চশমা বদল

গ্র্যাজুয়েশন পাশ করার সাথে সাথে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করল। পাত্রপক্ষের সবারই দেখি যত রাগ আমার চশমার উপরে। বলে — “ও বাবা! এত্ত ভারী চশমা! ছেলেমেয়েগুলো তো চোখ থাকতেও ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী হবে!” তারপর বাবার আনা মৌচাকের বিখ্যাত কালোজাম খানায় কামড় বসিয়ে বলে — “না— না, কমলবাবু এ আপনার ভারী ভুল হয়েছে, আপনার কন্যা যে চোখে ছোটখাটো একজোড়া ডাম্বেল পরে আছে, তা তো আপনি বলেননি! শুধু শুধু সেই ভবানীপুর থেকে দৌড়ে আসা!” মহাবিরক্তি সহকারে এবার বাঞ্ছারামের শিঙাড়ায় আক্রমণ।

মটকা গরম হয়ে যায় কথা শুনলে! আজ বাবাকে আমি ২৪০ বাসের জালনা থেকেই দেখেছি। বেস্পতিবার করে ইউনিভার্সিটি  থেকে আমার দুপুরের দিকে  ছুটি হয়ে যায়, ওইদিন টিউশানিও থাকে না, অতএব কতক্ষণে বাড়ি ফিরে গরমাগরম ডিমের ঝোল ভাত খেয়ে মজাসে শুয়ে শুয়ে “১০০ বছরের গোয়েন্দা কাহিনী”-র রহস্যে রোমাঞ্চিত হবো তার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকি।

বাসটা সবে গোলপার্কের ট্রাফিকে স্বামী বিবেকানন্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, ওমা! দেখি এই দুপুর গরমে এক মাথা ঘাম নিয়ে বাবা মৌচাক থেকে হাঁড়ি হাতে বেরিয়ে আবার বাঞ্ছারামে ঢুকে গেল। তখনই আন্দাজ করেছি আজ কেস জণ্ডিস না হয়ে যায় না। বাড়িতে হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি আসা মানেই চিঁটে গুড়ে পিঁপড়ের পালের মতো পাত্রপক্ষ আসা! তার সাথে মা’র গলার ভীমপলশ্রী — “ওরে, মুখটা একটু সাবান ঘষে ধো না! সারাদিন রোদে ঘুরে কি ছিরি হয়েছে মা গো! এই কাপড়টা পরলি কেন! জামরঙা হলদে পাড়টা পর। সেই একঘেয়ে টিকটিকির ন্যাজ ঝুলিয়ে মেয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একটা এলো খোঁপায় কত ঢলঢলে লাগে মুখখানা…” ইত্যাদি এবং প্রভৃতি।

আমি যতক্ষণে বাড়ি পৌঁছেছি বাবা তার অনেক আগেই পৌঁছেছে এবং যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হওয়ার মতো, খিড়কি দিয়ে ঢুকতেই কিছু অজানা অচেনা গলার ‘আরে দূর মশাই’, ‘তাই তো’, ‘সে আর বলতে’ কানে আসাতে বুঝলাম “তাঁরা” আসিয়াছেন।

কাঁধের ব্যাগ বিছানায় রাখতে না রাখতেই মা এসে হাজির।

“হ্যাঁ রে, আজ এত দেরি হল যে?” বুঝলাম আমার মেজাজ পরখ করার জন্য অবান্তর প্রশ্ন করছে। আমাকে চুপ দেখে মা নরম গলায় বললে, “দ্যাখো বাপু, সোজাসুজি বলি, এমন পাত্র হাতছাড়া করা আর গাছের যে ডালে বসেছ সেই ডালেই কোপ মারা একই ব্যাপার। এখন বাইরে থেকে এসেছ, মুখে চোখে জল দিয়ে একটু হাল্কা কিছু সেজে এ ঘরে এসো।”

আমি রাগ চেপে বললাম, “মা, এটা কি হরি ঘোষের গোয়াল, যে যার যখন খুশি ঢুকে আসবে? ভর দুপুরে পাত্রী দ্যাখা? ইয়ার্কি হচ্ছে?”

“ও কী কথা টুনি?” মা’র মুখ দেখে মনে হল এমন অভদ্র ভাষা মা জীবনে শোনেনি! “ওনারা বিকেলেই আসতে চেয়েছিলেন, বৌবাজারে আত্মীয় বাড়িতে গিয়ে দেখেন তাঁরা সব বেরিয়েছেন, তাই…ই…”

“তাই তাঁরা ভাবলেন বউবাজারের আত্মীয় না থাক গোলপার্কের হরি ঘোষ তো আছেন, তাঁর গোয়ালে ঢুকে গেলেই হল!”

“আঃ, চুপ কর! একেই ভদ্রলোক তোর বাবারা বরিশালের লোক শুনে গাঁইগুই করছিল, এর উপর তোর এই বাক্যি শুনলে তো দুয়ে দুয়ে চার করেই ফেলবে!”

শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিসের দুয়ে দুয়ে?”

মা ঠোঁট উলটে বলল, “কে জানে! কি নাকি কহাবত আছে ওনার ভায়রাভাই বললেন — ‘আইতে শাল যাইতে শাল / তার নাম বরিশাল / ছুঁচ হয়ে ঢোকে তারা / হয় যে পরে ফাল।”

আজব তো? বাড়ি বয়ে এসে ভর দুপুরে আমার শখের ডিম ভাত আর গোয়েন্দা কাহিনীর ভিটে মাটি চাঁটি করে, যা নয় তাই বলে অপমান করে যাবে?

“আমি কিছু সাজতে গুঁজতে পারব না, আই মীন আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাব না, আণ্ডারস্ট্যাণ্ড?” মা’কে তড়পে বললাম। মা-ও কামান দেগে বলল, “দশ মিনিটে ভদ্র সভ্য হয়ে বৈঠকখানায় এসো।”

রোখ চেপে গেলে যা হয়, যেমন ঘামে ধুলায় পঞ্চভূতের তত্ত্ব মেখেছিলাম সেই ভাবেই ভিতরে গেলাম।

আমাকে দেখেই বার্নপুর এণ্ড কোং-এর বোলতি বন্ধ হয়ে গেল। বেচারা বাবার এত কষ্ট করে রোদ্দুরে বেরিয়ে বাছাই করা মিষ্টির দোকানের মিষ্টিও ওনাদের মূডের ভাঙ্গা হাট জোড়া লাগাতে পারল না। অতএব আবার কানে বাজিল মোহন বীণা —   “ও বাবা! এত পাওয়ারের চশমা পরে? এ তো সাঙ্ঘাতিক মশাই…”

বাবা চোরের দায়ে ধরা পড়া সুরে বলল, “মিত্তির মশাই, আমি বলি কি, ও সব চশমা টশমা পরে হবে, আপনি আগে এই মিষ্টিটা একটু টেস্ট করে দেখেন, এ হল আমাদের পাড়ার স্পেশাল ‘মনহরা’। আহা! যেমন নাম তেমন কাম, মন হরণ —  আহা!”

মিত্তির মশাই হাত গুটিয়ে ব্যাজার মুখে বললেন, “না মশাই, ও সব মনহরা-ফরা থাক, আমার ডাইবেটিস!”

বাবার করুণ মুখখানা দেখে আমার বরিশালি রক্ত গেল গরম হয়ে। আমি কদম কদম বাড়ায়ে যা স্টাইলে মিত্তির মশাইয়ের সামনে গিয়ে প্লেট উঁচিয়ে বললাম, “খান একটা মনহরা! বাবা এই রোদ্দুরে বেরিয়ে আপনাদের জন্য কিনে এনেছেন, খেতে তো হবেই!”

এমন বিদ্রোহিণীর মতো কেউ কোনওদিন কাউকে মিষ্টিমুখ করিয়েছে কি না আমার জানা নেই। মিত্তির মশাই কাঁপা গলায় বললেন, “আ… আমার তো ভাই ডাই…”

“…বেটিস তো?” আমি কঠোর কণ্ঠে বললাম। “একটা খেলে কী আর এমন হবে? এই তো শুনছিলাম আপনারা এই নিয়ে বারো খানা মেয়ে দেখেছেন! আরও বারো দেখতে হবে তো! আরে বাবা, শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে তো?”

মুখ চুন করে মিত্তির মশাই মনহরা হাতে ভায়রা ভাইয়ের দিকে তাকালে তিনি আমাকে বললেন, “মনহরা খেলেই কি আর ডাইবেটিস ভাল হয়?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আজ্ঞে না, তা হয় না ঠিকই তবে মৌচাকের মৌচাকগুলো আপনাদের সদব্যবহার পেল, আর পাড়ার তৈরি বলে মনহরা আপনাদের মন পেল না, এটা কেমন ধাঁধা?”

বলাই বাহুল্য মিত্তিরমশাইরা এরপর বার্নপুরের ট্রেন ধরার জন্য আর দেরি করলেন না। কিন্তু সংসারে তো এক মিত্তিরে সমস্যা মেটে না, ঘোষ বোস দত্তরা যাবেন কোথায়? তাঁদের বাড়ির আদুরে বলদদের জুততে হরি ঘোষের গোয়াল ঘরের তত্ত্ব তালাশ না করলে চলে?

অতিষ্ঠ হয়ে একদিন আমি ঘোষণা করলাম, দিল্লী যাব। ভাই টিপ্পনী কেটে বলল, “বাঃ! বেশ তো, যমুনার ধারের জমিগুলো এমনিতেই বড্ড ফারটাইল, বুঝলি ছোড়দি, তুই ওখানে আলু মুলো যাই ফলাবি দিব্যি ফলবে। মোদীর স্বচ্ছ ভারতের জলজ্যান্ত  একখানা প্রজেক্ট ওখানে গিয়ে বানিয়ে ফেল তো দেখি!”

“ভাট বকিস না,” ভাইকে দাবড়ানি দিয়ে থামাই।

আমার জেদের ফল হল এই, দিল্লী পৌঁছে দেখলাম যার নাম চালভাজা তার নাম মুড়ি! অর্থাৎ অবস্থার কিছু মাত্র হেরফের হল না। বাবার বদলে মামাতো দিদি এখন ‘পাত্র চাই’ দেখতে বসে গেল। তফাত এই, বাবার ছিল বং স্পেশাল বিজ্ঞাপন আর দিদি শুরু করল আন্তর্জাতিক লেভেলে খেলা।

শুরু হল এক অভূতপূর্ব জীবনযাপন। দিনের বেলায় এক পত্রিকা আপিসে কাজ করি, আর রাত ঘন হলে দিদির সাথে বসি শাদির টাট্টু পছন্দ করতে। মন্দ টাইম পাস নয়!

কী আর দেখার থাকে, রোজ রোজ সেই একই সুন্দরী বরতনু হাই-টেক পাত্রীদের জন্য ছপ্পড় ফাড়কে বিজ্ঞাপন। পাত্রপক্ষদের ভাবটা এমন যে, দেখো বাবা, কেমন সব লাল কানকোওলা রুপোলী আঁশের তরতাজা রাঘব বোয়ালরা ছাড়া আছে বাজারে, সওদা করতে চাও তো যার যেমন ট্যাঁকের জোড়, নিয়ে এসো!

ওই সব কেষ্টবিষ্টুদের চোখ যে আমার আতশকাঁচের মতো চশমা ভেদ করে আমার বনলতা সেনের মতো, পাখির নীড়ের মতো চোখে পড়ে চারচক্ষুর নয়ছয় করে একটা বিষম কাণ্ড ঘটাবে না, সে বিষয়ে যখন আমার আর কোনও সন্দেহই ছিল না, তখনই একটা কাণ্ড ঘটল।

রোজকার মতো পাত্র চাই হাঁকড়াতে হাঁকড়াতে দিদি কফি কাপে চুমুক মারছে আর আমি ছাইয়ের গাদায় আড়ে আড়ে দেখছি আমার ওজন দরের কিছু পাই কি না, হঠাৎ দিদি পেল্লায় চেঁচিয়ে বললে, “অ্যাদদিনে ব্যাটাচ্ছেলেকে পেয়েছি। অ্যাই টুনি, এদিকে আয়! দ্যাখ, শোন কী লিখেছে! আহা! পড়লেও চোখের পাওয়ার কমে যায় রে!”

আমি কটমট করে তাকাতে সে জিভ কেটে বললে, “সরি।” তারপর আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেখালে কী? না, একখানা বিজ্ঞাপন!

ব্যাজার মুখে বললাম, “আবার? ও আমি অনেক দেখেছি।”

দিদি পাত্তা না দিয়ে বলল, “ব্যাটার বয়ানে দম আছে, বাংলা করলে যা হয় তা হল — জীবনের চড়াই উতরাই পথ একসাথে চলার জন্য ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে এফিশিয়েণ্ট হাইকার সাথি চাই।”

পড়ে লাগল তাক! “হুম, বেশ অন্যরকম!” গম্ভীর চালে বললাম। দিদি চোখ নাচিয়ে বলল, “অতঃ কিম?”

দিলাম দরখাস্ত ঠেসে। উত্তর আসবে ভাবিনি। কিন্তু এল, এবং দেখা করতে চাইল। আনমনে আমার মনে হল, নাহ, চশমাটা সত্যি বড্ড ভারী।

সেদিনটা ছিল শনিবার। কাজের বালাই নেই, দুপুর গড়িয়ে গেলে সেজেগুজে নিলাম। কলকাতার বাড়ি তো দূর, দিল্লীতে দিদিদের যত আত্মীয়গুষ্ঠি আছে কাউকেই জানানো হয়নি কিছু। এমনকি দিদির যে মাসি হুট বলতে হুট যখন তখন এসে পড়ে তাকে নিয়ে আমাদের ভারি ভয় হচ্ছিল। আসলে দিদির চিন্তা আবার অন্য। ষড়যন্ত্রের গলায় বলল, “পরের সোনা নিও না কানে —  কহাবত শুনেছিস তো? তোর এখানে উল্টো পাল্টা কিছু হলে পিসি কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে?” তারপর ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে, “সসসস… নো ওয়ান হ্যাস টু নো দিস!”

পাঁচটার সময় আসবে বলেছিল আমাদের মিস্টার পারফেক্ট। আমি যখন শেষবারের মতো চোখে কাজল চড়াচ্ছি, তখনই দিদির বিচ্ছু যমজ ছোঁড়া দুটো আমাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হেসে গেছে। এখন দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ হলে আমি পড়িমরি করে ছুটে দরজা খুলে দেখি দিদির সেই বি বি সি নিউস মাসি! মুখটা পুরো চোপসান বেলুন হয়ে গেল। পেছনে বাঁদর দুটোর সে কী হাসি! দিদির মাসি বলল, “টুটুল আছে?” মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল,  ‘কাল আনা, কাল আনা’, বদলে বললাম, “অন্দর আনা!”

ঠিক পাঁচটায় আবার বেল। দিদির মুখে গর্বের হাসি। দরজা খুলে দেখি অস্তসূর্যের লালিমা মেখে এক সিল্যুএট।

তারপর পায়ে পায়ে ড্রয়িংরুম, ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধি চা, গরমাগরম শিঙাড়ার খুশবু, আর নানা কথামালার ফাঁকে ছোট্ট একটা অনুরোধ — “এক গ্লাস জল খাওয়াবেন?”

দিদির বাঁদর দুটো কানের কাছে খুক খুক হেসে বলল, “টুনি মাসি, নীড এনি হেল্প?”

বিচ্ছু দুটোকে এড়িয়ে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং টেবিলের কাছে। ওই তো জলের বোতল! কাঁচের গ্লাসে সবে জল ঢেলেছি, হাত ফসকে ছিপিটা গেল পড়ে! উবু হয়ে আমি যখন টেবিলের তলা, চেয়ারের পায়া হাতড়ে হাতড়ে হয়রান, “আপনি কি এটা খুঁজছেন?” বলে মিস্টার পারফেক্ট ছিপিটা আমার নাকের ডগায় ধরল! তারপর এলো গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো কমেণ্ট, “এটা তো সামনেই পড়েছিল!”

আমি তো আর পাতালকন্যা জনকনন্দিনী সীতা নই, যে মোক্ষম গুঁতোটি খেলুম আর পাতালে সেঁধিয়ে মান বাঁচালুম, অতএব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। দিদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আগেই ঘরে বোম ফাটাল। কে আর? ওই বিচ্ছু দুটো! এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল, “মাসি দেখবে কি করে? ও তো আজ চশমাই পরেনি!”

হাতে বিসলারির ঢাকনা নিয়ে আমি যখন ভাবছি দিল্লিতে ভূমিকম্প-টম্প অনেকদিন হয়নি, এখন হলে মন্দ কি? তখনই মিস্টার পারফেক্ট চেঁচিয়ে উঠল, “ওয়াট? আপনার চশমা আছে?”

হয়ে গেল! এখানেও সেই চশমা ব্যাটাই চোর! কাছে দাঁড়ানো দিদির মুখটা ঝাপসা হলেও বড্ড করুণ দেখাল। কিছুক্ষণ আগের আনন্দঘন ঘরটা কেমন যেন গোমড়া হয়ে ওঠাতে বাচ্চাছেলে দুটোও হাসি থামিয়ে দিল। দিদির মাসির হাতটা অমন মুখের কাছে স্ট্যাণ্ডস্টিল কেন? ভদ্রমহিলা বোধহয় শিঙাড়া মুখে পুরতে যাচ্ছিলেন তখনি সুনামি এলো ঘরে!

“ইয়ে, মানে আজ চশমাটা…” কী যে বলি!

গমগমে গলায় মিস্টার পারফেক্ট বলে উঠল, “আরে, কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ে, মানে করছেন! যান, তাড়াতাড়ি চশমাটা পরে  আসুন! আপনি তো তার মানে এতক্ষণ কিছুই দেখেননি আমাকে!”

কী বলল লোকটা? আমি কিছুই দেখিনি ওকে? এতদিন জেনেছি পাত্র পক্ষের দেখাটাই ‘দেখা’। এই প্রথম কেউ আমার দেখাটাকে এত গুরুত্ব দিলো।

অভূতপূর্ব আনন্দে মনটা কেমন ভরে উঠল। জালনা দিয়ে তখনই গোধূলির আলোটা আমার মুখে চোখে চুলে সর্বাঙ্গে পড়ার ছিল! মিস্টার পারফেক্ট গাঢ গলায় বলে উঠল, “আমি কিন্তু তোমাকে শুধু চোখের আলোয় না, মনের আলোতেও দেখে নিয়েছি!”

শুনে আমি হাঁদার মতো ঢাকনা হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে? রান্নাঘর থেকে দিদির রান্নার বউদি গাঁকগাঁক চিল্লিয়ে ছুটে এসে বলল, “ও মাসিমা, শিঙাড়া ছাড়ুন! শাঁখ বাজান! উলু দিন! আশ্চর্যি নোক বটে আপনারা! চুপচাপ বসে আছেন, ঘরে যেন কাউর  হাটএটাক  হয়েছে!” বলে সে নিজেই তারস্বরে উলু উলু করতে লাগল।

এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে দিদির মুখে হাসি। দিদির মাসি বোকা বোকা মুখে সেই থেকে হাতে ধরে থাকা শিঙাড়াটা হাতে ধরেই বললে, “খাব না বলছ তাহলে, অ্যাঁ?”

হো হো হাসিতে ঘর ভরে উঠল। এই সুযোগে আমি কোমরের খাঁজে গুঁজে রাখা চশমাটা নাকে চড়িয়ে নিলাম। ছয় চোখের মিলন হল। আহা, কী ছিল না সেই চোখে চোখে বলা কথায়!

দিদি ছুটে গেল কলকাতায় ফোন করে বাবা-মার মন হাল্কা করা শুভ সংবাদ দিতে। সেই ফাঁকে মুচকি হেসে বললাম, “চোখে চোখে কথা তো হয়েই গেল, এবার মনের কথা সেরে নিতে নেক্সট স্যাটারডে লোদি গার্ডেনস?”

দরাজ গলায় উত্তর এল, “মিয়া বিবি রাজি, হু কেয়ারস ফর কাজী?”

এক সাথে হেসে উঠলাম। সুয্যি মামাও অবশেষে আমার চশমার একটা হিল্লে হল দেখে নিশ্চিন্তে  টুপ করে পাটে নেমে  গেলেন।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

2 comments
Add Your Reply