নিশুত রাত্রির ডাক

রাত তখন আন্দাজ দেড়টা কি দুটো। বরের চাকরি সূত্রে নতুন এসেছি শহর জেনিভায়। নতুন সংসার গুছিয়ে বসতে ধকল তো আর কম না, আচ্ছা আচ্ছা পালোয়ানদেরও কোমর বেঁকে যায়! শুতে শুতে বেশ রাত হয়েছে, ক্লান্ত শরীরে তন্দ্রা নেমেছে, হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে গুম গুম গুম গুম গুম গুম একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমেই মনে হল কারা যেন হামলে পড়েছে সদর দরজার উপর। এলোপাথাড়ি লাথি চালাচ্ছে! ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল। বরকে ধাক্কা মেরে তুলতেই যাব, দেখি সে নিজেই ধড়মড় করে “ক্কে ক্কে” করে উঠে বসেছে।

কাঁদো কাঁদো হয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, “শোন, সুইস ডাকাতে দরজা গুঁতচ্ছে বোধহয়।”

“রাবিশ!” বলে বর বিছানা থেকে নামল। গরমের দিন, কিন্তু জালনা খুলে ঘুমতে পারি না। বাড়ির পাশেই একটা আইরিশ পাব, অনেক রাত্তির অব্দি হৈ হল্লা চলে। এসব দেশে আবার সিলিং ফ্যানও থাকে না, তাই খাটের পাশে একটা স্ট্যাণ্ড ফ্যান রেখেছি।

আমার বর প্রথমে জালনা খুলে রাস্তায় উঁকি মারল, তারপর ড্রয়ার থেকে টর্চ বার করতে গিয়ে হুমড়ি খেল ফ্যানের পায়ে। “উফ মলি! কতবার বলেছি ফ্যানটা যাতায়াতের পথে বসিও না! ওই কর্নারে কার্পেটের উপর থাকে ভালো, তা না, ফ্যানটাকে একেবারে কোলের উপর না নিয়ে শুলে চলে না তোমার?”

আমি ততক্ষণে নীলচে নাইট ল্যাম্প জ্বেলেছি, খাট থেকে নামব বলে সবে পা দুটো মেঝেতে রেখেছি  কি রাখিনি, আবার সেই হাড় হিম করা গুম গুম গুম গুম গুম গুম! বর ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললে, “সসসসস, একদম নড়বে না! লেট মি সি!” বলে টর্চ হাতে গুটি গুটি সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আওয়াজের ডেসিবেল মাত্রা ছাড়াচ্ছে। হাত পা গুটিয়ে চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। ততক্ষণে সে দেখি বেড়াল পায়ে ঘরে এসে হাজির। আমি সভয়ে চাইতে চাপা গলায় বললে, “স্ট্রেঞ্জ! বাইরে তো কেউ নেই!”

গুমগুম গুমগুম গুম গুম গুম — সে কি তীব্র আওয়াজ! কান চেপে ধরলাম। আমাদের শোবার ঘরের খাট বিছানা তো বটেই, দরজা জালনাগুলো পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল। হাউমাউ করে বললাম, “ওগো! ভু ভু ভুত নয় তো! ওরে বাবা সুইস ভুতে মেরে ফেললে গো, যে রেটে গুঁতচ্ছে আজ আর রক্ষা নেই! ঘর বাড়ি সুদ্ধু আমাদের হাড় গুঁড়িয়ে পাউডার করে আল্পসে ছড়িয়ে দেবে!”

“মলি! ডোন্ট বি সিলি!” বরের ধমক খেয়ে গোঙানি গিলে নিঝুম বসে রইলাম। ড্রেসিং গাউনের গিঁটটা কোমরে কষে আমার বর ঘর জুড়ে পায়চারি করতে করতে বলল, “হুমম, অফিসে চ্যাটার্জিদারা বলছিল বটে জেনিভায় চোরের উতপাৎ খুব বেড়েছে!”

“অ্যাঁ? সুইৎজারল্যাণ্ড চোর?” আঁতকে উঠলাম। আমার দিকে বিরক্ত ভাবে তাকিয়ে বর বললে, “তো কী? সুইৎজারল্যাণ্ডটাকে তুমি আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ভেবেছিলে নাকি?”

গোমড়া মুখে শুয়ে পড়লাম। ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো ছাড়িয়েছে। যেদিন শুনলাম আমার বরের নেক্সট ওয়ার্কিং স্টেশন জেনিভায় হতে চলেছে ভেবেছিলাম আমি বুঝি ঈশ্বরের বহু যত্নে বানানো একখণ্ড স্বর্গরাজ্যে থাকতে চলেছি! এই সব চোর চাট্টা, মাঝরাত্তিরে প্রাণঘাতী আওয়াজ কিছুই তো সুইৎজারল্যাণ্ডের সাথে মেলে না! ভারি অভিমান জমলো মনে।

কাল কখন ঘুমিয়েছি জানিই না। ছাড়া ছাড়া ঘুমে রাত কেটেছে, তাই ভোরের আলো ফুটতেই উঠে পড়লাম। দিনের আলোর নিজস্ব একটা ম্যাজিক থাকে। রাতের অন্ধকারে যে সব খুটখাট খুচখাচকে পাহাড় প্রমাণ বলে মনে হয়, দিনের আলোয় সেগুলোকে ততটা আর ভয়ঙ্কর লাগে না।

এক কাপ কফি বানিয়ে বসার ঘরের জালনার ধারে বসলাম। দূরে দেখি আল্পসের নিচে জুরা পাহাড়ের গায়ে ভোরের নরম আলো পড়েছে। হাল্কা গোলাপি, কমলা রং ধরছে। আমাদের বিল্ডিংটা একটা চৌরাস্তার উপর। সামনেই একটা বড় পার্ক। কি বিশাল বিশাল গাছে সবুজ হয়ে আছে! পার্কের বাঁধানো রাস্তার ধারে ধারে কত ফুলের বাহার। হলুদ কমলা লাল সাদা… পাখিদের মিষ্টি ডাক, দু-এক জন করে শরীরচর্চার জন্য হয় দৌড়চ্ছে, কেউ বা কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। বাস ট্রাম চলতে শুরু করেছে। শহর জাগছে আবার একটা ব্যস্ত দিনের জন্য।

কাঁধে হাতের ছোঁয়ায় চমকে দেখি হাসি মুখে আমার বর। “মলি, আজ তো ফ্রাইডে! বিকেলে তৈরি থেকো, আজ তোমাকে জেনিভার প্রাণ ভোমরা দেখিয়ে আনব। এখন চটপট কী ব্রেকফাস্ট দেবে দাও, আজ একটু আগেই বেরব, জরুরি মিটিং আছে।”

ইচ্ছে করেই রোজ ওকে একটু ভারি ব্রেকফাস্ট করে দিই। লাঞ্চে তো বেশির ভাগ দিনই সালাদ খেয়ে থাকে। তড়িঘড়ি রান্নাঘরে গিয়ে টমেটো কাপ্সিকাম পেঁয়াজ কুচোতে বসলাম। এগ স্যাণ্ডুইচ বানিয়ে দেব। ও তৈরি হতে হতে গলা তুলে বলল,  “আজ আকাশ পরিষ্কার, বেলাবেলি গেলে মঁ ব্ল্যঁ র চমৎকার ভিউ দেখতে পাবে।”

“মঁ ব্ল্যঁ?” আচ্ছন্নের গলায় বলি।

“ইয়েস! আল্পসের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। অবিশ্যি তার সাথিদারদেরও দেখতে পাবে! মঁ ব্ল্যঁ-র আলাদা ট্রিপও আছে, একেবারে চূড়ায়, কেবল কারে করে যেতে হয়। হবে, সব হবে, আছি তো এখন এখানে,” বলে হাসল। ও জানে আমি কী রেটে বেড়ানোর নামে পাগল!

কম বেশি সব বঙ্গতনয়াদের মনটাই যেন বেনারাসি মিঠে পান পাতার মত! মুখরোচক মিঠা চুন পড়লেই হল! থোড় বড়ি খাড়া জীবনে ক্লান্ত বন্ধ মনের তালা খুলে যায় যেন! গদগদ হয়ে আমি বললাম, “পড়ন্ত বিকেলে সূর্য ডুবে যাচ্ছে কালো রঙের পাহাড়ের সিল্যুয়েটের পেছনে। সোনা রং চিকচিক করছে। আকাশে সাদা সিগাল ঘুরছে, ওদের বুকে পেটে অস্ত সূর্যের আলো …”

আমার বরের গোল্লা চোখ দেখে কথায় ব্রেক মেরে বললাম, “ কী হল?”

ও থতমত খেয়ে বলল, “নাথিং, ক্যারি অন!” তারপর জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছে বলল, “তবে ওটা কালো পাহাড়ের সিল্যুয়েট না হয়ে, হবে সাদা।”

ও বেরিয়ে গেলে দশ হাতে কাজ সারতে লাগলাম। নতুন জায়গায় এখনো ভালো করে আলাপ হয়নি কারোর সঙ্গে। তবে কাল শনিবার, চ্যাটার্জিদাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন। আরও বাঙালিরা আসবেন, পরিচয় হবে। চ্যাটার্জিদারা প্রায় কুড়ি বছর আছেন এ দেশে, আমার বরের কলিগ। খুব নাকি জমাটি মানুষ।

“জেনিভার প্রাণ ভোমরা হল এই যে তোমার সামনে — ‘জেট দ এয়াঊ!’

অবাক হয়ে বলি, “এই ফোয়ারাটা?”

“ইয়েস ম্যাম,” বর বললে, “ওয়ার্ল্ডের মধ্যে টলেস্ট! এই ফোয়ারাটাই হল জেনিভার সিম্বল। পাঁচশ লিটার জল পার সেকেণ্ডে প্রায় একশ চল্লিশ মিটার উঁচুতে উঠছে। দুশ কিলোমিটার পার আওয়ার বেগে শূন্যে উঠে আছড়ে পড়ছে এই লেকের জলে।”

আমি দু চোখ ভরে দেখছি লেক জেনিভার ওই পাড়ে মঁ ব্ল্যঁ-র বরফ ঢাকা চূড়া। আর তার সাথিদার বরফ ঢাকা পাহাড়ের সারিদের। কি দৃপ্ত যূথবদ্ধ মৌনী তাপসের দল! লেকের জলে তখন অস্ত সূর্যের রং। সাদা ধবধবে রাজহাঁসগুলো রাজকীয় চালে তরতর করে সাঁতরে যাচ্ছে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জলে। মাঝে মাঝে সুগ্রীবা ডুবিয়ে দিচ্ছে জলে, আবার মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। সবচেয়ে ভালো লাগল লেকের ধারে ধারে মখমলের মতো সবুজ ঘাসের গালিচায় রং বেরঙের টিউলিপের সাজ । লাল, বেগুনী, কমলা, হলুদ, সাদা গোলাপি। কত সেলবোট, স্টিমার ! দুলছে জলের ঢেউয়ে, ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ হচ্ছে।

“ওই বড় সাদা জাহাজটা করে লেক ট্যুরে যাওয়া হয়। বিশাল বড় এই লেকটা, রণ নদী এর জলে এসে মিশেছে বলে মিষ্টি জলের লেক।”

লেকের দু’ধারে অজস্র ছোটখাটো দোকান। নামজাদা ডিজাইনারদের বড় বড় শোরুম সব একটু দূরে বড় রাস্তার উপর । রলেক্সের ঘড়ি, গুচি , লুই ভিন্ত , কি নেই!  শুক্রবারের সন্ধ্যে বলে লেকের ধার লোকে লোকারণ্য। সবাই যেন জীবনের মৌতাতটুকুর আমেজ নিতে এখানেই এসে জুটেছে ।

লেকের দু পাশে বাতিস্তম্ভগুলো জ্বলে উঠল । দোকানগুলোতে লাল নীল আলোর মালা, সেই আলোর ছায়াছবি লেকের কালো জলেও।

“এই লেকের তাজা মাছ  আর  ঠাণ্ডা বিয়ার খুব ফেমাস বুঝলে?” আমার বর বললে। “দেখি চলো টেস্ট করা যাক!”

দু জন ঢুকলাম একটা দোকানে। থরে থরে সাজানো স্মোকড, গ্রিলড, বেকড ফিস। ফিসফিসিয়ে বরকে বললাম, “হাজার রকম মাছ! কী নেবে?”

সে বোধহয় অফিসে চ্যাটারজীদার কাছে আগেই পাঠ পড়ে এসেছিল, গ্রাম্ভারি চালে বলল, “মেইনলি তো ট্রাউট, ক্রে, পারচ, এইসব। তবে ফেমাস হল ওয়াইট ফিশ, লোকালি নোন অ্যাজ ফেরা। চলো ওটাই খাওয়া যাক!”

“বনআপেতি!” বলে ওয়েটার এক প্লেট ভাজা মাছ রেখে গেল। সাথে অপূর্ব স্বাদের ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং দেওয়া সালাদ। খাওয়া শেষ হল যখন সন্ধ্যে উতরে গেছে। লেকের উপর রাতের আকাশটা ঝিকিমিকি তারার সলমাজরিতে কী অপরূপ!  জল থেকে উঠে আসছে আঁশটে গন্ধ। ভারি মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছে, কোত্থেকে ভেসে আসছে মৌরি ফুলের সুবাস, টিউলিপের রেণু থেকে হয়তো ! বুক ভরে সেই গন্ধ নিয়ে বরকে পণ্ডিতি ফলিয়ে বললাম, “ওই দ্যাখো ছায়াপথ! আর ওই যে সপ্তর্ষি মণ্ডল! আরে, ও দিকের আকাশে অতত বড় ওটা কী গো?”

সে মিটিমিটি হেসে বললে, “পণ্ডিতাইন! ওটা ধ্রুব! এই যেমন তুমি আমার!”

লেকের ধারে এক আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে দুজনে দুটো ম্যাঙ্গো আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি ফেরতা ট্রামে বসে মনে হল, এই তো জীবন!

রাতে ডিনারের ঝামেলা ছিল না। আমাদের বিল্ডিংএর পাশেই আইরিশ পাবের লোকজনদের হাসি গল্প গুঞ্জন কানে আসছিল। জালনাটা বন্ধ করে গল্পের বই নিয়ে সোজা বিছনায় গেলাম। কখন চোখ লেগে গেছে জানিনা।

ঘুম ভাঙল আমার বরের ডাকাডাকিতে। “মলি! কিভাবে শুয়েছ, চশমা টশমা পরে!” অনেক রাত অব্দি কাজ করা তার অভ্যেস। আমাকে ত্রিভঙ্গমুরারি রূপে শুয়ে থাকতে দেখে জাগিয়েছে।

দু’জনের কেউই গত রাতের বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা মুখে আনলাম না। বাজে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় এটা ওটা কথা নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম, “ঘরের ভিতর এতো গুমট, জালনা খুলতে পারি না, আবার ফ্যানটাকে কাছে নিয়ে শুলেও তোমার রাগ হয়!”

বর হেসে, উঠে গিয়ে ফ্যানটাকে কর্নারের কার্পেট থেকে সরিয়ে খাটের পাশে রেখে ফুলস্পীডে চালিয়ে দিয়ে বলল, “লুটে নাও, দু দিন বই তো নয়!”

“মানে?” অবাক হলাম।

“এসব দেশে সূর্য ওঠা, গরম লাগা, এসবই হল দু’দিনের বিলাসিতা! জুন জুলাই অগাস্ট… ব্যস! তারপরেই রবিমামা হামা টেনে এক্কেবারে…” বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল! আমি কথার খেই ধরে বললাম, “ কী?” সে গাঢ় গলায় বললে, “ভ্যানিশ!”

ফুলে ফুলে ঢাকা পাহাড়ি পথখানি কি মায়াবী! এঁকে বেঁকে এ পাহাড় ও পাহাড়ের বুক চিরে কোথায় গিয়ে মিশেছে! সরষে খেতের ফুলে ভরা সবুজ উপত্যকাগুলোতে বসন্ত বিলাপ! কোথাও বা চষা কালো কুচকুচে মাটি আলো করে ফুটেছে রাশি রাশি সূর্যমুখীর দল। আমার মন মৌটুসি পাখি হয়ে ফুলের এ রেণু ও রেণু করে বেড়াচ্ছে। আঙ্গুর খেতের পাশে লাল টুকটুক টালির সাদা কালো  কাঠের বাড়িগুলোকে কোন জাদুকর যেন পরম যত্নে হাতে করে উপত্যকার ইতিউতি বসিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের মোহন রূপের কি বাহার! জালনায় সাদা লেসের পরদা, কাঠের বারান্দা উপচে পড়ছে ঝোলানো ফুলের টবে। লাল কমলা হলুদ সাদা গোলাপি জারবেরা, গাঁদা, জিরেনিয়াম, হাল্কা বেগুনী অ্যাকাশিয়ার ঝাড় বারান্দা বেয়ে ঝুলছে। বার্চ, উইলো, পাইন, ফার, চেরির গাছপালা ঘিরে রেখেছে বাড়িগুলোর আঙ্গন। কে জানি তাদের ডালে বেঁধে রেখেছে ধাতুর উইনড চাইম! টিংলিং টিংলিং আওয়াজ উঠছে উপত্যকায়। সেই মধুর শব্দে এসে মিশেছে দুধেলা গাই গরুদের গলায় বাঁধা বড় বড় ঘণ্টার টংলং টংলং ধ্বনি। ম্যাহ্যা হ্যা হ্যা বলে ডেকে উঠছে পাহাড়ি ভেড়ার দল।

আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি আরও পথ। দেখি পাহাড়ি ঝরণার পাশে বসে ফ্লুটে লোকগীতির সুর তুলছে গাঁয়ের চারণ বালক। সারাটা পথ নুড়ি পাথরের সাথে খুনসুটি করতে করতে পাহাড়ি ঝোরাটা নিচে নেমে এসে শান্ত  জলাশয় হয়ে গেছে। বুকে ফুটিয়েছে গাঢ় লাল শালুক।

এমন সময় পাহাড়ি পথ বেয়ে রিনরিনে সুরে গাইতে গাইতে নেমে এল সাদা ফুলেল গাউন, বুকের কাছে লাল সবুজ কালো সুতোর এম্ব্রয়ডারি, মাথায় সাদা লেসের গোল টুপি পরা এক ঝাঁক গাঁয়ের মেয়ে। তাদের হাতে বেতের ঝুড়িতে লাল তাজা স্ট্রবেরি, নতুন আলু, কচি টমেটো। তাদের পেছন পেছন আসছে খাকি ঢোলা প্যাণ্ট লম্বা সাদা মোজা, বুট, মাথায় ফুলেল হ্যাট আর বুকের কাছে লেসের কাজ করা কোট পরা এক অচিন মানুষ। বিরাট লম্বা হাতীর শুঁড়ের মতো পাহাড়ি আল্পহর্ন বাজাতে বাজাতে। সব সুর মিলে মিশে সে জায়গাটা যেন এক অমরাবতী।

সে মধুর তানে হঠাৎএমন বিশ্রী তালভঙ্গ কেন? কোন দানব যেন এক নিমেষে তছনছ করে দিচ্ছে চারিপাশের এমন মধুরিমা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে। মনে হচ্ছে ওই নীলচে মায়াবী পাহাড়গুলো যেন ফেটে পড়ছে চূড়ান্ত কোন তাণ্ডবে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে দেখি আমার বর ঘরের মধ্যে ইতিউতি তাকাচ্ছে। তক্ষুনি আবার সেই হাড় হিম করা গুমগুম গুম গুম শব্দে আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেঁপে উঠল। বুঝলাম দুঃস্বপ্ন ছেড়ে যায়নি আমাদের, সে আছে, ভীষণ ভাবে আছে!

কেঁদে ফেললাম। ও তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, “এ কী ছেলেমানুষি হচ্ছে মলি? একটু ভাবতে দাও আমাকে কেন এমন হচ্ছে! চোখ থেকে এত ইজিলি জল পড়ে তোমার?”

ফুঁপিয়ে বললাম, “ইজিলি? আই জাস্ট ক্যাণ্ট টেক ইট এনি মোর! এই নাকি আমার ড্রিমল্যাণ্ড সুইৎজারল্যাণ্ড? রোজ রাতে সুইস ভূতের গুঁতো? প্লীজ ডু সামথিং রোহিত!”

কেন যে অত কাঁদছিলাম জানি না। সে কি ভয়ে, না অমন মিঠে স্বপ্ন আচমকা চুরমার হয়ে যাওয়াতে আমি সত্যি জানি না।

এমনও তো নয় যে আমরা জঙ্গলের মাঝে আছি! ওই তো এত রাতেও পাব থেকে ভেসে আসছে হৈহুল্লোড়ের আওয়াজ! রাস্তা দিয়ে একটা মোটরবাইক চলে গেল ! দু’একটা বাড়িতে এখনও  আলো জ্বলছে! তবে আমাদের ঘরেই কেন এমন বিভীষিকা ! কী দোষ করেছি আমরা?”

গুমগুম গুম গুম গুম… মনে হল মেঝে ফুঁড়ে এক্ষুনি রক্তমাখা নখ দাঁত নিয়ে উঠে আসবে এক দানব আর চোখের নিমেষে গ্রাস করে নেবে আমার সাজান ছোট্ট সংসার। কান্না আরও উথলে উঠল আমার। রোহিত, আমার বর, এবার জোর গলায় বলল, “মলি, আই প্রমিস, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব! নাও হোলড ইয়োরসেলফ! কাল চ্যাটার্জিদার বাড়িতে সবাই থাকবো , কথাটা তুলব। ওরা অনেক বছরের বাসিন্দা, দে উইল নো!”

“আরে! শালার শহরটাই এমন বদখত হয়ে উঠছে যে এমন ঘটনার কথা শুনে আমি মোটেই আশ্চর্য হচ্ছি না মশায়!” বলে বিয়ারের গ্লাস খানা চোঁক চোঁক করে শেষ করে দিলেন চ্যাটার্জিদাদের বাড়িতে জমায়েত হওয়া বঙ্গকুলের এক বাঙালি। “এ বচ্ছর জেনিভা ক্যাণ্টনের ফেডেরাল আইনে কী প্রস্তাব যাচ্ছে শুনেছেন তো? শহরে ভিখারির সংখ্যা বাড়ছে বলে শালারা ঠিক করেছে ভিখারিদের ভিক্ষার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের উপর ট্যাক্স বসাবে! এমন  বিদঘুটে খবর শুনেছেন আর কোথাও?”

গলা ছেড়ে হো হো হেসে চ্যাটার্জিদা বললেন, “সত্যি মলি! আই মীন, এটা যে তোমার ওই সুইস ভুত ফুতের কাজ না এ ব্যাপারে তুমি সেণ্ট পারসেণ্ট নিশ্চিন্ত থাকতে পার। এ শালারা হল টাকার পিশাচ। টাকা ছাড়া জীবনে কিচ্ছুটি বোঝে না! তুমিই বলো, তোমার বাড়ির ছাত দেওয়াল ফুঁড়ে সে ভুতের পুত পাবেটা কি? ব্যাপারটা থিওরিটিক্যালি ভাবতে হবে তো?”

আমার বর গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু ব্যাপারটা তো ঘটছে চ্যাটারজীদা! পুলিশে ইনফর্ম করব কি?”

কাবেরী বউদি তক্ষুনি বললেন, “দাঁড়াও রোহিত! জেনিভা আর সেই বছর কুড়ি আগের জেনিভা নেই। ইস্ট ইউরোপের দরজা খুলে যাওয়াতে হাজার রকম লোকের ভিড়ে গিজগিজ। ক্রাইমও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। পুলিশ কি বুঝতে কী বুঝবে, মাঝরাত্তিরে তুমিই হাঙ্গামা করছ ভেবে হেভি ফাইন করবে!”

“কাবেরী বউদি ইজ রাইট!” রত্নাদি নামে এক মহিলা চিকেন নাগেটস খেতে খেতে বললেন। “আমার এক কলিগ অফিস ছুটির পরে সন্ধ্যে বেলায় গাড়ি করে ফিরছে, এই তো দু দিন আগের ঘটনা, হঠাৎ সামনের এক ট্র্যাফিক সিগনালে এসে দেখল ওর সামনের গাড়িটার কিছু একটা প্রব্লেম হয়েছে। নিজের গাড়িটা কর্নারে পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে দেখে, ব্যাপার গুরুতর, ব্রেকের গণ্ডগোল! অগত্যা পুলিশ ডাকতে হল। সে এসে কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে খালি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে দেখে কলিগ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ব্যাপার কী ! কি দেখছ তখন থেকে!’ পুলিশ ব্যাটা হেসে বললে, ‘হে উপকারী বন্ধু, পরোপকার করার ঠ্যালায় নিজের গাড়িখানা বিলকুল ভুল জায়গায় পার্ক করেছ, তাই দেখছিলাম। তোমাকে ধন্যবাদের সাথে সাথে এটাও দিলাম,’ বলে মোটা অঙ্কের একটা চালান ধরিয়ে দিল ! জেমস বণ্ডের ব্যাটারা টাকা কামাবার একটা ভুলও ভুলেও মাফ করে না।”

কাবেরী বউদি হেসে বললেন, “জেমস বণ্ড! বেড়ে বলেছ কিন্তু!” তারপর হৈ হৈ করে আমার দিকে স্নাক্সের প্লেট এগিয়ে ধরে বললেন, “জানো মলি, ওই সমুদ্র নীল শার্ট আর কালো ট্রাউজারে অসম্ভব স্মার্ট আর সুপুরুষ সুইস পুলিশের প্রেমে পড়েনি এমন মহিলা তুমি খুঁজে পাবে না ! তবে  ওরা হল অনেকটা ওই বিছুটি পাতার মতো। ছুঁলেই  আঠেরো ঘা! এদের সিস্টেম এমন কড়া যে আইন ফাঁকি দিয়ে তুমি পাতালেও পালাতে পারবে না! এদের দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যে আই কার্ডটি ধরায়, সেই কার্ডের ঝুঁটি ধরে এরা তোমাকে খুঁজে বার করবেই!”

মনমরা হয়ে পনির পাকোড়া মুখে পুরে ভাবলাম, “আহা ! ওই সুপুরুষ জেমস বণ্ডের দল কি পারে না আমাদের সমস্যাটা মেটাতে?”

আমাকে অন্যমনস্ক দেখে আমার বরের বন্ধু রুদ্রদা বললেন, “মলি মনে হচ্ছে জেমস বণ্ডদের উপর বেজায় ইম্প্রেসড!”

“এ মা! না! না!” আমাকে লজ্জা পেতে দেখে ঘরের সবাই হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল।

গল্প হাসি ঠাট্টায় কখন যেন মনের মেঘ কেটে গেল। কতরকম রান্না করেছিলেন বউদি! খুব ভালো সময় কাটিয়ে দিলাম। আমার মুখে হাসি ফুটেছে দেখে চ্যাটার্জিদা বললেন, “দ্যাটস বেটার! আমরা তো আছি! দ্যাখো হয়তো কোন রেসিস্ট ব্যাটার কাজ! পাত্তা দিও না! আপসে থেমে যাবে!”

বউদি বললেন, “আমরা বরং নেক্সট স্যাটারডে তিতলিস পাহাড় ঘুরে আসি চলো, মলি! তোমার খুব ভালো লাগবে। রাস্তায় একটা গ্রাম পড়বে এঙ্গেলবেয়ারগ, পথের ছোট ছোট চটিতে গ্রামের মেয়ে বৌ-রা ঘরের তৈরি কমলালেবু ফুলের রেণুর মধু, জ্যাম, খাঁটি হোমমেড মাখন, আভেন ফ্রেশ ক্রসোঁ বিক্রি করে!”

“ ব্যস ব্যস! মলিকে নাচানোর জন্য এটুকুই এনাফ বউদি,” আমার বর ঠাট্টা করে বলল। রুদ্রদা আমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।

বাড়ি ফেরার পথে জোর বৃষ্টি নামল দেখে আমি আর বর চোখ তাকাতাকি করে হাসলাম। তবে কি রবিমামার দিন ফুরাল?

নাইট ড্রেস পরতে পরতে ওকে বললাম, “খুব খারাপ লাগে এমন নিষ্পাপ রূপের একটা দেশে চোর ছ্যাঁচোরের কথা শুনতে!”

ও হেসে বলল, “শুধু কি চোর ছ্যাঁচোর? শুনলে না, রেসিস্ট, সেয়ানা পাগল সবই আছে! আসলে জেনিভাটা ফ্রান্স আর ইটালির বর্ডার ঘেঁষে এমন ভাবে আছে, যে এখানে ক্রাইমটি করে টুক করে ওই দুটো দেশে সেঁধিয়ে গেলে আর ধরবে কে? জেমস বণ্ডের বাপেও পারবে না! নাও, রাত হয়েছে, শুয়ে পড়।”

ওকে কর্নার থেকে ফ্যানটা আনতে দেখে বললাম, “আজ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ আছে, ফ্যান থাক!”

আমার বর আমার কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে বলল, “গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়!”

— এ পথে আমি যে গেছি বারবার ভুলিনি তো একদিনও

আজ ঘুচিল কি চিহ্ন তাহার, উঠিল বনের তৃণ।

ঘুম ভাঙল যখন, তখন সারা ঘরে আহ্লাদী সোনালি রোদ্দুরের লুটোপুটি। বেড-টি হাতে আমার বরের মুখে অমলিন হাসি। ভারি আশ্চর্য হয়ে উঠে বসলাম। যেন এমন একটা সকাল আমার জন্য হতেই পারে না!

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ও হেসে বলল,  “নাথিং হ্যাপেণ্ড!” শুনে আমার খুশি হওয়া উচিত কিনা ভাবতে ভাবতে  অন্যমনস্ক ভাবে মুখ ধুতে গেলাম।

দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি, ও নিউজ পেপার দেখতে দেখতে বলল, “কোনো পাগল রেসিস্টের কাণ্ডই হবে!”

ঠিক তক্ষুনি দরজায় বেল বাজল। রবিবারের সকালে না বলে কয়ে কে আসতে পারে ভাবছি। ও বলল, “আমি দেখছি।”

“ইয়েস, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?” রোহিতের প্রশ্নের উত্তরে রিনরিনে কণ্ঠের জবাব এল, “বোঁজু! আমি আন্দ্রেয়া, তোমাদের নেবার!”

আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দেখি ছোট্টখাটো চেহারার এক মিষ্টি মুখের মেয়ে। বয়েস আন্দাজ এই বছর কুড়ি হবে। চোখে সংশয় নিয়ে হাসি মুখে বলল, “আমি নাইট ক্লাবে কাজ করি। রোজ বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়, তাই  তিন চার দিন ধরে ব্যাপারটা বলব বলছি করে বলা হয়নি। কয়েক রাত্তির ধরে ভারি বিশ্রী একটা আওয়াজে আমার ঘুমের খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। আমার ধারণা আওয়াজটা তোমাদের ফ্ল্যাট থেকে আসছে। বুঝতেই পারছ, অনেক রাত অব্দি ডিউটি করে তারপর যদি একটু ঘুমতে না পারি… তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি তোমাদের ফ্ল্যাটটা একটু জরিপ করতে পারি? আমার মনে হয় তোমরা এমন কোন মেশিন চালাও, যার জন্য অত আওয়াজ হয়!”

“আমাদের ফ্ল্যাট থেকে আওয়াজ! আচ্ছা! কী রকম শুনি?” আমার বর বললে।

আমি বরকে টপকে গলা বাড়িয়ে বললাম, “বোঁজু , হ্যাঁ, আওয়াজটা কী রকম বলো তো শুনি?”

সে বললে,  “গরগর গ্ররর গ্ররর।”

আমি বললাম, “না, তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। আওয়াজটা হবে গুমগুমগুম।”

আন্দ্রেয়া মাথা নেড়ে  জোর গলায় বললে, “না না, গরগর গরগর…”

আমি — “না না, গুমগুম…”

“দ্যাটস এনাফ!” রোহিতের দাবড়ানিতে আমরা এই বিচিত্র ডাকাডাকি বন্ধ করলাম। আমার বর দরজা থেকে সরে বললে, “তুমি ভেতরে এসো , কি দেখতে চাও দ্যাখো।” আন্দ্রেয়া এ ঘর সে ঘর ঘুরে আমাদের বেডরুমে এলো। আড়ে আড়ে দেখল আমাদের পুরনো সেকেণ্ড হ্যাণ্ড স্ট্যাণ্ড ফ্যানটাকে। তারপর বিদায় নিলো। অবিশ্যি কফি খাবার নেমন্তন্ন করতে ভুলল না। তারপর সিঁড়ির বাঁকে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, “সামথিং অড ইন ইয়োর বেডরুম!”

আমি বললাম, “আচ্ছা পাকা মেয়ে তো!”

দেখলাম রোহিতের ভুরু কুঁচকে গেছে, কি যেন ভাবছে ও! আমি চা বানাতে বানাতে ভাবলাম, যাক বাবা আমরা একা নই, আন্দ্রেয়াও শুনেছে! কিন্তু গরগর না করে মেয়েটা যদি গুমগুম করত নিশ্চিন্ত হওয়া যেত!”

রাত্তিরে শুতে এসে আমার বর বলল, “শোন মলি, আমার মাথায় একটা ক্লূ এসেছে, আজ রাত্তিরে যত গরমই লাগুক, কর্নার কার্পেট থেকে ফ্যান সরান চলবে না।”

ভয়ে ভয়ে বললাম, “কেন গো?”

ও রহস্য করে বলল, “বিকজ আই ওয়াণ্ট  টু সি দ্যা কন্সিকয়েন্স!”

এ আবার কি! চাপা উদ্বেগ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। দু দিন ধরে রাতের দিকে বৃষ্টি হচ্ছে বলে তেমন গরম নেই। এই বুঝি শুরু হয় সেই দানবীয় আওয়াজ, ভেবে ভেবে কখন যে ঘুমিয়েছি আর কখন ভোর হয়েছে কিছুই জানি না।

আমাকে অবাক করে গোটা সপ্তাহ আওয়াজটা আর হলই না ! আমার সংসার কি সত্যি রাহুমুক্ত হল? ওকে জিজ্ঞেস করে কোন ফল হয়নি। খালি বলেছে, “ক্রমশঃ প্রকাশ্য।’’

কাবেরী বউদিরা অবিশ্যি শুনে খুব খুশি। তারা ধরেই নিয়েছে এ কোন সেয়ানা পাগলের কাজ।

দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল। ভোর ভোর তৈরী হয়ে নিচে ল্যাণ্ডিং-এ অপেক্ষা করছি চ্যাটার্জিদাদের জন্য। দেখি দরজা খুলে আন্দ্রেয়া ঢুক। তাকে দেখে আমার বর বেজায় উৎফুল্ল হয়ে বললে, “বোঁজু আন্দ্রেয়া! তোমার সঙ্গে দেখা না হলে কালই তোমার ফ্ল্যাটে যেতাম!”

আন্দ্রেয়া বললে, “এনিথিং পারটিকুলার?”

আমার বর দরাজ গলায় বললে, “এনি মোর গরগর?”

সে মুচকি হেসে পালটা বলল, “হাউ অ্যাবাউট গুম গুম?”

রোহিত তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, “নো মোর গুম গুম!”

আন্দ্রেয়া চোখ মটকে বললে, “বিকজ গরগর গরগর আর ভ্যানিশড টু !” তারপর তারা দুজনেই হেসে উঠল।

এই কিম্ভুত সংলাপে আমার মাথা ঘুরে গেল। আমাকে ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আন্দ্রেয়া বলল, “তোমার গরগর আমাকে  গুমগুম করতে বাধ্য করেছে ডিয়ার!”

“মানে?” আমি তো শুনে হাঁ।

আমার বর কাছে এসে বললে, “মলি, আন্দ্রেয়া সেদিন আমাদের শোবার ঘরে অড ওয়ানকে খুঁজতে বললে আমি অনেক ভেবে দেখলাম, খাট, ড্রেসিং টেবিল,ওয়াল আলমারি ছাড়া আর কী ‘অড ওয়ান’ আছে ও ঘরে? তক্ষুনি চোখে পড়ল আমাদের বুড়ো  ফ্যানটা। ফ্যানটা চল্লে কেমন একটা রিরিরিরি শব্দ হয় বোলেই  ওটাকে আমরা  কার্পেটের উপর বসিয়ে রাখি, রাইট?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, ফ্যানটা থেকে মাঝে মধ্যে একটা ট-ররর ট-রররর শব্দ হয় বটে! ইদানীং  গরম বাড়তে জালনা খুলতে পারি না বলে ফ্যানটাকে খাটের পাশে এনে রাখছি !”

হাতে তুরি বাজিয়ে বর বলল, “ওই খানেই গোড়ায়  গলদ। কাঠের মেঝেতে ফ্যানের আওয়াজ নিচে কতদূর ছড়ায় তার কোন আন্দাজ আমাদের নেই! আমাদের  কানে নিরীহ  টরররর শব্দটুকু  রাত্তিরে আন্দ্রেয়ার ফ্ল্যাটে বিচ্ছিরি রকমে ছড়িয়ে যায়।, রাইট?”

আন্দ্রেয়া হেসে বলল, “রাইট! আর তাই সুইস  ট্রাডিশান অনুযায়ী আমি আমার মেটালের ঝুল ঝাড়ুর ডাণ্ডা দিয়ে ছাতে গুঁতচ্ছিলাম। সুইসরা প্রতিবেশীদের শব্দদূষণের প্রতিবাদ এই ভাবে সিলিং গুঁতিয়েই এত্তেলা দেয়। তাতে কাজ না হলে তখন পুলিশে খবর দেয়!”

আমার ছানাবড়া চোখ দেখে আন্দ্রেয়ার বুঝি মায়া হল। সে আমার কাঁধে হাত রেখে বললে, “ওয়েলকাম টু সুইটযারলাণ্ড ডিয়ার! ডোন্ট ওয়ারি সুইটহার্ট! ফ্রম নাউ অন নো মোর গরগরে এণ্ড নো মোর গুম গুম।”

রোহিত হো হো হেসে বললে, “অল কোয়ায়েট অন ওয়েস্টেণ ফ্রণ্ট?”

রোহিতের কথায় আরও একবার ঝরনার মতো কুল কুলিয়ে হেসে ওঠে সুইস সুন্দরী। তবে আমি কিন্তু ঐ ঝরনার জলে লুকনো নুড়ি পাথরের ভয়ে সে হাসিতে যোগ দিতে না পেরে, যে বোকা সে বোকার মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম ।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: