জানাজানির জট

আজ স‍্যরের কাছে প্রচুর কেলানো কপালে আছে ভাবতে ভাবতে হাসপাতালের বড় গেট পেরোয় মদন। ঢুকতেই ধেয়ে আসে স‍্যরের ফেভারিট নার্স পিউ। “স‍্যর আপনাকে বলির পাঠার মতন খুঁজছেন!” বলেই খিলখিলিয়ে চলে যায় জেনারেল ওয়ার্ডের দিকে।

“স‍্যর কি রাউণ্ডে বেরিয়েছেন?” — গলা তুলেও উত্তর পায় না, অতএব কালবিলম্ব না করে ডিপার্টমেণ্ট অফ্ ডায়গোনোস্টিক মেডিসিনের দিকে গড়গড়িয়ে চলল মদন।

ফোনের স্ক্রীনে ফুটে উঠল — “কুমোরপাড়ার গোরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি, গাড়ি চালায় সেয়ানা পবন, সঙ্গে যে যায় ফেকলু মদন।” ওঃ, জিনিয়া! এই নিয়ে তিনবার তিন রকমের পদ‍্যগালি খেতে হল মদনকে। রাগ হলে জিনিয়ার পদ‍্যবায়ু চড়ে। সে তখন আনতাবড়ি পদ‍্যগোলা ছোঁড়ে। দেখা করতে হবে হবে মানে এক্ষুনি দেখা করতে হবে। “আরে, আমি কি পক্ষীরাজ ঘোড়া না কি রে?” বলেওছিল মদন একবার। শুনে মুখ ভেটকে মহারাণীর কি রাগ — “পক্ষীরাজ না ছাই! ভুষুণ্ডী কাক!”

আসলে ICU-এর নার্স তো! দিনরাত চোখের সামনে কী দেখছে? মৃতু‍্য, উদ্বেগ, শোক, কান্না, দুশ্চিন্তা — এই সব! দিন দিন কেমন যেন দরকচা মেরে যাচ্ছে মেয়েটা। পা চালাতে চালাতে মদন বিড়বিড়ায় — “জয় মা সিদ্ধেশ্বরী! জয় মা হংসেশ্বরী! জয় বাবা বামুনগাছি…” আজ যেন স‍্যরের ঝড়ের গোলাও খেতে না হয়!

স‍্যরের রুমের দরজা ঠেলে সন্তর্পণে ঢুকে এল মদন। এক্ষুনি নিশ্চয়ই স‍্যর বোমার মতন ফেটে পড়বেন, এই ভেবে উদ্বেগের সীমা ছিল না তার। বদলে দেখে স‍্যর মেডিকল ইন্সিওরেন্সের ওই চালিয়াত দালালটার সাথে গভীর আলোচনায় মগ্ন। মদনকে ঢুকতে দেখে দালালটা দাঁত কেলিয়ে হেসে কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে নিল। স‍্যর গম্ভীর হয়ে শুধু বললেন, “মদন, তুমি ভবেশের সঙ্গে বসে নিরুপমা দত্তগুপ্তের মেডিকেল ইন্সিওরেন্সের রিপোর্ট তৈরি রাখবে। আমি এখন রাউণ্ডে বেরিয়ে নাকতলা ক্লিনিক হয়ে বাড়ি ফিরব। কাল আমাদের মর্নিং ফ্লাইট। ভবেশ, তুমি এদিকটা সামলে রাখবে।”

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ান পবন। হাত কচলে ভবেশ বলে, “ও আপনি কিসু‍্য ভাববেন না স‍্যর। বৌদিকে নিয়ে মজাসে আমেরিকা ঘুরে আসুন। খালি আসবার সময় জবরদস্ত স্কচের পাঁচ পাত্তি যদি…”

“হবে, হবে,” বলে পবন আর দাঁড়ান না।

নাকের ভেতর খুকখুক হেসে ভবেশ মদনকে বলল, “রাখে কেষ্ট মারে কে, কী মদনদা? ভাগ্গিশ এই সক্কালবেলা ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিলাম, জোর বাঁচা বেঁচে গেলেন মশাই স‍্যরের দাবড়ানির হাত থেকে।”

মদন ব‍্যাজার হয়। “জম্পেশ ট্র‍্যাফিক জ‍্যাম ছিল!”

দাঁত বার করে ভবেশ বলে, “তাই? না কি রাস্তার বট অশ্বত্থের থানে যতগুলো চুনোপুঁটি, খয়রা বোয়াল মন্দির পেয়েছেন সবগুলোর সামনেই মাথা ঠুকতে ঠুকতে এসেছেন?” ভেতরে ভেতরে গুটলো মদন।

“নিন, নিন, আসুন। স‍্যরের শাশুড়ির জমা খরচের হিসেবটা বুঝে নিন।” বাঁকা হেসে বলে ভবেশ।

মদনের ধৈর্য‍্য হারায়। সে তুম্বোমুখে বলে, “ও আপনি কাগজপত্তর সব রেখে দিয়ে যান। আমি পরে বুঝে নেবোখন।”

“হেঃ, কালনেমির লঙ্কাভাগ হবে, আর উনি সব নিজে নিজেই বুঝে নেবেন!” তাচ্ছিল‍্যের হাত ঘোরায় ভবেশ। “বেশ, জ‍্যায়সা আপকা মর্জি” — বলে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠতে গেল ভবেশ। ঠিক তক্ষুনি সেই চেয়ারেই গুঁতো খেয়ে হুমড়ি দিয়ে ভবেশের পেটের উপর মুখ থুবড়ে পড়ল জিনিয়া। চমকে উঠল ভবেশ। ততোধক চমকাল মদন। জিনিয়া দাঁত কিড়মিড় করে মদনকে বলল, “মিচকে পটাশ, বুনো খটাশ! ডুমুর ফুল, আমারই ভুল! বড্ড ওঁছা, গন্ধ পচা!”

জিনিয়ার ধাক্কা ভবেশ ততক্ষণে বেশ সামলে উঠেছে। সে মদন আর জিনিয়াকে বার কয়েক জরিপ করে “মেরি ফোটু কো সিনে সে ইয়ার চিপকা লে সৈঁয়া ফেভিকল সে” বলে বত্রিশপাটি দাঁত দেখিয়ে চলে গেল।

মদন জিনিয়াকে রাগ দেখিয়ে বলল, “হয়েছে? শান্তি? লোকের সামনে ইজ্জতের ফালুদা বানালি!”

ফুঁসে ওঠে জিনিয়াও — “যাঃ যাঃ! খাঁদু, নাকের আবার ইজ্জত! মেসেজগুলো পাসনি না কি?”

“পাব না কেন? পেয়েছি,” মদন বললে।

“তবু একটা কল্ করতে পারিসনি!” এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে জিনিয়া বলে, “তোর ওই ঝাঁটাগুঁপো বসটা আবার আমাকে নাইট শিফ্টে ফেলেছে।”
খুব অবাক হয় মদন। “সে কি রে! তুই স‍্যরকে ডক্টর ভড়ের রিপোর্ট দেখাসনি?”

ধপাস করে পবনের চেয়ারেই বসে পড়ে জিনিয়া। তার চোখে জল চলে আসে। নাক টেনে টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, “তোর বস বৌ বগলে আমেরিকায় মজা মারতে যাচ্চে ওভার মাই ডেড বডি!”

মদন ব‍্যস্ত হয়ে বলল, “তুই জোর দিয়ে না বলতে পারলি না?”

রাগের চোটে উঠে দাঁড়ায় জিনিয়া। চেয়ারটা ধাক্কা খেয়ে গোঁ গোঁ ঘোরে। “বলবটা কী, শুনি? স্রেফ বলে দিল পিউ এখনও অত পাকেনি!”
“পা- পাকেনি মানে? পিউ কি পেঁপে?”

মদনের ভোঁদা প্রশ্নে জিনিয়া ফেটে পড়ে — “পাকেনি মানে পাকা হয়নি! রাত্তিরের ICU সামলাতে পারবে না। জানলি তো, এখন তুই কী করতে পারবি বল!”

মদন কাঁচুমাচু মুখে বলল, “মাইরি বলছি, স‍্যর ফিরলেই এর একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়ব। তুই দেখিস!” শুনে “ওয়ার্থলেস ওরাংওটাং” বলে গটগটিয়ে ঘর ছাড়ল জিনিয়া। এই হাসপাতালে ডক্টর পবন ভট্ট একজন জাঁদরেল ক্ষমতাবান। তাকে ভজাবে মদন?

****

“হরিদাসের বুলবুল ভাজা, টাটকা খাজা খেতে মজা!” — বোর্ডের ইয়ার-এণ্ডিং মিটিং-এর মাঝে এই রিংটোন শুনে মোটেই খুশি হল না টোপার বস মিঃ পাণ্ডুরঙ্গ। “ওহ্, নট্ এগেন! কাই জালা মিস্টার ডট্টাগুপ্টা?”

টোপা বসকে সামলে নেয়। “ভেরি ডিলিশাস মির্চ মসালা চানা স‍্যর, নেক্সট স‍্যাটারডে অন লাঞ্চ, স‍্যর? ট্রিট অন মি! ওয়ান মোমেণ্ট স‍্যর! হ‍্যাঁ, পবনদা, কী হল?” ঘর থেকে বেরিয়ে আসে টোপা।

“হ‍্যাঁ, শোন টোপা…” পবন সন্তর্পণে বলেন, “আমরা কাল প্লেনে উঠছি। যদি তেমন বোঝ, মার পেটের একটা ফটো তুলে নিও।”

জরুরি মিটিং-এর মাঝখানে এ কী মস্করা? “মা’র পেটটা কি কাশ্মীরের ডাল লেক যে ফটো তুলে রাখব? কেসটা কী?” বিরক্ত হয় টোপা।

“কিছু না, কিছু না, মনে হচ্ছে স্রেফ বদহজম!” পবন ফোন কেটে দেন।

হপ্তা দুই হল নিরুপমা কোলকাতা থেকে পুণে এসেছেন ছেলের কাছে। বেশ ছিলেন, দিন তিন চার হল সেই পুরনো পেটের ব‍্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। ছেলে-ছেলে বৌ ছোট্ট বাচ্চা, অফিস-ঘর নিয়ে ব‍্যস্ত, তার উপর তিনি গোদের উপর বিষফোঁড়া! খুব খারাপ লাগতে লাগল তাঁর।

সেদিন অফিস থেকে ফিরে বাড়ি এসে টোপা দেখল মা বাথরুমে বমি করছে। টিয়া হাতের আঙুল মেলে বলল, “এই নিয়ে পুরো পাঁচ।” শুনেই টোপার চিত্ত চিত্তির। বলল, “জুতো আর খুলব না, এক গ্লাস জল দাও তো। মাকে নিয়ে যাই একবার শিণ্ডের কাছে। দেখি কী বলে!”

বাথরুম থেকে নিরুপমা কোঁকান — “না না, দাঁড়া টোপা। ওরা তো বলছে বদহজম। আর ক’টা দিন দেখি!”

পুত্রবধূ টিয়া ক‍্যাঁককেকিয়ে বলল, “রাত্তিরে খান তো ওই পাতলা দুটো রুটি। বদহজমটা কোত্থেকে হবে শুনি? আর পাঁচমাস ধরে আপনার বদহজম হচ্ছে?”

এবার টোপার চোখ গোল। টিয়া হাঁটে হাঁড়ি ভাঙে। “মা তো পবনদাকে বলেছিল পেট ব‍্যথা, বমি-বমি ভাবের কথা। তোমার দিদি উল্টে শীতলাকে এক গাদা কথা শুনিয়ে দিল। সে না কি মা’র রান্নায় একগাদা তেল মসলা দিচ্ছে।”

নিরুপমা মিনমিন করেন — “আজকালকার দিনে শীতলাটার মতন মেয়ে আছে বলে নিশ্চিন্তে আছি। এত যত্ন আত্তি করে। রাগ করে কাজ ছেড়ে দিলে তো আমারই বিপদ! পবনকে ব‍্যথার কথা বলতে সে বললে, ‘হবে, হবে, আমেরিকা ঘুরে এসে দেখছি।’”

সব শুনে গুম মেরে যায় টোপা। আজকাল কী থেকে কী হয় কেউ বলতে পারে? অথচ ডাক্তার হয়ে একটা পাঁচ-ছয় মাসের পুরনো পেইনকে এভাবে ইগনোর করে আমেরিকা ঘুরতে চলে গেল? অবিশ‍্যি ওদের কাছে এর থেকে বেশি কীই বা আশা করা যেতে পারে! বাবা মারা যাবার ঘা তখনও শুকোয়নি জীবনের ক্ষত থেকে, কতই বা বয়েস তখন টোপার! একুশ কি বাইশ। জমি বাড়ি সম্পত্তির চেয়ে মায়ের শুকনো মুখ আর নিজের নড়বড়ে ভবিষ‍্যৎ অনেক বেশি ভাবাচ্ছিল টোপাকে। আর তখুনি পবনের সে কী তুরুক নাচ! জারুলকে শিখণ্ডি খাড়া করে বাবা কী রেখে গেছে, কি পাওনা, কবে পাওয়া যাবে, এইসব নিয়ে খরবায়ু হয়ে ধেয়ে এল। সেই যে টোপার সঙ্গে সম্পর্কটা ঘেঁটে গেল, আর স্বাভাবিক হল না।

****

ডক্টর কপিল শিণ্ডে বেশ যত্ন করেই দেখলেন নিরুপমাকে। হেসে বললেন, “ঘবড়াইয়ে মৎ! আপ তো বিলকুল ফিট্ দিখতি হ‍্যাঁয়!” টোপাকে বললেন, “ইটস্ আ কেস্ অফ্ হার্ণিয়া মনে হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারেন পেটের একটা সোনোগ্রাফি করান আর একজন ভালো সার্জেনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।”

টোপার মনে পড়ল পবনদা ওকে মা’র পেটের ছবি তুলে রাখতে বলেছিল, যদি দরকার হয়। তবে কি পবনদা আন্দাজ করেছিল সিরিয়াস কিছু? তাহলে চেপে রাখল কেন এতগুলো মাস! কেন?

ছেলের মুখে কাটা-ছেঁড়ার কথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন নিরুপমা। বললেন, “তাহলে তো ওদের একবার জানানো দরকার। ফোন করবি? নাম্বার আছে?”

টোপা বলল, “ওখানকার নাম্বার আমার কাছে তো কিছু নেই, দেখি টিয়া কী বলে!”

রাত্তিরে ছোট্ট অংশুকে ঘুম পাড়িয়ে টোপা টিয়া হাতড়াতে বসল সেই ফোন নাম্বার। “আমেরিকা পৌঁছে জারুলদি একটা নাম্বার ফেসবুকে শেয়ার করেছিল এমার্জেন্সি কন্ট‍্যাক্টের জন‍্য।” জারুলের পেজ স্ক্রোল করতে করতে বলল টিয়া, “য‍্যাঃ! এ তো শুধু নু‍্য ইয়র্কের তালঢ‍্যাঙা বিল্ডিংগুলো আসছে গো…” বৌ-এর কথায় ফোন স্ক্রীনে ঝাঁকি মেরে টোপা দেখে স‍্যাঁৎ করে শুঁটকো গোছের একটা সায়েব মুশকো কুকুর নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বুকে ‘ইউজ মী’ লেখা গোলগাল একখানা ময়লার ভ‍্যাঁট এগিয়ে আসছে। “কী, করছ কী!” বিরক্ত হয় টোপা। টিয়াও ঝাঁঝি দেয় — “আমি কী করব? তোমার দিদি যেমন আপলোড করেছে তেমনি তো আসবে!”

“আমাকে দাও! আমাকে দাও!” বৌ-এর হাত থেকে ফোন কাড়ে টোপা। ওর হাতে এক্সপ্রেস স্পীডে স্ক্রীনে শাঁ শাঁ ছুটে চলে জারুলের চিত্তের বিচিত্র সব তাতা থৈয়া। বার্গার হাতে গদ্গদ্ জারুল, ম‍্যানহাটানের সম্পূর্ণ অজানা এক দুম্বো ব‍্যাগপ‍্যাকধারী যুবক, হাত জড়াজড়ি-লাঠি ঠোকাঠুকি আমেরিকান বুড়ো দম্পত্তি ফলোড বাই নাকে শিকনি নিয়ে আমেরিকান শিশুর তারস্বরে কান্না, মায় আমেরিকান চকোলেটের একটা র‍্যাপার আমেরিকার বাতাসে লাট খেয়ে ফুরফুর… ফুরফুর উড়ছে!

“অল্ বোগাস!” সোজা হয়ে উঠে বসে টোপা। “ইমেল করে দিই, এ তো রাত পুইয়ে যাবে নাম্বার খুঁজতে!” বলেই “ওহ্ মাই গড!” বলে লাফিয়ে ওঠে টোপা। তার চীৎকারে ছোট অংশু কেঁপে ওঠে। নিরুপমা পাশের ঘরে ঘুমের ঘোরে বলে ওঠেন, “কে রে? কে ওখানে?”

টিয়া তাড়াতাড়ি ফোন স্ক্রীনে ঝুঁকে দেখে একটা কাগজের বাক্সের খোপে বারোখানা হৃষ্টপুষ্ট ডিম! দিব‍্যি গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে। বুকে ক‍্যাপশানের বাহার — “আমেরিকান হাম্পটি ডাম্পটি!”

বিছানায় ফোন ফেলে টোপা জল খায়। টিয়ার হাতে ছুটে আসে স্ট‍্যাচু অব্ লিবার্টির পশ্চাদ্দেশ, অপেরা হাউসের মুণ্ডু, আমেরিকার ফুটপাথের অজস্র রেস্টোরাণ্টের একটি। তার নিরীহ টেবিল-চেয়ার, কল বেসিন, এমনকি হাতধোয়ার সাবানটা পর্য‍্যন্ত! “আহা আমেরিকান সাবানেরও কত ফুটেজ ভাগ‍্য!” ভাবে টিয়া।

“পেলে?” টোপার প্রশ্নে মাথা নাড়ে টিয়া। হঠাৎ একটা সংখ‍্যার ডিজিট দেখে টিয়া আহ্লাদে চেঁচায়, “পেয়েছি! উহ্ পেয়েছি!” শুনেই টোপা

“হ‍্যালেলুইয়া” বলে চীৎকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাটে। নিরুপমা এবার বেশ জোরেই হাঁকেন — “কে রে? কে ওখানে?”

এক মুহূর্তের আনন্দ চুপসে যায় টোপা-টিয়ার। এটা কিসের নাম্বার? টিয়া বলে, “দ‍্যাখ এর নীচে ক‍্যাপশানে লেখা — আণ্ডারওয়‍্যার টিউব!”

“হোয়াট?” টোপা ফোন কাড়ে। “সাল্লা-আ, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বেরিয়ে গেল আর মিডিয়ার তোতাগুলো কিস‍্যু জানতে পারল না?”

“হাঃ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হোঃ হে হে হে হে হে” — টোপার বিকট হাসির গমকে ছোট্ট অংশু ঘুমের ঘোরে ঠোঁট ফুলিয়ে দিল। টিয়া ব‍্যস্ত হল, “ধ‍্যাৎ! চুপ করোনা, অত হাসছ কেন!”

নিরুপমা ‘কে রে’ বলে হাঁক দিয়ে উঠতেই যাবেন টোপা আবার একপ্রস্থ হাসির গান ফায়ার দেগে বলল, “কি মাল মাইরি! হে হে হে হে, এই নাম্বারটা কিসের জানো? এটা কুইন্স থেকে ম‍্যানহাটান আণ্ডারগ্রাউণ্ডের টিউবের নাম্বার! কমিক ক‍্যারেকটার টাইপ করেছে আণ্ডারওয়া‍্যর টিউব! হো হো হো!”

এবার টিয়াও হেসে ফেলে। ছেলে বৌ-এর হাসাহাসি শুনে নিরুপমা আর ওদিকে মাড়ান না, শুয়ে পড়েন।

****

শালার ফোন কল পেয়ে পৃথিবীর অপর গোলার্ধে বসে পবন ভট্টের ঝাঁটা গোঁফ চারা মেরে ওঠে। প্রথমেই তিনি ফোনে ধরলেন সেক্রেটারি মদনকে। “কে? মদন? ডাক্তারবাবু বলছি।”

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বাড়িতে লুঙি পরেন পবন। আমেরিকাতেও নিয়ে গেছেন খান চার পাঁচ। এখন লুঙির উপর নাভির ফুটো চুলকাতে চুলকাতে পবন বললেন, “দিন দুয়েকের মধ‍্যে আমার শালা শাশুড়িকে নিয়ে কোলকাতায় পৌঁছবে। শালার ফোন পেলেই তুমি শাশুড়িকে ডক্টর সাঁতরার আণ্ডারে ভর্তি করিয়ে দেবে। ভবেশকে বলবে নিরুপমার ইন্সিওরেন্সের ব‍্যাপারে কাকপক্ষীকেও যেন টুঁ-টি না করে। রাখো।”

মদন তড়বড়িয়ে বলে, “স‍্যর, জিনিয়ার নাইট…” ফোন কেটে যায়। মদন চিন্তিত হয়। দিন দিন কেমন চোপসানো পাঁপড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা আর মদনের উপর বাড়ছে চাপ। অকালকুষ্মাণ্ড, নামর্দ ইত‍্যাদি বিশেষণযুক্ত বাছাই বাছাই পদ‍্যবাণে মদন ভীষ্মের শরশয‍্যায় আপাতত শায়িত।

“দেখুক পাড়াপড়শিতে কেমন মাছ গেঁথেছি বঁড়শিতে-এ-এ-এ-এ,” গুনগুনিয়ে গানের কলি ভেঁজে দুটো পেগ বানিয়ে আহ্লাদী সুরে স্ত্রীকে হাঁকেন পবন। “কই গো, এসো! পেগ ঠাণ্ডা মেরে গেল যে!” গ্লাসে চুমুক মেরে জারুলকে বললেন, “এবার টোপা বাবুকে একটা মেসেজ লেখো দিকি! মাকে নিয়ে যেন অ‍্যাজ সুন অ‍্যাজ পসিবল্ কোলকাতা উড়ে যায়। বল, ইন্সিওরেন্সের দালাল বলেছে অপারেশান পুণেতে হলে টাকা ক্লেইম করতে নানা ফ‍্যাচাং হতে পারে।”

আকাশ ছোঁয়া প্লেন ভাড়ার টাকা দিয়ে টিকিট কিনে সপরিবার মাকে নিয়ে কোলকাতায় হাজির হল টোপা। নিরুপমার অবস্থা তখন কাহিল। সারা রাস্তা বমি করতে করতে এসেছেন। পরদিন ভোরে টোপার ফোন পেয়ে মদন অ‍্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাজির। নিরুপমা ডক্টর সাঁতরার আণ্ডারে ভর্তি হয়ে গেলেন। হাসপাতালে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়ে টোপা যখন কপালের ঘাম মুছছে, ডক্টর সাঁতরা পেছন থেকে এসে পিঠ চাপড়ে বললেন, “আরে মশাই, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনার মা, আমার মা! হল?” এই প্রথম বুক ভরে শ্বাস নিল টোপা।

দুপুরে খেতে বসে টিয়া জিজ্ঞেস করল, “খরচাপাতি কেমন পড়বে গো?”

মাথা নাড়ে টোপা। “জানি না। তবে ভাববার কী আছে? দশ বছরের ওপর মায়ের তো তেমন বড় কিছু অপারেশান হয়নি, অসুখ-বিসুখও হয়নি। আমার তো মনে হয় পুরো খরচাটা ইন্সিওরেন্স থেকেই পাব। দেখি পবনদার ওই দালাল ভবেশ, সে কী বলে, ফুল কভারেজ হবে কি না!”

ভবেশকে টোপা পরদিন সকালে হাসপাতালে ঢুকতেই পেয়ে গেল। সে ভাবলেশহীন মুখে বলল, “ফুল কভারেজ? ক্ষেপেছেন স‍্যর? ওনার তো বেশি কিছু জমা নেই। আচ্ছা আমি দেখছি। স‍্যর আমেরিকা থেকে পরশু ফিরছেন, আপনি চাপ নেবেন না।”

চিন্তার ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠল টোপার মগজে। প্রিমিয়মগুলো জমা করা কি তাহলে কোন কাজের নয়! হাসপাতালের মেইন পার্কিং এরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করতে করতে হঠাৎ শুনল ফ‍্যাঁচফোঁচ আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পবনদার চিমসেপানা সেক্রেটারিটা একটা মেয়ের হাত ধরে ঝোলাঝুলি করছে — “মাইরি বলছি! মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে ডাব-চিনি মানত, কাল, না স‍্যরি পরশু স‍্যর এলে আমি একটা হেস্তনেস্ত করবই।” মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে নাক মুখ থেকে রুমাল সরাতেই চিনতে পারল টোপা। আরে, এ তো মা’র কেবিনের রাত্তিরের ICU-এর নার্সটা!

****

আমেরিকা ভ্রমণ সেরে সস্ত্রীক ফিরেছেন পবন। হাসপাতালের খবরাখবর নিতে হাজির হলেন বিকেলে। পিউ তখন ডিউটি সেরে সদ‍্য বেরচ্ছে, স‍্যরকে দেখে বিগলিত হেসে বলল, “কেমন ঘুরলেন স‍্যর?”

এদিক ওদিক চোরা নজর মেরে পিউয়ের গালের গোলে টোকা মেরে পবন বললেন, “বেশ! বেশ! এদিকে সব?”

পিউ মিচকি হেসে বলল, “ভালোই তো, তবে রাত্তিরের নিউজ রীতাদি, জিনিয়ারাই জানে।”

জিনিয়া নামটা পবনের মগজে ধাক্কা দিল একটু, কিন্তু কিছু ভাববার আগেই কোত্থেকে ধেয়ে এল ভবেশ। “এ কি স‍্যর! আপনি এখানে কী কচ্ছেন? আপনার শালা আপনাকে পাগলা কুত্তার মতন খুঁজ্জেন।”

ভেতরে ভেতরে কেঁপে গেলেও বাইরে সহজ গাম্ভীর্য‍্য ধরে রাখলেন পবন। “কেন?”

ভবেশ উত্তেজিত হয়ে গলার সুর মন্দ্রকে নামিয়ে বলল, “আপনার ইন্স্ট্রাকশান মত ইলিয়াস আজ অপারেশানের ফুল বিল ধরিয়েছে। পুরো এক লাখ আশি হাজার। আমার কাছে ইন্সিওরেন্সের কভারেজ নিয়ে গুনগুনাতে এসেছিল, আমি পোষ্কার বলে দিয়িছি মালকড়ি ফোক্কা। কিসু‍্য হবে না। ব‍্যস, শুনেই খাপখোলা তরোয়াল হয়ে খুঁজতে লেগেছ আপনাকে।”

“ওটা তলোয়ার,” বলে পবন ভেবলে যাওয়া ভবেশকে ফেলে লিফট ধরে সোজা চলে এলেন তিনতলার ICU-তে। এখানে ভিজিটারদের কড়া ব‍্যবস্থা। এখানে ঘাপটি মেরে থাকাই ভালো।

জারুলকে টেক্সট করলেন — “ডোণ্ট রিসিভ অর কমেণ্ট এনিথিং অ‍্যাবাউট ইন্সিওরেন্স টু টোপা।”

শাশুড়ির কেবিনে সেঁধিয়ে এসে পবন দেখলেন নিরুপমা ঘোরে ঘুমাচ্ছেন। রুমে কেউ নেই। তক্ষুনি কেবিনের পর্দাটা অল্প দুলে উঠলে পবনের বুক ছ‍্যাঁৎ করে উঠল। কে? দেখেন মদন। “তুমি?” বিরক্ত হয়ে বললেন।

“স‍্যর, আপনার শালা আপনাকে নীচে খুঁজছে।”

“সেই কথা বলতে তুমি তিন তলা ঠেঙিয়ে এলে?”

“আজ্ঞে না, স‍্যর।” মদন তড়িঘড়ি বলে, “আমি আপনার কাছে স‍্যর একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। জিনিয়া সিস্টার, মানে স‍্যর ওই রাত্তিরের নার্স, ICU-এর জিনিয়া…”

পবন অধৈর্য‍্য হন — “ওহ্ কুইক, মদন কুইক!”

মদন তুতলে বলে, “জিনিয়ার নাইট ডিউটির ব‍্যাপারটা যদি দেখতেন…”

“হবে! হবে!” হাত তুলে মদনকে থামিয়ে দেন পবন।

মদন তো হাঁ। হবে, হবে মানে! নীচে এইমাত্র জিনিয়ার সঙ্গে তুমুল একচোট হয়ে গেছে। রাখালের গরু খোঁজা খুঁজে বার করেছে সে পবন স‍্যরকে। মদন মরিয়া হয়ে তীব্র ভাবে বললে, “স‍্যর, আপনি ভুল করছেন…”

“বটে?” ততোধিক তীব্রতায় গম্ভীর হলেন পবন। ঝাঁটা গোঁফের ডগা কেঁপে উঠল তিরতির। চোখ রক্তবর্ণ হল। মদন ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল।

পবন মদনকে আর কিছুই কিন্তু বললেন না। রুমের পুবমুখো জালনার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধাপার মাঠের ফসলগুলোয় শীতের সূর্যের ম্লান আলো কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে। “ইনটুইশান কাকে বলে জানো?” হাসিমুখে মদনের দিকে ঘুরে দাঁড়ান পবন। মদন কী বলবে? চুপ থাকে।

এবার শাশুড়ির বেডের দিকে যেতে যেতে পবন গুনগুনান, “এ তো বড় রঙ্গ জাদু, এ তো বড় রঙ্গ!” দেখেশুনে মদনের চোখ ছানাবড়া। স‍্যরের হল কী! মদনকে উদ্দেশ‍্য করে পবন বললেন, “গাভাসকারের ব‍্যাটিং দেখেছ?”

মদন ঢক করে ঘাড় নাড়ে, হ‍্যাঁ।

শাশুড়িকে দেখিয়ে পবন বলেন, “এই ইনি এক্কেবারে সেই গাভাসকারের লেডি সংস্করণ! গাভাসকারের সেই বিখ‍্যাত ঠুক্ ঠুক্ ব‍্যাটিং ঠুকেই যাচ্ছেন! ঠুকেই যাচ্ছেন! তেরো বছর আগে একটা পাইলস্ অপারেশানের পরে এই এতগুলো বচ্ছরে শুধু হাঁচি কাশি আর বার দুয়েক পেচ্ছাপ ইনফেকশান ছাড়া আর কিচ্ছু না! ক‍্যান ইউ ইমাজিন?” মদনের দিকে চশমার ভেতর দিয়ে চোখ গোল গোল করে তাকান পবন।

মদন রীতিমত বিব্রত হয়ে বলে, “আসলে স‍্যর, মানে হয়েছে কি, জিনিয়ার নাইট ডিউটিটা…”

তড়পে ওঠেন পবন, “আঃ! নাইট ডিউটি! নাইট ডিউটি! বলছি তো সব হবে। তুমি এত উচাটন হচ্ছ কেন? পেসেন্স কাকে বলে জানো? শিখেছ কিছু? এই আমাকে দেখ।” বলে নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখান। “পাঁচ মাস আগের শুধু একটা চিনচিনে পেইন। সাথে বমির ভাব ফিরে ফিরে আসছে। শুনেই বুঝে গেলাম ধ্বংসময়ী ধেয়ে আসছেন। শ‍্যামা মাকে বললাম, নেচে নেচে আয় মা শ‍্যামা। বুঝলে হে? পাঁচমাস ধরে শাশুড়ির ওই পেইন, কমপ্লেন আর শালা এণ্ড কোং-কে ভুজুং ভাজুং দিয়ে সামলে রাখা, ইটস্ নট এ জোক! ইটস্ এ ব্রেন টুল! এত বছরের ইন্সিওরেন্সের অশ্বডিম্বমার্কা প্রিমিয়মগুলো এবার সোনার ডিম পাড়তে চলেছে। তাই আর যাকে খুশি ‘আপনি ভুল করছেন’ বলোগে, এ শর্মাকে ওসব বলতে এসো না।”

এক দমে কথা সারেন পবন। মদনের ঘটে পবনের কথা বাউন্স হয়ে ফেরে। ঠিক এই সময় নিরুপমা জড়িয়ে মড়িয়ে বলে ওঠেন, “জানি! জানি!”

প্রচণ্ড চমকে উঠলেন পবন। মদনও চমকাল কম নয়। দৌড়ে এসে শাশুড়ির নাকের তলায় আঙুল ঠেকিয়ে শ্বাস পরীক্ষা করতে গিয়ে পবন উরুর ধাক্কায় দিলেন উল্টে জলের গ্লাস। সেই গ্লাস তুলতে গিয়ে পবন-মদনের হল মাথা ঠোকাঠুকি। তক্ষুনি নিরুপমা আবার স্পষ্ট বললেন, “জানি! জানি!”

“মুভ! মুভ! কুইক!” বলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে মদনকে কেবিন থেকে বার করে দিতে গিয়ে পর্দায় পা আটকে পবন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এক মহিলার বুকে।

“তু… তুমি?” জিনিয়াকে দেখে মদনের কালঘাম ছুটল। পবনকে বুক থেকে টিকটিকির মতন ঝেড়ে ফেলে জিনিয়া গনগনে উষ্ম আঁচে বলল,

“চোরের সাক্ষী মাতাল, ছিঃ এই হেস্তনেস্ত তোর? ভাঙব মাথায় জোড়া কাঁঠাল, করছি তোড়জোড়!”

মদন তুতলে বলতে গেল যে সে এসবের কিছুই জানত না। পবনের কিন্তু জিনিয়ার শাসানিতে কোন হেলদোল দেখা গেল না। জিনিয়ার ধাক্কা খেয়ে মেঝে থেকে হাত পা ঝেড়ে উঠে গম্ভীর চিন্তামগ্ন হয়ে তিনি লিফটের দিকে চলে গেলেন।

তাঁর কানে শাশুড়ির ওই ‘জানি জানি’ আগুন শলাকার মতন গেঁথে রইল। কী জানে শাশুড়ি? কতটুকু জানে? কে জানাল? ভবেশ কি? চিন্তায় ভাবনায় খোকলা মাথায় রাত্তিরের বরাদ্দ দু পেগ সেদিন ছ’-য়ে দাঁড়াল। ফলে যা হবার তাই হল। থলথলে বুদ্ধি নিয়ে পবন টোপার বাইশতম ফোন কলটা রিসিভ করে ফেললেন।

“হ‍্যালো পবনদা!” টোপা চীৎকার করে বলল, “আরে, সারাদিন তোমার পাত্তাই পাওয়া গেল না!”

ফোনের এপারে পবন দোলেন। টোপা চিল্লায়, “শালার হাসপাতাল না কসাইখানা গো? একটা হার্নিয়া অপারেশানের বিল ধরিয়েছে কত জানো? এক লাখ আশি!”

পবন হেঁচকি তোলেন, “অঁক!” শুনে টোপা কিঞ্চিৎ নরম হয়ে বলে, “ভাবো একবার! তুমি আবার বেশি টেনশান নিও না শুনে, শালার দালালটাও টুপি পরানোর চেষ্টা করছে বুঝলে? কিন্তু আমার সঙ্গে পারবে না।”

ভবেশের উল্লেখে পবন ফোঁপান, “অঁফফ! ফুঃ উহুঁ!” টোপা এবার বিচলিত হয়ে বলে, “আরে বস, ঘাবড়াচ্ছ কেন?”

পবন ফুঁপিয়ে ওঠেন — “স্সালার দালালটা একটা বারোহাতি গামছা। আমার গলায় পোঁচ মারতে লেগেছে।”

পবনদার কান্না শুনে টোপা বেজায় ঘাবড়ায়। “পবনদা? আর ইউ অলরাইট?”

দারুণ অভিমানী গলায় পবন বলেন, “সালা সব জেনে নিয়ে সব জানিয়ে দিয়েছে।”

“কী জানে? কাকে জানিয়েছে?” টোপা অবাক।

“তার আমি কী জানি?” বলে ফোন কেটে গড়িয়ে পড়েন পবন।

****

ডিসানের মোড়ে হাসপাতাল চত্বর ছাড়িয়ে চা পান বিড়ি সিগারেটের দোকান। কোল্ড ড্রিঙ্কসও বিক্রি হয়। দোকানগুলোর পেছনে একটা বোজা বোজা সবজেটে জলা। অটোস্ট‍্যাণ্ড আছে। লোকে হাসপাতালে ঢুকতে বেরতে দোকানগুলোতে দু দণ্ড বসে। অটো ধরে, ছাড়ে। বেশ জমজমাট।

টোপা মা’কে দেখে গাড়ি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরতেই দেখে ভবেশটা এক মহিলার সাথে বসে চা খাচ্ছে। আরে, এই মহিলা সেদিন পবনদার সেক্রেটারিটার হাত ধরে ফ‍্যাঁচফ‍্যাঁচাচ্ছিল না! টোপা ভাড়া গাড়ি সাইডে করে গুঁড়ি পায়ে হেঁটে ক‍্যাঁক করে ধরে ফেলল ভবেশকে। “অ‍্যাই! ওঠ, ওঠ বলছি! চল, যা জানিস সব বলে দে। বল বলছি!”

আচমকা আক্রমণে ভবেশ কাতরে ওঠে — “স-স‍্যর, মাইরি বলছি, কী বলছেন? কী জানি স‍্যর?”

টোপা ধমকে বলে, “তার আমি কী জানি রে? জঁ-বাবু বলেছে তুই-ই সব জানিস। ভালোয় ভালোয় বলবি না পুলিশ ডাকব?”

পুলিশের কথায় পায়ে পড়ে যায় ভবেশ। জিনিয়ার মুখও শুকিয়ে এতটুকু। টোপার হাঁটু ধরে ভবেশ বলে, “স‍্যর, আপনার জঁ-বাবু যে কি যন্তর একখানা আপনি জানেন না। আমার স্কচের পাঁচ পাত্তি ‘হবে হবে’ বলে জঁক দিয়েছে বলে বলছি না, লোকটা সত‍্যিই ঘোড়েল।”

টোপার মনে সন্দেহ জাগলেও বাইরে কঠিন হয়। “তোর ওসব ভুজুং ভাজুং থানায় হবে। ওঠ, গাড়িতে ওঠ বলছি!” ভবেশের কব্জি ধরে টোপা।
এবার জিনিয়া এগিয়ে এসে হাতজোড় করে বলে, “স‍্যর, ভবেশ কী জানে আমি জানি না। তবে আমি যা জানি তা জানলে আপনার জঁ-বাবুকে আপনি নতুন করে জানতে পারবেন। আপনার হাতে একটু যদি সময় থাকে আমি সব খুলে বলতে পারি।”

টোপা কোন কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে ধরে। ভবেশ, জিনিয়া উঠে বসে গাড়িতে। টোপা গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে জিনিয়া আর ভবেশকে টোপার গাড়ির সওয়ারি হতে দেখে মদন সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগায় পবনকে। মদনের বুক ঈর্ষাতে আর রাগে ফেটে পড়ে। জিনিয়া যেন ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে।

****

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন নিরুপমা। জামাই-এর ড্রাইভার তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। হাসপাতালের ফাইনাল বিল পেইমেণ্ট করে মাকে রিলিজ করাতে টোপা যায়নি বলে জামাই আগ্নেয়গিরি হয়ে ছিল। পরদিন রাত্তিরে আয়লা ঝড় হয়ে মেয়ে-জামাই ঢুকল নিরুপমার বাড়ি।

ছেলে রাতদিনের আয়ার ব‍্যবস্থা আগে থেকেই করেছিল। সেদিন রাত্তিরে আয়া নিরুপমার পায়ে মালিশ দিচ্ছিল তখন। নিরুপমা শুয়েই ছিলেন।

পবন ঘরে ঢুকেই নিরুপমার দিকে আঙুল তুলে শাসাতে লাগলেন — “মালিশের আরাম তো খুব নিচ্ছেন, ছেলে কেন হাসপাতালে ডিসচার্জ করাতে যায়নি জিজ্ঞেস করেছিলেন? তা করবেন কেন? আপনার তো আবার হীরের টুকরো ছেলে। আর যত দায়ে ধরা পড়েছি আমরা। এক লপ্তে এক লাখ আশি হাজার শুধু আপনার মেয়ে গুনবে কেন? ছেলের দায় নেই?”

টোপা পাশের ঘরে নির্বিকার যেমন টিভি দেখছিল তেমনি দেখতে লাগল। নিরুপমা আয়ার সাহায‍্যে বিছানায় বালিশে ভর দিয়ে বসলেন।

জারুল তেড়ে এসে টোপাকে বলল, “তোর জামাইবাবুর একটা মান সম্মান নেই? তোর ফোন বন্ধ। টিয়া ফোন ধরছে না। হাসপাতাল থেকে ফোন করে করে আমরা হয়রান। ইয়ার্কি হচ্ছে?”

পবন নিরুপমাকে চীৎকার করে বলেন, “আর আপনি ভাববেন যে আমি জানি না যে আপনি সব জানেন!”

জামাইয়ের অভিযোগ শুনে নিরুপমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তা দেখে রাগে ফেটে পড়ে পবন জারুলকে ডেকে বলল, “কী রকম সেয়ানা মা দেখেছ? সব জানে, সবাইকে জানিয়েছে শুধু আমাদের জানাবার দরকার মনে করল না। বাঃ বাঃ! আমার গাড়ি চেপে দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় ঘুরবেন, ব্লাড প্রেশার মাপাবেন, ওষুধপত্তর নেবেন আবার আমাদেরই গলা কাটবেন?”

নিরুপমা শান্ত হয়ে বলেন, “কী জানি বাবা? তাই তো জানি না!”

“চোওওপ! বাবা বলা হচ্ছে! সব জানেন, আপনি সব জানেন!” লাফিয়ে ওঠেন পবন।

জারুল ততক্ষণে সারা বাড়ি “থুঃ থুঃ কি ঘেন্না!” বলে থুতু ছিটোতে লেগেছে। এ ঘর ও ঘর থুতু বৃষ্টি করে নিরুপমার ঘরে খাটে বসে দেদার থুতু ছিটিয়ে বলল, “এ বাড়ির জলও খাওয়া উচিত নয়!”

টিয়া ছোট্ট অংশুকে এসব থেকে আড়াল করতে বারান্দায় চলে যায়। টোপাকে নির্বিকার শান্ত বসে থাকতে দেখে পবন গর্জন করে ওঠেন — “আমার মান সম্মান সব নষ্ট করবি তুই? একটা রাস্তার ছেলে কোথাকার! কে তোকে তোল্লাই দিচ্ছে? ওই ভবেশ? তোদের মতন চাষাড়ে ভাগাড়ের শকুনকে আমি থোড়াই কেয়ার করি! কুকুর, শুয়োর সব!” টোপার দৃষ্টি টিভির পর্দায় স্থির।

“দু’ টাকার দালালকে হাত করে আমায় টপকাবি তুই?” হাতের তালুতে কিল মারতে মারতে ঘরময় পায়চারি করেন পবন। নেকাপড়া জানা শিক্ষিত বাবুদের কীর্তিকলাপ এতক্ষণে ফ‍্যালফেলিয়ে দেখছিল আয়াটা। তার দিকে চোখাচোখি হতেই তেড়ে আসেন পবন, “কি? তুমিও জানতে?” সে বেচারি তাড়াতাড়ি দেয়াল ধরে মেঝেয় থেবড়ে বসে পড়ল, “না বাবু! মাইরি বলতিচি, আমি কিচু জানিনি!”

নিরুপমার কাছে রান্নার কাজ করে শীতলা। বহু বছর ধরে আছে। নিরুপমাকে দিদা ডাকে। বড়দি আর জামাইবাবুর কাণ্ড দেখে সে আর রাগ সামলাতে পারল না। ডালের খুন্তি দিয়ে দিলে কড়াইয়ের গায়ে ঢং করে এক বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে পবন রান্নাঘরে হাজির। “তুমি তো জানবেই। তোমার দিদা জানে আর তুমি জানবে না! নাটের গুরু একটি তুমিও।”

শীতলা শীতল গলায় বলে দিল, “এই দেকো ঝামাইবাবু! আমারে ঝা বলার বল। অসুস্থ বুড়ো মানুষটারে তখন থে ডলতে নেগেছ ক‍্যানো?”

জারুলের ততক্ষণে আবার থুতু ছিটিয়ে ছিটিয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। সে রান্নাঘরে এসে বোতল থেকে কঁক কঁক করে কয়েক ঢোক ‘অশুদ্ধ’ জল গিলে শীতলার সঙ্গে পবনের রণনীতিটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল। কোন পক্ষই কিছু বলছে না দেখে সে চোখ পিটপিটিয়ে মধ‍্যম মার্গ নিয়ে পবনকে বলল, “চল তো, পাড়ার সব কটা বাড়ির দরজা ধাক্কিয়ে বলে আসি!” শুনে টোপার ঘর থেকে সে কি হাসি!

বৌ-এর এমন একটা কাঁচা সংলাপে পবনের সিচুয়েশনটা খানিক কাদায় পড়া হাতীর মতন হল। সে রক্তচক্ষু পাকিয়ে শীতলাকেই বলল, “নির্লজ্জ! বেহায়া মেয়ে লোক কোথাকার! আমার থেকে জ্বরের বড়ি, পাছার ফোঁড়ার মলম, আবার আমার উপর চোপা?”

“ছিঃ ছিঃ!” নাকে আঁচল চাপা দিল শীতলা। যেন পবনের গা থেকে ওই ক্রীমের দুর্গন্ধ আসছে। তারপর ফুটন্ত ডালে খুন্তি ঘুরিয়ে বলল, “এমুন ভাষা আমরা বস্তিতেও বলি নাকো। তুমি জামাই না ঝম্ গো?”

শাশুড়ির রাঁধুনির মুখের এত বাড়, শুনে রাগে দিশেহারা হয়ে পবন ডাইনে বাঁয়ে কোমর লচকে লচকে বলল, “ঝম্ ঝম্ ঝম্ ঝম্। কী করবি?”

ঠিক তখুনি সদর দিয়ে ঢুকে আসে জিনিয়া। জালনা দিয়ে তাকে ঢুকতে দেখে টোপা এগিয়ে আসে। পবনের দিকে চোখ পড়তে জিনিয়া কুণ্ঠিত হয়ে টোপাকে বলে, “স‍্যর, বাড়িতে পার্টি হচ্ছে বুঝি? সরি, না জানিয়ে এলাম। মাসিমা ওনার রোজ পড়ার গীতাটা ফেলে এসেছিলেন। ওটা আমি রেখেছিলাম নিজের কাছে। আজ আমার ছুটির দিন, তাই ভাবলাম মাসিমাকে দেখা করে দিয়ে যাই। তা এখানে দেখছি মাসির ফেরার আনন্দে নাচাগানা হচ্ছে!” পবনের দিকে তাকিয়ে বলল জিনিয়া।

মুচকি হেসে টোপা বলল, “তা একরকম হচ্ছে বৈকি! তুমি একদম রাইট টাইমে এসেছ।” টিয়াকে ডেকে টোপা বলল, “এ জিনিয়া। মা’র রাতের নার্স ছিল হাসপাতালে। খুব সেবাযত্ন করেছে।”

জারুল ঘুরঘুর করছিল সামনেই। তাকে ইশারায় ডেকে টোপা বলল, “তোর বর জাল ভালোই বিছিয়েছিল। তাতে আমি, মা, ভবেশের মতন চুনোপুঁটি সরপুঁটিরা ভালোই ধরা পড়েছিলাম। কিন্তু ঘাই মারল কে, বল তো?” উত্তরের অপেক্ষা না করে টোপা বলল, “থ‍্যানাটোফোবিয়া।”

জারুল ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “কী যা তা বকছিস?”

টোপা বলল, “থ‍্যানাটোফোবিয়া এমন এক সাংঘাতিক মানসিক অসুখ যেখানে মৃতু‍্যভয় পাথরের মতন চেপে বসে মানুষের মনে। আমাদের জিনিয়া এই রোগেরই শিকার।” জিনিয়া চুপ করে এসে দাঁড়ায় টিয়ার পাশে। “দিনের পর দিন তোর বরকে নাইট ডিউটি থেকে রেহাই দেওয়ার জন‍্য বলছিল জিনিয়া।”

এবার টোপার কথা টেনে বলে জিনিয়া, “রাতের ICU এক ভয়ঙ্কর জায়গা। ডাক্তার থাকে না। মৃতপ্রায় সব রোগী। এমার্জেন্সি হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দু সেকেণ্ডে সঠিক ডিসিশান না নিতে পারলে সব শেষ হয়ে যাবে। আমি আর পারছিলাম না। তবু স‍্যর আমার কোন কথা কানে নেননি। মাসিমাকে বলতাম মনের কথা। উনি মায়ের মতন ভালোবেসেছিলেন।”

পবনের মুখ ঝুলে গেছে। টোপা আর কথা না বাড়িয়ে জিনিয়াকে বলল, “তুমি ভেতরে চল, মা খুশি হবেন।”

জিনিয়া নিরুপমার ঘরে ঢুকল। নিরুপমা বলে উঠলেন, “জানি! জানি!”

সেই শুনেই পবনের মুখ দেখে মনে হল ভ‍্যাঁক করে কেঁদে ফেলবেন। নিরুপমা স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন জিনিয়ার মাথায়। সবাইকে এক পলক দেখে নিয়ে বললেন, “জানি! জিনিয়ার ডাক নাম। ভারি মিষ্টি, না?”

পবনের মাথা ঘুরে গেল।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: