মহালয়ার তিথি গত। মা এলেন বলে। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। আপনাদের কেনাকাটার বহর নিশ্চয়ই তুঙ্গে। প্যাণ্ডেলগুলোতে জোর কদমে কাজ চলছে। বড় তোড়জোড়। দর কষাকষির রশি নিয়ে দোকানগুলোতে ক্রেতা আর দোকানীর যুযুৎসু প্যাঁচ দেখার মতন। কে কাকে আড়াই প্যাঁচের জিলিপি খাওয়াবে তার ধান্ধা।
প্যাণ্ডেলের কর্মীরা দু’দণ্ড যে বিড়ি টানবে তার জো নেই। একদিকে ঢিবি হয়ে আছে চীনে বাদামের খোলা। প্যাণ্ডেলের অঙ্গসজ্জা হবে। টিফিন টাইম বলে আলাদা কিছু নেই ভেবে দু’ একটা খোলা ভেঙে ভেতরের বাদামের খোঁজ করতে না করতেই কর্মকর্তাদের দূত লেঠেল ব্যাটা হাজির।
“এই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ফুঁকফুক করছিস রে তোরা? শালা, আমার বলে নাক চুলকাবার সময় নেই, আর এই মালগুলোকে দেখো! আজ চীনেবাদামের দেওয়ালগুলো টেনে শেষ করবি, এই বলে দিলাম! মাত্তর আর একটা দিন পড়ে আচে মাঝে। লে, লে, চল, লাঙল তোল!”
এখন বাঙালীর জীবন কেবল পূজোময়। নতুন বৌ তার বরকে মুখ ভেংচে বললে, “সেই একই পুরনো স্টাইলের চুমু? পূজো স্পেশাল বলে তোমার ঘটে কিছু আছে কি?”
ক্যাবলা হেসে বর বললে, “শারদীয়া স্পেশাল? আই বাপস্! দেখব ’খন ঘট নেড়ে চেড়ে!”
শোভনা রান্না করতে করতে ভাবলো, তার মতন সংসারের জাঁতাকলে কে আর ফেঁসেছে? পূজোর কেনাকাটার ছুটি নিয়ে ঝি পর্য্যন্ত মুরুব্বি দেখালো আর তার ভাগ্য দেখ! মহালয়ার পুণ্য প্রাতে শ্বশুরের শখ জাগলো ‘মা’কে সাদা সাদা সোনালী করে ভাজা ফুলকো নুচি আর কচি নঙ্কার ফোড়নে আলুর ছক্কা খাওয়াবেন। এখনও নিয়ম করে ফি বচ্ছর তর্পণ করেন কি না! এখন কবেকার এক্সপায়ার্ড প্রডাক্ট শ্বশুরের মাতাঠাকুরাণীর জন্য কোমর বেঁকিয়ে লুচি ভাজো!
এদিকে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সবাই ফেসবুকের প্রফাইলে দুর্গার মুখ ছেপে দিলো! ফেসবুকের ওয়ালপেপারে শিউলি কাশের হুড়োহুড়ি লড়াই লেগেছে। আর তার কপালে? শুদু নুচি আর নঙ্কার নেত্য!
রং চটা ডাবর থেকে একটা বিরাশি শিক্কার পান বের করে মাখনবাবু ট বর্গে বলে উঠলেন, “টো ডা বলছিলাম, টারা বচ্ছর ডা বিক্কিরি হয় না এই টময় লাগিয়ে দিন!” পানের পিক ফেলে বললেন, “মশাই, গান থেকে কি বই! খালি খোলনলচেটাকে জব্বর রাখবেন। কভারে একখানা সোন্দরপানা নারীমূর্তির দু’ হাতে পদ্মফুল গুঁজে দেবেন। নারীর বাঁ কোমরে কাশ, ডান কোমরের খাঁজ বেয়ে সূয্যি উঠছে। মানে, সময়টা বোঝাচ্ছে সকালবেলা, বুইলেন? তাপ্পর লিখে দিন ‘শারদীয়া পূজা ইস্পিশাল’ — ব্যস্! কেল্লা ফতে! এই সময় বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সেণ্টিমেণ্ট থাকে হড়কা বাণের মতন। সেরকম যদি দেখনদারিখানা খেলিয়ে তুলতে পারেন, মাল হড্হড্ করে কেটে বেরিয়ে গেলো!” বলে আর একখানা গন্ধমাদন পান-পর্বত মুখের গর্তে চালান করলেন।
ঝি মানদা কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে চিল্লিয়ে উঠল, “অ বউদি, বলি তোমার আক্কেলটা কী, অ্যাঁ? পূজোর সময় এতো বাসন দিতি হয় মাজতে? বলি কদ্দিন এট্টু এধারে ওধারে খেলেও তো পারো বাপু!”
ভেতরে গিন্নী প্রমাদ গোনেন। যত বুড়ো হচ্ছেন কর্তার ভোজনরসে যেন হজমির আরক পড়েছে। কী দরকার ছিল, একদিনেই একেবারে চিংড়ি চিতলের মছলিবাবা হয়ে আহ্লাদ করার? তার উপর তেনার বন্ধুবান্ধবের আদি অন্তহীন চা-টা পর্ব তো আছেই। মরেছে, পূজোর সময় ঝি-হীন জীবন মানে জলহীন মীন অবস্থা। হে মা দুগ্গা, কৃপা করো মা! বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা হও মা গো!
“ওরে ও মানদাসুন্দরী!” মধুর হেসে গিন্নী বলেন, “বাছা, তোমার পূজোর বোনাসটা আমি আর কদ্দিন বুকে ধরে বইব বলো দিকিনি? না বাপু, আজ তোমাকে নিতেই হবে, এই বলে দিলুম, হ্যাঁ!”
মানদা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, “ঝা দেবে ঝানি তো! হুঁঃ তা দিও। বলি, শাড়ি একখান দেবে তো না কি?” তেল চুকচুক কড়ার পেছনে ছাই ঘষতে ঘষতে মানদা লাজুক হাসে। “এবার পূজোয় একখানা মটকা দিও তো বউদি!”
শুনে গিন্নীর ঘাড়ে ঝটকা লাগে। কাতর হয়ে মেয়ে রিনিকে বলে, “মানদা তো ঘাড় মটকাতে বাকি রেখেছে, কিছু একটা কর। নইলে পূজোর সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে গ্যাসের আগুনে ঘাম ফেলবি, এই বলে দিলুম। আজ বাদে কাল তোর পিসি এণ্ড কোং এল বলে!”
“ঘবরাও মত, মম্” বলে রিনি ফিল্ডে নামে। ফুরফুরিয়ে বলে, “মম্, মানদামাসিকে এবার পূজোর টপ্ ফ্যাশন ট্রেণ্ড শাড়ি কিনে দিও। আঃ, যা লাগবে না তোমাকে মাসি!” হাতের মুদ্রায় রিনি বোঝায় ‘আউটস্টাণ্ডিং’!
গিন্নী দাঁত কিড়মিড়ায়। এ মেয়ে না মীরজাফর? মানদা দাঁত কেলায়। “কী শাড়ি গো, দিদিমণি?”
রিনি ভ্রু তোলে কপালে। “ওম্মা, তাও জানো না? গামছা!”
“গ-গামছা?” গিন্নী আর মানদার চোখ ছানাবড়া। “হ্যাঁ, গামছা। আমিই তো কিনলাম ডিজাইনারের করা। গামছা শার্প ট্রাইপস্, গামছা ফ্লেয়ার্ড সিলুয়েটস্। দারুণ রোমাণ্টিক!”
মানদার দিকে চোখ নাচিয়ে রিনি বললো, “টিভি শো-তে পূজো পরিক্রমায় তোমাকেও দেখাতে পারে।”
“মরণ!” বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো মানদা।
আজ সকাল থেকেই ঘোষাল জায়ার মন কেমন করে। একমাত্র মেয়েটা বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়তে গেছে। সকালে ফোন করে বললেন, “গিনি, তোদের ওখেনেও কি চাদ্দিকে পূজো-পূজো গন্ধ?”
গিনি খ্যাঁক করে হেসে বললে, “নো মম্! এখানে চাদ্দিকে বড্ড সেক্সি সেক্সি গন্ধ। আহাম্, উহুম্… মম্, বুঝলে, আজ আমি ল্যাব থেকে তড়িঘড়ি রুমে এসেছি বিরিয়ানী রাঁধব বলে। কিছু ফ্রেণ্ডস্ আসবে। ওহ্ যা খুশবু বেরিয়েছে না! আমার বয়ফ্রেণ্ড তো গন্ধেই ল্যাদ খেয়ে গেছে! হি-হি-হি-হি-”
‘ল্যাদ খাওয়া’ কাকে বলে সেটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করবেন কি না ভাবছেন, রাজপুত্তুর নিজেই ষাঁড়ের মতন চিল্লিয়ে উঠলেন, “মা! অ মা! এই বিনিটা রোজ রোজ সাত সকালে আমার ঘরের ফ্যান বন্ধ করে দেয় ঝাড়ু দেওয়ার জন্য। কী ভেবেছোটা কী তোমরা, অ্যাঁ? পূজোর সময় একটু আরামসে ল্যাদ খেতেও পারব না?” উপর্যুপরি ল্যাদের ঘায়ে ঘোষাল জায়ার তখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা।
ইতিমধ্যে গলিপথে মহা শোরগোল পড়ে গেছে। রোজকার মতন হরেক মালওয়ালা হেঁকে যাচ্ছিল। দোষের মধ্যে সে বলেছে, “এ-ই— হরেক মাল দশ টাকা। পূজোর মাল দশ টাকা। গামলা-বালতি-চাদর দশ টাকা। আম-আমড়া-আচার, কিলিপ-ফিতে-কাঁটার দশ টাকা!”
এই শুনে জালনার কপাট খুলে চিমসেপানা মুখ বাড়িয়ে দত্তবাবু বলেছেন, “হতভাগা! হরেক মাল দশ টাকা? যত্তসব চোর বাজারের চোরাই মাল!”
দত্তবুড়োর নাতি দরজার পাশেই বসা মুচিকে দিয়ে জুতো সেলাই করাচ্ছিল। তার নতুন প্রেমিকা হয়েছে। পঞ্চমী টু দশমী কোলকাতা আপ ডাউন করতে হবে প্রেমিকাকে ঠাকুর দেখাতে। রাস্তায় জুতো পাংচার হলে প্রেস্টিজের আর কী বাকি থাকবে?
তো সেই মুচিকে শুনিয়ে হরেক মালওয়ালা বলে বসলে, “বাবুর দশ টাকার পূজা ইস্পিশাল মালে রাগ ধরছে, আর শ্যামবাজার মোড়ে ধেনো মালের ঠেকে দশ টাকা দিতে রাগ নাই!”
দত্তবুড়ো জালনার ওপারে তিড়িং বিড়িং করতে লাগলেন। মুচি বোধহয় হরেক মালকেই সমর্থন করে নাতিবাবুর জুতায় কষে দু’বার হাতুড়ি ঠুকে দিলে। মনে হল রায় দিলে — “অর্ডার! অর্ডার!”
পাড়ার প্যাণ্ডেলে বিটকেল সুরে বেজে উঠল, “আমার কাঁচা পিরিত পাড়ার লোকে পাকতে…এ দিলো না!” তাই শুনে ধূম্রলোচন আশুবাবু চা খেতে খেতে যেই গিন্নীর সাথে ইণ্টুমিণ্টু করতে গেছেন, গিন্নী ছ্যাঁকা মেরে বললেন, “আঃ! পূজোর সময় এতো রস কোত্থেকে আসে বুঝি না! ধেড়ে খোকা কোথাকার!”
তখনি দেখেন ঝাড়ু হাতে পাসোয়ান ঢুকছে খিড়কি ঝাঁট দিতে। হেঁকে বললেন, “অ্যাই জমাদার! কাল কিঁউ নেহীঁ আয়া?”
পাসোয়ান গম্ভীর চালে বললে, “কাল পূজা শপিং গিয়া থা মাঈজী।”
এদের সবার কাণ্ডকারখানা দেখে সোনা মামীমার বাগানের পদ্মগুলো পেট ফেটে হাসতে হাসতে ফুটে উঠলো। শিউলির হাসি আগেই ঝরে পড়েছে সবুজ ঘাসের গালিচায়। আকাশের গায়ে কোথাও আর মেঘ লেগে নেই। ওই দূরে ঘুরে ঘুরে ওড়া চিলটার বুকে লেগেছে সূর্য্যের সোনালী রং। সপ্তরঙা রামধনুর আভায় সন্তানের দিকে চেয়ে হাসছেন মা। তাঁর ধুলো কাদা মাখা সন্তান, জীবন খেলায় মত্ত সন্তান, দোষে-গুণের মায়াজালে থাকা সন্তান। মায়ের বড় প্রিয়। ভালোবাসার সন্তান।
কোথায় বাজছে এমন অপূর্ব মনকাড়া গান? সোনা মামীমার বাড়ির গ্রামোফোন কি? — “আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও, জননী এসেছে দ্বারে।”