কুখ্যাত ডেনিশ সাইক্লোন উর্দের মতন আমার আপিস ঘরে সেঁধিয়ে এল সিসি। আমি কিছু বলার আগেই ধপাস করে সামনে রাখা চেয়ারে বসে, সোনালী সাদাটে চুলের জটাবুড়ির মতন ব্রহ্মতালুতে বাঁধা খোপাটা দুলিয়ে বলে উঠল, “Stort problem igen.” অর্থাৎ আবার সমস্যা।
আমি বিন্দুমাত্র নড়চড় না হয়ে কেবল কপালের গুটিকয় পেশী তুলে বললাম, “অহো! আবার?” তারপর সামনে রাখা কফি ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি এগিয়ে ধরে বললাম, “Afhjaelpning af alle spaendinger.” অর্থাৎ সব টেনশানের মোক্ষম দাওয়াই!
চুমুক মেরে সিসি বলল, “হারবার খুব সিরিয়াসলি ভাবছে আমাদের রিলেশানশিপটা নিয়ে। কিন্তু আমি এখনও কন্…”
“…ফিউশ্ড! তাই তো?” ওর মুখের কথা কাটি আমি। আসলে আমি জানি সিসির সমস্যাটা। এ তো আর আমাদের দেশের মতন সেই আম আঁটির ভেঁপু হাতে খেলে বেড়ানো খুকীকে পাঁজাকোলা করে তুলে “ওঠ ছুঁড়ি, তোর বে” বলে সংসার কলে জুতে দেওয়া নয়! পশ্চিমাদের জীবনে বিয়ে-শাদীর ব্যাপার মানে বিরাট মাপের সিরিয়াস কিছু ঘটনা। বোঝাপড়া, আত্মত্যাগ, বিশ্বাস, ভরসা, কর্তব্য — এক একটা শব্দ যেন কামান গোলার মতন আছড়ে পড়ে এদের বুকে। আর ততই এরা কনফিউশ্ড হয়ে ভাবতে বসে যে ‘আল্ ইজ্ ওয়েল’ যদি না হয়, তাহলে এত খরচ খরচা সবই তো ভোগে!
if your browser doesn’t display Bangla script properly.
সিসির প্রবলেমটাও এক্কেবারে তাই। প্রেমে ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতার অভাব। পান থেকে চুন খসলেই ওর মনে হয় দুনিয়াটা এবার রসাতলে যেতে বসেছে আর আমাকে ঠাউরেছে নোয়েলের বোট। যব মর্জি উঠে চড়ে বসলেই হল! অথচ আমি মশাই আদতে একজন কাউন্সেলার বই কিছু নই। আমার কাজকম্ম মানুষের মন নিয়ে। দেখুন, দেহ আর মন, এই নিয়েই মানুষের সত্তা। আমাদের দেশে, ওঃ থুড়ি, আমার পরিচয়টা দিই আপনাদের — আমি তারা সিং সিধু, B.Sc. (Hons), Therapeutic Counsellor. Ph D করেছি Riverside College, UK থেকে। ডেনমার্কের একটি শহরে প্রাকটিশনার।
হেঃ হেঃ হেঃ, ভাবছেন বাংলাটা এত ভালো আসে কি করে? ছিলাম অনেকদিন কর্মসূত্রে কলকত্তায়। তখনই এই সুইট ভাষার প্রেমে পড়ে শিখে নিয়েছি মশাই! হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম, আমাদের এশীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে ‘দেহ’-ই প্রধান। ‘মন’ পিছুওয়াড়ে কানা নর্দমা। দেহ মন্দির, মন বোঝা। বোঝো!
এসব দেশে ব্যাপারটা বিলকুল উল্টা। অর্থাৎ মন একশো ভাগ আস্কারা পায়। অবিশ্যি, ডেনিশরা দেহের যত্নে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে! জলহস্তীর মতন চেহারা কোটিতে গুটিক! এখন ব্যাপারটা হচ্ছে আমাদের এশীয়দের কাছে দেহ যেমন দেবালয়, এদের কাছে তেমনি মন! অতএব দু’ তরফেই ‘লগে রহো মুন্নাভাই’!
ওদেশে দেহপট সনে নটের ফ্যাচাং-এর শেষ নেই। শুভ্রতার ঝলক চাই। লাগাও ফেয়ারনেস ক্রীম, সোনা রুপোর গুঁড়োদার ফেসিয়াল, তা বাদে পেঁপে, পেয়ারা, কলা, শশার ক্বাথ রস দিয়ে ধোয়া মোছা মাজা চলছে তো চলছেই। দেবালয়ে শান্তি নেই। আজ ঘুষঘুষে জ্বর, কাল অলিন্দে অলিন্দে গাঁঠ ব্যথা, পরশু ভুক্তির বদহজমে গ্যাস, তরসু মুক্তির অভাবে কনস্টিপেশন — ফ্যাঁকড়া অনন্ত। চিকিচ্ছে এন্তার!
ফ্যাঁকড়া তেমনি এদেরও। আপিসে এক অপরিচিতের সঙ্গে রোজ কেন চোখাচোখি হল? অমুকবাবু কেন বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে খেজুরে আলাপ জুড়লো? তমুক কেন আমার গোবদা বাচ্চাকে দেখে অতিশয় গলে গলে পড়ল? আমার নতুন পাতানো ইণ্ডিয়ান ফ্রেণ্ডের বাড়িতে নেমন্তন্ন হাজিরার সময়টা বলেছে, কিন্তু কখন উঠতে হবে বলেনি! ওঃ য়েসু! আমার পাস্তা রাঁধার ক্যাসারোলটার ঢাকনাটা বড্ড গড়বড় করছে, নতুন কিনলে হয়, কিন্তু ইন্সিওরেন্স টাকা ভরবে তো? তা বাদে আরও আছে। আবহাওয়ার প্রভাব। হাঁ জী, ঠিক ধরেছেন। পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের এই দেশটাতে সূর্য্যের পক্ষপাতটা বেশ কম। ভয়াবহ শীত, দিন-রাত অন্ধকার, বরফ বৃষ্টি মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাই এসব দেশে আসতে হলে গ্রীষ্মে আসুন! নীল আকাশ, ফুল দল, রঙীন প্রজাপতি, মৌমাছি আর বাল্টিক সাগরের নির্মল হাওয়া, আঃ, প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তখন খেয়াল করে দেখেছি চেম্বারেও হাতে গোনা লোক আসে। হেঃ হেঃ, সব ব্যাটা গিয়ে ভেড়ে সমুদ্রের বালিয়ারিতে সূর্যস্নান করতে। মনের রোগ ফোগ তখন হাওয়া!
‘আমার মন না চায় এ ঘর বাঁধি লো কিশোরী।’ এ কি! লালনের ভাব ডেনিশ ছুঁড়ির ফোঁপানিতে! বাস্তবে ফিরি। গলার স্বরকে কিঞ্চিৎ নরম করে বলি, “সিসি, তোমার প্রবলেমটা কী? তুমি হারবারকে ভালো বাসো কি না?”
হাতের তেলো দুটো ফুলুরির মতন গোল্লা পাকিয়ে ঠোঁট চোখ কুঁচকে সিসি বলে উঠল সেই এক চর্বিত চর্বণ, “Jeg er sa forvirret!” অ্যাই আম সো কনফিউশ্ড!
“ধুত্তোর! তোর কনফিউশান গেছে তেল আনতে!” মনে মনে রাগ হলেও মুখে হাসি ধরে রাখি। কাঁহাতক সহ্য হয়! এই মেয়েটা আজ দু’ বছর হল এক হরবীরের পাল্লায় পড়েছে। বলা ভালো, জুটিয়েছে। হরবীর আর আমি পাঞ্জাব দা পুত্তর, এই সূত্র জানতে পেরে আমার চেম্বারে এই চন্দ্রিমার আবির্ভাব এক পক্ষে বারো বার হচ্ছে। গলায় হাজার ওয়াটের কনফিউশানের মালা! — “ট্যারা! তোমার তো ডেনিশ ওয়াইফ। অ্যাণ্ড্ বোথ্ অফ্ ইউ আর হ্যাপিলি ম্যারেড্ ফর থার্টি ইয়ারস্। ওয়াট্স্ দ্য রিয়েল পাঞ্চ? কাম্ অন্, টেল্ মী, টেল্ মী!”
আবার কখনো বলে, “ট্যারা! তোমার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হলে কী করো? কে অ্যাডজাস্টমেণ্ট বেশী করে? শুনেছি ইণ্ডিয়ানরা হুটহাট করে দরজা জানলা খোলার মতন যার তার বাড়ি যখন তখন চলে যায়? ওঃ য়েসু! সেভ্ মী! ডজ্ দ্যাট্ অলসো হ্যাপেন ইন ইওর হাউসহোল্ড?”
আজও যেই শুরু করতে গেছে, “আচ্ছা, ট্যারা! টেল মী…” আমি বাগড়া দিয়ে বললাম, “সিসি, ইটস্ এনাফ্! তুমি হারবারের সঙ্গে দু’ বছরে দুশোটা ডেট-এ গেছো, অ্যাণ্ড্ ইচ্ অফ্ দেম্ আর সাক্সেসফুল্, নয় কি?” ওহ! ডেনিশ ছেলেগুলো ডেট্ হিসেবে এক্কেবারে যা তা! কেউ নিমন্ত্রণ করবে ক্লাউন ক্লাবে, কেউ আবার সাইকেলের ওয়ার্কশপে। ওদের সাথে সময় কাটানো মানে পার্সে দুটো মাথা ধরার বড়ি রাখা।
ডেনিশ মৌটুসি চিন্তায় পড়ল। “সারপ্রাইজিংলি ইয়েস!”
“তবে?”
সিসি টিসু্যপেপারে নাক ঝেড়ে সিরিয়াস চোখে তাকালো। “ট্যারা, তুমি জানো, এটা কোনো চামড়ার রং বা ধর্ম বা জাতির ব্যাপার নয়, অলরাইট্?”
মাথা নাড়ি। “আমি জানি, তা নয়। তবে দ্বিধা কী? এগিয়ে পড়! আমার জীবনের অ্যাডজাস্টমেণ্টের উত্তরপত্রে নাম্বার দিয়ে দিয়ে আর কতদিন ট্রাপিজের খেলা খেলবে? আরে বাবা, ইটস্ অল্ আবাউট্ ওয়েডিং, পয়জনিং অর ইলেক্ট্রোকিউশন্ নয়!”
সিসি নিশ্চুপ বসে জালনা দিয়ে সুদূরে তাকালো। ওর চোখ ধরে আমিও। বসন্ত এসেছে বহুদিন। নীল আকাশ আরও নীল। জলভারহীন পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ। আমার চেম্বারের সামনে বেশ খানিকটা খোলা মাঠ। সবুজ ঘাস। দু’ চারটে আপেল গাছ। তাতে দেখি সাদা ফুল ধরেছে। দূরে দুটো চেরীফলের গাছ। গোলাপীফুলে ভরে উঠেছে তাদের শাখা প্রশাখা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কি নির্মল নিষ্পাপ রূপ! মনে পড়ল জাপানীদের সাকুরা উৎসব আসছে। চেরীগাছের গোলাপী-সাদা ফুলে ফুলে ভরে থাকবে উৎসব প্রাঙ্গণ। কত দেশের কত মানুষ সেই পুষ্পবিতানে এসে জড় হবে, আনন্দ করবে। অ্যাবেলোনি বলে রেখেছে যাবে বলে। অ্যাবি আমার গিন্নী। ফোটোগ্রাফির মেলা শখ। ওহ, নতুন বিয়ের পর হানিমুনে গেলাম আমাদের গ্রাম হোশিয়ারপুর জেলার খারৌডি। শর্ষের ক্ষেতে ক্যামেরা হাতে সফেদ বিদেশী দুলহনকে দেখতে মেলা লোক জমে গেল। মেঘের ওই রোদ ছায়ায় কত পুরনো কথা ভীড় করে মনে এলো…
আমার পরদাদার দাদাজী মহারাজা রণজীৎ সিং-এর আমলে ছিলেন তাঁর সেনাবাহিনীতে। মহারাজা তাঁকে জায়গীরদার করেন ফতেপুর আর খারৌডি এই দুই গ্রামের। গাওঁয়ের পাঁচটা লোকে সম্মান দিয়ে তাঁকে সর্দারজী বলে ডাকতো। ব্রিটিশ রাজ আসার আগে পর্য্যন্ত পুরা পরিবার রোটি-ঘিয়ে ছিল। শাদী বেহাতে বারাহ দিন রৌশন চৌকি, লাখো লাড্ডু। আর সে কি খুশবুদার! লোকে এক হপ্তা হাতে লাড্ডুর ঘি-এর গন্ধ পেতো।
আমার পিতাজী ছিলেন জাত চাষা। পরদাদা দাদার মতন অত রৌনক না থাকলেও খরিফে আর রবিতে চাষ জরুর দিত। আখ, বাজরা, জোয়ার, বার্লি, সর্ষে, সবজি, নানা রকমারি ফল। গোয়াল ভরা ভৈঁস গাই। বাড়িতে হরদম টাটকা ঘি, ননী, ছানার গন্ধ। দই এমন বানাতেন মা, সেই দইয়ের ভাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে খেলে কমবখ্ত গোঁফের চারা দুটো চিকনা হয়ে থাকত কমসে কম দেড় দিন। আহা!
“ট্যারা!” সিসির ডাকে স্বপ্নরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরলাম। “কী ভাবছ বসে?” সিসি শুধালো।
একগাল হেসে বললাম, “একযুগ হয়ে গেছে নাড়ির টান ঘুচেছে। কিন্তু দেখছিলাম স্মৃতির সুতো এখনও বেশ নাজুক। পাক খাচ্ছিলাম অতীতে। আমার গ্রাম, আমার স্কুল। যাক সে সব কথা…”
“না ট্যারা, প্লীজ্! আমাকে বলো, আমি শুনতে চাই।” সিসির জেদ। আমি কিন্তু কিন্তু করছিলাম। এসব দেশে কাউন্সেলিং-এর একট সেশন মানে বেশ কিছু অর্থব্যয়। সেখানে আমার ফেলে আসা দিনের ব্যাপারে জেনে সিসির কী সুরাহা? কিন্তু মেয়েটার জেদাজেদিতে বললাম আমার গল্প…
শিবালিক পাহাড়ের ঝর্ণাজল দেখতে পেতাম রোজ আট কিলোমিটার হেঁটে স্কুলপথে যেতে। অনেক ভোরে উঠতাম। আকাশের বুকে তখন কচি সূর্য্যের আলো খেলা। গুরুদ্বারে জপজী সাহিব মন্ত্রপাঠ শুরু হয়ে গেছে। মাহালপুরে ছিল স্কুল। খাকি জামা, খাকি প্যাণ্ট, খালি পায়ে ক্লাসে ঢুকতে হত। যার যার চাটাই পেতে খোলা আকাশে আম গাছের ঘন ছায়াতে পড়তে বসা। রং বেরং-এর পাগড়ি। গুলাবি, নীলা, পীলা, বৈগন। তাই দেখে ঠাহর হত কে কোন ক্লাসে পড়ে। ঘন ঝিম ধরা হলুদ দুপুরে ছুটি হয়ে যেত। পথে পড়তো বিরাট আমের বন। গরমে আমের বোলমুকুলের ঘ্রাণে মন পাড়ি দিত উদাস পথে। ছায়া ছায়া পথ, কিছু জঙ্গুলে, কয়েকটা খরগোস, হীরণ, কোয়েল। মাঝে মধ্যে একটা দুটো শেয়াল।
গ্রামের ছেলেরা যুবক হলেই অ্যায়সি ত্যায়সি করে জমিজমা বেচে পশ্চিমা পাড়ি দিত। গ্রীস, ইটালি, ইউ-কে, কানাডা। সেখানে হাড় ভাঙ্গা খাটনি খেটে গ্রামে টাকা পাঠাত। সেই টাকায় বুজুর্গদের জমিজমা কেনা, লাটসায়েবী।
আমাদের সামনে ছিল সিমরণ চাচিদের ঘর। এক গরমে চাচির দুই ছেলে পাড়ি দিল গ্রীসে। পরের শীতে চাচিদের নতুন লাল টালি, চিকনা শালিমার পেণ্ট! আমার মা’কে ডেকে হেঁকে চাচি কারণে অকারণে বলত, “গুরপ্রীত কৌরজী! তুসি কৈসি হো জী? আস্সি তো চাঙ্গে সি মৈনু! তুসি দাস্ দিও।”
মা ঘরে এসে দাঁত কামড়ে আমাকে শপথ করাতো এর বদলা নিতেই হবে।
শুনে সিসির চোখ গোল গোল হয়ে গেল। “তারপর?”
গাওঁয়ের পাঠ শেষ হলে শহরে গেলাম। তারপর ছুটকো ছাটকা কামকাজ করতে করতে কলকত্তা। সেখানে ছাপাখানায় বেশ কিছুদিন কাজ শিখলাম। মন তৃপ্ত হল না। যে ধাবাতে রাতে রুটি তড়কা খেতে যেতাম সেখানেই আলাপ হয়েছিল তেজবল কপুর, মাধো সিং, আজ্ঞাপাল-দের সঙ্গে। ওরা ছক কষছিল কলকত্তার পাট গুটিয়ে দেশের জমিজমা বেচে পশ্চিমে পাড়ি দেবে। কাজ যেমন তেমন। কুছ পরোয়া নেহী! আমাকে দলে টানতে চাইলো। বেঁকে বসলাম, “লিখাপড়া শিখেছি। কুলী মজদুরি পারবো না।” আজ্ঞাপাল বললে, “ভাই, তুমি আমাদের দু’ভাষীর কাম করে দাও, আমরা তোমার ভাগের কাম করে দেব, পৈসাও তোমার। রাজি?”
ভেসে পড়লাম। জার্মানী থেকে রোম। রোম থেকে ভিয়েনা। ভিয়েনা থেকে এই ডেনমার্ক। কুলীকামিনগিরিতে সুপার ফেল হয়ে বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো অবস্থায় পকেটের পাতি উপার্জন নিয়ে গুটি গুটি ভর্তি হলাম ভাষা শেখার ক্লাসে। সেখানেই অ্যাবির সঙ্গে আলাপ, প্রেম। ইউ-কে পাড়ি, কলেজের ডিগ্রী, স্বপ্নসাধন। মায়ের স্বপ্নপূরণ এবং আমার নটে গাছের মূলকর্তন!
সিসিকে কেমন আনমনা লাগলো। প্রেমে পড়লে এই হাট্টাকাট্টা বলিষ্ঠ মনের মেয়েগুলো কেন যে এমন হাতির কাদায় পড়া অবস্থা হয়ে যায় কে জানে! বলতে নেই, টাচ্ উড্, এই বয়সেও অ্যাবি রোজ দু’বার ছ’তলা সিড়ি এক দমে ওঠে, তাও আবার ওর বাহন সাইকেল ঘাড়ে করে। পাঁচ কিলোমিটার জগিং করে শীত গ্রীষ্ম নো ম্যাটার। কড়কড় মড়মড় করে চিকেনের হাড্ডি তোড়ে, খায়। বাপস্! সাধে কি আমি ঘরে ‘খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো’ হয়ে থাকতেই ভালোবাসি।
“ট্যারা!” সিসি ডাকে। “তুমি আর দেশে ভিজিট করো না?”
“নাঃ! কে আছে যে করবো? আমাদের গ্রাম এখন থুরথুরে বুড়োবুড়িদের গ্রাম। সবার ঘরে ঘরে একই চালিসাপাঠ। সবারই পুত্তররা বাইরে। কুড়িগুলো NRI বেহা করে পগার পার। তাদের টাকায় গাওঁতে এখন পাঁচটা গুরুদ্বার, বুঢাদের অনন্ত জমি, রঈসি, বাড়ি-গাড়ি। কিন্তু ভোগকরার না তাখত্ না নিজের লোক। আমি কবেই সব বেচেবুচে হাত ধুয়ে ফেলেছি।”
মেয়েটার শুকনো মুখ দেখে মায়া হল। ভরসা দেওয়ার সুরে বললাম, “সিসি, বিলীভ মী, হরবীর ইজ্ আ পারফেক্ট ম্যাচ ফর ইউ। যে তোমার খাতিরে নিজের নামের বলি দিয়েছে, সে আর যাই হোক তোমাকে ঠকাবে না। তাহলে ওয়েডিং-এর আদর্শ মাস জুন-এ মল্লিকা বনে প্রথম কুঁড়ি ফুটবে তো?”
আঁতকে উঠে সিসি বললো, “নাই, নাই, নাই! আই মাস্ট নীড সাম টাইম।”
অবশ্য আমি জানতাম ভবী সহজে ভোলবার নয়। কারণটা আর কিছুই নয়, মেল-ফিমেল ডেটিং এবং ম্যারেজ খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার এখেনে। মশাই প্রজাপতি হয়ে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ান যত মর্জি। বলেছি তো, নো প্রবলেম। কিন্তু সিরিয়াস রিলেশানশীপ তৈরী করা মানেই আপনাকে রীতিমত তৈরী হয়ে আখড়ায় নামতে হবে।
ডেনিশ ছুঁড়ি পটানো অত সহজ নয়। তবে, একবার পটে গেলে সেই একেবারে আর্থ টু আর্থ, অ্যাশেস্ টু অ্যাশেস্, ডাস্ট্ টু ডাস্ট্। মৃতু্য এসে আলাদা করবে, আর কেহ নয়!
এক কাজ করুন, আমি তো অনেক বকলাম। বাকিটা যান না, হরবীরকে জিজ্ঞেস করুন, সে বলবেখ’ন।
হরবীরের কথা
উঃ! এই ডেনিশ মেয়েগুলো যেন পেঁয়াজের খোসা। ছাড়াতে টাইম লাগে। কিন্তু সিসি তো নিজেই গড়িয়ে আমার স্যালাড প্লেটে এসেছিল। সিসির সাথে মুলাকাতের দিনটা কি ভোলার?
রোজকার কাজ সেরে হনহনিয়ে ফিরছিলাম মেস বাড়িতে কারণ মা না কি দশবার ফোন করেছে চাচার ফোনে, আমাকে না পেয়ে। খেয়াল করে চার্জ করিনি। চাচা দোকানে ফোন করে খাঁটি পঞ্জাব দা শের হয়ে যখন বলছিল, “তুসি কিথে হো? অ্যাঁই? কিথে অ তু?”
মেঁ, মেঁ করে বলার সুযোগ পেলে তো বলব? ততক্ষণে দোকানের সবার চোখ ছানাবড়া। মান ইজ্জত কিছু থাকল আর! আবার হুঙ্কার — “যাজ্যো তুসি গর পহুঁচ গয়ে তো দাঁসালি কল্ করিও।” হাজার বার মাকে বলেছি, “চাচা ঠ্যারিয়েছে বার্মিংহাম, ইংলণ্ডে। তুই আমার নাড়ির খোঁজ ওখানে কেন করিস?”
“ফটে মুহ্ তেরে! তাও তো তোরা কাছাকাছি আছিস!” মা’র নাছোড় জবাব। “দো ঘণ্টে ওয়াস্তা কিথে বড়ী বাত্? খুজা নাহি হ্যায়!” আচ্ছা! আর মাঝের ভিসা বাবাজী? তার ঘেঁটি না ধরলে কোনো সাগর পার হওয়া যায়! অথচ মা বুঝলে তো!
সিটি সেণ্টারে এমনিতেই ভীড় ভরা। তায় উইকেণ্ড। লোকে বাইরে খানাপিনা, মৌজ মস্তি করে। ডেনিশগুলো আবার ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে বেজায় ওস্তাদ ধূম্র আর তরল পানে। যস্মিন দেশে যদাচার! সেদিন সকালটা রোদ ঝলমল হলেও রাত্রে মেঘ বৃষ্টি ছিল। টিপিক্যাল মহিলাদের মুডের মতন এখানকার আবহাওয়াটা। খেই পাওয়া ভার। হঠাৎ পাশের গলি থেকে তা তা থৈ থৈ করতে করতে এক হুডিওয়ালা কুড়ি গায়ে এসে পড়লো।
দুজনেই চল্লিশবার অন্সকুণ্ড্ (“স্যরি”) বললেও সমাপতন কাণ্ড ওখানেই শেষ হল না। বরং তার শাখা গজালো। পরিচয়ের শাখা। এল হালকা ঠাট্টা তামাশার প্রশাখা। সিগারেট আর ফোন নাম্বার আদান প্রদানের ফুলফল ধরলো। তারপর একই বাসে চেপে বসে একই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেখলাম যা সর্বঘটে ঘটে, তাই ঘটে গেল! এদেশে তো ছুৎমার্গের বালাই নেই!
এখন সমস্যা এটা নয় যে সর্বঘটের ক্রিয়াকলাপটি ঘটেছে। এ তো আর আমাদের ফাগওয়াড়া গাঁও নয় যে ছিছিক্কার ঢিঢিক্কারের হ্রেষাধ্বনিতে কান পাতা দায় হবে! যদি মিয়াঁ বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজী? এ দেশে আবার ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি ইচ্ছার গুরুত্ব সিলিং ছোঁয়া। তাতে স্বয়ং য়েসুও হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। ব্যাপারটা বড় করে দেখাও হয় না। গোলাপী নেশায় টিপ্সি হয়ে এক রাত্তিরের ইণ্টু মিণ্টু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। রাতের নেশা কেটে সকালে দেখা যায় যে যার ধান্ধায় মস্ত্। আমারই সহকর্মী রিচার্ডের সঙ্গে হয়েছে। রাত্রের মায়াবিনী সকালের আলো মুখে পড়তেই ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে জুতাজামা পরতে লাগলো। হতভম্ব রিচার্ড আমতা আমতা করে যেই বলতে গেছে, “হ্যালো!” মেয়েটা তড়বড়িয়ে “আমায় এখন দুধ কিনতে যেতে হবে, স্যরি,” বলে ধাঁ! নামটা পর্য্যন্ত পরস্পরের জানা হল না!
কিন্তু আমার আর সিসির ভালোবাসার রেশ একরাত্তিরের হ্যাংওভারের ওভার অ্যাণ্ড আউট তো হলই না, উল্টে দানা বেঁধে উঠল। পেলাম ফার্স্ট ডেটের আমন্ত্রণ। সেদিন মা ফোনে হাজার গালি ঢাললেও বেশ মির্চ মসালা লাগলো।
ফার্স্ট ডেটে কার্পণ্য করেছি, অতি বড় বাপের লাল বলুক দিকি! ফুল, দামী রেস্তোরাঁ, ভারী ওয়ালেট পাতলা করা, কী না! ওয়াহে গুরু, সিসি কিন্তু কেমন যেন সিঁধিয়ে গেল। ভেবেছিলাম এবার আমায় পায় কে, সিসিকে শিশি করে পকেটে ভরলাম আর কি। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
সেকেণ্ড ডেট পেরুলে মেয়েটা আর যেতেই চায় না! খালি তা না না না। অথচ ফোন রিসিভ করছে। ব্যাপার কী? গহরাইতে গিয়ে দেখি সিসি কোন এক সিধুর ক্লিনিক থেকে বেরোচ্ছে হপ্তাহ নিদান পক্ষে দু’বার।
ওক্কে! জাতভাই টক্কর? লড়ে গেলাম। অ্যাপয়ণ্টমেণ্ট নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি আধবুড়ো ঢোঁডা! তবে সেয়ানা খুব। আমাকে দেখেই বলা হল, “সিসির হারবার?” হেসে বললাম, “ওই আর কি!”
“জানতাম তুমি আসবে। ফুলের আনাগোনায় ভোমরা কি আর দূরে থাকে? মাছ গেঁথেছ বড়শিতে অথচ তোলা যাচ্ছে না, কেমন?”
দাড়ি চুলকানো ছাড়া কিই করি? বললাম, “স্যর, সিসি ইজ্ আ গুড্ গার্ল!”
“থামো!” হুঙ্কার দিয়ে বুড়ো বললে, “সিসিকে আমায় চেনাতে হবে না, নিজে চেনো। প্রথম ডেটে কী করেছিলে? রাজা উজীর মেরেছিলে তো? সব ভেস্তেছো তাইতে। এখন আঙ্গুল চোষো! পাকা ছেলে!”
“আজ্ঞে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!” সারেণ্ডার করলাম।
বুড়ে শেখালে — “শোনো হে ছোকরা, এ তোমার হেশিয়ারপুর পাটিয়ালা নয় যে…”
বাধা দিয়ে বললাম, “স্যর ফাগওয়াড়া…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই সই! তো যা বলছিলাম, আলফা মেইল হয়ে পছন্দের মহিলাকে বগল দাবাই করে, নামী দামী নাইট ক্লাব, এক্সপেন্সিভ ডিনার, খাবারের বিল মেটানো সব একাই সারবে? এটা ডেনমার্ক। এখানে জেণ্ডার ইকু্যয়ালিটির জ্ঞান টনটনে। বলা বাহুল্য, সিসি তোমার শো অফে আনকাম্ফর্টেবল ফীল করেছে। তোমার সব উদ্যোগ বাপু বেনে বণে মুক্তো ছড়ানো হয়েছে। এর থেকে বিল ভাগাভাগি করতে, সিসিকে একটা বরং ড্রিংক কিনে দিতে, মেয়েটা খুশি হয়ে যেত।”
“মাথায় আসেনি, স্যর!” স্বীকার করলাম।
“ক’ বচ্ছর?”
“মানে?”
“এখেনে ক’ বচ্ছর?”
“তিন।”
“বহুৎ কুছ শিখনা বাকি হ্যায়। কাল থেকে রোজ আসবি। পনের মিনিটের টিপ্স। পয়সা লাগবে না। যাঃ, পঞ্জাব দা পুত্তরের মান ইজ্জত বলে কথা। যাঃ!” বলে বুড়ো ধাক্কিয়ে বের করে দিলে।
ট্রেনিং শুরু হল পরদিন থেকে। “শোন রে মুণ্ডা! ডেনিশ কুড়ি অত সহজে তোর খালি ডালে ফুটবে না। তাই, ‘আজ ছিল ডাল খালি, কাল ফুলে যায় ভরে’ করতে হলে সিম্পলি কিছু নিয়ম মেনে চলবি। আর তাতেই হবে মিশন ফতেহ্।
“বাপু হে, হাজার হোক এরা আদতে ভাইকিং অর্থাৎ জলদসু্যদের উত্তরসূরী। কাজেই তেজ তো থাকবেই। ধরে আনা, তুলে আনা, কচু কাটা — এসবে অভ্যস্ত। তোমার সিসি এমনি এমনি পুসি্য হয়ে তোমার পায়ে পায়ে তো আর ঘুরবে না? তার জন্য হোমওয়ার্ক চাই।”
স্যালুট মেরে বললাম, “হুকুম কিজিয়ে সর্দার!”
“মেইল ইগো রেখেছো কি মরেছো। ডেনিশ কুড়ি তোমার বাহুবল চায় না। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ দেখেও টসকাবে না। কারণ, এদের নিজেদের সোস্যাল সিকিউরিটি সাঙ্ঘাতিক। মাঝখান থেকে তোমার পয়সা বেশী আছে শুনে গভর্ণমেণ্ট সর্বস্ব শুষে ছিবড়ে করে দেবে ট্যাক্সের চক্করে। তুমি হোমড়াচোমড়া পদাধিকারী হলেই যে ডেনিশ কুড়ি পটাবে এমন ভুলেও ভেবো না।”
বললাম, “কিন্তু স্যর, আমি তো হোমড়াচোমড়া নই। আর আমার অতিরিক্ত পয়সাও নেই। আসলে স্যর, আপনি খেয়াল করে দেখেছেন কি না জানিনা, ডেনিশ মেয়েগুলো কিন্তু বড্ড পুরুষালি। আমি তো স্যর পিজ্জেরিয়ার কুক্। মাঝেমধ্যে তন্দুরে পিজ্জারুটি বসিয়ে ওই একটু এদিক ওদিক দেখি। তখন হয়তো কোনো একটা অ্যাঙ্গেল থেকে এক একজনকে বেশ লাগলো। যেই সামনে ফিরলো স্পষ্ট দেখি মুছোওয়ালা! স্যরি, ওয়ালি…”
“চোপ! একদম বাজে বকবে না!” বুড়োর ধমকানির তোপে পিলে চমকে গেল। তবে রাগলাম না। যে হাঁস সোনার ডিম দেয় তার ব্যাঁক ব্যাঁক শুনলে ক্ষতি কী? মিনমিনিয়ে বললাম, “না মানে… সেই তুলনায় সিসি পরমাসুন্দরী।”
“সিসিকে তোমার প্রফেশান বলেছ?”
“একটু হিণ্ট দিয়েছি, স্যর।”
“তোমার প্রফেশানটাকে একটু খেলিয়ে বলবে যে ডেনিশ সোসাইটির জন্য তুমি কত বড় মহান কাজ করছ।”
“কিন্তু, আমি তো শুধু পিজ্জা বানাই, শিধু সাব!”
“আহা, তা হোক। বলার সময় বলবে কত শত ক্ষুধার্ত ডেন্ তোমার হাতে এবেলা ওবেলা অন্ন পাচ্ছে। তাছাড়া এসব দেশের মেয়েরা রান্নাঘরকে যমের মতন ভয় পায়। কাজেই মারকাটারি একটা ডিশ্ রেঁধে একবার যদি সিসির নাকের গোড়ায় ধরে বলতে পারো — ‘হাও অ্যাবাউট সাম্ ইণ্ডিয়ান কারি, হনি?’ দেখবে সিসি এক পলকে তোমাতেই গেছে মিশি। নাও, ওঠো! এদের কাছে বিয়ে শাদী দুরাশার ডাক। আগে গ্রাউণ্ড তৈরী করো, তারপর আকাশ কুসুম গড়ো।”
বুড়ো সিধুর বুদ্ধি অভূতপূর্ব কাজ করলো। সিসির চোখে আমি ৪০-৫০টা ডেটে একেবারে পারফেক্ট ফ্যামিলি ওরিয়েণ্টেড ওরিজিনাল স্পিসিজ হয়ে দেখা দিলাম। পটাপট সব পয়েণ্টস ঠিক হয়ে গেল ১৯৯ নাম্বার ডেটে। সিসি ওর চতুর্থ পিএচডি চালিয়ে যাবে। লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন, অর্থাৎ গভর্ণমেণ্ট। আমি শরীর স্বাস্থ্য ফিট্ রাখতে দুপুর একটা হোক কি রাত দশটা, সিসির সঙ্গে পাঁচ কিলোমিটার দৌড়বই দৌড়ব, চাহে আঁধি হোক ইয়া তুফান। রান্নাবান্না আমার, কাচা ধোওয়া ঘর সাফাই ফিফটি-ফিফটি। বাজার, বাড়িভাড়া আর অন্যান্য খরচখরচা ফিফটি-ফিফটি। রেস্তোরাঁ আহার, প্রমোদ ভ্রমণ ফিফটি-ফিফটি। বাচ্চাকাচ্চা হলে প্যাটারনাল লীভ আমি নেব। বাচ্চাদের জুতোসেলাই থেকে গ্রন্থসাহিব, স্যরি, বাইবেল পাঠ আমি করবো। কারণ এসব দেশে মেয়েলি কাজ বলে যে কিছু হয় না, তা আমি ভালিভাঁতি জানি।
অতএব অ্যাংটা অ্যাংটি বদলের জন্য আর তো কোনো দুবিধা থাকতে পারে না! তবু সিসির ষোলকলা সায় আর পাচ্ছি না। ওদিকে ফোন করে করে মা মাথা খারাব করে দিলো। গাওঁতে আমার দর উঠেছে নাকি দশ লাখ টাকা। কী যে করি! এত হোমওয়ার্ক তো স্কুলেও করিনি, ওয়াহে গুরু!
সিধুর কথা
সিসির চিরতাপানা মুখটাকে দেখে বিতৃষ্ণা হচ্ছিল এবার। একেই বলে যত পায় তত চায়। এমন সোনা মুণ্ডা, আর তাকে কি না ঝুলিয়ে রাখা?
কড়া গলায় বললাম, “শোনো সিসি, শুনতে তোমার যত খারাপ লাগুক, তোমরা ডেনরা রোমান্সের র-ও বোঝো না। নিতান্তই raw তোমরা। রস বলে কিছু নেই। এক কাজ করো — হারবারকে ফোনে ধরো অ্যাণ্ড গেট সাম্ ফ্রেশ এয়ার টু ইওর ব্রেন!” প্রস্তাব শুনে হাসিমুখে বিদায় নিলো।
সিসি বেরোতেই হরবীরকে ফোনে ধরলাম আমি। এবার চেক্ মেটের টাইম এসে গেছে। “পুত্তর, আজ সিসিকে কিছু ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যা ফর সাম্ ডিলিশাস্ ড্রিঙ্কস্। আর ঝোপ বুঝে মার কোপ্!”
ত্রিশ বছরের নিজের অভিজ্ঞতা। দেখছি তো, দু-চার পেগ পেটে পড়লেই অ্যাবেলিনের অ্যাড্রোনালিন ইউনিকর্ণ হয়ে শিং বাগিয়ে তেড়ে আসে। রোমান্সের ঝড় ওঠে।
এরপর দেড় বছর কেটে গেছে। হরবীর ফোনে ওয়েডিংর নিমন্ত্রণ দিয়েছিল, যাওয়া হয়নি। হঠাৎ একদিন পেশেণ্ট লিস্টে দেখি সিসির নাম। মন মুকুরে কত স্মৃতি দপ্ করে উঠলো। নির্ধারিত দিনে সেই গুপ্তিপাড়ার দিদিমাদের মতন ব্রহ্মতালুতে খোঁপা বেঁধে সিসি হাজির আমার দরজায়। একগাল হেসে বললাম, “Er alt i orden?” সব ঠিক তো?
কিছু না বলে নেয়াপাতি ভুঁড়িতে হাত বোলালো। প্রেগনাণ্ট! তারপর ষড়যন্ত্র করার গলায় বলল, “ট্যারা, তুমি ছাড়া এ বিপদ থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আমায়! প্রমিস করো, ইউ উইল হেল্প মী?”
মনে মনে কেঁপে উঠলাম। মুখে শান্ত হেসে বললাম, “কী বিপদ আবার?”
ব্যাগের লটবহর ঘেঁটে বার করলো কটা খাতার পাতা। “দ্যাখো তো, এগুলো ঠিক কি না! কারণ আমি খুব কনফিউশড্!”
“ওক্কে, ওক্কে! দেখছি, কিন্তু এগুলো কী?”
“পাঞ্জাবী শাশুড়িকে কব্জা করার নিয়মাবলী। থিসিসের বদলে এগুলোই পড়ছি। আপ্লাইও করছি হারবারের মা’র উপর। তিনি এখন এখানেই কি না!”
সিসির উদ্যোগে হাসি পেলেও সামলালুম। “এসবের দরকার কি, সিসি?”
চোখে ঝিকমিক আলো ফুটে উঠল সিসির। গাঢ় গলায় বলল, “ফর মাই ম্যান্স সেক্। হি ইজ্ আ জেম্ অফ্ দ্য ওয়ার্লড!” বলে ব্যাগ থেকে একটা চিরকুট খুলে দেখাল। “আমার মাদার ইন ল’ প্রতিদিন চার-পাঁচ বার আমাকে এটা বলে থাকেন। হারবার কিছুতেই মীনিংটা বলতে পারছে না। প্লীজ্ হেল্প মী, ট্যারা! আই ওয়াণ্ট টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড হার ওয়েল।”
চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখি ডেনিশ অক্ষরে লেখা আছে ভারতীয় শাশুড়িদের বৌমাদের প্রতি সনাতন স্নেহ ভালোবাসার উক্তি — ‘ফটে মুহ্ তেরি!’