অতি নিষ্ঠুর মানুষকে লোকে কসাই বলে। আজ ভাবি এই ভাবনার সত্যাসত্য কতটুকু!
রবিবারের দুপুর মানেই আমাদের বাড়িতে গরগরে মাংসের ঝোল আর ভাত। বাজার যদিও আমিই করি, ইদানীং অরুণার তাড়নায় খোকা যায় আমার সঙ্গে। “রাতদিন নেট-এর নেটে ফেঁসে আছে ছেলে। রোববারের বাজারটুকু তোমার সঙ্গে যাক।”
if your browser doesn’t display Bangla script properly.
ভেবেছিলাম সে বিরক্ত হবে। সত্যি কথা বলতে কী, ছেলেকে আমার কোনোদিনই আলাদা করে কাছে পাওয়া হয়নি। এক সময় বদলির চাকরি করেছি। যদ্দিনে থিতু হলাম ছেলে তখন নাগাল পার। সোস্যাল মিডিয়াতে ওর বয়সী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতই মত্ত। বাপ-মা’র সঙ্গে কথা বলতেও এদের কেমন জানি গায়ে জ্বর ভাব। সর্বক্ষণ দু’কানে গোঁজা গানের তার। অষ্টপ্রহর বাপ-মা’র কচকচানির চেয়ে বোধহয় ভালো। অবিশ্যি আমাদের আর খোকাদের বেড়ে ওঠা তো একরকম নয়। আমি যে বয়েসে মাঠের জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল পিটিয়ে কলতলায় সাঁঝবেলায় সন্ধ্যেতারা মাথায় নিয়ে চান করেছি, সেই বয়সে আমার পুত্র বাটিভরা কাটা ফল খেয়ে পিঠে বইএর গন্ধমাদন নিয়ে গম্ভীর মুখে কোচিং ক্লাসে গেছে। এত প্রতিযোগীতা, চুলচেরা ফলাফলের জন্য পাহাড় প্রমাণ স্ট্রেস, অভীষ্ট সিদ্ধিতে নাকানি চোবানি — এসব যে ছিল না তা নয়। কিন্তু এত মারাত্মক রূপে নয়। যাই হোক, শ্রীমানের দেখলাম বাপকে সঙ্গ দিতে আপত্তি হল না।
10 ষ্টার দেবার option থাকলে তাই দিতাম, আর কিছুই বলার নেই । স্টোরিটা আমায় স্পীচলেস করে দিলো।
মণ্টুর দোকানে আজ ভিড়টা বেশী। মাংস কোপাতে কোপাতে মণ্টু হাঁকল, “স্যর, আজ একদম কচি মাল। কিলো দুই দিয়ে দিচ্ছি, নিয়ে যান!”
সম্মতি জানালাম। তখুনি কানে এল বড় করুণ এক আকুতি। “দাদাভাই, আমারে ছাড়ি দ্যাও গো! ভিক্ষে তো চাচ্ছিনে, আড়াইশ মাংস দে দাও দাদা!”
তাকিয়ে দেখি এক জীর্ণ কাপড় পরা মহিলা। মুখখানি রুক্ষ। দৃষ্টিতে করুণা মাখা। হাতের তেলোয় ক’টা ময়লা দশ টাকা নোট পাকানো।
মণ্টুর হাতে উদ্যত খাঁড়া। “ও সব আড়াইসো ফাড়াইসোর টাইম এটা নয়। দু’ কিলো, তিন কিলোর খদ্দের চাদ্দিকে। কামের সময় খুচরোর খদ্দের ধরব? যত্তো সব!”
ঠিক তখুনি মহিলার পেছন থেকে এক মুরুব্বি গোছের লোক চীৎকার করে উঠল, “অ্যাই মণ্টু! এটাকে সরা না! আমার রাণ আর চাঁপগুলো কী দিলি কিসু্য দেখতে পেলুম না। অ্যাই, তুমি সরো তো, সরো!” সেঁদিয়ে এল মুরুব্বি।
মহিলা সেঁটে গেল এক কোণে — “বাবু, মোর ছেল্যাটার বড় অসুক। রক্ত নাই। ক’দিন খায় নাই।”
“ধ্যাআত্! ঘ্যানোর ঘ্যানোর!” মুরুব্বি গর্জে ওঠে। মণ্টু নির্বিকার। চর্বি, ছাল, রক্তে ওর অস্তিত্ব ক্লেদাক্ত। ওর সময় কোথায় জীর্ণতার পাষাণে কারণ্যের স্রোত খোঁজ করা? আড়চোখে তাকিয়ে দেখি জটলার লোকেদের মুখে বাঁকা হাসি। খোকার কানে দুরাশার তার গোঁজা!
মহিলা ময়লা আঁচলে মুখের ঘাম মোছে। “দাদা, ছেল্যাটারে একা থুয়ে এসেছি। ছাড়ি দে। ডাক্তারবাবু বললেন এট্টু মাংসের সুরুয়া খেলি যদি চোকে তাকায়!”
মুরুব্বি তীব্র স্বরে সালিশি মানে। “ঢপের কীত্তন শুনছেন? পয়সা নেই, মাংস সাটাবার নোলা!”
থরথর কেঁপে উঠল ক্লান্ত অবয়বখানি। লোকটার এই অকারণ হিংস্রতায় জায়গাটাকে মনে হল বধ্যভূমি।
মণ্টু কলুর বলদের মতন অন্ধ। “স্যর, দু’ কিলো করে দিই তা’লে?”
বজ্রের মতন শরনিক্ষেপ হল — “না!” খোকা! এক অশ্রুতপূর্ব আলোকসামান্য আশ্বাসের কিশলয় ফোটা গলায় খোকা বললে — “আমরা আড়াইশ মাংস নেবো।”
মণ্টুর হাতের উদ্যত খাঁড়া শূন্যতায় স্তব্ধ হয়ে থাকে।