“মশাই, আপনার এই ছ্যাঁচড়ামো আর তো সহ্য হয় না! শীতের বেলা। বাড়ি ভরা নাতিটার ক্যাঁথাকানি। এতটুকু বিবেচনা নেই আপনার? রোদ্দুরটুকু মোটে আসে না। রোদ কি আপনার বাপের?”
“সারাদিন গতর নাড়িয়ে খেটেখুটে গরমের দুপুরটুকু একটু জিরোবো, তা সে উপায় আছে? বলি, ওটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা? রাজ্যির পাখির চুলবুলানি আস্কারা দিয়ে রেখেছে!”
“বীরুদা! বীরুদা! কোথায় আপনি? কাল ইন্দ্রাণী আপনার বাড়ির সামনে আর একটু হলে তো পা স্লিপ্ করে পড়ে যাচ্ছিল। এসব তো চলতে দেওয়া যায় না! পাড়াটা কি আপনার একার?”
if your browser doesn’t display Bangla script properly.
এমনি কত মন কষাকষি, খিস্তিখেউর, কথার পৃষ্ঠে কথার চাপান উতোর। কিন্তু আমাদের বীরেশ্বরবাবু কানে গুঁজেছেন তুলো আর পিঠে বেঁধেছেন কুলো। বেশীর ভাগ সন্তানস্নেহান্ধ মা-বাবার থেকে কিছু বিশেষ আলাদা নন তিনি। বরং একটু বেশী মাত্রায় অপত্যস্নেহে কাতর। আর তাই সন্তানের যতেক বাতুলতা আড়াল করতে তিনি অন্যের গালমন্দে স্রেফ ব্যোমভোলা মেরে যান। অনেকটা ওই মহাভারতের দুর্যোধনের অন্ধ বাপ ধৃতরাষ্ট্রের মতন।
এই ভাবেই দিন চলছিল। তারপর এল সেই প্রলয়ঙ্কর দিন। কোথা থেকে আকাশের দিকচক্রবাল জুড়ে মত্ত মাতঙ্গের মতন ধেয়ে এল আইলার ঝড়। সে কী তীব্র দামামা। মৃতু্য আর ধ্বংসের মেলবন্ধন। সমস্ত ভুবন জুড়ে শত শত ক্ষুব্ধ ফণা মেলে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে থাকলো এক অতিকায় কালসর্প যেন!
বীরেশ্বরবাবুর শোওয়ার ঘরের জালনা সপাটে খোলা ছিল ওই তাণ্ডব ঝড়ে। যেন প্রকৃতির প্রতিটা চপেটাঘাত তিনিও চট্টানের মতন বুক পেতে দাঁড়িয়ে সহ্য করতে চাইছিলেন। হাড়হিম করা ধ্বংসের মট্ মট্ শব্দে বীরেশ্বরবাবুর পাঁজরের হাড়গুলোও ভেঙে যাচ্ছিল। অনন্ত রাত্রি, অশান্ত হৃদয়, দু’ চোখে তপ্ত অশ্রু। তিনি মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন তাঁর আর অমলার ভালোবাসার শেষ অস্তিত্বটুকু রাত পোহালেই চিরতরে মুছে যাবে। আর সেই বিরহের ঝঞ্জা তাঁকে সহ্য করতে হবে একা।
প্রকৃতির ধ্বংসলীলা সাঙ্গ করে গেছে সব কালরাত্রে। অমলার নববিবাহিত লজ্জারুণ মুখটি মনের চিত্রপটে যেন চিতাধূমের মতন জ্বলে গেছে। তাঁরা দুজনে মিলে যে নবাঙ্কুরকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, স্নেহে ভালোবাসায় যত্নে লালন করেছিলেন, কত মানুষের কত কথার বোঝায় ক্লান্ত হননি কখনো, সেই সন্তান আজ স্বেচ্ছায় তাঁকে সকল ক্লেদ, গ্লানি, উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে।
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তাঁর আমগাছটা। শেষ বিদায়ের আগে কনকাঞ্জলি দিয়ে গেছে দুটো কাঁচা মিঠে আম।