একুশের ভাষা

২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস।  আমাকে এই দিবসের মাহাত্ম্য নিয়ে পাড়ার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে দু চার কথা বলতে অনুরোধ করা হয়েছে। দলের পাণ্ডা বাবু আর কেউ নয়, আমারই বাসাবাড়ির ঘোগ, ভাগ্না শাঁটুল। “নাই কাজ তো খই ভাজ, এই তো কাজ তোর? সমবচ্ছর মুখের ভাষার ছিরিতে তো আঁতকে ওঠার জোগাড়! লেখার ঢং-ও তথৈবচ, অথচ ভাষা দিবসটি পরিপাটি উদযাপন করা চাই! কেমন?”

আমার মগজে রাগের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠলে কী হবে, সে মাতব্বর তাল ঠুকে বলে দিল, “মামী, আপ টু ডেট থাকাটা যদি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মনে কর তাহলে দিও না বক্তিমে, কিন্তু ভাষা দিবস উদযাপন হবেই!” জানালার বাইরে থেকে কারা যেন বললে, “হিপ হিপ হুররে!”

ছোকরাকে ডেকে বলি, “খুব তো ভাষা দিবস ভাষা দিবস কচ্ছ! এর ল্যাজামুড়ো জানা আছে কিছু?”

মুখ দেখে মালুম হল ক-অক্ষর গোমাংস! বললুম, “যা, কড়া করে এক কাপ কফি নিয়ে আয়। বক্তিমে আমি দোবো, আর এমন দোবো যে তোর শির ঝাণ্ডার মত উঁচা থাকবে সারাদিন। কিন্তু তার আগে আমাকে তোদের হরি ঘোষের গোয়ালের একটা সার্বজনীন কেলাস না নিলেই নয়! এই বিদ্যার দৌড় নিয়ে তোরা করবি ভাষা দিবস উদযাপন? যা, দলের সবকটা হুঁকোমুখোকে ধরে নিয়ে আয়।”

শাঁটুল এন্ড কোং এই অনাহুত কেলাসের গুঁতোয় খুব যে একাত্ম খুশি হল তা নয়। তবু এল এবং দ্বিরুক্তি না করে বসে পড়ল দেখে বললুম, “ভাষা দিবস কী এবং কেন?”

চড়বড়িয়ে উত্তর এল, “ভাসা, মানে ভাসাই তো সব ! ভাসা না থাকলে এই পঞ্ছু কি করে লাভলিকে বলবে, আই লাভ ইউ?”

চাদ্দিকে আবার ফিসফাস, “এই উজবুক, কাকে কী কইছিস?”

হাত তুলে তাদের থামিয়ে বললুম, “দ্যাখো হে, পরের ধনে পোদ্দারি করতে করতে আমরা ভুলে গেছি আমাদের নিজেদের কতটুকু ক্ষমতা। বিগত শতাব্দীর একটা গোটা জেনারেশনের আত্মবলিদানে পাওয়া স্বাধীনতার সীতাভোগ সাঁটাচ্ছি আবার সমালোচনা করে বলছি, ‘এহ, হে, স্বাধীনতাটা ঠিক মত করতে পারেনি হে! স্বাধীনতার পাকে পাকে রসের তারটা ঠিক ধরেনি, আমরা অনেক ভাল পারতুম!’”

“বলার কথা কী জান? যা কিছু আমরা পরিশ্রম করে অর্জন করি না, তার যথাযথ মূল্যও বুঝি না। তা সে শিক্ষা হোক, কলা, শিল্প বা স্বাধীনতা!  পড়ে পাওয়া চোদ্দআনায় আমাদের দশা হয় দশচক্রে ভগবান ভুতের মত।”

শাঁটুল দেখলে এণ্ড কোং-এর সামনে তার প্রেস্টিজের কুকার ফাটল বলে। সে দাঁত কেলিয়ে বললে, “মামী, কাম টু দ্য পয়েন্ট।”

“দাঁত কেলানে বাঞ্ছারাম,” মনে মনে কিড়মিড়িয়ে মুখে বললুম, “যে জন্য তোমাদের ডাকা তা হল, বছরভর তোমাদের তো দিন যাপনের উৎসব লেগেই থাকে, যে কোন দিবস পালন হোক, তার সম্বন্ধে কিছু জেনে রাখা ভাল নয় কি? আয়োজন আলুনি হওয়ার ভয় থাকে না, এই আর কি!”

মুখ তাকাতাকি করে তারা বললে, “মাইমা, কী বলবেন বলুন, আধা ঘণ্টা দিতে পারি।”

গাম্ভীর্য ধরে রেখে তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললুম, “তোমাদের মত এমন শ্যাওলার জীবন নিয়ে আর যাই হোক আন্দোলন করা যায় না।”

কথা না বাড়িয়ে ঘরের কোণে রাখা আমার বড় প্রিয় গ্রামফোনে চালালুম, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি? ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।”

ঘরের কোণায় কোণায় বিষাদের অনুরণন উঠল। ছেলেরা শান্ত হয়ে বসল।

“সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে

রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে—

পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেন

এমন সময় ঝড় এলো এক, ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।”

গান থামলে ছেলেরা সপ্রশ্ন মুখের দিকে তাকাল। “সন ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারী। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে কি যে এক নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছিল ক’জন জানে সেই ভাষার আব্রু, মান রক্ষার কাহিনী? ব্রিটিশ রাজের দ্বিজাতি তত্ত্বের ফলে ভারত ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষরা জীবন যাপনে, বেশভূষায়, স্মরণে মননে আপাদমস্তক ছিলেন বাঙ্গালি। পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনযাত্রা ও মানসিকতার থেকে লক্ষ যোজন দূরে। শুরু হল পশ্চিমী পাকিস্তানিদের নানা অত্যাচার, দমননীতি। জোর করে বাঙ্গালিদের মুখে উর্দু ভাষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হল। এই অবিচারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু কর্মী মিলে মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। নিহত হন নিরীহ ছাত্রদল ও কর্মীরা। রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে রাজপথ।”

দমবন্ধ হয়ে ওঠে ঘরের পরিবেশ। শাঁটুল আঁতকে উঠে বলে, “এ কি!”

“আচমকা নিদারুণ অভিঘাতে না জানি সেই মিছিলের কত নিরীহ মানুষের চোখে এমনি বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের মুখে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষার আন্দোলন, মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।”

থামলুম। ইষ্ট, শাঁটুলের স্যাঙাত বললে, “ও মাইমা, কী গান শোনালে, বুকের ভেতরটা যেন আঁকুপাঁকু করছে!”

ম্লান হেসে বললুম, “আব্দুল গফফার চৌধুরীর রচনা। জানিস ইষ্ট, ছেলেবেলায় এই বিশেষ দিনে রেডিও খুললেই ভেসে আসত এই মন মোচড়ান গানটা। শিশু আমি খেলনাবাটি ফেলে উঠে পড়তুম, মা’কে খুঁজতুম চোখে জল নিয়ে। ঠিক বুঝে উঠতে পারতুম না কেন মন খারাপ, কী করলে মন আবার আনন্দে ভরে উঠবে! তাই মা’র কাছে যেতুম। মা হয়তো তখন সংসারের ঊনকোটি কাজে ব্যস্ত, আটা মাখছে কি কুটনো কুটছে, গিয়ে জড়িয়ে ধরতুম। মা হেসে বলত,  ‘কী হয়েছে রে?’ বলতে পারতুম না কিছুই। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, ‘যাও, খেলগে যাও।’ মা’র হাতের ছোঁয়ায় মন শান্ত হয়ে যেত।”

বড় হয়ে বুঝলুম নিজের দেশ, ভাষা, মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসা ফল্গু নদীর মত আমাদের বুকে চিরকাল বয়ে যায়। এই অনুভূতি যত নির্মল স্বার্থগন্ধহীন হয় ততই মঙ্গল। চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষতে কষতে আজ আমাদের মন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আমরা লাভ লোকসানের দাঁড়িপাল্লায় ভাষাকে মাপতে বসেছি । লোকদেখানো চমক, ঝুটা আভিজাত্যের মিছে গরবে অধুনা বাংলা ভাষার স্থান হয়েছে বছরে এই একটিমাত্র দিনের আহ্লাদিপনায়। দু-চার লাইন ইংরিজি কি ফ্রেঞ্চ বললে লোকে এমন চোখে তাকায় যেন ভানুমতীর খেল, অথচ দু চার লাইন ভুল বাংলা শুনলে দিব্বি হজম করে বলে — আহা! ওর কি দোষ! আসলে ভাষাটাই “যেন কেমন কেমন! খুব দুর্বল প্যানপেনে/ শুনলে বেশি গা জ্বলে যায় একঘেয়ে আর ঘ্যানঘেনে।”

“মামী, যাই বল আমার কিন্তু বাংলা বলতে হেব্বি লাগে! আহা ফি বছর স্টেজে সারদা-দা যখন গানটা ধরেনা — ‘কিসের গরব কিসের আসা’, জাস্ট জমে যায় গুরু।”

শুনে বলি, “তাই? না কি যারা ভাবেন ‘কিসের গরব কিসের আশা/ আর চলে না বাংলা ভাষা’ এমন লোকেরাই আসর ভরাতে আসছে না তো রে?”

কেষ্ট বললে, “কে জানে মাইমা, কচুরি জিলিপি প্যান্দাতেও আসতে পারে!”

“ছিঃ!” ধমকে বললুম, “ও কি কথার ছিরি রে?”

কাঁচুমাচু মুখে কেষ্ট বললে, “দুঃখিত!”

শুনে খুশি হয়ে বললুম, “ভাষা আমাদের ভাব প্রকাশের একটি মাত্র মাধ্যম। কখনো ভেবে দেখেছিস কি যদি আমরা কালঘাম ফেলেও আমাদের মনের ভাব বোঝাতে বা আদানপ্রদান করতে না পারতুম তা হলে সেই ক্ষণ, সেই মুহূর্ত কী ভয়ঙ্কর হত ! বোবা হয়ে পেঁচোয় পাওয়া একটা জীবন কাটানো কি দুর্বিষহ হত!”

ছেলের দল দেখলুম চিন্তায় পড়েছে।

আমি উস্কানি দিয়ে বললুম, “এই যে তোরা সারা বছর ধরে নানা দিবস পালন করিস, এরপর নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এঁরাও লাইনে আছেন, তাঁদের স্মরণে মননে কী ভাষা ব্যাবহার করবি বল? তোদের মুখ খুললেই যে ভাষার পপকর্ণ ফোটে ফাটে তা তো ঠিক পাতে দেওয়ার যোগ্য নয় চাঁদ!”

এবার বিরক্ত হয়ে ভাগ্না বলে, “তাহলে কি প্রাকৃত ভাষায় কথা কইতে হবে?”

বললুম, “হ্যাঁ রে, আমি একবারও কি তাই বলেছি? শুধু স্মার্ট বাংলা বলার জন্য এফ-এম, বাংলা সিরিয়াল, কি টিভির বিজ্ঞাপনের ভাষায় কথা বলিস না। একখানি সবেধন নীলমণি বাক্যে আধখানা হিন্দি বাকি কয়েক ছটাক ইংরিজির ফোঁড়ন, শেষ পাতে কখনো পঞ্জাবন কখনো মালায়ালাম কখনো ভোজপুরী। সববোনাশের মাথায় বাড়ি হয়ে নিয়ত নেত্ত করছে রিয়ালিটি শো। অতএব ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’-র অর্থ তোদের কাছে যদি হয় ‘আমার ল্যাদ খাওয়ায় চাপ নিও না বস’ তাহলে আর আশ্চর্য কী!”

“তবে কি জানিস, সব দোষ তোদেরও দেওয়া যায় না। পৃথিবীতে কয়েক হাজার ভাষা আছে। সব ভাষাই পরিশ্রম করে শিখতে হয়। তার জন্য উদ্যোগ লাগে পরিবারের লোকজনদেরও।একবারও ভেবে দেখেছিস কি শিশুরা কি আয়াসে একটা ভাষা শিখে নেয়! এমনকি কখনো কখনো একাধিক ভাষা! দুধের দাঁত পড়েনি এমন ব্রিটিশ মা আর ফ্রেঞ্চ বাপের শিশুকে একসাথে দুটো ভাষার বোলিং সামলাতে দেখেছি। ধর, শেওরাফুলির মেয়ে পাকেচক্রে গিয়ে পড়েছে সাউথ কোরিয়া, তো আগে তো তাকে ভাষা কানে শুনতে হবে, তারপর তো শেখা! সে যদি অহরহ বিকৃত ভাষা শোনে তবে তাই শিখবে! তাই বাপ-মার দেখা দরকার সন্তান শুদ্ধ ভাষা শিখছে কি না তার খেয়াল রাখা এবং লাভ লোকসানের হিসেব না কষে মাতৃভাষার সঙ্গে পরিচয় করান।”

“ইংলিশ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ

হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ

কি লাভ বলুন বাংলা পড়ে?

বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?

বেঙ্গলি থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই তেমন ভালবাসে না!

জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।।”

“এই অমোঘ লাইনগুলো কতবার পড়েছি, আমার মত আরও কতলোক পড়েছে, কিন্তু মনে রেখেছে কি?”

শাঁটুল এগিয়ে এসে বললে, “মামী, আমাদের মুখের ভাষা খুব খারাপ হয়ে গেছে না গো?” ওর মনমরা ভাব দেখে খারাপ লাগল। কাছে ডাকলুম। “একটা গল্প শোন। সরল করে মানে বুঝিয়ে বলতে পারলে পঞ্ছুর দোকানের রাধাবাল্লভি ফ্রি!”

“এক ভট্টাচার্য ছিলেন। তাঁহার স্ত্রী ডাইল পাক করিতেছিলেন। তিনি স্বামীকে রন্ধনশালায় বসাইয়া পুষ্করিণীতে জল আনিতে গেলেন। এদিকে ডাইল উথলাইয়া উঠিল। ভট্টাচার্য দেখিলেন বিষম বিপদ। ডাইল উথলাইয়া পড়া কী  প্রকারে নিবারণ করিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া হাতে পইতা লইয়া পতনোন্মুখ ডাইলের অব্যবহিত উপরিস্থ শূন্যে তাঁহা স্থাপন করিয়া চণ্ডীপাঠ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহাতেও তাঁহা নিবারিত হইল না। এমন সময় তাঁহার ব্রাহ্মণী পুষ্করিণী হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি কহিলেন, ‘এ কি? ইহাতে একটু তেল ফেলে দিতে পার নাই?’ এই বলিয়া তিনি ডাইলে একটু তেল ফেলিয়া দিলেন। ডাইলের উথলাইয়া পড়া নিবারিত হইল। এই ব্যাপার দেখিয়া ভট্টাচার্য গললগ্নিকৃতবাসা হইয়া করজোড়ে ব্রাহ্মণীকে বলিলেন,’তুমি কে আমার গৃহে অধিষ্ঠিত বল? অবশ্য কোন দেবী হইবে। নতুবা এই অদ্ভুত ব্যাপার কী প্রকারে সাধন করিতে পারিলে?”

গল্প শুনে ভাগ্না বললে, “খেঁক!” বললুম, “কী হল রে?”

সে বললে, “আমার পেটটা আজ তেমন সুবিধের নেই মামী! আজ আর পঞ্চুর দোকানে খাওয়া টাওয়া থাক।”

হেসে বললুম, “ভাগ্না, ভাষা একটা নদীর মত। যুগের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। তাই সংরক্ষণ নয় ভাষার সংস্কার দরকার। যুগের সাথে ভাষায় পালটা হাওয়া না লাগলে আমরা তো মুখ থুবড়ে পড়ব! ধর তুই বাঘাযতিন-গড়িয়া রুটে উঠে ১০০ টাকার নোট বাগিয়ে কন্ডাক্টরকে বললি, ‘দাদা, একটা পাটুলি!’ তখন দাদা যদি তোকে বলেন,  ‘কিঞ্চিত বিলম্ব হইবে। অবগত আছেন নিশ্চয়, বাজারে খুচরার আকাল পড়িয়াছে। মুদ্রারাক্ষসের প্রকোপে জনজীবন বিপন্ন।'”

আবার “খেঁক”! “কী হল কি তোর?”

শাঁটুল হাতজোড় করে বলে, “ক্ষ্যামা দাও মামী! আমি নাক কান মুলছি, ভাষা দিবস পালন করব না, বরং যাই গিয়া কোন ভাল ভাষা শিক্ষা কেলাসে ভরতি হই!”

ভাগ্না এন্ড কোং-দের উৎসাহ দিয়ে বললুম, “কেন রে, তোদের লেখার হাত তো খারাপ নয়, এই তো বেড়ে নেমন্তন্ন পত্র লিখেছিস!”

মাথা চুলকে পঞ্চা বল্লে, “আসলে বাংলা লেখা খুব তো একটা হয় না মামী। বাংলাদেশের মত আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তো আর চাকরি বাকরির পরীক্ষা বা কোন অ্যাপ্লিকেশান লিখতে বাংলা লাগে না; তখন তোমার ওই হিন্দি ইংরিজিই ভরসা। তাই ইচ্ছে থাকলেও শুধু বাংলা নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না।”

থমকে বললুম, “তা তো বটেই রে! আসলে ভারতের মত বহুজাতিক রাষ্ট্রে এটা একটা সমস্যা বটে! আমাদের মাতৃভাষায় আমাদের জন্মগত অধিকার, সে অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, কিন্তু কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে সেটা রাজনৈতিক বিষয়। আমরা যেটা করতে পারি তা হল ভাষাকে জাতি ধর্ম বর্ণের ভেদাভেদের বাইরে নিয়ে যাওয়া।”

“পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে নানা মানুষের সাথে মিশে বুঝেছি আন্তরিকতা হল সবচেয়ে বড় সম্পদ। কাউকে তাঁর নিজের দেশের ভাষায় সম্ভাষণ করলে তিনি খুশি হন, বিদায় জানালে আনন্দিত বোধ করেন। তাই জার্মানদের গুটেন ট্যাগ, ফ্রেঞ্চদের যেমন বোঁ জু, তেমনি ইসলাম ভাষাভাষীদের সালাম-আলেকম বলতে যেন দ্বিধা আসে না মনে। ভাষা আমাদের লালন করে। মনুষ্যত্ব শেখায়। ভাষা মানে কতগুলো ব্যাকরণের চর্বিত চর্বণ নয়। তাই জানবি শুদ্ধ ভাষা মানে প্রাণের ভাষা। মনের ভাষা। যে ভাষা মানুষকে মানুষের কাছ থেকে লক্ষ যোজন দূরে নিয়ে যায় সে ভাষা কখনো শুদ্ধ নয়, তা সে কালো মোটা  চশমা পরে কত্তাবাবারা যতই বলুন, ‘ওরে, বলি, ভাষার সুক্তুনিতে ব্যাকরণের বড়িটা মাষকলাইয়ের ছিল তো?’ ব্যাকরণের চাপে তখন ‘বগা ফাইন্দ্যে পইর‍্যা কান্দ্যে,’ তো উত্তর দেবে কে?”

“পৃথিবীর অনেক ভাষা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে রে ভাগ্না, তবু বাংলা ভাষার মত এমন মিষ্টি ভাষা আর দুটি শুনলাম না। বাঙ্গালির মুখে ‘ও মশাই’ ডাকে যেন প্রাণে তানপুরা বেজে ওঠে, বিশেষ সেই ডাক যদি শুনি হিমশীতল বিদেশ বিভূঁইয়ের মাটিতে!”

ফাজিল ভাগ্না টিপ্পনী কাটে — “আর মাসিমাদের জন্য কিছু নেই?”

আমিও কি কম যাই! একগাল হেসে বলি — “মাসিমা, মালপো খামু!”


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

রাজনারায়ণ বসু – ‘সেকাল আর একাল’

ভবানীপ্রসাদ মজুমদার – কবিতা ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: