(ছবি : কিশোর বিট)

অমৃতের পুত্র

গৃহস্থবাড়ির এক রবিবারের দুপুরবেলা। মনোবীণার জীবনে কিন্তু আর পাঁচটা দিনের থেকে কত আলাদা! ছেলে আজ মায়ের পছন্দমত সব বাজার করেছে। ভরপুর আনন্দে দুটি দুটি খেয়ে বিছানায় সবে একটু গড়াচ্ছেন, ছেলে ঢুকল ঘরে।

“মা, তৈরী হয়ে নাও। চল, তোমাকে কালিন্দী ঘুরিয়ে আনি।”

বৃদ্ধার দু’ চোখে হাজার তারা বাতি। কতযুগ ছোট বোনকে দেখেননি! সংসারে ছেলে-বৌ-এর গালিগালাজ, ছেলের উদাসীনতা, নাতির রাগবিদ্রুপ বিরক্তি সহ‍্য করে পড়ে থাকেন। বোঝেন, সম্পর্কের স্বার্থের সুতো মলিন হয়েছে। আমাদের সব সম্পর্কই তো কমবেশী তাই। কাঁচাপাকের সুতোয় কাঁচা সেলাই। দু’ দিনেই নষ্ট। যাই হোক, পুরনো ভাবনাচিন্তা সরিয়ে রেখে মনের আনন্দে ছেলের পাশে গাড়িতে চেপে বসলেন মা। বহুপথ পার হয়ে গাড়ি চলেছে। শহর কলকাতায় এই ঢুকল বলে। মনে মনে ভাবছেন ছেলেকে একটু মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দেবেন কি না। সেই বহুযুগের ওপারে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর মতন।

Download this post in PDF format

if your browser doesn’t display Bangla script properly.

হঠাৎ ছেলে বলল, “মা, সামনে বেশ টাটকা আপেল বিক্রি হচ্ছে। কিলোখানেক নিয়ে এস তো! আমি আর গাড়ি থেকে নামছি না।” বলে গাড়িটাকে রাস্তার ধারে দাঁড় করালো। সানন্দে নেমে গেলেন মনোবীণা। ভালই হয়েছে। তাড়াহুড়োয় মিষ্টি নেওয়া হয়নি। না হয় ফল নিয়েই বোনের বাড়ি যাবেন।

টাটকা লাল আপেল বেছে পলিথিনে ভরছেন, গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে দেখলেন তীব্র বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল ছেলের গাড়ি। তবে কি তেল ভরতে গেল? ধূ-ধূ পথের দিকে তাকিয়ে থলে হাতে নিয়ে আধঘণ্টা পার করে দিলেন। বেগতিক দেখে ফলওয়ালা টুল এনে দিল মা’জীকে বসতে।

দুপুর পার হয়ে এল বিকেল। ক্রমে সন্ধ‍্যে ঘনিয়ে রাত। ছেলে তো এল না! শহরের কিছুই চেনেন না বৃদ্ধা। জমাট বাঁধা আতঙ্ক, এক বুক কষ্ট, অবিশ্বাসের বেদনা আর প্রতারণার আঘাতে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। একটা আবর্জনার বস্তার মতন ছেলে যে তাঁকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই সত‍্যটা বুঝতে পারলেও মেনে নিতে পারলেন না।

ফলওয়ালা রহিম অনেক রাত্তিরে যোগাযোগ করতে পারল তার শালার সঙ্গে। সে এই এলাকায় রিক্সা চালায়। দু’জনে শলা পরামর্শ করে বৃদ্ধাকে স্থানীয় NGO-তে নিয়ে যায়। তারা যখন বৃদ্ধাকে দেখে তিনি তখন জমাট বাঁধা একখণ্ড পাথর। তারা তখন যোগাযোগ করে শহরের বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মনোনীল সমাদ্দারের সঙ্গে।

ডক্টর সমাদ্দারের মনোরোগীদের হোম ‘নীড় ছোট’-র বেশ সুখ‍্যাতি আছে শহরে। কিন্তু প্রথম একমাস তিনি মহিলাকে দিয়ে কোনো কথাই বলাতে পারেননি। স‍্যালাইন চলত। জ্ঞান হলে বুকফাটা কান্নায় গোটা হোমের আকাশ বাতাস থমথম করত। যখন বৃদ্ধাকে কিছু আলোর রাস্তা দেখাতে পারলেন বলে ডাক্তারবাবু ভাবছেন, তখন বৃদ্ধা নিজেই একদিন সব খুলে বললেন। তাঁর দুঃখে পাষাণ পাথরও বুঝি প্রাণ পাবে। ডক্টর সমাদ্দার ইস্তেহার দিলেন সব কটা কাগজে। বৃদ্ধাকে কিছু বললেন না।

দিন দুই পরে একটা ফোন এল। ডাক্তারবাবু শুনলেন মনোবীণার পুত্রের স্বীকারোক্তি। “আমাদের ছেলে বড় হচ্ছে, একটা আলাদা ঘরের ভীষণ দরকার। কদ্দিন আর দখল দিয়ে পড়ে থাকবে মা? আপনি যা করার করে নিন, আমার পক্ষে ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়।”

নিজের কানদুটো ঠিক শুনল তো? বিশ্বাস করতে পারলেন না ডাক্তারবাবু, একটা ঘরের দখলের জন‍্য কি না গর্ভধারিণী মা’-কে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল তারই সন্তান!

ভারী মন নিয়ে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ওনার ঘরে দরজায়। কোন মন্ত্রবলে মনোবীণা জানতে পারলেন সে আজও এক রহস‍্য। মলিন দুটো চোখ তুলে শুধোলেন, “খোকা ভাল আছে তো?”

সেই মর্মভেদী দৃষ্টির সামনে মিথ‍্যে বলতে পারলেন না ডাক্তারবাবু। তাঁর খোকা নিত‍্যদিনের পান-আহার-রমণে বেশ তোফাই আছে মনে হল, এ কথা জানালেন। মনোবীণা চোখ বন্ধ করে নিলেন।

ডাক্তারবাবু বৃদ্ধাকে অনেকবার বোঝাতে গিয়েছেন, শুধু শুধু কেন এই আত্মনিপীড়ন? অন‍্যের জঘন‍্য কৃতকর্মের বোঝা তিনি কেন বইবেন? কিন্তু মনোবীণা অনড়। তাঁর এক কথা — “খোকা তো অন‍্য নয়, সে আমার সন্তান! আমার ছেলে! গাছের ফল যদি খারাপ হয় তবে সেখানে ফলের কী দোষ? হয়তো মাটিই বাজে ছিল!”

ডাক্তারবাবু বিশ্বাস করেন মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক। মানুষের মাঝেই সুর অথবা অসুর। আর আমরা সবাই অমৃতের সন্তান। তবে ওনার মনে হয়, এমন অমৃতের পুত্র লাভ করার চেয়ে চিরকাল সন্তানহীন থাকা বাঞ্ছনীয়।

মনোবীণাকে কতবার রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ডাক্তারবাবু। “আপনার খোকা ওই দিন আপনাকে জবাই করার জন‍্য ভালমন্দ গিলিয়ে বার করে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা আপনি বোঝেন?”

কী দৃঢ়ভাবে তখন মনোবীণা বলেন, “কিন্তু আমি তো খাবারটুকু বড় তৃপ্তি করে খেয়েছি বাবা!”

এই বার্তালাপের সাতদিন পর মনোবীণা মারা যান। হোম থেকেই তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া হয়।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

3 comments
Add Your Reply