এমন বেয়াড়া গোছের মেয়ে আমি জন্মে দেখিনি! রাতদিন কেবল খাই খাই! আর ঘুমে তো আমার ভাই কুম্ভকর্ণকেও হার মানায়! বীচপার্টি ওনার আর ফুরায় না! কিছু বললেই বলে ‘হলিডে ডেসটিনেশানে এসেছি!’ এঃ, কী আমার মহারানী এলেন রে! মহিলাকে জব্দ করতে রাক্কুসিদের লেলিয়ে ভয় দেখাতে গেলাম, এমন হাঁটু চাবড়ে চাবড়ে হাসতে লাগল সব কটা ভালমানুষের ঝি পালিয়ে বাঁচল। দাসদাসী তো বটেই আমার পেয়ারের পাটরানিকে দিয়ে কি খাটান খাটাচ্ছে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না মশাই! কথায় কথায় কারাতে মারের ভয়ে আমরা স্ত্রী পুরুষে সিঁটিয়ে আছি। আমার ঘর বার সব গেল রামবাবু! আপনি আপনার মাল ফেরত নিয়ে যান!”
রামকে চুপ দেখে রাবণ কাতর হয় — “ও মশাই! রাম মশাই! রামজি! আমি আপনার কেনা চাকর হয়ে থাকব প্লীজ, কিছু তো বলুন! রামদা গো! “
বিরক্ত হয়ে রাম এবার বলে, “ম্যালা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করবেন না তো! জানেন না বনবাসে আছি? পয়সাকড়ির অভাব! লঙ্কা যাব বললেই যাওয়া যায় না।”
রাবণ কেঁদে পড়ে বলে, “দাদা গো! যতো টাকা লাগে আমি দোব! আপনি শুধু একবার পায়ের ধুলা দেন!”
হাই তুলে রাম বলে, “যাব যে, জুতাও তো নাই ! ভরত, আমার ভাই, নে গেছে!” শুনে রাবণের ভারি রাগ হয়। “ এ কি হদ্দ দশা মশাই আপনার? শেষে কিনা জুতাও পারসেলে পাঠাতে হবে?”
রাম তাকে এক দাবড়ানি দিয়ে বললে, “চোপ রে ব্যাটা রাবণা— তোরে কই কটা মোর ভাবনা। তাড়া কি তোর, মোর বৌ ফেরানর তরে?/ কটা বছর যত্ন করে রাখনা আরও ধরে!”
কুচ করে লাইন কেটে দেয় রাম। তারপর লক্ষণকে হেঁকে বললে, “লক্ষণ, যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল!” দুই ভাই অনেক দিন পরে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল ।
৬
পাণ্ডব কুটীরে আজ আনন্দের হাওয়া লেগেছে। কৃষ্ণ আসলে এমনি হয়! চায়ের কাপে সুরুৎ চুমুক মেরে কৃষ্ণ ভীমসেনকে বললেন “বাঃ, ভীম, কিছু ওজন কমিয়েছ মনে হচ্ছে!”
ভীম দ্রৌপদীকে দেখিয়ে অভিযোগ করে বললে, “না কমিয়ে উপায় আছে? ষাঁড়ের গোঁ ভয়ঙ্কর হয় জানতুম, কিন্তু স্ত্রী লোকের এমন গোঁ! বলে যুদ্ধু না জেতা অব্দি চুল বাঁধবেন না। সেদিন ওই চুলের জালে পা লটকে বড়দা মুখ থুবড়ে পড়ছিল আর কি!”
দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের উপর খুব প্রসন্ন ছিল না। মুখ বেঁকিয়ে বললে, “হুঁঃ, যারা তালকানা হয়, তাদের মুখ থুবড়ে পড়াই উচিত।”
যুধিষ্ঠির চোর চোর মুখে বসে রইল। আসন্ন বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করে কৃষ্ণ কথা ঘুরিয়ে বললে, “এখন বাজে প্রসঙ্গ থাক! অজ্ঞাতবাসের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। আমার কাছে খবর আছে, যুদ্ধ হবেই। ভাল কথা, রামবাবুর সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলেছেন তো? লোকটার ম্যান পাওয়ার যথেষ্ট কিন্তু !”
যুধিষ্ঠির মিনমিন করে বললেন, “কি জানি কী হয়েছে, ভদ্রলোকের বৌ সম্প্রতি রাবণ নামের কোন এক উঠতি হিরোর সাথে নাকি ভগলবা হয়েছে, আমি নিজে গেসলুম খোঁজখবর করতে, তখন তো ভালোই কথা বললেন। ইদানীং দেখছি বন বাদাড়ে দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন! মানুষের মন বড় বিচিত্র হে মধুসুদন!” মাঝে মধ্যে আতান্তরে পড়লে যুধিষ্ঠির এই নামেই কৃষ্ণকে ডাকেন।
সব শুনে মুচকি হেসে কৃষ্ণ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললে, “যে দূরদৃষ্টি আর একাগ্রতায় তুমি পাঞ্চালীকে জয় করেছিলে, সেই দৃষ্টি কোথায় গেল তোমার? দুর্যোধনের গুপ্তচর যে তোমাদের হাঁড়ির সব খবর রাখে তা কি তোমরা জানো? শকুনি গিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে শুধু যে রামের কান ভরে এসেছে তাই নয়, এখন সে রাবণকে নিজেদের দলে ভেড়াতে গেছে লঙ্কায়। এই খবরও দেখছি তোমাদের অজানা!”
ভীম বিড়বিড়িয়ে বলল, “তাই বল, সব সময় মনে হত শালা পেছনেও যেন একটা ছায়া আছে আমার। আমি ভেবেছিলুম এ সব বুঝি ওই রামবাবুর জন্য হচ্ছে!”
চিন্তিত মুখে অর্জুন বললে, “আমাদের কী কর্তব্য এখন? আমাদের মিত্রপক্ষ তো তাহলে শূন্য!”
কৃষ্ণ মৃদু হেসে বললে, “পাণ্ডব! হস্তিনাপুর রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে দেখা করে আশীর্বাদ চেয়ে নাও আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। রামবাবুকে আর পাশে বোধকরি পাবে না, তবে আমার মন বলছে এক ভয়ঙ্কর টুইস্ট তোমাদের জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেবে।”
৭
দুর্যোধন হস্তিনাপুরের ছাদে টহল দিচ্ছিল। বর্ষা শেষ হয়ে আকাশে শরতের হাল্কা সাদা মেঘের ভেলা। দুঃশাসন খবর এনেছে পাণ্ডবরা রাজ্যে ফেরার গোছগাছ শুরু করেছে। ভালো, শীতের আগেই যুদ্ধ টুদ্ধ যা হবার হোক। তারপর এই জমি প্রাসাদ বেচে বুচে টাকার পাহাড় ভেঙে আয়েশ করে বাকি জীবনটা কাটানো যাবে!
সুখের ভাবনার মাঝেই দুর্যোধনের মোবাইল বেজে উঠল। “হ্যালো” বলতেই ওধার থেকে ভারি গলার আওয়াজ এল, “রাবণা স্পিকিং!”
গলার স্বরে কোনো তালেবর মালুম হতে দুর্যোধন সতর্ক হয়ে বললে, “রাবণা, হু?”
এক ধমকে ভারি গলা বলে উঠল, “স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল যাকে এক নামে চেনে, তাকে তুমি চেন না, এর থেকেই বোঝা যায় তুমি একটি আকাট। যাক, শোন, তোমার মামা এখানে এসেছিলেন তোমাদের সঙ্গে আমার বিজনেসের পার্টনারশিপ নিয়ে কিছু কথা বলতে। আই লাইক ইয়োর মামা, হি ইজ আ গুড ম্যান! ইন্টেলিজেণ্ট টু!”
“কিন্তু যার তার সাথে পার্টনারশিপের গাঁটছড়া বাঁধাটা একটু রিস্কি, তাই তোমার ক্ষমতার একটা প্রিলিমিনারি টেস্ট দিতে হবে। আমার বিজনেসের মূলধন থেকে বার্ষিক আয় হয় প্রায় পঞ্চাশ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা, বুঝেছ?”
বার্ষিক আয়ের অঙ্ক যার এত তার মূলধন কত হতে পারে ভেবে দুর্যোধনের হাত পা কিলবিল করে উঠল! সে কি স্বপ্ন দেখছে কোনও? দুঃশাসনকে ফিসফিস করে ডেকে সে বলল, “ওহে, আমায় একটা চিমটি কাটো তো দেখি!”
দাদার এমনতর কথায় দুঃশাসন যখন ‘এ আবার কি গেরো’ ভাবছে, ফোনের ওধার থেকে মেঘের মতন ডেকে উঠল একটা গলা — “বলি, দিন দাহাড়ে নেশা ভাং কর না কি হে? আমার সময়ের দাম আছে, বোকার মত চুপ করে না থেকে মন দিয়ে শোন!”
দুর্যোধন জিভ কেটে বললে, “সরি স্যার, মানে আমি, আমি মানে…”
“আঃ! বাজে বকা থামাবে? শোন, আমার এজেন্ট তোমার কাছে একটা প্যাকেজ পাঠাবে, সাথে তুমি পাবে পঞ্চাশ সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা! প্যাকেজের ভিতরে কী থাকবে তা তুমিও জানো না, আমিও জানি না । নিয়ম হল , প্যাকেজ রিসিভ করার পরে যাই বেরোক না কেন তার লাইফ টাইম লায়াবিলিটি তোমার। সেই লায়াবিলিটি মেইনটেন করতে তুমি ওই মুদ্রার ব্যবহার করতে পারবে। তবে, ঐ প্যাকেজের মাল যদি লঙ্কার ত্রিসীমানায় দেখা যায়, অথবা তোমার তরফ থেকে এ ব্যাপারে যদি কোনও নেগেটিভ ফোন কল আসে, তাহলে ডিল ডিসমিস! আরও একটা কথা, কোনও রকম চালাকি করলে তোমার মত চুনোপুঁটিকে আমি স্রেফ টিপে মেরে খেয়ে নেবো!”
দুর্যোধন ভাবতে পারছিল না এমন জলের মত একটা সহজ পরীক্ষা দিয়ে সে কিনা এমন একজন বিজনেস টাইকুনের সাথে হাতে হাত মেলাতে পারে!
“বাই দি বাই, তোমার ট্রান্সপোর্ট সুবিধে কেমন?”
দুর্যোধন গর্ব ভরে বললে, “আজ্ঞে, একদম লেটেস্ট মডেলের রথকার! বিশ হাজার ক্রোশ যায় বিশ মিনিটে স্যার!”
“গুড! আজ সোম, তুমি কালই তোমার রথকার নিয়ে দক্ষিণের উপকূলে চলে আসবে। আমার এজেন্ট ওখানেই তোমাকে প্যাকেজ ডেলিভারি দেবে। ওভার এন্ড আউট!” ফোন কেটে যায়।
“ব্যাপার কী, দাদা?” দুর্যোধনের গদগদ মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃশাসন তো অবাক!
“এবার সোনার গাড়ু মসলিনের গামছা ইউস করার সময় এল, বুঝলে?”
দুঃশাসন মাথা নেড়ে ‘না’ বললে, দুর্যোধন হেসে বলল, “তোমার অত বুঝে কাজ নেই, নতুন রথ খানা নিয়ে মঙ্গলবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বে।”
৮
“মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। খনার বচন মেনে চললে আমাদের বুধবারই রওয়ানা হওয়া উচিত হস্তিনাপুর। লাগাতার হেঁটে গেলে শুক্কুরবারের মধ্যে পৌঁছনো যাবে রাজ্যে। যাবার আগে চল রামবাবুর সঙ্গে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে আসি।” যুধিষ্ঠিরের কথায় সবাই একমত হয়ে রামের কুটীরে হাজির হয়ে দেখে কুটীর শূন্য। কেউ কোথাও নেই। অগত্যা পাণ্ডবরা পথে নামল।
হস্তিনাপুরে পৌঁছে তাদের মনে ডাক দিল। রাজাহীন রাজ্য যেমন অনাথ টাইপ হয় আর কি, ঠিক সেই রূপ। পায়ে পায়ে প্রাসাদে পৌঁছে এ মহল ও মহল কোথাও কৌরবদের টিকির দেখা না পেয়ে তারা দরবার মহলে এসে হাজির হল।
“এ কি! তুমি! এখানে?” দ্রৌপদী ছুটে গেল রাজ সিংহাসনের কাছে। সেখানে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে সীতা তখন মুখে শাহি টুকরা কাবাব পুরেছে ! তার চারদিকে থরে থরে নানা রকম বিলাস সামগ্রী।
পাণ্ডবরা থতমত খেয়ে বললে, “বৌদি তুমি? মানে আপনি?”
সিংহাসন থেকে নেমে এসে এক গাল হেসে সীতা বললে, “হ্যাঁ, আমিই তো! সে এক দারুণ মজার ম্যাজিক! সান বাথ নিচ্ছিলুম বীচে বসে, একটা আনারসের স্মুদীতে চুমুক মারছি, ঝেঁপে এলো ঘুম! তারপর চোখ খুলতেই দেখি হলিডে ডেসটিনেশান বদলে হয়েছে হস্তিনাপুর! রাবণবাবু পারেনও বটে সারপ্রাইস দিতে! এদের ব্যবস্থা তো ভালোই ছিল, সেবা যত্ন দু দিনে ভালোই পেলাম, কিন্তু পালের গোদা, মানে আমার যে মেইন সেবাইত ছিল, দুর্যোধন, তাকে আজ আর সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না!”
সীতার কাহিনী শুনে পাণ্ডবদের মুখে তালা এঁটে গেল। দ্রৌপদী কোনক্রমে বললে,“সীতাদি, দুর্যোধন কোথায়?”
সীতা আঁচলের গিঁঠ খুলে একখানা চিরকুট ধরিয়ে দিল দ্রৌপদীর হাতে। “বললাম তো, জানি না। এই নাও, ধরো। কাল রাত্তিরে তোমাদের ওই দুর্যোধন আমাকে এই খানা হাতে দিয়ে বলল, বৌঠান, পাণ্ডবরা যদি কোনদিন আসে, ওদের হাতে এটা দিয়ে দেবেন।”
তাড়াতাড়ি দ্রৌপদীর হাত থেকে চিরকুটটা নিয়ে অর্জুন পড়ল। একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না। সবাই যখন “কী পড়লে, কী পড়লে?” বলে উদ্বিগ্ন, তখনি রাজদরবারের রাজদ্বার দিয়ে ঢুকল কৃষ্ণ। অর্জুনের হাত থেকে চিরকুট টা নিয়ে জোরে জোরে পড়ল — “আমরা কৌরবরা জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে চললুম, আমাদের খুঁজো না, পাবে না!”
বিনা যুদ্ধে রাজপাট পেয়ে যুধিষ্ঠির তো আহ্লাদে আটখানা ! ভীম গাল ফুলিয়ে বলল, “যাঃ, যুদ্ধু হবে না? এত করে মেদ ঝরালুম!”
তীব্র গলায় দ্রৌপদী সবাইকে বললে, “খুব বাহাদুরি হয়েছে তোমাদের! সত্যিকারের বাহাদুরনি কেউ যদি হয় তো সে হল সীতাদিদি!”
দ্রৌপদী সীতাকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসিয়ে বলল, “দিদি, তোমার তেজ আর সাহসের জন্য আজ বিনা যুদ্ধে আমরা সব ফিরে পেলাম। কত মানুষের প্রাণ অকারণ হিংসা আর মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। তুমি ধন্য!”
সীতা মধুর হেসে বললে, “আমি তো ভাই শুধু ভালো মন্দ যে অবস্থায় থাকি না কেন, জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছি মাত্র! তাতে যদি তোমাদের এত বড় লাভ হয়েছে, তার জন্য আমি দায়ী নই, এ তোমাদের ভাগ্য!”
দ্রৌপদী সীতাকে হস্তিনাপুরের আতিথ্য গ্রহণ করে যদ্দিন খুশি থাকতে বললে, সীতা বলল, “না ভাই, রামচন্দ্র আর দেবর লক্ষণকে ছেড়ে অনেকদিন আছি। লঙ্কায় থাকার সময় নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারিনি। লক্ষণের আমাকে গণ্ডি কেটে, ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে থাকতে বলার বাড়াবাড়ি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মেয়েরা পুরুষের জীবনে জগদ্দল পাহাড় নয়, বোঝা নয়, এটাই ওদের বোঝাতে চেয়েছিলাম! চিরকাল শাস্ত্র বলে এসেছে পথে নারী বিবর্জিতা! তাই এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ! আমরা নিজেদের খেয়াল নিজেরা রাখতে সমর্থ! কিন্তু আজ স্বামীর জন্য বড্ড মন কেমন করছে ভাই। তাকে খবর করেছি, এলেন বলে!”
রাম যখন “সীতা, সীতা” করতে করতে ব্যাকুল হয়ে হস্তিনাপুরে পৌঁছলেন, আবার দুই বনবাসি পড়শিদের মিলন মেলা বসে গেল। ধুয়ে মুছে গেল সব ভুল বোঝাবুঝি।
দেখতে দেখতে প্রকৃতিতে লাগল হিমেল হাওয়ার পরশ। অযোধ্যার ঘরে ঘরে আজ হাজার হাজার মাটির প্রদীপের আলোয় পথ ঘাট আলোকিত। ফুল মালায় সেজে উঠেছে রূপসী নগরী, শুভ দীপাবলির পুণ্য লগ্নে রামচন্দ্র, সীতা আর লক্ষণ অযোধ্যা নগরীর পথে পা রাখলেন। বেজে উঠল শঙ্খ, দুন্দুভি, কাড়া নাকাড়া। ভরত বরণ করে নিলেন রাজা রামকে।