Photo: Shutterstock/Filipe Frazao

বাঙ্গালবাবা এবং আরও বারো

“কী পড়িস? বইটা কই? কিস্যু মনে থাকে না যা পড়সস? এত্ত কঠিন যে মাথার উপর দি যায়? যা জিগাইব ভুল! থাউক, আর কাম নাই তর পইর‍্যা। আবার দাঁত কেলাইতেসস? কোপাই দিব!”  

সে বহু বছর আগের কাহিনী ফেঁদে বসেছি। সাল উনিশও তিয়াত্তর-চুয়াত্তর হবে। পারিবারিক রেষারেষির শিকার হয়ে সাত ঘাটের জল খেয়ে আমার বাবা শেষ পর্যন্ত ঠাকুরদার শেষজীবনের অনুশোচনার প্রাপ্তিস্বরূপ পৈত্রিক বাড়ির পাশেই বিঘে দুই জমি পেয়ে ওখানেই বাড়ি তুলেছে। 

আমার তখন চড়াই পাখির জীবন। সারাদিন শুধু ফুরফুরাচ্ছি! প্রাইমারি স্কুল দুপুর দুপুর ছুটি হয়ে যেত।  খাওয়াদাওয়ার পর মা’র নাসাধ্বনি গাঢ় হলেই একছুটে ছাদে দে চম্পট! আমাদের পাড়ার বাড়িগুলো বেশিরভাগই তখন ছিল একতলা, বড়জোর দেড়তলা ছাদের চিলেকোঠা নিয়ে। সব বাড়ির আঙিনায় এক চিলতে সবুজে দিব্বি আম, কাঁঠাল, পেঁপে, সজনে, নিমের গাছ। আমাদের বাড়ির বাঁ দিকে ঘোষদস্তিদারদের বিশাল আম গাছটা আমাদের ছাদের আলসেতে এসে কোলাকুলি করত। পাখ পাখালির কিচির মিচিরে ভরে থাকত গলিপথ। আমের মুকুল, কাঁচা আমের গন্ধের সাথে আমাদের বাড়ির দরজা জালনার কাঁচা মিঠে রং দুপুর সূর্যের আলোয় জ্বলে জ্বলে ভারি মিঠে একটা গন্ধ ছড়াত।  

রোজকারের মতন সেদিনও ছাদে উঠে আমগাছের নতুন বউলের খবর নিচ্ছি, এমন সময় হেঁড়ে গলার ওই বাক্যি শুনে চুপিচুপি ছাদের সামনে আলসের ধারে এসে দাঁড়ালাম। দেখি ফর্সাপানা গোলালো মুখের একটা লোক। মাথায় অল্প টাক হলেও কাঁধের গোড়া অবধি জটা চুল, গালে অল্প ফিনফিনে দাড়ি। সাদা ধুতি মালকোঁচা মারা সাদা ফতুয়া। গলায় দু’ ছড়া তুলসীর মালা, কপালের তিলক নাক অবধি নেমেছে। 

ফর্সা, মোটা, ঘেমো কপালে বিরাট বড় সিঁদুরের ধ্যাবড়ানো টিপ পরা এক মহিলাকে আঙ্গুল তুলে শাসাচ্ছে, আর মহিলা দাঁত বার করে হাসছে! 

পাড়ার এই বাড়িটা ছিল বড় অদ্ভুত! বড় বড় পাথর বসান দেড়তলা বাড়ি। নীচে তলায় খান দুই বড় বড় ঘর আর চিলেকোঠায় এক খানা লজঝরে টালির। নীচের টানা বারান্দায় চিত্রবিচিত্র ঘুলঘুলি। অলিন্দে দেবদেবী, নর্তকীদের মূর্তি। কুলুঙ্গি গাঁথা দেওয়াল, অশ্বত্থের চারা গজান প্যাঁচাল সিঁড়ির রেলিঙে মাটির জোড়া সাপ। একটা সিংহের মাথায় এসে ছাদের শুরু। এই বাড়ির সদর দরজা সবসময় হাটখোলা। আমাদের বারান্দায় দাঁড়ালে ওদের সদর বরাবর রান্নাঘরটা দেখা যেত। সকাল সন্ধ্যে এই বাড়ির আনাচ কানাচ থেকে হাসি ঝগড়া, গালি গালাজ, চ্যাঁ ভ্যাঁ র দাঁড়ি কমা হীন বোলচাল চলত। 

“বাঙ্গালবাবা আসো নাকি?” বলতে বলতে দেখি সাদা শাড়ি লাল পাড় পরা ঘোমটা মাথায় এক মহিলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। হাতে আলতার শিশি। আরে, একে তো আমি চিনি! এক বিকেলে “বউমা আসো নাকি?” বলে আমাদেরও খিড়কি ঠেলে ঢুকেছিল। মা’র নখ কেটে আলতা পরাল। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমিও লাজুক মুখে রাজি হলাম আর সারাদিন রাঙ্গা পা জোড়া তুলে তুলে বেড়ালাম। পাড়ার কাঠ মিস্ত্রি অনন্তর বৌ অমিয়। বরটা অকম্মার ধাড়ি। অমিয় পাড়ার বৌ-ঝিদের আলতা তালটা পরিয়ে দুটো টাকা কামায়।

সিংহের মুখে হাতের থাবা গেঁড়ে মুখ বাড়িয়ে বাঙ্গালবাবা বলল, “হাও! উপরে আইস!” 

অমিয় মাদুরে বসে বলল, “আর, আসো ক্যামন?” 

বাঙ্গালবাবা নামের লোকটা ধুতির কষি খুলে আবার বেঁধে বললে, “আইর থাকা! ঠাইরনরে পড়তে দিলাম ‘পুত্র সন্তান লাভের অব্যর্থ উপায়’ আর ইনি সিনেমার পাতা ‘মুখ ও মুখোশ’ উলটাইতাসেন!”

এক আকাশ রোদের নীচে আমাকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্যাবড়ানো টিপ বললে, “ও ঝণ্টুদার মাইয়া না কি?” 

অমিয় হেসে বললে,  “হ। ছুটো মাইয়া, অহন থিকাই আলতা পরতে বড় ভালবাসে।” 

দুই মহিলা জোরে হেসে উঠল। বাঙ্গালবাবা ‘ভাটি হইতে আইল বঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি’ গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। ধ্যাবড়ানো টিপ আমাকে বললে, “বিকালে আসিস, মুড়ি দিব।” 

নতুন পাড়ায় এসে অবধি আমার বিকেলগুলো একপ্রকার পানসেই ছিল। ঘোষদস্তিদারের মেয়ে আর সেনেদের মেয়েদের সাথে মাঝে মধ্যে মাঠে যেতাম রান রেস খেলতে। অন্য পাড়ার বড় ছেলেরা প্রায়েই মাঠ জুড়ে বল লাথাতে আসত, তখন আমাদের ভারি অসুবিধে, আবার গলিতে নেট টাঙিয়ে পাড়ার বড় মেয়েরা ব্যাডমিন্টন খেললে আমরা গলি থেকেও উচ্ছেদ!

বাঙ্গালবাবার কল্যাণে আমাদের নির্জীব জীবনে হঠাৎ যেন তুফানের ঘোর লেগে গেল। ছাদ, মাঠ, গলি যখন যা জোটে তাইতেই ভানুমতীর শতেক খেলার উৎফুল্লতায় আমাদের শিশু জীবন আনন্দে ভরে গেল। 

নয় নয় করে বাঙ্গালবাবার ছিল ছয়-ছয়খানা মেয়ে। পাড়ার মা কাকিমারা নিজেদের ফেলাছড়ার আলোচনায় প্রায়েই মুখ বেঁকাত — “ওঃ ভগবান! এই বাজারে ছ’ ছখানা মেয়ে! তায় শেফালিটা আবার পোয়াতি।” 

স্নানভেজা চুলের গুটলিতে আঙ্গুল চালাতে চালাতে ঘোষদস্তিদারের বৌ বলত, “শুধু ছেলে ছেলে হাকাইপানা করে এমন হাল করেছে বৌটার!” 

বেনেবাড়ির নতুন বৌ বলত, “নির্লজ্জতার মাথায় বাড়ি!” 

মা-ও গ্রামভারি চালে বলত, “একা হাতে কি আর তালি বাজে, রমা?”

মোটের উপর পাড়ার কেউই খুশি ছিল না ওই বাড়ির সদস্যদের উপর। 

আমারও অবিশ্যি কিছু সমস্যা ছিল। চোখের সামনে দিবারাত্র নানা রঙের বোতাম ছেঁড়া ফ্রক পরে একপাল মেয়ের দল যখন খুশি গলিজুড়ে লাট্টু ঘোরাচ্ছে, সবুজ নীল বেগনি কাঁচের গুলি টিপ করে গুলতানি করছে, আর আমি তখন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গোঁফে চারা মেরে চাণক্যের পরামর্শে কোন রাজ্যের কোন রাজার পেছনে কত খ্রিষ্টাব্দে কতবার বাঁশ দিয়েছে তার হিসেব মুখস্থ করছি! এই অত্যাচার কাঁহাতক সওয়া যায়?

দুপুরের ছাদটুকু যা আনন্দযজ্ঞের জায়গা ছিল, ধ্যাবড়ানো টিপ নাক গলিয়ে সেটাও ধেবড়ে দিল। এক নির্জন দুপুরে আমি যখন মা’র আচারের বয়েমগুলো হাতড়ান শেষ করে ঘোষদস্তিদারদের আম গাছের দিকে ঝাল নুন হাতে গুটি গুটি এগোচ্ছি, ধ্যাবড়ানো টিপ ওদের ছাদ থেকে হেসে বললে, “গাউচ্ছা মাইয়ার চোখে ঘুম নাই! মা জানতি পারলে দিব অ’নে।” বলে কিল পাকিয়ে দেখাল। এ তো ভারি মুশকিল! মার কানে তুলে দেবে না তো! 

মহিলাকে খুশি করতে মুখ ফসকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসিমা মালপো খামু’ স্টাইলে বলে দিলাম — “মাসি, মুড়ি খাব!”

“ওরে আমার সোনা রে! ধন রে!” বলে নিজের থুতনিতে যথেচ্ছ আঙ্গুল বুলিয়ে চুমু খেয়ে মহিলা বললে, “বিকালে আইস ক্যামন? মাসি নয়, পিসি বলবা।”  

নেওতা তো পাওয়া গেল এখন মা-বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অতএব বাবাকে ধরা! “বাবা, গাউচ্ছা মা-মানে কী?” 

হো হো হেসে বাবা বলল, “আমাদের গেছো মেয়েকে কে নাম ধরে ডাকল?” 

ধ্যাবড়ানো টিপের কথা বলতে বাবা হেসে বলল, “ওঃ! শেফালি? ওর দাদা ধনু ছিল আমার ছেলেবেলার বন্ধু,  বুঝলি টুনি! ধনু, রামু, মদনা, ভোলা, কেশী আমরা সব একসাথে ওই কুলতলার মাঠে বল পিটিয়েছি, চাঁদনী রাতে কাটা তেঁতুল গাছের গুঁড়িতে বসে ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর’ বলে গলা ছেড়ে কত গান… ওই মাঠেই হৈ হৈ করে দুগগা পুজো, আবার বেপাড়ার মাস্তানদের টাইট করতে সাইকেলের চেন ঘোরাতে ঘোরাতে দল বেঁধে লড়ে এসেছি!” 

আমার এমন হিরো মার্কা বাবা থাকতে মা ভৈঃ ভেবে মনের আর্জি পেশ করে দিলাম! শুনে মিটিমিটি হেসে বাবা বলল, “তোমার হাফ ইয়ারলির অঙ্কের নম্বরখানা একেবারে ভাল হয়নি মা! তুমি যদি রোজ দুপুরে অন্ততঃ তিরিশ খানা অঙ্ক কষতে পারো, তাহলে আমি শেফালির মেয়েদের সাথে তোমার খেলাধুলোর কথাটা মাকে পাড়তে পারি!”

দুপুরে আমার নিজস্ব আমোদখানা বড় লোভনীয় ছিল, তাছাড়া একেবারে তিরিশ খানা পাটিগণিত বীজগণিতের বাটখারা সেধে কাঁধে নেওয়া তো চাট্টিখানি কথা না! আবার সত্যি বলতে কি,  বিকেল হলে বাঙ্গালবাবার মেয়েরা রে রে করতে করতে যখন গলিময় ছড়িয়ে পড়ত, ওদের ‘কুমির তোমার জলকে নেমেছি’ চিৎকারে আমি বারান্দায় ছুটে এসে দেখতাম সে সব আশ্চর্য খেলা। মন চাইত এক ছুটে গিয়ে ভিড়ে যাই ওদের দলে, অমনি ঘুরে ঘুরে গাই ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাত ধরি ধরি, নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।’

যেদিন দেখলাম ঘোষদস্তিদারের মেয়েকে ‘নাম পাতাপাতি’ খেলায় ‘আয় তো রে আমার গোলাপবালা’ বলে  ওরা ডাক দিল, আমার বুকে ভূমিকম্প হয়ে গেল! অঙ্কের বলি কাঠে সাধের দুপুরগুলোকে পাঁঠা করে দিলাম।   

বিকেলগুলো অনাবিল আনন্দে ভরে গেল। বৌ-রানি, রুমাল চোর, ওপেন্টি বাইস্কোপ — খেলার যেন ধুম পড়ে গেল! সকাল হলেই বিকেলের অপেক্ষা! যেদিন বড় মাঠ থেকে ছেলেদের হোহো আওয়াজ ভেসে আসত — ‘গোও ও ও ল’, আমরা গলিতে খেলতাম। আবার যেদিন গলিতে বড় মেয়েরা ব্যাডমিন্টনের নেট টাঙাত, আমরা পালা করে এর ওর ছাদে খেলতাম।  

দেখতে দেখতে পরিচয় গাঢ় হল। এক একদিন বাঙ্গালবাবা বাজারের থলি ঝুলিয়ে গলিতে ঢুকত। “কুমড়াটা ধর” বলে থলি বাড়িয়ে ধরলেই সবচেয়ে বড় দুই মেয়ে স্বপ্না আর চম্পাদি সুরুৎ করে ঘরে সেঁধিয়ে ঘটি ভরে  জল আর গামছা আনত। মাঝের দুই মেয়ে টিঙ্কু রিঙ্কু খেলা ছেড়ে যেত না। রকে বসে বাঙ্গালবাবা ঘাড়ে মুখে জল ছিটিয়ে গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খেত। খেলার মাঝে এই ব্যাগড়া বড় বিরক্ত লাগত। ওদের পরের দুই বোন পুতুল আর পুঁটুরানিকে আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনতাম না। খেলায় জোগাড়ের কাজ ছাড়া তেমন কিছুই তারা পারত না। 

ছোটরা অনেক সময় না চাইতেও বড়দের অনেক কথা শুনে শিখে ফেলে। অমিয় মাকে আলতা পরাতে পরাতে বললে, “অ বউদি! শ্যাফালির প্যাটটা কি সোন্দর হইসে দ্যাখসেন? তরমুজের মত গোলালো! এবারেও মাইয়া না হইয়া যায় না!” 

বিকেলে ওস্তাদি করে আমি খবরখানা টিঙ্কুর কানে তুলতে সে শিউরে উঠে বললে, “কস না! কস না!” 

ঘাবড়ে বলি, “কেন?” 

সে বললে, “বাবা মাকে ‘কাইট্যাঁ ফালামু’ বলবে।” 

শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। “সে কি? কেন?”

টিঙ্কু শুকনো মুখে বললে, “বাবা পোলা চায়।”

মানুষের মনের বিচিত্র সব চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব জটিলতা বোঝার বয়েস তখন আমার নয়। বাঙ্গালবাবার এই বেয়াড়াপনায় বেজায় রেগে গেলাম।  

শেফালি পিসিকে আমার খারাপ লাগত না। ফর্সা মুখটা সংসারের কাজে ঘেমে থাকত সব সময়। পিসিদের গোটা সংসারটা যেন খোলা রকের উপরেই ছিল। ছোটদের চান খাওয়া, উকুন বাছা, চুল বাঁধা, ঘড়ি ঘড়ি চা মুড়ি, ঝগড়া গল্প খুনসুটি সব যেন খোলা খাতা! গলি দিয়ে কেউ গেলে পিসি হাসি মুখে খবর নিত। বলত, “আসো, চা মুড়ি খাবা?” 

এক রবিবারের বিকেলে টিঙ্কু রিঙ্কুরা খেলতে এল না। ওদের সদর দরজাটাও বন্ধ। এ তো বড় আজব ব্যাপার! অতএব ঘোষদস্তিদারের মেয়ে আর আমি মিলে দরজাটা ঠেলে দেখলাম, ভেজানো! কোথাও কোনও আওয়াজ পেলাম না। রান্নাঘরের পেছন থেকে হাল্কা কথাবার্তা শুনে আমরা দু’জন বেড়াল পায়ে গিয়ে দেখি, রান্নাঘরের পাশের চাতালে মাদুর পেতে পিসি শুয়ে আছে আর লম্বা একটা চুলে আংটি জড়িয়ে বাঙ্গালবাবা পিসির গোল ভুঁড়ির উপর দোলাচ্ছে! ব্যাপার দেখে আমরা বেবাক স্তব্ধ হয়ে গেলাম। 

“গুলগুল ঘুরত্যাসে, এবার পোলা না হইয়া যায় না! যদি প্যানডুলামের মত ঘুরত তো চিন্তার বিষয় সিলো।” বাঙ্গালবাবার কথা শুনে আমাদের তাক লেগে গেল। “প্যাট ভইরা খাবা আর পশ্চিমে মাথা রাইখ্যা শোবা। বইখান তো পড়বা না, ওতে সব লেখা আসে!”    

বলাবাহুল্য ওখানে দাঁড়ান আর উচিত মনে করলাম না। বাইরে এসে ঘোষদস্তিদারের মেয়ে বলল, “পোলা কী রে?” 

তাকে গম্ভীর চালে বললাম, “সে এক বিষম বস্তু!” 

পরদিন খেলার সময় টিঙ্কু বললে আসানসোল থেকে তাদের মামু এসেছে তাই নাকি চিড়িয়াখানায় গেছিল। টিঙ্কুর মামু সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমাদের বাড়িতে এলে বুঝলাম এই সেই বাবার বন্ধু ধনু!

ধনু চা খেতে খেতে বাবাকে বললে, “কলকাতার এই প্রপার্টি এই ভাবে ফেলে রাখা যাবে না ঝণ্টু! বাবা বেঁচে থাকতে যা হবার হয়েছে, আমি এই বাড়িটাকে হরি ঘোষের গোয়াল হতে দিতে পারি না!” 

লোকটার সব কথা না বুঝলেও একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলাম। 

বাবা বলল, “এদের ব্যাবস্থা কী করবি?” 

তাতে ধনু বলল, “কেন? মেদনিপুরে আমাদের কিছু জমিজমা আছে তো! আমি লিখে দিতে পারি সে সব। শুধু এই বাড়ি আমার চাই!” 

বাঙ্গালবাবার আংটি পিসির ভুঁড়ির উপর গুলগুল ঘুরলে কি হবে ! পিসির কোলে সপ্তম কন্যা জন্ম নিলে পিসি নাম রাখল ‘ক্ষান্তমণি’। 

ক্ষান্তমণির যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে তখনি বাঙ্গালবাবা ক্ষান্ত দিত এই উদগ্র বাসনাবীজের খেলায়। কিন্তু তা তো হবার নয়, তাই অচিরেই পিসির মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাবিজ কবচে ভরে গেল। গলিতে সাধুবাবা পীর ফকিরের আনাগোনা শুরু হল। পিসিদের বাড়িতে জলপড়া, চালপড়া, মন্ত্রতন্ত্রের হিড়িক পড়ে গেল। পাড়ার  পাঁচ লোকে পাঁচ রকম কথা বলতে লাগল। 

বাঙ্গালবাবার গোঁ তখন তুঙ্গে। কারও কথার ধার ধারে না। পিসির জীবনটা যদি কংসের কারাগারের মতন হয়,  বাঙ্গালবাবার এই পুত্রেষ্টি যজ্ঞে অষ্টম সন্তান পোলার প্রতিজ্ঞাটা ঠিক যেন ভীষণ কংসমূর্তি! 

দীনেশ দাদুদের বাড়িটা ছিল শেফালি পিসিদের বাঁ দিক লাগোয়া। একটাই পাঁচিল দুই বাড়ির মাঝে। পিসিদের শোয়ার ঘরটা পড়ত ওদিকে। দীনেশ দাদুর ছেলের বৌ পাড়ার মা কাকিমাদের ভারি রসাল এক খবর শোনালে, চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। হায় পোড়াকপাল বাঙ্গালটা ঋতুস্রাবের দিনেও ছাড়ে না?

মা কাকিমাদের এই “হায় হায়” পল্লবিত হয়ে পিসির কানে পৌঁছলে স্বামী-স্ত্রীতে কী হয়েছিল তা আমাদের জানার কথা নয়। তবে দিন দুয়েক পরে টিঙ্কুদের ছাদে খেলতে যাবার সময় ঢাউস একটা চার্টবোর্ড দেওয়ালে টাঙ্গানো দেখেছিলাম। ‘পোলা সঙ্ক্রান্ত অব্যর্থ প্রয়াস’ — এই চার্টের প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম এই ভাবে ঘরগুলো দাগানো ছিল।  

ছোটরা সবসময় যে আঙনের ধোয়া তুলসীপাতা হয়, তা নয়। আমাদের মধ্যেই কেউ ‘ভবম হাজাম’ হয়ে এই চার্টের চাট মশলাটি বাইরে ছড়ালে পাড়ায় রীতিমত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। “শালা, বাঙ্গালভুত কোথাকার! নিধুবনের কলির কেষ্ট সাজা হচ্ছে? নোংরামির চূড়ান্ত? ইতর!” যার যা মুখে আসে শুনিয়ে দিল।

বাঙ্গালবাবাও রকে দাঁড়িয়ে “কী বললি শুয়ার? ঘর থিক্যা বাইর হয়ে বল,” বলে কম চেঁচাল না। তারপর ধুপধাপ ধস্তাধস্তির মধ্যে ঝুপ করে পাড়াময় লোডশেডিং হয়ে গেলে দুই যুযুধান পক্ষ শান্ত হতে বাধ্য হল। বাঙ্গালবাবার মেয়েদের সাথে খেলা ঘুচে গেল আমাদের। গরমের ছুটির মুখে আমরা দিল্লি ঘুরতে চলে গেলাম। ফিরে এসে অমিয়র মুখে শুনলাম শেফালি পিসি পোয়াতি। 

দুর্গাপূজার পর পর আবার ধনু এল, সাথে এল একগুচ্ছ তর্কাতর্কি। ধনু বোধহয় পিসিকে বলে থাকবে যে পাড়ার লোকেরাই চায় না যে পিসিরা এখানে থাকুক। পিসি ক্ষান্ত কোলে এক মাথা ঘোমটা টেনে রকে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, “ক্যান যামু? আমার বাবা খাইয়া না খাইয়া শরীরের রক্ত পানি কইর‍্যা এই বাড়ি বানাইয়াসিলেন, খেদাইয়া দিলেই হইল?”

বাবার পরামর্শে এক বছরের নোটিস দেওয়া উচিত মনে করে ধনু সেইমত উকিলি ব্যবস্থা করল। পাড়ার বয়স্করা বললেন, হাজার হোক, ধনু ছেলে তো! ওর অধিকার আছে। 

বাঙ্গালবাবা যতই গলা ফাটাল, “তর অধিকারের মুখে গুল্লি মারি! বেয়াদপ, এই জন্যি আমার মাইয়াদের লগে এত্ত প্রেম! আইজ চিড়িয়াখানা, কাইল জাদুঘর!” বলে গলা ফাটাল, কিছুতে কিছুই হল না। পাড়ার লোকের কোনও সহানুভূতি পিসিরা পেল না।

বাঙ্গালবাবা ধুতির কষি খুলে আবার বেঁধে বলল, “ঠিক আসে, আমার পাপের প্রাইত্তির আমিই করব। মেদনিপুরের জমিজমা বাসাবাড়ির দেখাশুনা করতে আমিই যাব। তবে আমার সময় চাই, হুট বলতি হুট আমি  পরিবার নড়াতে পারি না!” 

দেখলাম রান্নাঘরের মেঝেতে কুপির আলোয় বসে পিসি চোখে আঁচল চাপা দিল। 

শীতের শুরুতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম টিনের ফুলছাপ ট্রাঙ্ক, সবজেটে হোল্ডল হাতে ঝুলিয়ে “পোলাপানরে লইয়া এট্টু সাবধানে থাইক্যো” বলে বাঙ্গালবাবা সদর দিয়ে বেরল। চোখ ফেটে জল এল যখন দেখলাম আমার কত বিকেলের কত রং বেরঙের ভানুমতীর খেলার সাথি টিঙ্কু রিঙ্কুও জলের বোতল গলায়,  ঝোলাঝুলি নিয়ে তাদের বাবার সাথে গলির বাঁকে মিলিয়ে গেল। যাবার বেলায় বন্ধুদের সাথে একটা কথাও হতে পারল না। 

পিসি মৃদু গলায় বলল, “কান্দস ক্যান? অরা আবার আইব, আবার খেলবি, ক্যামন?” 

বিকেলগুলো নেতানো মুড়ির মত হয়ে গেল। দুপুরগুলোও আর মধুর রইল না। যেন কোন অচিনপুরির এক দুরন্ত রাক্ষস এসে আমাদের আনন্দময় মুহূর্তগুলোকে পায়ে দলে দিয়ে গেল। 

এমনি এক নিঝুম দুপুরে একটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে একটি বানর এক মিনিটে তিন মিটার উঠেও বাঁদরামি করে দু মিনিটে আবার দু মিটার নীচে নেমে যায়। বাঁশের উচ্চতা পঞ্চাশ মিটার হলে বানরটা বাঁশের ডগায় কতক্ষণে পৌঁছবে? ভেবে ভেবে যখন আধখানা পেন্সিল প্রায় উদরস্থ করে ফেলেছি, নারকেলের মালায় করে কৎবেল মাখা নিয়ে শেফালিপিসি গুটি গুটি বারান্দার সিঁড়িতে এসে বসল। 

অভিমানভরে তাকালাম না, বানরের বদমায়েশি কব্জা করতে বিশেষ মনোযোগী হলাম। পিসি যখন বুঝলে কৎবেল দিয়ে আমার সাধনা ভঙ্গ করা যাবে না, তখন একেবারে চুপ করে উদাস মুখে নিজেই চকাস চকাস করে খেতে খেতে বললে, “টুনি, তুই এখনো এত বড় হস নাই যে সব কথা বুঝবি! তয় এটুকু তো বুঝিস যে এই পাড়ায় আমাগো কেউ পছন্দ করে না। এই যে বউদিরা আইজ এরে অরে কচু শাক, ঘণ্ট, ঝোল ঝাল চচ্চড়ি দেওয়া থোয়া করে, আমারে কখন কেউ দিসে? বলসে কেউ, পোয়াতি প্যাটে মুখে কি রোচে না রোচে? আসলে কী জানিস, আমাগো ট্যাঁকা নাই, তাই আমাগো চলন ব্যাঁকা। মানুষডারে এক দিনের তরে সুখ দিতি পারলাম না। তার সব আছিল জানিস? জমি, বড় ভিটা, ফলপাকুড়ের বাগান, পুকুর ভরা মাস, সব। কত বড় নদী সিলো আমার শউরের ভিটার গাঁয়ে। কত লোক নাইত। গরু মোষকে পানি খাওয়াত। দ্যাশ ভাগ হইয়া গেল। সামান্য কিসু কাপড় চোপর লইয়া সব ফেলাইয়া এপাড়ে চলে আসা! ঘর বাড়ি, বাগান ক্ষেত, মাস- পুকুর বন্ধু স্বজন সব পিসনে পড়ে থাকল।” 

পিসির কথায় কী ছিল জানি না, নিজের হাতে সাজান সংসার হারানোর ব্যাথা কী তাও জানিনি, তবু ছোট্ট বুকে বড্ড মোচড় দিল। পিসি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি রে, আমার কেন পোলা হয় না বল তো বাপ?” পিসির গাল বেয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। 

এই চোখের জলের বন্যা বেয়েই এল বাঙ্গালবাবার অষ্টম কন্যা, ‘ফেলনা’। 

বাঙ্গালবাবাকে গত এক বছরে বার দুয়েক দেখা গেলেও টিঙ্কু রিঙ্কুদের আর আসতে দেখিনি। সে বছর ধনুরা আসবে বলে বাড়ি ঘর সারানোর মিস্ত্রি লাগল। ভাই বোনে বাতচিত হত না। ধনু চিলেকোঠার ঘরে থাকত, স্বপাক খেত। বোনকে উচ্ছেদ করার জন্য সে উঠেপড়ে লাগল। ধনু পরিবার আনবে বলে আসানসোল চলে গেলে আমি একদিন বাঙ্গালবাবাকে দেখতে পেলাম। তবে কি টিঙ্কুরাও এসেছে? বুকের লাবডুপ সামলে পিসিদের বাড়ি ঢুকেই শুনি বাঙ্গালবাবা পিসিকে আঙ্গুল তুলে বলছে, “তুমি বেশি কথা বলিও না। ওই ধনুর পোলারে ক্যামন ঘোল খাওয়াইতে হয় তা জানা আসে আমার। হালায় জমি বাড়ি কিসুই তোমার নামে করায় নাই, ভিখিরির মত আমাগো খেদাইবার মতলব সাঁটসে।”

হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তে পিসি “কী রে টুনি?” বলাতে বাঙ্গালবাবা হনহনিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। আমার খেলার সাথিরা আসেনি শুনে আমি চুপচাপ বাড়ি চলে গেলাম। 

শেফালিপিসি আবার পোয়াতি হল। ধনুর কাছে খবর পৌঁছলে সে ধনুকের জ্যা ছেঁড়া হয়ে, পরিবার ফেলে কলকাতায় ধেয়ে এল।  

যথাসময় পিসির কোলে এলো ‘মিছরি’। 

পিসিও যে এখানে খুব সুখে ছিল তা মনে হত না। মুখভরা সেই হাসি, পথচলতি মানুষকে ডেকে মুড়ি খাবার আপ্যায়ণ আর চোখে পড়ত না। 

মাঝে মধ্যে ধনু আর শেফালি পিসির ধুন্ধুমার বেঁধে যেত। চিলেকোঠা থেকে ধনু চেঁচাত, “বাড়ির একমাত্র পোলা হইয়া এই ভাঙ্গা চিলেকোঠায় কাকের মত বেঁচে থাকব? কভি নেহি!”

পিসি চেঁচাত,  “পোয়াতি গাভীদেরও কেউ গোয়ালসারা করে না আর এ তো আমার নিজের বাপের বাড়ি!” 

দাদা হয়ে ধনু লজ্জার মাথা খেয়ে বোনকে বলতে পারত না যে এবার পোয়াতি হওয়ার পোদ্দারিতে ক্ষান্ত দে, তাই আসল কালপ্রিটকে ধরার আশায় সে তক্কে তক্কে রইল।

কিন্তু কথায় বলে যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল! বাঙ্গালবাবা সেই যে এক পোলালাভের অব্যর্থ চার্ট বানিয়ে গেছিল, তাতে পোলা লাভ না হলেও ধনুর স্বর্গলাভের পথ সুগম হল। দেড় বছরের মাথায়  উপর্যুপরি শেফালি পিসি ধনুর দুর্বল বুকে যমজ মুক্কা মেরে নক আউট করে দিল। ধরাধরি করে পাড়ার লোকেরা ধনুকে হাসপাতালে ভর্তি করে তার বাড়িতে খবর দিল। ছুটে এল ধনুর দুই ছেলে, বৌ। শেফালি পিসি তখন আমসির তেল মেখে মুড়ি খেতে খেতে এই দুই মহাবলিনীর নাম ভাঁজছে। পিসির যমজ দুই মেয়ে কাঞ্চী আর কালী পাড়ার হেডলাইন নিউজ হয়ে গেল।    

ধনুর বৌ একদিন ঘোমটা মাথায় সন্ধ্যেবেলায় বাবার কাছে এসে কেঁদে পড়ল — “ঝণ্টুদা, একটা বিহিত করুন। ইনি বাড়ির ছেলে হয়েও অধিকার পাবেন না? দিদির চালাকি আমি ধরে ফেলেছি। বছর বছর পোয়াতি হয়ে এনার পাকা ধানে মই গোঁজার মতলব। আর এখন তো মনে হচ্ছে এনাকে খুন করার মতলব এঁটেছে এরা!”   

আমার তখন উঁচু ক্লাস হয়েছে, পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। বাড়ি ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তবু এক এক দিন নির্জন গলিটা দেখে মনে পড়ে যেত কত রকমারি খেলার ভেলায় এক সময় মুখর হয়ে থাকত এই গলি!  

সন্ধ্যে হলেই তখন লোডশেডিংএর রমরমা। আমাদের কাজের মাসি বিকেলের বাসন মেজে যত লম্প, হ্যারিকেন আছে, সবগুলোর কাঁচ মুছে, পলতে উস্কে, তেল ভরে রাখত। খুব গরমের দিনে আমরা ভাইবোনরা মাদুর বগলে ছাদে গিয়ে পড়তাম। মা রেডিওতে গান শুনত, বাবা মাদুরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখত। ফুরফুরে হাওয়ায় মা’র লাগানো বেল জুঁই কাঞ্চন কামিনীর সাদা ফুলভরা ডাল দুলে দুলে সুগন্ধ ছড়াত। 

এরকমই এক সন্ধ্যেবেলায় দুলে দুলে পড়ছি, ধনুর আকাশ ফাটান “ধরসি! ধরসি!” চিৎকারে গলি কেঁপে গেল। হাসপাতাল ফেরত অসুস্থ লোক যে এমন গলা বার করতে পারে ধারণার বাইরে। এক লাফে আলসের সামনে এসে দেখি পাড়ার লোকে যে যেমন পারে কুপি লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এসেছে। বাবা দুদ্দাড় করে নীচে নেমে গেছে, আর ধনুর বগলের তলায় গামছায় আটকা পড়ে যে লোকটা কুস্তাকুস্তি করছে সে আর কেউ না, বাঙ্গালবাবা!

বিজয় গর্বে ধনু বললে, “মুততে গেসি, দেখি শয়তানটা খাটাপাইখানার দেওয়াল টপকাইতেসে! তরে আমি পুলিশে দিব।” 

বাঙ্গালবাবা নিজেকে ধনুর বগল মুক্ত করে মুচকি হেসে বললে, “আমার বৌ-এর লগে দেখা করতে আসছি, এইডা কি অপরাধ?” 

তাতে  ক্ষেপে গিয়ে ধনুর বৌ বললে, “আপনার চালাকি আমরা বুঝি না?” 

বাঙ্গালবাবা সবার সামনে “কী বুঝ? ব্যাখ্যা কর।” বলাতে সে লজ্জায় রণে ভঙ্গ দিল। স্বামী স্ত্রীর কাছে আসবে এতে বেআইনি কিছু নেই!  

ধনু বুঝল সে কী ভীষণ প্যাঁচে পড়েছে। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না বুঝে ধনু জ্যা ভেঙে নুয়ে পড়ল। রাত পোয়ালেই মেদিনীপুরের জমিজমা ভিটে বাগান পুকুর সব সম্পত্তি লেখাপড়া করে দিতে চাইলে বাঙ্গালবাবা রকে গুছিয়ে বসে বললে, “দড়ি আসে?” 

ধনু হকচকিয়ে বললে, “না।”

“তয় গামছাটা দ্যান!”

বাঙ্গালবাবার বেআক্কেল কথা শুনে পাড়ার লোকে অবাক! ধনু বললে, “ক্যান?” 

বাঙ্গালবাবা গলায় ফাঁস লাগাবার ভঙ্গী করে বললে, “এহন আপনার শর্ত না মানলে লোকে আমায় জুতা মারবে। অথচ আইজ দেড় বছরের উপর হইল আপনার মেদনিপুরের জমি ভিটা শ্যাফালির নামে করনের সময় হইল না! আপনারে আমি বিশ্বাস করি ক্যামনে? তয় আমার পোয়াতি বৌরে আমি গাসতলায় তো রাখতে পারি না!”  

বাবা গম্ভীর মুখে ধনুকে “এটা অন্যায়” বলাতে পাড়ার মাতব্বররা মোটামুটি বাবাকেই সমর্থন করল। সবাই পিসিদের রকে থেবড়ে বসে পঞ্চায়িতি জমালে বহুযুগ পরে পিসির মুখে সব পেয়েছির হাসি ফুটে উঠল। স্বপ্নাদি চম্পাদিরা গ্লাসে গ্লাসে জল এনে দিল। স্থির হল আগামী দুর্গাপূজা কাটিয়ে পিসি চলে যাবে। 

পিসির যাওয়াটা আহামরি কিছু হল না। শেষের দিনে কেউ তাকে একবাটি ঘণ্ট কি কচুর শাক খাওয়াল না,  ডেকে দুটো বিদায় সম্ভাষণ তো দুরের কথা। আমি স্কুল থেকে ফিরে মা’র কাছে শুনলাম, বাড়ি খালি করে পিসিরা চলে গেছে। মুখ বেঁকিয়ে মা বলল, “অমিয়টা দেখা করতে গেছিল বোধয়, বললে পেটটা নাকি আবার  উঁচু উঁচু!” 

বড্ড আফসোস হল পিসিকে একবার যদি সময় করে বলে আসতাম, এই অবিরাম মেয়ে সন্তানের স্রোতে পিসি যত অপমান দুঃখ, হেলা পেয়েছে, যত দোষারোপ শুনেছে, তার জন্য এক অংশ পিসি দায়ী নয়! মানুষের দেহে লিঙ্গ নির্ধারণের ক্রোমোজোমের খেলায় পুরুষই সর্বদা চেকমেট দেয়, এই সত্য বিজ্ঞান বইতে স্পষ্ট লেখা আছে। 

পিসি বেচারা বিনা দোষে সারাজীবন এই হার না মানা হার খেলায় ছত্রাখান সেপাই ঘোড়া পাগল রাজা সামলাতে সামলাতেই জেরবার হয়ে গেল। তবে পিসি নিজে এই জীবনটাকে আদৌ ‘জেরবার’ ভেবেছিল কি না তা আমি জানি না। 

শেষের ক’মাস রোজ বিকেলে রকে বসে পিসিকে রঙ্গিন সুতোয় ফুল পাখি বসিয়ে সুচের আগায় লিখতে দেখেছিলাম —  “পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য।” 

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: