বাংলা গানের দল দোহারের অন্যতম মুখপাত্র শ্রীযুক্ত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্যের অকালপ্রয়াণ তাঁর অগণিত ভক্তের সঙ্গে আমাকেও মর্মাহত করেছে। আমরা যারা নির্মল কথা ও সুরে, মন মাখানো ছন্দে ও তালে বাংলার মাটি জল বাতাসের অনুরেণু মাখা গান শুনতে ভালোবাসি, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে ওনার প্রয়াণ এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি শুধু তো গায়ক ছিলেন না, ছিলেন হারানো লোকগানের গবেষক।
if your browser doesn’t display Bangla script properly.
বাংলার বুকে লুপ্ত সরস্বতীর স্রোতের মতন হারিয়ে যাওয়া অজস্র লোকগীতি — ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, বাউল, ভাদুটুসু — এই সকল গানকে তিনি পরম মমতায় পুনরুদ্ধার করে তাতে এনেছিলেন পূর্ণ স্রোতস্বিনীর ধারা।
গ্রাম গ্রামান্তরে ধুলামাটি, শস্যক্ষেত্র, তুলসীতলায় সাঁঝবাতির আলো আঁধারে যে সব আলোকসামান্য গান কালের প্রবাহে হারিয়ে গিয়েছিল, তাদের খুঁজে পেতে আনতেন গবেষক কালিকাপ্রসাদ। তাঁর ঐকান্তিক কর্ম প্রচেষ্টায় বাংলার মানুষের মুখে ফুটেছিল সেই সব হারানো সুরের কথাকলি।
তাঁর মর্মান্তিক পরিণতির খবরটা আমি যখন পেলাম, স্বভাবতই আরও বিস্তারিত সংবাদ পেতে আমি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের দ্বারস্থ হলাম।
তখনই চোখে পড়ল সংবাদ মাধ্যমের দেওয়া একটি অত্যন্ত মর্মভেদী ছবি। বর্ধমান মেডিকেল কলেজে শ্রী কালিকাপ্রসাদের মরদেহ শায়িত। পরণের বস্ত্রটি বক্ষদেশ ছাপিয়ে উঠেছে। বারবার দেখানো হচ্ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে তাঁর শরীরে বাঁধা গোলাপী ট্যাগ, তাতে লেখা তথ্য বিবরণ, এবং তাঁর মুখবিবর।
মৃতু্য মানুষের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। জীবনের জয়গানে আনন্দ হাসি হুল্লোড় থাকে। মৃতু্যতে থাকে গাম্ভীর্য্য। কারণ মৃতু্য গভীর, বেদনাদীর্ণ। মৃত হলেও মানুষের আত্মসম্মান, গোপন সংবেদনশীলতা থাকে। কারণ মৃতু্য কেবল দেহের। অথচ পরিমিতিবোধের অভাবে আমরা মৃত ব্যক্তির এই স্বাতন্ত্র সম্মানবোধটুকুকে বেমালুম ভুলে যাই। ইঁট কাঠ পাথরের মতন জ্ঞান করি। মৃত ব্যক্তির দেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদগ্রতার সাথে দেখাতে এবং দেখতে আগ্রহী হই।
শ্রী কালিকা প্রসাদের নয়নাভিরাম হাসিমাখা মুখখানি যাদের মনোমুকুরে গেঁথে আছে, তাদের কাছে তাঁর ওই প্রাণহীন হাঁ করা মুখবিবরের ক্লোজ আপ যে কতটা হৃদয়দীর্ণ তা বোঝার শক্তি কি আছে সংবাদ মাধ্যমগুলোর?
যখন ভাবি তাঁর শোকার্ত পরিবার পরিজনদের চোখে যখন ওই ক্লিপিং-এর ছবিগুলি ধরা পড়বে, না জানি কতই না অসহ্য পীড়াদায়ক হবে। সংবাদ তো পরিশীলিত মার্জিত ভাবেও পরিবেশন করা যায়! সীমাহীনতা ছড়ানোটাই কি এ যুগের সভ্যতা?