মেলা বই, বই কই

(আমার লেখার ভক্ত পুলোমার সঙ্গে বই মেলাতে। )

বইমেলা থেকে ফিরব বলে করুণাময়ীর মোড়ে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হয়ে হা পিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি উবের ট্যাক্সি বুকিং এর ছিপ ফেলে। তা সে ব্যাটা এমন বাঘা বোয়াল যে ছিপই গেলে না ।

“ ও দাদা, কোথায় বলুন তো আপনি ? “ কোঁকাতে কোঁকাতে বলি ।

“এই তো দিদি এলুম বলে! আপনি ডাঁড়ান না ! করুণাময়ীর মোড়ে ওই যে অটো ইসটানড আচে, ঐখেনে ডাঁড়ান। ফুলবাগানের দিকে মুখ করে ডাঁড়াবেন।”

অগত্যা ফুলবাগানের দিকে মুখ করে “ডাঁড়িয়ে” থেকে থেকে যখন চোখে সর্ষেফুল দেখছি, গাত্রে যখন ব্যথা, ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে উবের উজিয়ে এসে থামে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই ড্রাইভারের কৈফিয়ত, “স্যরি দিদি! এমুন শালার এক পেসেঞ্জার জুটেছিল মাইরি! পুরো সল-লেক করুণাময়ী ঘুইরে ছেড়ে দিইচে। কোতায় যে নাববে তা নিজিই জানে না। সেসে বল্লুম ‘মামা আপনি নাবুন তো! আমার পেসেঞ্জার কতখন ডাঁড়িয়ে আঁচেন! যেখেনে যাবেন হেঁটে যান।’ মাল নাবিয়ে এই আসচি!”

উত্তর করলাম না। কান মাথা এমনিতেই জামপ্যাক্ট! চক্ষু মুদে পড়ে রইলাম ব্যাকসিটে মাথা হেলিয়ে। আজ ৩১শে জানুয়ারী ২০১৮,  বইমেলার দ্বিতীয় দিন। এ বছর শ্রীযুক্ত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা, তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অনারারি সম্মান “লিজিঅন অফ অনার” দেওয়া হয়েছে গতকাল অর্থাৎ বইমেলা উদ্বোধনের দিন। আসার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠেনি। তাই আজ বইমেলার রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ নিতে কোনও  ত্রুটি রাখব না ভেবে আসা!

মেলা তো চলবে ১১ই ফেব্রুয়ারী অবধি, কিন্তু অতদিন মেলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকার উপায় নেই। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কর্মজীবন প্রবাসের আর মনের যত সুকুমারবৃত্তি তার লালন করি এদেশে। দীর্ঘ বচ্ছর  প্রবাসে থাকলেও দেশের সোঁদাটে মা মা গন্ধের টানে ফি বছরই গুটি গুটি হাজির হই বাক্স প্যাঁটরা বগলে।

গরমের নিঝুম দুপুরে বাপের বাড়ির সবুজ ছায়া ঘন বারান্দায় বাক্স থেকে কভু বেরয় রং তুলি, মনের সুখে একই ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলি ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে সাদা আর লাল জবা! আশ্চর্য কেন? বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু! আবার কখনও শীতের উড়ু উড়ু সেঁজুতি সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ফেলে তাতে ভরেনিই  খান কতক লেখা জোখার নমুনা, বগলদাবাই করে পথ হাঁটি এ শহরের বুকে, হেথা হোথা, কোনও জ্ঞানী গুণী জন যদি আঁখি ঠেরেন আমার লেখায়, এই আশায়।

বছর তিন চার হল বইমেলার সময়টাই আসার চেষ্টা করি। প্রকাশক লেখক পাঠক এই তিন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে একই তীর্থে ধরতে। তঁাদের বহুমুখী প্রতিভার প্রসাদগুণ লাভের লোভে।

কিন্তু বলব কী ভাই ! ফি বছরই মনে হয় যেন ভি ভি আই পি বইবাবুর বিয়েতে ঢুকছি তোরণ দিয়ে। ঢুকেও তো শান্তি নেই। নিমেষেই চক্ষু কর্ণ ও অন্য ইন্দ্রিয়াদির উপর নিজের বশ্যতা আর থাকে না। এ যেন কি এক কুহেলিকার গড্ডালিকার প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলা!

খুলেই বলি, গাড়ি সাইকেল অটো বা টোটো যাই হোক না কেন, মেলার প্রধান তোরণের মুখে নামলেই খাকি উর্দি পরা পুলিশ কত্তা ডাণ্ডা উঁচিয়ে “নিপাত যাও, নিপাত যাও” ভঙ্গীতে ছুটে আসছে। হুমকি মেরে বলছে, “ওদিকে চলে যান! ওদিকে চলে যান!”

মিনমিন করে বলি, “আজ্ঞে, মেলা তো ইদিকে!”

ভবি কখনো ভোলে? না। “ওদিকে চলে যান।” লে হালুয়া! বিশ গজ দুরে গিয়ে কোনক্রমে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামি। মেলায় ঢুকতেই যেরকম আপ্যায়ণ, ভেতরে গেলে না জানি কী হবে!

ফুটপাথ জুড়ে ‘ব’-এর বাহার বসেছে। সবজে নীল সোনালি আলোর মালায় ঘুরছে ‘ব’। চাদ্দিকে এত ‘ব’ কেন রে ভাই? অম্মা, তলে তো লেখাই আছে, আহাম্মক আমার চোখেই পড়েনি, “বেঙ্গল ইজ বিজনেস”! বাহ! বেড়ে তো! ‘ব’-এর বিজনেসের মান রাখতে বইমেলার গ্রাউণ্ডটি যে আগাপাশতলা একখানি জব্বর দাঁও তা কে না জানে?

যাকগে, নিরাপত্তার ইঁদুর কলে নিজের সত্যাসত্যের ড্রাই ক্লিনিংটি সেরে সবে সেঁধিয়েচি, প্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ… এঁ… এঁ… সানাই এর লয়। কিছু এগুতেই দেখি লয় সমুদ্রে গিটকিরি মারতে উঠেপড়ে লেগেছেন এক বাউল গোঁসাই। গগনভেদী চিৎকারে চাদ্দিক ফাটাচ্ছেন — “ক্যান… ও ও ও নয়ন দিয়েছিলাম!” তাঁর কান্নাকাটির গমকে আমার সবেধন নীলমণি কান দুখানা বাঁচাতে জোরে চেপে ধরি। প্রাণপণ চিল্লিয়ে এক ভলেণ্টিয়ার দিদিকে বলি, “ম্যাপ কোথায় পাব বলতে পারেন?”

তিনি তো বললেন, কিন্তু শুনবে কে? কান ছাড়লেই তো গোঁসাইজীর অনুতাপের তোপ! অগত্যা লিপ রিডিং-এ বুঝে হাজির হলাম গিল্ডের আপিস ঘরের সামনে। সেখানে টেবিল চেয়ার ছেতরে বসে আছে জনা দুই লোক।  “দাদা, মেলার ম্যাপ?”

নির্লিপ্ত উত্তর — “আসেনি!”

মনের দ্বিধায় বলি, “কবে আসবে?”

ব্রেহ্মজ্ঞানীরা বললেন, “বলেনি।”

গিল্ডের আপিসে ম্যাপহীন হয়ে অনেকেই দেখি আমারই মত বেভুল ঘুরতে লেগেছে। তাঁর ফল হল এই সবাই সবাইকে বলতে লাগল, “ও দাদা, আনন্দটা?” — “দিদি, দে’জটা দেখেছেন?” — “আচ্ছা মাসিমা, দেব সাহিত্য কুটীরটা যদি বলেন!”

কোন দাদা, দিদি, মাসিমা কী যে জানেন তা ভগবানই জানে অতএব আমরা সবাই মেলার বুকে আমড়াতলার মোড়ে তিনমুখো তিন রাস্তা গেছে তারই একটা ধরে নিজ নিজ অভীষ্ট সিদ্ধির পথে প্রস্থান করলাম। তবে আমার কপাল ভাল, নাক বরাবর গিয়েই দেখি গয়নার বিশেষ শো-রুম। জনা দুই সুন্দরী লক্ষ্মী ঠাকরুণটি সেজে হেসে হেসে আপ্যায়াণ করছেন। মেলায় ঢুকে এই প্রথম কারও মুখে হাসি দেখে বড় ভাল লাগল। আম্মত্ত দাঁত বার করে সবে ঘাড় ঘুরিয়েছি দেখি ঠাকরুণদের স্টলের ওপারে ঐরাবতের দেহতুল্য অক্ষরে সাঁটা দে’জ ব্যানার।

মা লক্ষ্মীদের নিরাশ করে বাইলেন ঘুরে এসে দেখি অহো! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! মহাসাগর তীর্থের সঙ্গমে দাঁড়িয়ে ভক্তদের প্রাণ বোধহয় এমনি আকুলি বিকুলি হয়! একাধারে আনন্দ-দে’জ আর দেবতাগণের সাহিত্যকুটীর!

অদূরে গোঁসাই ঠাকুর না বুঝে কেষ্টকে নিজের চক্ষুদুটি দান করে পস্তে বিস্তর কান্নাকাটি করছেন। খোল-কত্তাল আর খুনখুনে খঞ্জনির দাপট অগ্রাহ্য করে নিজের নাকের উপর বাড়তি দু চক্ষুকে ভাল করে চেপে বসিয়ে গটগটিয়ে চললাম ত্রিবেণী সঙ্গমে সাঁতরে কিছু রত্নরাজি খুঁজতে।

ঢুকতেই ‘ওরে বাবা দেখ চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে’ — যথেচ্ছ গুঁতোগুঁতি এবং ঠেলাঠেলি করে সামনে এসে দেখি, বকতপস্যি সেজে কিছু বইবাজরা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স কচি, নজর দিগভ্রষ্ট। বই নয় তারা বোধহয় বৌ খুঁজতে এসেছে! মেনকা উর্বশী রম্ভারা স্বমহিমায় চাদ্দিকে বিকশিত! বিনম্রতার সাথে তাদের কিঞ্চিত হাল্কা কনৌষধী (কনুই + ঔষধি) মেরে এগিয়ে চললাম সামনের সারিতে। সম্মুখে থরে থরে ‘মণ্ডা মেঠাই কোরমা কালিয়া পোলাও’ মন হাঁকলে ‘জলদি লাও! জলদি লাও!’

মনের সুখে পছন্দের বই বগলে বুকে চেপে এক-পা দু-পা এগুই। এবার নীল কুর্তাধারী গুঁপেদা এসে ধরে — “ও মেডাম! বই তুলচেন যে বড়?”

মুখ ফসকাই, “তা বই মেলাতে এসে পটল তুললেই কি খুশি হতেন?”

স্টলের সংশ্লিষ্ট কর্মী এসে নারদ নারদের হাত থেকে বাঁচান। “দিদি, বইগুলো এখান থেকে তুলবেন না। কাউণ্টারে বললেই তারা দিয়ে দেবে।”

আমি বলি, “দাদা, দশখানা বই পছন্দ। সবগুলোর নাম কাউণ্টার অব্দি যেতে যেতে যদি মনে থাকত তো বর্তে যেতাম। স্বামীজীর আই কিউ তো পাইনি!” আশেপাশে রসিক বাঙ্গালি হাসে। “ছোট ছোট বাস্কেট তো রাখতে পারেন যাতে ক্রেতারা মনের মত বই ভরে কাউণ্টারে গেল, দাম মেটাল চলে গেল। ফাঁকা জায়গায় আবার ভরে দিন বই! আর নেহাত তা না হলে সবাইকে একটা কাগজ পেন্সিল অন্তত দিন, বইয়ের লিস্ট করার জন্য!”

বলা বাহুল্য আমার এই বারোয়ারি বুদ্ধি তেনাদের পছন্দ হল না। পাঠকরা একটা দুটোর বেশি বই কিনলে তাঁদের কাজ বেড়ে যাবে যে!  অতএব ‘যুক্তি তক্ক গল্প’ ঝোলায় পুরে বাইরে বেরিয়ে বাঁ হাতি এক গলি ধরে খোলা প্রাঙ্গণে এসে দেখি ‘বন্ধু সেজে বিপদ আমার দাঁড়িয়ে আছে এ কি!’ দার্জিলিং টী স্টল।

ভাবছেন, এ আবার কী, তাই তো? মশাই, আমার মতন চা-প্রেমীর জন্য ওই স্টলটি সাক্ষাত একটি জবাই স্টল। গত দু’বছরে মিনিমাম পাঁচশত টাকার চা গিলেছি ঐ স্টলের খপ্পরে পড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার, যখন যেখানেই দেহ মন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হোক না কেন অবশেষে ডানা মুচড়ে এদের স্টলের সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ব।

ধকধক করছে মাটির উনুন, তাতে পেল্লায় সাইজের কেটলির মুখে বগবগে ধোঁয়া।  কিছু লম্বাটে গোলালো নলমুখো মাটির ভাঁড়ের লক্ষ্মীশ্রী রূপ। কেসর রঙা চায়ে সুমন্দ দারুচিনির গুঁড়ো, নব এলাচের ফুল, মনের প্রশান্ত সাগরে তুফান না উঠে পারে? ফলে ভাঁড় পিছু চা-ওলার নীরস ‘কুড়ি টঙ্কা’র টরেটক্কা শুনেও তখন মনে হয়—

‘বাজাও কি বন সুর পাহাড়ি বাঁশিতে

বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্ত হাঁসিতে…’

আর  বাড়ি ফিরে মনিব্যাগের দশা দেখে মন বলে — ‘ঝোলালে তুমি মোরে কি ফাঁসিতে!’

তো জেনেশুনে বিষ পান করতে, ফাঁসিকাঠে বলি প্রদত্ত হতে এগিয়ে গেলাম। ভাঁড় হাতে বই বাবাজীর বিয়ে মেলার এক চাঁপাতলার বাঁধানো চাতালে বসে চুমুক মারছি, দেখা আমার এক পরমভক্ত হনুমতী, না, না, বড্ড ভাল মেয়ে পুলোমার সাথে। সে আমার ব্লগ বং ঢং ডট কমের বেজায় ভক্ত। আমাকে দিদি ডেকে ভালবেসে একাকার।

তার মুখের নির্মল হাসির দাবি, আমার স্ব-উদ্যোগে বের করা এক ঝুড়ি রম্যরচনার একটি কপি সই করে দিতে হবে। অতএব চাঁপাতলায় সই এবং শুভেচ্ছাবার্তা সহ তার হাতে বইটি তুলে দিতে গিয়ে দেখি বেশ জনা পাঁচেকের ভিড় জমেছে। একবার ভাবলাম দেব না কি ‘হরেক মাল দু’শ টাকা’ বলে ঝোলার ম্যাও বের করে? কিন্তু সে সময় এখনো আসেনি ভেবে মেঘ না চাইতেই জলভরাদের দিকে নলেন গুড়ের মতন মিঠি মিঠি ‘হাস’ উপহার দিয়ে কেটে পড়লাম।

আমাদের ম্যাপহীন ভ্রান্তিবিলাস দলের অনেককেই আবার দেখলাম হনহনিয়ে চক্কর কাটছেন। কপালে উদ্বেগ আর বিরক্তির চন্নন চড়চড় করছে। যাকে পাচ্ছেন তাকেই “ও দাদা মিত্র এণ্ড ঘোষটা কোথায় বলতে পারেন?” — “এই শুনছো, ওনার হাতে পত্রভারতীর ব্যাগ দেখলুম, ওনাকে ধরো না! যাহ্‌ চলে গেল!”

কাতান, সিল্ক, জামেওয়ার শাল মোড়া বিভ্রান্ত বাঙ্গালিকুলকে ডিঙ্গিয়ে উটের মতন পা ফেলে ফেলে এক বিদেশিনী কালো ধুতি সালোয়ার পরে পিঠের ব্যাগপ্যাক বুকে শেল বেঁধে বেরিয়ে চলে গেল। ভ্রান্তিবিলাসের দল তাকে হাঁ করে জরিপ করতে লাগলে আমিও রাস্তা পালটালাম।

বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটি বেশ লাগল। একটা সুরম্য অট্টালিকা, তার ভেতর যাবার দুরপনেয় ইচ্ছা থাকলেও সময়ে কুলল না। মনে পড়ল বাংলাদেশেও এখন একুশের বইমেলা চলছে। মনে পড়ল সে দেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন একবার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে ভারি সুন্দর করে বইমেলার আপ্তবাক্যটি বুঝিয়েছিলেন। বই যে শুধু এন্ট্রান্স আর এক্সিটের দু মলাট বিশিষ্ট একটা জড়পদার্থ নয়, বই যে একটি অসাধারাণ শক্তি, সে ব্যাখ্যা মনে বেশ দাগ কেটেছিল। সত্যিই, এই তথ্যপ্রযুক্তির রমরমা বাজারে, ইণ্টারনেট, ওয়েবসাইট, ব্লগ, ই-বুকের বাজারেও বইয়ের গুরুত্ব বা আদর কিন্তু কোথাও এতটুকু ঘাটতি হয়নি।

সবচেয়ে আনন্দের কথা বইয়ের কোনও জাতি ধর্ম বর্ণ নেই। সীমাভেদ নেই। এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ আমেরিকার হাজার মানুষের সুখ দুঃখ ভালবাসার আবেগকে মুঠো ভরে তুলে একসূত্রে গেঁথে দিতে পারে কেবল বই! মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতার শেষ কথা বইয়ের প্রতি ন্যাক, ভালবাসা। বাংলাদেশে আমার কবিবন্ধু আমেনা খানেমকে নাকের বদলে নরুণ উপহারে পাঠাবার জন্য কপাৎ কপাৎ করে গোটা দু-চ্চার ছবিই তুলে নিলাম।

এবার পদযুগল রীতিমত বিদ্রোহ করে খিস্তিখেঁউড় শুরু করল। পরিষ্কার বুকে ধ্বনিত হল তাদের ধিক্কার — “অলপ্পেয়ে! কতটা পথ হাঁটলে তোকে শহিদ করা যায়!” অতএব তাদের শান্ত করতে ঘুরে ফিরে আবার সেই দারুচিনির দ্বীপে দার্জিলিং টী স্টলের খপ্পর। ভাঁড়ে মা ভবানী হয়ে থিতিয়ে বসি এক কোণায়। ‘তোমার দেখা নাইরে তোমার দেখা নাই’ বলে মহাসমারোহে সারমেয়কুল ছুটে আসে ‘ভোউ… উ… উ… ঘেউ ঘাউ…’ তাদের অযাচিত উৎসাহে চা থুড়ি জল ঢেলে কম্পিত বক্ষে আবার পথে নামি।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা ৮টা পেরিয়েছে। পুলিশমামারা বাগিয়ে ধামা (ভুঁড়ি) জনে জনে কাকুতি করছেন, “ও দাদারা, এবার উটুন না! আটটা তো গড়িয়ে গেছে!” তা বললে চলবে কেন মামু? বাঙালিকে মেলা থেকে হটানো অত্ত সোজা? — ‘বাঙালি আর মেলা? যেন বিকার রুগীর ঘরে রাখা, মস্ত জলের জালা।’ বিকারের রুগীর জল খেতে নেই তবু সে পাগলের মতন জলের সন্ধানে আঁকু পাঁকু করে। বই বিহীন বাঙালির দশাও কতকটা ওই রূপই হয়।

চটকা ভাঙল আমার উবের চালকের উজিরিপনায়। “দিদি, মা ধরব?”

বিষম খেয়ে বললাম, “ম-মা ধরবেন মানে?”

সে স্টিয়ারিং থেকে চোখ সরিয়ে সামনের আরশি নগরে পড়শি নজর মেরে বললে, “মা ফ্লাইওভার। ধরব?”

নিজের মাথা নিজে চাপড়ে শান্ত সুরে বললাম, “আপনি মা পা ধা নি যা মর্জি ধরুন, কেবল আমার এই দেহখানি নির্বিঘ্নে আমার বাসাবাড়ির দেউড়িতে পৌঁছে দিন।” সে গোটা রাস্তা আর দ্বিরুক্তি করল না।

বাসায় এসে মা-র হোম ম্যানেজার পুন্নিমার হাতের ঝাল পার্শেমাখা ভাত আর মার বানানো মিষ্টি পাতার পান মুখে পুরে আহ্লাদী একটি ঘুম। আঃ, এই তো জীবন! বিশ্ব বাংলার বই মেলা, তোমার ত্রিমাত্রার গৌরব বুকে করে দাঁড়িয়ে থাকো । বিস মরগেন! (জার্মান ভাষায়, কাল দেখা হবে।)

পরদিন ১লা ফেব্রুয়ারী। গত বছর গ্রীষ্ম কালে লণ্ডন যাবার সুবাদে দেখা হল আমার এক বাতাসি বন্ধু (ফ্যান) অরুন্ধতী আর তার জমাটি স্বভাবের অর্ধাঙ্গ আনিন্দ্যের সঙ্গে। এবছর তারা কলকাতায়। অতএব ফোনে বার্তালাপ, “দিদি, বইমেলাতে দেখা হবে।”

খেয়াল করে দেখেছি লেখকদের শ্বাসবায়ু ফুস্ফুসিয়ে চলে না, চলে ‘ফ্যানের’ বাতাসে। আহা, আজ আমার মনও তাই ‘ফুলেফুলে দোলে দোলে’। আলিঙ্গন, আদর, ভরসা, স্নেহের বিনিময় হল। ভারি সুন্দর কেটে গেল ছোট্ট এক টুকরো সময়। ওদের সাথে বাচ্চারা ছিল। তাদের খিদে পেয়েছে, অতএব জলদি যেতে হল ওঁদের।

আমার মামাতুতো বংশে সরস্বতী বিদ্যেবতীর খাস তালুক। সবাই লেখাজোকা, আঁকা, গান নিয়ে দিব্যিটি আছে। সবার আনন্দযজ্ঞে সবারই আমন্ত্রণ। এই মেলা গ্রাউণ্ডের লিটল ম্যাগাজিনের মণ্ডপে ছাউনি ফেলে আঁছেন আমার মামা। গতকাল দেখা হয়নি। আজ দেখা করলাম, দুটো বই কিনলাম মামাদের মতন যারা বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার ছোট বড় নানা রকমের উদ্যোগ করছেন, তাঁদের জন্য সহমর্মী হয়ে।

বই দুটো ঝোলায় পুরে হেঁটে চললাম প্রধান তোরণের দিকে। একটু আগে ভাতৃপ্রতিম রজত মেসেজ করেছে, দেখা করতে আসছে। সে ভালমানুষের পো আমাদের প্রবাসী ডেনমার্কের সুধী বঙ্গজীবনের যাপনে একটা বড় খুঁটি। জানেন তো, বাঙালি আর লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্কটা চিটে গুড় আর পিঁপড়ের মতন। আদি অনন্তকাল ধরে প্রবাসী বাঙালির জীবনে ‘পত্রিকা’ বিশেষ পত্ররচনা করে আসছে। আমাদের শহরেও বছর পাঁচেক দুর্গাপূজার সাথে সাথে রমরমিয়ে প্রকাশিত হছে শারদীয়া পত্রিকা। ডেনমার্ক থেকে কলকাতা ফেরত গিয়েও পত্রিকার কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছে রজত। প্রিণ্টিং প্রেস-এর পুরো কাজটাই সে ‘একা কুম্ভ’ হয়ে সামলাছে।

তাকে আরও একটি অনুরোধ করেছিলাম। “ভাইটি, কোন পাগলে আমার বাংলা পত্রিকার সাবস্ক্রিপশান কপিগুলো নিজের ভেবে সাবাড় করে দিচ্ছে, জানি না। একটি দুটি পত্রিকা ওই বকরাক্ষসের গর্ভে গেছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে চার চারখানা শারদীয়া পত্রিকার মহাভোজে তো আর হরির লুঠের ডিস্কাউণ্ট দিতে পারি না, অগত্যা বাঁচাও।”

বুদ্ধিমানের কাছে ইশারাই যথেষ্ট। সে আমার কপিগুলো যথা সময়ে কিনে রেখে আজ দিতে এসেছে। রথ দেখা কলা বেচা অর্থাৎ আড্ডা আর কর্ম সারতে যথারীতি আবার সেই দারুচিনির দ্বীপের কোতোওয়ালি টী স্টল!

এই যাঃ! রজতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়ালই ছিল না আমার এক ফেসবুকস্য বান্ধবী বারংবার অনুরোধ করেছিল, “ওম্মা, তুমি এবছর বইমেলা যাচ্ছ? আহা, আমার মেয়েটাকে দেখে আসবে প্লীজ!” অবাক হই, যদ্দুর জানি বারমুডা পরিহিত সেই মেয়েকে আমি অকল্যাণ্ডের ল্যাণ্ডস্কেপে যথেচ্ছ বিহার করতে দেখেছি ছবিতে! বললাম, “তোমার মেয়ে স্টল দিয়েছে না কি?”

“আহ-হা! সে স্টল দিতে যাবে ক্যানো? সে স্টল আলো করে বসে আছে!” বান্ধবীর অম্লমধুর কণ্ঠ জানাল।

বুকে ঈর্ষার সূক্ষ্ম হুল বিঁধল। হে প্রভু, খালি আমারই ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো?’ সংযত হয়ে জানতে চাই, “কোনও পুরস্কার টুরস্কার পাচ্ছে না কি?”

বান্ধবীর আবেগের হড়কা বাণে পা পিছলে পড়লাম। “তাই যেন হয় গো বাপু! তোমার মুখে ফুল চন্দন! কি আর বলব বল, আঁতুড় থেকে তুলতুলে হয়ে মেয়ে আমার বেরল এক মাসের মাথায়। উইম্মা, প্রথম যখন তাকে হাতে স্পর্শ করলাম, উঃ সে কি ভরাট বাঁধুনি! কি উত্তাপ! কি শীতল! কি তাজা! কি গন্ধ! তার চারকোনা চেহারায় আমার চতুর্বর্গপ্রাপ্তি হল যেন।”

বান্ধবীর মেয়ে বিয়োনর ডেমোতে চূড়ান্ত গণ্ডগোল মালুম করে মনটা সন্দেহে দমে গেল। হিসেব তো কিছুই মিলছে না বাপু! বললাম, “তোমার মেয়ের নামটা কী?”

সে বললে, “ভারতবর্ষের কোহিনূর ও ছেঁড়া ন্যাতা।”

শুনে তো আমার চোখে ধুধুলের ধোঁয়াশা। কোনও মতে বললাম, “ক্কি?”

সে জবাবে বললে, “আমার প্রথম ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ গো দিদিভাই। আমার প্রথম ভূমিষ্ঠ সন্তান!” বোঝা গেল!

অগত্যা বান্ধবীর কাব্য কন্যাকে দর্শন করে এলাম।

ইতি উতি অজস্র তাঁবু। তাঁবু ভরা বই! প্রকাশক। পাঠক। কিন্তু তবু কেন স্মৃতির সরণি বেয়ে আসে সেই কবেকার গড়ের মাঠের ধুলোয় ফেলে আসা বইমেলার দিনগুলো। সেই তীর্থের কাকের মতন দিন গোনা।  যতরকম ধান্দায় বাবাকে খোসামোদ করে এক্সট্রা পয়সা আদায় করা যায়, তা সে অঙ্কের হোমওয়ার্কটি নিখুঁত করে সারা হোক অথবা বাবার মাথায় শনাঘাতে কালো চুলের শরবণ থেকে গুনে গুনে পঞ্চাশখানা পাকা চুলের উৎপাটন — কিছুই বাদ যেত না। তবু কি করে জানি না, বইমেলাতে বাবার দেওয়া পুঁটুলিভর্তি দশ দশ টাকাও নিমেষের মধ্যে হয়ে যেত ব্যাঙের আধুলি!

তখন বইমেলায় দু’ পা গেলে এই বড়ি আচার পাঁপড় চপ কাটলেট মোমো, পঁচিশ ফ্লেভারের রসগোল্লা, আইসক্রিম এসবের রমরমা ছিল না। পাড়ার পিণ্টুদা কাল একগাল হেসে শুধিয়েছিল, “কি রে, বইমেলা যাচ্ছিস? কি কি নতুন খাবার উঠেছে র‍্যা?”

তখন লোকে গড়ের মাঠের ধুলো খেয়ে হুপ্পুস চেহারায় ধুলো পায়ে সবুজ ঘাসের গন্ধ গায়ে মেখে বইয়ের স্টলে স্টলে ঘুরত। ঝোলা ব্যাগ, কাঁখে বুকে বই ঝোলা হয়ে মুখে সব পেয়েছির আনন্দরেণু মেখে বাড়ি ফিরত।

এখনকার মেলা গ্রাউণ্ড, পোক্ত টেণ্ট, ফিনাইলের গা গুলোন গন্ধ, চা পকোড়া চপের পোড়া তেল মিশে হৈ রে বাবুই হৈ রে করে গোগ্রাসে গিলছে মানুষ। তা সে বই না বটুরে (ছোলা) তা বলতে পারব না মশাই! নিজেরা গিয়ে দেখে আসুন!

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: