মধুমাসের সর্বনাশ

ছোট থেকেই আলতারাণীর যেমন জাঁদরেল স্বভাব তেমনি বাঁজখাই গলা। তার খ‍্যাঁকখেঁকে স্বভাবের জন‍্য গাঁ-বস্তির সকলেই তাকে এড়িয়ে চলত। তার উপর ছিল গোদের ’পরে বিষফোঁড়ার মতন তার পুরুষবিদ্বেষ। মা তাকে শিখিয়েছিল পুরুষগুলো ড‍্যাকরার জাত। ওদের থেকে শ’ হাত দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।

এ হেন আলতার কিন্তু হঠাৎই বিয়ে হয়ে গেল কলকাতার এক নেতাবাবুর ড্রাইভারের সাথে। তখন চৈত্র মাস। নেতাবাবু আসন্ন ভোটের জন‍্য গলাবাজি করতে গাঁয়ে এসেছিলেন। তিনি ভোটভিক্ষায় বেরুলে গাঁয়ের আমলকিতলায় গাড়ি ভিড়িয়ে পুলিন বিড়ি ফুঁকত, চা খেত। যাতায়াতের পথে পুলিনের সাথে আলতার চার চোখের মিলনে মাহেন্দ্রক্ষণে কামদেব বাছা বাছা কিছু মোক্ষম তীর ছুঁড়েছিলেন। পুলিনের কার্তিকপানা চেহারা, শহুরে ভাবসাব, নেতাবাবুর ডেরাইভার — অতএব কেওড়াতলার বদলে পুলিন ছাদনাতলায় টপকে পড়ল। মধুমাসের সর্বনাশ তখন থেকেই শুরু।

Download this post in PDF format

if your browser doesn’t display Bangla script properly.

বিয়ের মাসখানেকের মাথায় পুলিন সহ গোটা বস্তি জেনে গিয়েছিল আলতা বাড়িতে যত কম সময় থাকে তাতে সবার মঙ্গল। তাই গোটা বস্তি উঠেপড়ে লাগল তাকে একটা মনোমত কাজ জুটিয়ে দিতে।

শেষে ত্রাণ নিয়ে এলেন নেতাবাবু। তাঁর কথামত এক সকালে আলতাকে নিয়ে পুলিন গেল পাড়ার কাউন্সিলারবাবুর কাছে। নেতাবাবুও ছিলেন সেখানে। আলতাকে দেখিয়ে বললেন, “তোমার ননস্টপ ন‍্যাস্টি টীমের হেডনী হতে পারে এ! নিয়ে নাও!”

বাবুর মুখে ‘ইনজিরি’ শুনে আলতার কেমন সন্দ হল। সে ক‍্যাটক‍্যাটিয়ে বলল, “কাজটা কী, বাবু? ঝেড়ে কাশুন তো!”

গলা শুনে কাউন্সিলারের সত‍্যিই বিষম লাগল। তিনি কোনোমতে ইশারা করে বল্লেন, বোসো!

অবশেষে জানা গেল কাজটা একধরণের বাচিকশিল্প। থিম্ বেসড্ ঝগড়া করতে হবে। শুনে তো পুলিন হাঁ। আলতা অবিশ‍্যি বেশ মন দিয়ে শুনতে লাগল। “দ‍্যাখো বাপু, আমার কাছে নিত‍্যিদিন হাজারটা অভিযোগ অনুযোগ আসে। সব জায়গায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যে সব কাজে মুখের দু-চারটে চোপাই যথেষ্ট সেই সব কাজে আমার তৈরী ননস্টপ ন‍্যাস্টির সদস‍্যরা, মানে তোমরা যাবে। সেখেনে গিয়ে প্রতিপক্ষকে একেবারে কথার তোড়ে কুপোকাত করে ফেলবে। ঝগড়া হতে হবে থিম্ বেসড্, ফোকাস্ড এবং মারকাটারি। প্রত‍্যেকদিন এসে নতুন থিম পেয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে লেসন প্ল‍্যান বানিয়ে নেবে মগজে এবং স্পটে গিয়ে গান ফায়ার দাগবে। বুঝেছ?”

হৈ হৈ করে নেমে পড়ল আলতা। প্রথম প্রথম হালকা অ‍্যাসাইনমেণ্ট। কোন বাবুর নালিশ, তাঁর পড়শি বাড়ির বৌ রোজ তাঁরই সদরদরজায় কুকুর হাগায়। কারও আবার মাথায় বাজ, সামনে বাড়ির ধেড়ে মেয়ে শুধু সায়া বেলাউজ পরে ঘোরে, ঘরে জোয়ান ছেলে! কারও সাধের বাগানের পেঁপে পেয়ারা টমেটো লঙ্কা গাছে যেন হরির লুঠ লেগেছে। আলতাও অকুস্থলে পৌঁছে যার যেমন দাওয়াই, তাকে তার মোক্ষম বাড়ি দিত।

ধীরে ধীরে কাজের গুরুত্ব বাড়তে থাকল। তখন ক্লায়েণ্টেরা কেউ প্রমোটার, কেউ বেওসাদার, কেউ বিরোধী পার্টির ত‍্যাঁদোড় লোক। আলতার নাম ডাক বাড়ল। ট‍্যাঁকে ট‍্যাকা আসতে লাগল। ঘরে বাইরে খাতির বাড়ল। পুলিন তো কবেই শখ আহ্লাদ প্রেম পিরীতির ঘরে আগল দিয়েছে। সর্বক্ষণ আলতার মতে মতি দিতে দিতে সে ক্লান্ত। তার উপর আলতার সেবাযত্নের পান থেকে চুন খসলে সেদিন গোটা পাড়ায় চার রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়।

“আমার গার্গলের গরম জলে নুন দিসনি?”

“মিনসে, কত্তবার বলিচি তরকারিতে কম করেও আধ ডজন নঙ্কা দিবি! নঙ্কার ঝালে গলার তার খোলে তা জানিসনি?”

“ড‍্যাকরা, ভেড়ুয়া, মিটমিটে!”

মাস ছয়েক পরের কথা। সকালে কাউন্সিলারের ঘরে ঢুকে আলতা দেখে নেতাবাবু বসে। গভীর ষড়যন্ত্রের সুরে নেতাবাবু বললেন, “আলতা, আজ আমার ঘরের আব্রু বাঁচাতে আমি তোমার কাছে ছুটে এসিচি। আমার ঘোর সন্দেহ হচ্ছে যে তোমাদের বৌদিদির চামচে জুটেছে।”

জিভ বার করে আলতা মা কালী হল। বাবু বললেন, “তোমাকে সেই চামচার হ‍্যাণ্ডেল ভেঙে দিয়ে আসতে হবে। বাছাধন বুঝুক, কার বাড়ির বৌকে সে গেলার হিম্মত করেছিল!”

কাউন্সিলার আশ্বাস দিয়ে বললেন, “স‍্যর, আপনি কিছু ভাববেন না। আলতা আমার বাহিনীর গোলন্দাজ!”

নেতাবাবু বললেন, “ফেউ বলছে ওরা এখন দুটিতে বাইপাসের ধারে চিংড়ি ভেড়ির জলে পা ডুবিয়ে খিলখিলাচ্ছে!”

আলতা ভাঁটার মতন চোখ ঘুরিয়ে বলল, “খিলখিলাচ্ছি ব‍্যাটাচ্ছেলেকে!” তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। নেতাবাবু আর কাউন্সিলার চোখ তাকাতাকি করে অন‍্য আর একটি গাড়িতে চেপে বসলেন।

ভেড়িতে পৌঁছে আলতার চোখ কপালে উঠে গেল। লাল ঘোমটা টানা মহিলার পাশে কে ও? এ যে পুলিন গো! “তবে রে ব‍্যাটা! চামচিকে! চিমড়েপটাস!”

আলতার চীৎকার শুনে লাল শাড়ির কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে পুলিন কোঁকাল, “তু… তু… মি?”

“হ‍্যাঁ রে হতচ্ছাড়া, হাড়গিলে! এই দ‍্যাখ তোর পাঁজরগুলো এবার পাটকাঠির মতন কেমন পটাপট ভাঙি!” বলে আলতা যেমন এক লাফ দিয়েছে, পুলিন সোজা ঝপাং ঝাঁপ জলে।

আলতা শিকার ফস্কে একেবারে হতভম্ব। স্থলচর শত্রু তার থাবা থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না। কিন্তু জলচর? সে তো সাঁতারই জানে না।

পাড়ে দাঁড়িয়ে বিস্তর গলাবাজি করতে লাগল আলতা। পুলিন ততক্ষণে সাঁতরে অন‍্য পাড়ে।

ভেড়ির ওপারে বড় রাস্তায় একটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল পুলিন। জালনার কাঁচ নেমে এল নীচে। নেতাবাবু একটা জামার প‍্যাকেট, টাকাপয়সা দিয়ে বললেন, “মুম্বইয়ের টিকিট আছে। সোজা স্টেশন চলে যা। আমি তাড়াতাড়ি ওদিকে যাই। এই গরমে ঘোমটা দিয়ে বসে থেকে এতক্ষণ রাঁধুনিটার ভিরমি না লাগে!”

পুলিন শুধু বললে, “বাবু!”

নেতাবাবু হেসে বললেন, “যা রে ব‍্যাটা! রাখে কেষ্ট মারে কে! তবে দেখিস মধুমাসের সর্বনাশে আর পড়িসনি যেন বাপ!”

কাউন্সিলার আর নেতাবাবু হো হো হেসে গাড়ি ঘোরালেন।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

1 comment
Add Your Reply