মিডনাইট মিশন

বেশ ছিলাম পুব-পশ্চিম খোলা বাসা বাড়িটায়, কপালে ঘি খাওয়া পোষাল না, বাড়িওয়ালা নোটিশ ধরিয়ে দিল। সাত বছর আগে যে সংসারের রূপরেখা ছিল পদ্মকুঁড়ির মতন ক্ষীণ, ষোড়শী চন্দ্রকলার ন‍্যায় তাই-ই গতরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে হস্তীতুল‍্য — “বোঝা আছে কত শত, বাক্স কত রূপ, টিন বেত চামড়ার, পুঁটুলির স্তূপ।”

অতএব খোঁজ পাড়লাম মুভার্স কম্পানীর। বেশ কিছু দরখাস্ত পড়ল। মনে ধরলো অপেক্ষাকৃত পেষাদার এক দলকে যারা বিনা ক্ষয়ক্ষতিতে দু’ দিনে আমার বিশাল বপুর সংসার কলেবরকে কব্জা করার আশ্বাস দিলো।

Download this post in PDF format

if your browser doesn’t display Bangla script properly.

নিদৃষ্ট দিনে সকাল বেলা আমার সদর দরজার সামনে ইয়াব্বড় দুটো সাদা ভ‍্যান এসে থামল। সাদা গেঞ্জী আর খাকি হাফপ‍্যাণ্ট পরা প্রায় জনা বারো তরুণ লাফিয়ে নামল। মিনিট কুড়ির মধ‍্যে তার সুদক্ষ সৈন‍্যের মতন আমার সুবিস্তৃত সংসারাঙ্গনে পিলপিল করে ছেয়ে গেল এবং প্রায় গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতিতে। দ্বিপ্রহরের আগেই বিস্ফারিত নেত্রে দেখলাম বাজার করার বাতিকগ্রস্ত আমার গিন্নীর অবিবেচনায় দৈর্ঘ‍্য-প্রস্থে ছ‍্যাতড়ানো সংসার কাঠামোটি অনেকটাই সমাহিত হয়ে এসেছে শত খানেক প‍্যাকিং বাক্সের গহ্বরে।

ঘর জুড়ে হাঁকাহাঁকি — “হেঁই সামালো, ধর রে, সর রে” — র মাঝখানে একটি তরুণ আলাদা করে আমার নজর কাড়ে। সকাল বেলায় দলের নেতা সবাইকে যা যা কাজ ভাগ করে দিয়েছিল, তাতে ছেলেটির ভাগে পড়েছিল আমাদের শোবার ঘরখানি। ঘরের দেয়াল জোড়া দরাজে কী আছে আর কী নেই! কিন্তু খেয়াল করছিলাম ছেলেটি আপনমনে প্রত‍্যেকটি কাপড় জামা, গিন্নীর ব‍্যাগ, ছাতা, গয়না মায় মশলার ডাব্বাটি পর্য‍্যন্ত পরম যত্নে বাক্সবন্দী করছে।

দ্বিপ্রাহরিক আহারের পরে ছেলেটিকে ডেকে দলনেতা বলল, “আয়ুব, তুমি এখন রান্নাঘরের প‍্যাকিং করবে।” নীরবে মাথা নেড়ে সে গিন্নীর রান্নাঘরে যেখানে যত থলি ঝুলি, চাল-ডাল-আটার কৌটো, মশলাপাতি, বড়ি-আচার, থালা-বাসন ছিল, সে সবই পূর্বের ন‍্যায় যত্ন করে মুখটি এঁটে, ধীরে ধীরে বাক্সে সাজাতে লাগলো। তার অন‍্য সহকর্মীরা সবাই যে খুব হুমহাম করে তাড়াহুড়ো করছিল, তা নয়। কিন্তু আয়ুবকে দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন নিজের সংসারের চালচিত্র যত্নে তুলে নিচ্ছে অন‍্যত্র সাজাবার অপেক্ষায়।

মাস দুই লাগলো নিজেদের নতুন বাড়িতে থিতু হতে। এক সন্ধ‍্যে বেলা আপিস থেকে বেরোচ্ছি, নাম ধরে কে যেন ডাকল। দেখি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আয়ুব। বলল, সরজমিনে তদন্তে এসেছিল আপিসের জিনিষপত্র বদলি করার সংক্রান্ত কোনো কাজে। ছেলেটা আমার মনে একটা বিশেষ আকর্ষণ কেড়েছিল, তাই বললাম, “বাড়ি ফিরবে তো? চল ছেড়ে দিই।” স্মিত হেসে গাড়িতে বসলো।

“বাড়িতে কে কে আছে?” বলতে আয়ুব বলল, “মা, চার বোন।”

“আর বাবা?”

বেশ খানিক নীরবতার পর আয়ুব বলল, “সিরিয়াতে প্রাসাদের মতন বাড়ি ছিল আমাদের। সুখ স্বাচ্ছন্দের জন‍্য যা লাগে সব ছিল। এক রাতে খেতে বসব, প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ হল দেউড়িতে। আব্বু দেখতে বেরলো, বুকে এসে বিঁধলো গুলির টুকরো। সব শেষ। এখন মা চার বোনকে নিয়ে জোর্ডানের রিফিউজি ক‍্যাম্পে থাকে। আর আমি থাকি এখানে। এই যে, এখানেই ছেড়ে দিন।”

দেখলাম, হোমলেস রিফিউজিদের একটা আস্তানা, ‘মিডনাইট মিশন’।

“ঘর হারিয়ে, ঘর খুঁজে পাই আপনাদের ঘরের চার দেওয়ালে। গুড নাইট, স‍্যর!” বলে আয়ুব হারিয়ে যায় হারানো ঘরের স্মৃতির গহ্বরে।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: