মনে রয় শব্দের বাজিকর

“আরে লাগ লাগ, লাগ লাগ, লাগ
আরে লাগ ভেল্কি লাগ!
শব্দবাজির বাজিখেলা, খেলছে জাঁবাজ শব্দবাজরা,
দ‍্যাখ বাবাজী দ‍্যাখ!
দেখরে খেলা, দেখ চালাকি, ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি
দ‍্যাখ দ‍্যাখ, দ‍্যাখ দ‍্যাখ, দ‍্যাখ!”

বইমেলা চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে বাঁজখাই গলার আমন্ত্রণ শুনে এক বাঁধানো মঞ্চের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি, হারুণ, মাঝখানে অল্ শেষে রসীদ, বোগদাদের খলিফ, জগলরের বাদশা নয়, দাঁড়িয়ে আছে ঝক্ঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক যুবক। বাঙালীর মশাই এমনিতেই ধৈর্য‍্য কম। তাই ব‍্যাপারখানা ঠিক কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই দেখি যুবক বলছে — “আমি হারুণ অল্ রসীদ। সত‍্যজিৎবাবু পাঠালেন। আমি একমেদ্বীতিয়ম বাজিকর! জী হাঁ। বল নিয়ে ভোজবাজি আমার, কিন্তু সে বল কিসের বলুন তো? — শব্দের! বাংলা ভাষা আজকাল হাঁসজারু, বকচ্ছপ। এই যে, এই যে দাদারা, দিদিরা, মাসিমা-মামারা বলুন দেখি, হাঁসজারু, বকচ্ছপ কী মূর্তি?”

Download this post in PDF format

if your browser doesn’t display Bangla script properly.

চতুর্দিকে জমা ভিড়ের মধ‍্যে চাপা হাসির গুঞ্জন উঠল। লোকে হাত ওঠালো আবার কেউ কেউ সটান হাটে হাঁড়ি ভাঙল, “বক আর কচ্ছপ! হাঁস আর সজারু!”

গোটা ব‍্যাপারটা বেশ মজার লাগলো। পায়ে পায়ে ভিড় ঠেলে এগোলুম। ছোকরা তখন সত‍্যজিৎ রায়ের ‘ফটিকচাঁদ’ গল্পের হারুণ অল্ রসীদ হয়ে মঞ্চে নেচে নেচে বলছে —

“কামবয় গুডবয় ব‍্যাডবয় ফ‍্যাটবয়
হ‍্যাটবয় কোটবয় দিস বয় দ‍্যাট বয়
কালিং অলবয়, অলবয় কালিং
কালিং কালিং কালিং কালিং
কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্।”

তারপর শুরু হল সে কী এক অসাধারণ শব্দ কল্পদ্রুম! দেড়ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর খেলা। কখনো বোর্ডে লিখে, কখনো মুখে বানিয়ে চললো অনন‍্য এক ভাষার খেলা। কখনো খেলার নাম লোপাট, কখনো পাল্টি, ছড়রা, কখনো খাবলি। আহা, যেন চট্পটে মশলাদার শব্দের পপ্কর্ণ ফাটছে দর্শককুলের মগজখোলায়। মেতে গেল জনতা। চলছে লোপাটের খেলা। শব্দ থেকে বর্ণ অদৃশ‍্য! আবার যথাযথ বর্ণ বসিয়ে অর্থযুক্ত শব্দ বানানোর খেলা। যেমন — খ দ স ম গ, বলুন দেখি এই বর্ণগুলোর লোপাটের কলকব্জাগুলো জুড়ে কী হবে? “খাদ‍্যসমগ্র!” অনেকেই চেঁচাল।

এবার, ম হ র হ। “মহীরুহ?” নিজের হেঁড়ে গলায় নিজেই চমকালুম। মঞ্চ থেকে এল উৎসাহের করতালি। লোপাটের শব্দের অঙ্গপ্রত‍্যঙ্গ খোঁজার ধূম পড়ে গেল। য থ থ? “যথার্থ!” প শ ব ক ত? “পাশবিকতা!”

তাক লেগে গেল। এবার এল খাবলির খেলা। “একটা জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবলে নেওয়া হয়েছে। বলুন তো প্রবাদটি কী!” মঞ্চ থেকে আহ্বান এল। বোর্ডে লেখা হল — র — চা — — তে — ড়ে।” ক্ষণকাল সব নিশ্চুপ। শেষে এক মহিলা কণ্ঠে যখন উত্তর এল, “পুরনো চাল ভাতে বাড়ে” তখন উল্লাসের জোয়ার বয়ে গেল। এমন মজাদার চনমনে খেলায় সবার উৎসাহের চড়চড়ে পারদ। বোর্ডে এল নতুন খেলা ছড়রা। একটা বাংলা শব্দের অক্ষর আর চিহ্নগুলোকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। সঠিক জায়গায় সঠিক উত্তর বসিয়ে শব্দগুলো চিনে নিতে হবে। বেশ!

বোর্ডে লেখা হল ফ  ি  ল  া  ত  ি  গ। “বলুন?” গোঁফে চারা মেরে চিল্লালুম, “গফিলতি! গফিলতি!”

“ধুর মশায়, গফিলতির নিকুচি করেছে, আমার পা’টাকে যে মাড়িয়ে আলু বানালেন, সেই গফিলতির কী হবে শুনি?” এই সেরেছে, কোত্থেকে এক খেঁকুড়ে বৃদ্ধের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে গফিলতির ম‍্যাও সামলাতে না সামলাতেই পরের বাজি — ট  ত  ন  ক   ী    ূ  ি — বলুন? রব উঠল ‘কূটনৈতিক’ বলে। আমিও দেঁতো হেসে খেঁকুড়কে বললুম, “এই মানে, এই ধরণের কূটনৈতিক বিষয়ে আমরা পরে কথা বলি? ইয়ে, মানে, খেলা চলছে তো!”

খেঁকুড়ের অগ্নিদৃষ্টিবলয় থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালুম। মঞ্চের উপরে নীচে তখন বেজায় উত্তেজনা। হবে নাই বা কেন? বাঙালীর ঘিলু নাড়াবার মোক্ষম দাওয়াই ধাঁধার খেলা চলছে যে!

“দুই অক্ষরের নাম তার, প্রসিদ্ধ একটি গাছ / নামটি উল্টে দিলে পুঁতি চারা গাছ।”

‘বট’ ‘বট’ অনেকেই অবিশি‍্য বললে। পাল্টি খেলাটা এত মজাদার যে মজে গেলুম পুরামাত্রায়। সে খেলায় দেখি কিছু বাংলা শব্দের জায়গা পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক জায়গায় ঠিক অক্ষর বসিয়ে শব্দগুলো চিনে নিতে হবে। ছোকরা বললে, “যেমন উদাহরণ দিচ্ছি — বাপ, ররি — অর্থাৎ ‘পরিবার’!”

বোর্ডে লেখা হচ্ছে, ও কি! এ কি! কস্মিনকালে এমন বাংলা শব্দ না কানে শুনিচি, না চোখে দেখিচি! এ কি কোনো রহস‍্যময় তন্ত্রমন্ত্রের অলৌকিক মন্ত্রটন্ত্র না কি?

‘ভাইতি ডুচ চিন বর জী / খাছ নত্র জপ টিল’

বোঝ! সবাই দেখি পাল্টি খেয়ে মৌনব্রত ধরেছে। বেশ এট্টু লজ্জা হল। বাংলা সাহিত‍্যের একরকম অনুরাগী আমি। নয় নয় করে ক্লাসিক সাহিত‍্যাদি কিছু কম পড়িনি। বাসায় বইয়ের আলমারীতে ধুলো পড়তে সময় পায় না, আর আমার কি না এই বেহাল অবস্থা!

কর্মসূত্রে সাংবাদিক ছিলুম মশাই। কাগজে কাগজে খবরে খবরে জীবনপাত্র যখন উচ্ছলিয়া উঠল, দিলুম ছেড়ে সব। এখন বেশ আছি সংবাদাদির বিষবৃক্ষ থেকে দূরে। কিন্তু এই দু’দিনের উঠ্তি ছোঁড়ার কেরামতিতে হেরে গেলুম ভেবে মনে বড় দুঃখু হল। এহ্! বৃথা আমার সাহিত‍্যচর্চা, বৃথাই পুঁথিবনে ভোমরা হয়ে ঘোরা। নাহ্, ভেবে লাভ নেই, ওই কিম্ভূতকিমাকার অক্ষরগুলোই দায়ী। ওগুলো দেখেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। শুনি মঞ্চ থেকেই একটি অল্পবয়সী মেয়ে হেসে হেসে বলছে, “চড়ুইভাতি! তারপরেরগুলো চিরজীবন, ছত্রখান, জলপটি।”

নানা রকমারি আফশোষধ্বনিতে প্রাঙ্গণ ভরে উঠল। আমি এক অপ্রতিরোধ‍্য টান অনুভব করলুম ওই অল্পবয়সি ছেলেটার বুদ্ধিদীপ্ত ব‍্যক্তিত্বের প্রতি। ঘড়ি বলছে ছোকরা তিন ঘণ্টা সবাইকে এই এক জায়গায় মন্ত্রমুগ্ধের মতন দাঁড় করিয়ে খেলিয়েছে। তাও আবার কী নিয়ে, না, বাংলা ভাষা, শব্দ, ব‍্যাকরণ, এইসব মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে!

বই দেখা কেনা মাথায় উঠল। তড়িমড়ি এগোলুম আলাপ সারতে। আমার আলাপ করার আগ্রহে বোধকরি ইন্ধন যোগাল শীতের সন্ধ‍্যায় গরম কফির নেমন্তন্নের ডাকটা। আমি পেষায় সাংবাদিক (ছিলুম) শুনে ছেলেটা কফি নেমন্তন্ন এড়িয়ে গেল না। তার দলের দু’একজন সঙ্গীসাথীও চলল। সঙ্গে গাড়ি ছিলই, সদলবলে চলে এলাম আমার প্রিয় ক‍্যাফে ‘পিরীচ পেয়ালা’তে।

নাম বললে রয়। পেষায় রেডিও জকি। বাহবা! সাধে কি আর কথাবার্তায় মন্ত্রমুগ্ধ ছিলুম সবাই! বাগ্দেবী এ ছেলের বাকযন্ত্রটিতে যে আসনপিঁড়ি হয়েছেন তা বেশ বোঝা গেল। বেশ স্পেশাল এক এক কাপ কফির আদেশ করে রয়কে পাক্কা সাক্ষাতকারের চালে জিজ্ঞেস করলুম, “বাপু হে, তিন কুড়ি বয়েস পার আমার, এমন অভূতপূর্ব বাজির খেলা না কোথাও দেখিচি, না শুনিচি। কেমন করে এই শব্দবাজি খেলার নক্সা তোমার মাথায় এল, বল তো!”

“রেডিওতে জকির পেষায় আমার বছর দশেক হল,” বলল রয়। এর আগে টিভিতে ১৫ বছর সঞ্চালনা করেছি, বাণিজ‍্যিক সূত্রে ইতি উতি কিছু কাজও করেছি। এমন কি অভিনয়েও অভিজ্ঞতা আমার আছে। সৃজনশীল মানুষ তো!”

শব্দবাজি — এমন বেড়ে নামখানি!”

“হ‍্যাঁ,” আমার কথা কেটে রয় বলল, “তখন আমার কিই বা বয়েস। কুড়ি, একুশ। সেণ্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র। অবরে সবরে ফাঁক পেলেই শব্দের খেলা খেলতাম ইংরিজিতে। খেলতে খেলতে নেশা ধরে যেত। হঠাৎ এক দিন মনে খটকা লাগল, আচ্ছা, এমন জাঁদরেল শব্দের খেলা বাংলা ভাষাতেও কি আছে? খুঁজেপেতে দেখে হতাশ হতে হল। ইংরিজি শব্দের খেলা অ‍্যানাগ্রাম, স্ক্রাবল, জাম্বল, ক্রসওয়ার্ড — এসবের কোন পরিপূরক বাংলায় পেলাম না। যা পেলাম, তা হল শব্দছক তৈরী করা, ধাঁধা এই সব।

“আমার ওই বয়সেই ছিল পড়ার নেশা।” কফিতে চুমুক মেরে রয় বলল। “বাংলা সাহিত‍্যে বুদ্ধিমতার খুব অভাব। আমার প্রিয় ছিল দাদাঠাকুরের লেখা। তাতে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ছড়া ধাঁধার খোঁজ পেলাম। তখন মাথায় একটা ধারণা এল। অ‍্যানাগ্রাম, জাম্বলের মতন আমি নিজেই তো বানাতে পারি বাংলা শব্দের খেলা। রাতারাতি অক্সফোর্ড থেকে কিনে আনলাম শব্দ খেলার উপর বইপত্র। শব্দ খেলার জগৎটা সাতরঙা রামধনুর পালক মেলে উঠল আমার চোখের সামনে।

“উৎসাহের চোটে আমার তৈরি করা কিছু শব্দের খেলা নিয়ে হাজির হলাম ছোটদের এক জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের দপ্তরে। কিন্তু তিনি খেলাগুলোর যথার্থতা বিচারে পাঠিয়ে দিলেন এক প্রখ‍্যাত বৈয়াকরণের শুদ্ধ ব‍্যাকরণ নৈয়মিক নির্ধারণের কাঠগড়ায়। ফেল হলাম। তাঁর বিচারে এসব খেলা বাল‍্যখিল‍্য। এতে মানুষের ব‍্যাকরণগত শিক্ষার সম্ভাবনা শূন‍্য।

“রোখ চেপে গেল। নিজেই শব্দের খেলা বানাবো, এমন জেদ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। ২০০৮ সাল অবধি অনেকগুলো খেলা বানিয়েও ফেললাম। দেখলাম বাংলা ভাষায় বর্ণ আছে দুপ্রকার। স্বরবর্ণ, ব‍্যঞ্জনবর্ণ আর আছে ি     ী    ু    ূ  ইত‍্যাদির মতন মাত্রা। শুরু করলাম মাঝাই নামের খেলা। দুটো শব্দের মাঝে শূন‍্যস্থানে এমন শব্দ বসাতে হবে যার সাথে প্রথম ও শেষের শব্দ দুটো অর্থবহ হয়।”

“যেমন?” রয়ের কথার স্রোতে ধাক্কা দিয়ে বলি।

“যেমন ধরুন, যদি বলি ‘আয় — দাতা’। মাঝের শূন‍্যস্থানে এমন কী শব্দ বসতে পারে যা প্রথম ও শেষ শব্দের সাথে অর্থবহ হয়?” রয় কফিতে দীর্ঘ চুমুক দিলো। ততক্ষণে আঁতিপাতি ভেবে বের করে ফেললুম ‘কর’ শব্দটা। উৎসাহ নিয়ে বললুম, “এ আর এমন কী হে! ‘কর’ — ‘আয় — কর — দাতা’। ‘আয়কর’ একটা শব্দ, অন‍্যটা ‘করদাতা’।”

খুশী হল রয়। দেখলাম তার সঙ্গীসাথীদের মুখও উজ্জ্বল। “ঠিক এমনিই হতে পারে ‘সুল তান পুরা’।” রয় বোঝালো। “এটা অনেকটা ইংরিজি জাম্বলিং-এর খেলা। তবে স্ক্র‍্যাবলের মতন বাংলায় বোর্ডগেম খেলানো অসম্ভব, সেটাও বুঝলাম। কেন জানেন? পঞ্চাশটা বর্ণ, তা বাদে যুক্তাক্ষর, চিহ্ন সব মিলিয়ে তিন-চার শ’ ঘুঁটি লাগবে। সব ঘেঁটে ঘ হবে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। তাই আনলাম বর্ণ বিশ্লেষণের খেলা।

“আপনি তখন শব্দবাজি নামের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না, সত‍্যিই এই ধারণাটা বাজির মতনই হাজার হাজার মানুষের মনে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে, জানেন! আর এই বাজির খেলায় দূষণ ছড়ায় না, দূষণ কমায়। ভাষার দূষণ, শব্দ দূষণ, বানান দূষণ! ২০১০ সাল থেকে রেডিওতে নিয়মিত আমরা এই খেলা শুরু করি ‘মনে রয়’ নাম দিয়ে। সেখানে শব্দবাজির খেলা শুরু করি। লোকে রীতিমত খেয়েছে।”

ভড়কে বললুম, “খেয়েছে কী হে?”

রয়ের স‍্যাঙাত দেবপ্রিয়া নামের মেয়েটি বলে উঠল, “মানে, খেলেছে।”

রয় খেই ধরে — “আপনাকে কী বলব, মাধ‍্যমিক পরীক্ষার্থী পড়তে পড়তে খেলেছে মগজে পুঁথিপড়া বিদ‍্যের জট ছাড়াতে, তাঁতীরা তাঁত বুনতে বুনতে খেলেছেন, এয়ারো আস্ট্রো এঞ্জিনীয়ার রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে খেলেছেন। তাঁরা সরাসরি কথায় জানিয়েছেন যে এই শব্দবাজির খেলা তাঁদের মনে কী বিপুল এক তাজা হাওয়ার ঝলক এনে দিয়েছে। দৈনন্দিন কাজের চাপের গতানুগতিকতায় ক্লান্তি আমাদের বুদ্ধির উপর পলির মতন জমতে থাকে। এই শব্দবাজির মাথা ঘামানোর উত্তাপে সব ক্লান্তি কর্পূরের মতন উপে যায়। মগজের ঘিলু একেবারে তরতাজা মনে হয় জানেন!”

বললুম, “তা বাপু, কারোর মগজ খুলে তো দেখিনি, তবে এটা জানি এই যুগে যেখানে বাংলার মতন একটা সর্বোৎকৃষ্ট ভাষা, যা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ভাষার বিচারে পাঁচ নম্বরে আছে, সেই ভাষার আজ কী কুৎসিৎ রূপ! যেমন বঙ্গসন্তানের মুখে তেমন লেখায়।”

রয় এবং তার সঙ্গীরা গম্ভীর হয়ে উঠল। “এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম। আমার দলে যে সদস‍্যরা আছে আমরা সবাই শব্দকর্মী। আমাদের জীবনে একমাত্র সাধনা বাংলা ভাষার  মূমুর্ষূ রূপে লাবণ‍্যের প্লাবণ আনা।” রয় আত্মমগ্ন হয়ে বলল। “আসলে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। আমাদের সন্তানরা গড়গড় করে দু’পাতা ইংরিজি বুলি কইলে আমাদের বাপ-মা’দের মুখ যেমন গর্জন তেলে চোবানো চকচকে হয়ে ওঠে তেমনি ‘এ আমার বাবা হচ্ছে’, ‘কথাবাত্তা’, ‘জন্মদিন মানাচ্ছি’ — এই সব বাংলা শুনে দাঁত কিড়মিড় না করে তারা বরং বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বলেন, ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না!’”

“হুমম্।” আমার তলানি কফিটুকু গলাধঃকরণ করে বললুম, “আবার সেই বটতলা সাহিত‍্যের নোংরা রুচি ফিরে এসেছে। নতুন আকারে নতুন মোড়কে। মোবাইল অ‍্যাপে ডাউনলোড করলেই হল। আজকাল ওই খেলাই খেলছে সব। নেতা মন্ত্রণাকক্ষে দেশোদ্ধারের ফাঁকে, ব‍্যবসায়ী ব‍্যবসার ডীলের ফোঁকরে, শিক্ষক শিক্ষাদানের ছলে চাতুরিতে! আজকাল মানুষের স্বচ্ছ ভাষাজ্ঞান, শেখার ইচ্ছে আগ্রহ আর আছে কি? আজ তো চারিদিকে দেখি ‘বন্ন বন্ন এ অরন্ন কালো’ (বন‍্য বন‍্য এ অরণ‍্য কালো)। মাত্রাহীনভাবে যেখানে সেখানে কায়াহীন স্রোতের ন‍্যায় চন্দ্রবিন্দুর ব‍্যবহার — ‘আমি স্বঁপনচারিণী’।  কেউ আবার দেখি লেখে — ‘আমার প্রেমিকা আগে আমার প্রাণনাথ কইতো, এখন অন্ন কাউরে কয়!’ সেদিন খবরের কাগজে এক বিজ্ঞাপন দেখলাম এক প্রসিদ্ধ প্রকাশনীর পুস্তক ‘পাপ্তিস্তান’ অমুক! ব‍্যাপার বোঝ!”

রয় কিন্তু দমল না। দৃপ্ত বিশ্বাসী স্বরে বলল, “না স‍্যর, এমন নিরাশার কথা বলবেন না। লোকে আমাদের সঙ্গে তিন-তিন চার-চার ঘণ্টা খেলছে এমন নজীরও আছে। শব্দবাজির খেলা নিয়ে কত জায়গায় ঘুরছি। কত স্কুল কলেজ, আবাসন, অফিস, মেলা। লোকের অদ্ভুত সাড়া পেয়েছি। শব্দবাজির খেলা এখন দশকর্মা ভাণ্ডারের মতন হরেক কিসিমের। আমরা মানুষকে শব্দবাজির খেলা খেলিয়ে অনেকের বাংলা বানান, শব্দের ব‍্যবহার, উচ্চারণ শুধরোচ্ছি। শব্দবাজির কাজ এখন বাংলা ভাষাটাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গর্বের করে তোলা। সহজ সহজ খেলার মাধ‍্যমে পৌঁছে দেওয়া আর নতুন যে শব্দগুলো বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ছে তা যেন অগাছার মতন মূল ভাষার প্রাণ নষ্ট না করে সেদিকে কড়া নজর রাখা।

“আমরা সাধারণ মানুষদের মধ‍্যে থেকেই ‘শব্দপুলিশ’ নির্বাচন করি যারা এই সব ভুল বানান খুঁজে পেতে তুলে আনেন। ‘শব্দবাজ’রা সে সব ভুল বানান মেরামত করেন। আর শুধু তো বানান নয়, ভাষায় বেনোজলের মতন বিদেশী শব্দ ঢুকে পাড় ভেঙে যায়। তাই বাঙালীর জন্মদিন ‘পালন করি’  না বলে, ‘মানাই’ বলা শেখে। ‘অপরূপ’ সুন্দরী না বলে ‘মারাত্মক’ সুন্দরী বলে। নেতিবাচক শব্দকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতন ব‍্যবহার করে। তাই ব‍্যাকরণের বাঁধ তো দরকার পাড়ভাঙা রোধ করতে। সারা দুনিয়ায় প্রায় ৩০ কোটি বাঙালীকে নিয়মিত শব্দের খেলা খেলিয়ে তাদের আপাদমস্তক বাঙালী করে রাখাই শব্দবাজির মূল কাজ।”

রয় দম নিতে জানে না। আসলে ওর কাজটা এত উত্তেজক আর গঠনমূলক যে ওর উত্তেজনার ভাব সততই ইউনিকর্ণ হয়ে ছুটছে। “২০১২ সালে রেডিওতে আমাকে সকালের শো করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সকালের শো-তে একঘণ্টা শব্দবাজি খেলাই। লোকের তো কতরকম নেশা থাকে। আমার শব্দবাজিই নেশা। রোজগারের অর্দ্ধেক টাকা এই খাতেই যায়। কোন কন‍্যা মালা দেবে জানি না, তবে আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে শব্দবাজির উন্নয়নে পিছুপা হব না। ২০১৩ সালে একটা মোবাইল অ‍্যাপ শুরু করি, বেশি বেশি করে লোকে যাতে খেলতে পারেন। বাংলায় শব্দের খেলা নিয়ে এমন অ‍্যাপ আপনি আর পাবেন না। শব্দ জাদুকর মীর এই অ‍্যাপের উদ্ঘাটন করেন। তবে ওই, সর্বঘটেই লক্ষ্মীর কৃপা লাগে। নতুবা সবই শুধু হিং টিং ছট!

“নিজের ঢাক আমি রেডিওতে ৯৪.৩ রেডিও ওয়ান-এ দেদার পেটাই সপ্তাহে ৬ দিন। দিনে ৫ ঘণ্টা, সকালের শো-তে। রেডিও আর শব্দবাজির বাইরে টিভিতে সঞ্চালনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা, অভিনয় — এসবও করি।”

“বাবা, তুমি যে দেখি জ‍্যাক অফ আল ট্রেড্স!” প্রশংসার চোখে দেখি এই উদ‍্যোগী যুবককে।

“না, না, স‍্যর, আমি একা নই। ৩০ জন জাঁবাজ শব্দবাজদের নিয়ে আমাদের দল। সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে কাজ করে চলেছি বাংলা ভাষার বহতা নদী থেকে অশুদ্ধ আবর্জনার মিশেল সরাবার। তাছাড়া পয়সাকড়ির ব‍্যাপারটাও ভাবতে হয়। বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকদের বোঝানো আমাদের কাজের গুরুত্ব। নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। বিদেশের বাঙালীদের কাছে এই খেলার ফায়দা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিদেশে বাঙালীদের ছেলেমেয়েরা যাতে ‘ম‍্যাগের কলে রোড হেশেচে/ ব‍্যাডাল গেচে টুটি,’ (মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি) আহা! অহো! করে রবীন্দ্রগীতির সত্তে পে সত্তা না করে, তার দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছি।”

পুরনোদিনের স্মৃতি মন্থন করে বললুম, “সেই এক যুগ ছিল কলকেতার বাবুরা একশো একশো নোটের পুঁটলিতে তামাক পুরে ধোঁওয়া খেতো, লক্কা পায়ার ওড়াতো, হুলো মেনির বে’তে হাজার টাকার বাজি ওড়াতো। আর এই তুমি কলির নবাবপুত্তুর নিজের সর্বস্ব শব্দবাজিতেই ওড়াচ্ছ!”

বিগলিত হেসে রয় নিজের বুকে হাত রেখে বলল, “হ‍্যাঁ স‍্যর। শব্দবাজি আমার শ্বাসপ্রশ্বাস যে! ভাবী বৌ-কেও বলে দেবো সতীন নিয়ে ঘর বাঁধতে পারলেই যেন সাত পাক ঘোরে।”

“বিদেশ থেকে কেমন সাড়াশব্দ পাচ্ছ? আমাদের দেশের প্রকল্পগুলো আবার বিদেশের মাটিতে স্বীকৃতি না পেলে দেশের মাটিতে লাগু হয় না। জানো বোধকরি, ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্র আগে ক‍্যান্ ফেস্টিভালে বাজিমাত করাতে দলে দলে লোক গিয়ে প্রেক্ষাগৃহে বসে হাপুস কেঁদে এসেছিল। তার আগে সত‍্যজিতবাবু মজা খালটিও কারও চোখে দেখেননি কো!”

রয় অমায়িক। “না, না, স‍্যর, কী যে বলেন! দেশের মানুষের অগাধ ভালোবাসা আর ভরসা যেমন পেয়েছি, পাচ্ছি, বিদেশেও আমাদের শব্দবাজির গ্রহণযোগ‍্যতা বাড়ছে। শব্দবাজির নানা খেলা নিয়ে ভবিষ‍্যতে আমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার কথা ভাবছি। বিদেশের বাঙালীদের কাছে শব্দবাজির খেলা তাদের দেশের শিকড়ের কাছাকাছি এনে দেবে, এই বিশ্বাস আমরা করাতে পারছি। কাজ এখনো প্রচুর বাকি। অন্লাইন অভিধানের কথা ভাবছি। মানুষের মধ‍্যে শব্দবাজি নিয়ে কৌতুহল, চাহিদা বাড়ছে। নতুন নতুন খেলার আগ্রহ বাড়ছে। ছোটদের এবং তরুণ তরুণীদের কাছে শব্দবাজি আরও আকর্ষক করার চেষ্টা চলছে।

“আচ্ছা, আপনি এত কিছু জানতে চাইলেন কেন? শুধু মেলা প্রাঙ্গনে আমাদের খেলায় মুগ্ধ হয়েছেন বলে? আমার তো তা মনে হয় না। আর আপনি যতই অবসরপ্রাপ্ত হোন, আপনাকে আমি চিনি। তাই এলাম, এত কথা হল। আপনি কি শব্দবাজির প্রচার করতে চান?”

রয়ের জিজ্ঞাসার ঘরে পূর্ণচ্ছেদের চিহ্ন দিয়ে উঠে পড়লুম। বললুম, “জানো তো, যে সয় সে রয়!” ওরা সবাই হাসিমুখে বিদায় নিলো। গোপনে বার করলুম ছোট্ট রেকডিং যন্তরখানা। বহু বছরের বদভ‍্যেস মশাই। চিত্তাকর্ষক কিছু বিষয় পেলেই হাত নিশপিশ করে এখনও। ইচ্ছে করে বিষয়টা হাজার হাজার পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। তবে কি না বয়েসের দোষ, স্মৃতিশক্তিতে ভরসা করা চলে না। আজই লিখবো রয়ের এই একান্ত সাক্ষাতকারের খসড়া আর কালই দেব পাঠিয়ে আমার সম্পাদক বন্ধুর কাছে।

শব্দবাজির ওয়েবসাইট
ফেসবুকে শব্দবাজির খবরাখবর রাখুন
শব্দবাজির ভিডিও দেখুন

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: