মোড়ের মাথার কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের কোনো লুক্কায়িত পত্রপুষ্পের আড়াল হইতে কুউ-উ, কুউ-উ ডাক শুনতে পেয়ে কালু বুঝলো বসন্ত এসে গেছে। শয্যা থেকে নেমে রাত পাজামার রশি কষতে কষতে খোলা জালানার সুমুখে দাঁড়িয়ে ভাবুক চোখে বাইরে তাকাল কালু। বৃক্ষ তন্ন তন্ন করে খুঁজে লাল সবুজের আভরণ ভেদ করে কোথাও কোকিলের কালো দেহ নজরে এল না। খুব খুঁজলো, তন্নিষ্ঠ হয়ে। শেষে একেবারে বেঁকে চুরে উবু হয়ে ঝুঁকতে যাবে, দেখে কোথায় বসন্ত! কোথায় কোকিল! এ যে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের হীমশীতল দেশের ধূম্র ধূসর আকাশ। সাদা তুলোর বরফ বৃষ্টি। ন্যাড়াপোড়া কতগুলো গাছের নগ্ন কলেবর। তার মধ্যে গলা পর্য্যন্ত কম্বলে ঢেকে বৃথাই সে এতক্ষণ শয্যায় আস্ফালন করছিল।
if your browser doesn’t display Bangla script properly.
কালুর মেজাজটি যারপরনাই খিঁচড়ালো। দাঁত মাজা মুখ ধোওয়া শিকেয় তুলে সে তার কম্পিউটারখানি খুলে বসলো। দেশে যাবার টিকিট কেনার প্রচেষ্টায়। বসন্তের রঙীনমধুর দোলনা থেকে একেবারে প্রাণহীন বরফের চাঙরে আছাড় খেয়ে পড়াটা বোধকরি তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল।
ইতিমধ্যে পঞ্জিকা অনুসারে বসন্তকাল কিন্তু সত্যিই এসেছিল। সাথে এনেছিল জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধির দেবী সরস্বতীর পূজা। বস্তুতঃ বিশ্বজগতে সবজান্তা বলে বাঙালীর নাম আছে। নামের আগে ‘সু’ অথবা ‘কু’ বসাবার অধিকার আমি বহন করি না। অতএব পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের মুণ্ডুদেশে অবস্থিত কোপেনহেগেন শহরের বাঙালীরা মিলেজুলে যে বাগদেবীর আরাধনায় মাতবে, এতে আর আশ্চর্য্য কী! বসন্তকালে আকাশের মেঘভরা গোমড়াপনা মুখ, হাড়া কাঁপানো বর্ফিলি বাতাসের গুঁতো, বৃষ্টির ছঁ্যাকা — এই সকল বসন্ত বিলাপকে উপেক্ষা করে পুরুষরা দুধসাদা কলিদার পায়জামা পাঞ্জাবী এবং মহিলাবৃন্দ হলুদ শাড়িতে অঙ্গ সাজিয়ে ইয়াব্বড় গামবুট থপথপিয়ে পূজাবাড়িতে হাজির। সাথে কিলো দুয়েক ভোগের খিচুড়ি, পোয়াটাক পায়েস, কিলোখানেক লাবড়া আর পঞ্চভাজার ঝোলাঝুলি।
সহকর্মী হিসেবে কালুকে আমি বৎসর দুই আগে বাঙালীদের আয়োজিত পূজায় নিয়ে এসেছিলাম। সাধারণতঃ পূজাপার্বণের ভার ন্যস্ত থাকে যে ব্রাহ্মণ ভদ্রসন্তানের কাঁধে, তার তদ্গতভাবে বিভোর পূজাকর্ম দেখে কালু তো রীতিমত উৎফুল্ল। চোখের ইশারায় সে আমাকে বলল, ‘আহ্! কি জিনিস একখানা, আঁ্য? এই বিদেশে, ভাবা যায়?’ এর পরেই সে সৌম্য ব্রাহ্মণতনয়কে ঠাকুরমশাই, ঠাকুরমশাই করে ডেকে ডুকে কখনো মায়ের পায়ের ফুল দিন, আরও একটু শান্তির জল দিন, ঘটের শাড়িখানা প্রসাদী হিসেবে দিন, এইসব করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তার এই তঁ্যাদড়ামোতে আমি যথেষ্ট বিব্রত হলেও ব্রাহ্মণ তনয়টি ধৈর্য্যহারা হলেন না। স্মিতমুখে কালুর যতেক আবদার মেটালেন ।
মনে মনে ভাবছিলাম, এই এনাকেই যদি কালু কলকাতার সুবিখ্যাত সিরাজের দোকানের চিকেন চাঁপ সাঁটাতে সাঁটাতে এক হাট লোকের মাঝে ঠাকুরমশাই! ঠাকুরমশাই! বলে আহ্লাদ করতো, তাহলে এনার মুখখানা কি এমনই সৌম্য দেখাতো?
মোদ্দা কথা হয়তো এই যে, বিদেশের মাটিতে বাঙালী আপন আপন পরিচয়ের উপরেও আর এক পরিচয়ের ধ্বজা বারো মাসে তেরো পার্বণের সময়বিশেষে সুউচ্চ তুলে ধরে। সেটা হল খাস বাঙালীয়ানার ধ্বজা। সেই ধ্বজার এমন গুণ যে তার তলায় দাঁড়িয়ে তাবড় তাবড় জ্ঞানীগুণী মর্য্যাদাসম্পন্ন মানুষজন মুহূর্তমধ্যে বনে যায় রাঁধুনি, পুরুত, মিস্তিরি, হিসেবরক্ষক, মালাকার, মোদক, কেটারার, বেয়ারা মায় দারোয়ান পর্য্যন্ত। অতএব কলকাতার নামজাদা কলেজের কোনো অধ্যাপিকাকে পূজাস্থলে কোমরে আঁচল গুঁজে ন্যাতা হাতে ল্যাপাপোছা করতে দেখে অথবা নামজাদা তেল কম্পানীর ডিরেক্টরকে মহানন্দে দুলে দুলে ঢাকের পেটে কাঠি বাজিয়ে ঢাকীভাই বনে যেতে দেখে আঁতকে ওঠার কোনো ব্যাপার নেই। বিদেশে এই সকলপ্রকার উৎসব অনুষ্ঠানকে সাবেকীয়ানার ঐতিহ্যমণ্ডিত করার জন্য নিজের বাঙালীয়ানার সত্তার শেষবিন্দু দিয়ে বাঙালী জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করে থাকে।
বিদেশভূমিতে বাঙালীর বাঙালীয়ানার গৌরব রক্ষা করার সদিচ্ছা যে কতদূর যেতে পারে এবার সেই গল্পে আসি।
যেদিন কালু কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কালো কোকিলের স্বপ্ন দেখে উন্মনা হয়েছিল, সেদিন সারা সকাল পাত করেও তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। দেশে যাবার টিকিট সে করতে পারেনি। তার ফল হল এই যে আপিসের হাজার কাজের ভিড়ে, দমহীন ব্যস্ততার মাঝে, ক্যাণ্টিনে চা-জলপানের ক্ষণিক ফাঁকে সারাক্ষণ কালু মুখ ভেটকিয়ে থাকলো। আর যখনই সুযোগ পেল কেবল পুরনো স্মৃতি আওড়াতে লাগলো। তখনও জানি না যে স্বপ্নের কোকিল কালুর জীবনে কাল হিসেবে আসবে।
ল্যাবরেটরিতে এই সকালটুকু বড্ড ব্যস্ততা। আমি বার্নারে ঠাণ্ডা জলের হাঁড়ি চাপিয়ে ধীরে ধীরে সালফিউরিক অ্যাসিড মেশাচ্ছি। কালু মহাচিন্তিত মুখে পাশে এসে দাঁড়াল। চাপা গলায় বললাম, ‘কি হে, আজ কাজ টাজ কিছু হবে কি?’ সে উত্তরে বললে, ‘দেখো, বাঙালীয়ানার সাবেকীপনা যা কিছু এই বিদেশের মাটিতে দেখছ তা তোমাতে আমাতে এসেই থেমে যাবে।’
হাঁড়িতে বগবগ করে সালফিউরিক অ্যাসিড ফুটছে, তাতে কী কী যৌগের ফোড়ন দেব সন্ধান করছি, কালুর বকবকানি থামল না। ‘বছর দুই আগে তোমার সাথে বাঙালীদের সরস্বতী পূজায় গিয়েছিলাম তা বোধকরি তোমার মনে আছে?’ মনে মনে বললাম, ‘বিলক্ষণ! তোমার আদিখ্যেতা কি ভোলবার?’ মুখে বললাম, ‘তাতে কী?
কালু বলল, ‘তুমি যখন একরাশ সর্ষেফুলের ক্ষেতের ন্যায় মহিলাদের মাঝো আরও একগাছা সর্ষেফুল হয়ে ঢুকে মহানন্দে পূজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি তখন ভগ্নদূতের ন্যায় একটু ইদিক উদিক ঘুরছিলাম। তা দেখি গোটা চারেক শিশু-কিশোর বসে বসে হাসিতামাশা করছে। কী মনে হল, গুটি গুটি গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের পূজা কেমন লাগছে। বলল, “ইট্স্ ও.কে.।” পূজার আগে কুলটুল খাওনি তো? আমার প্রশ্ন শুনে ওদের মধ্যে চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল। একটি শিশু জিজ্ঞাসা করল, “ওয়াটস্ কুল?” সেই মুহুর্তে নিজেকে আস্ত একটি ফুল (fool) বোধ হল। তবু, না দমে বললাম, “ও একটা বেরী জাতীয় ফল। সরস্বতীর প্রিয়। পূজার পূর্বে খেতে নেই।” তারা হাসতে হাসতে চলে গেল। আর কী বলে গেল জানো? বলে গেল “উই ডোণ্ট ওয়াণ্ট টু।” সেই থেকে ভাই, এই বিদেশের মাটিতে পূজাপার্বণের সময় থাকতে আমার মন চায় না।’
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। কালু গাঢ় গলায় বলল, ‘না মানে, ব্যাপারটা বোঝো! প্রকৃতির নিয়মে এই পোড়ার দেশের টপ টু বটম শীতের মাঝে বসন্ত আসবে। তার সাথে আসবে সরস্বতী পূজো। আর সরস্বতী পূজো মানেই কী? কুল। বাজার আলো করা টোপা কুল, নারকেলি কুল কত সাগর মরু পার করে এসে দম নেবে এশিয়ান বাজারের ঝুড়িতে। এইবার, তৎপর বাঙালীর মাইক্রোস্কোপিক চোখ সেই কুল সন্ধান করে ঝোলাবন্দী করবে। তারপর কয়েক দিবস কেবল পরস্পরকে ‘কুল পেলে? কুল খেলে?’ করে নাচানাচি করবে। তবে না বিদেশে বাঙালীর কুলরক্ষা হবে! অথচ সেই বাঙালীর সন্তানরা আজ কুল খেতে চায় না। তবে কি বাঙালীর সকল বাঙালীয়ানা প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাবে?’
আমার মাথা ভনভন করছিল। চা’এর প্রত্যাশায় ক্যাণ্টিনে চললাম। কালু কিন্তু পিছন ছাড়ল না। চা পান করতে করতে বাইরে দৃষ্টিপথ বাড়ালাম। বেশ বরফ ঝরছে। অথচ পঞ্জিকা বলছে ফাল্গুন! কালুর দোষ নেই। কোকিল ডাকা বসন্তের স্বপ্ন দেখে শীতের বরফের রাস্তায় হাঁটলে মাথা গরম হওয়ারই কথা। কিন্তু কালুর ভাবালুকতাকে আর প্রশ্রয় দিলে আমার কাজকম্ম আজকের মতন চৌপাট! তাই দুম্ করে তাকে বলি, ‘কালু, কদমা কী জানো?’
প্রবল আত্মবিশ্বাসে কালু দাঁত মেলে হাসে। ‘তা জানব না? সাদা গোল গোল, শক্ত মতন, ভারি মিঠে। কদমা, গোলাপী-সবুজ-হলুদ চিনির মঠ, বাতাসা — এই সবই তো সরস্বতীর শুকনো ভোগ। শশা দিয়ে নাড়ু খেয়ে দেখো, অপূর্ব লাগে। আমাদের ছেলেবেলা…’
হাত দেখিয়ে থামাই ওকে। ‘তোমার ছেলেবেলা তোমাকে পূজার আগে কুল না খেতে শিখিয়েছে। কদমা, নাড়ু, চন্দ্রপুলির অপূর্ব আস্বাদ পেতে দিয়েছে, চিনির মঠ কাকে বলে জানতে শিখিয়েছে। কিন্তু তাই নিয়ে এত গৌরব কেন? বরং বিদেশের মাটিতে যে শিশু কিশোরের দল দেশের সংস্কৃতির পরিবেশ থেকে লক্ষ যোজন দূরে থেকে বড় হচ্ছে, তাদেরও এই সকল জিনিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কি আমাদের দায়িত্ব নয়? তাছাড়া তুমি কথায় কথায় যে বলো, তোমার ছেলেবেলার দিনগুলোর কথা, পূজা, প্রসাদ, সবই অমৃত, তুলনাহীন। এইখানে আমার মৃদু আপত্তি। এক অমৃততুল্য স্বাদ গন্ধ আমি কিন্তু ভাই এই বিদেশের মাটিতে আয়োজিত পূজার মধ্যে পাই।’
কালু চুপ করে গেল। আমি বললাম, ‘দেশ কাল স্থান আমাদের অতৃপ্তির কারণ কিছুটা হতে পারে। সবটা নয়। মায়ের আরাধনায় আমাদের ভক্তি ভালোবাসা, কত কষ্টে জোগাড় করা বিবিধ পূজা উপাচারের সাথে মিলেমিশে এই পূজাকে সার্থক করে তোলে, কালু! তাছাড়া, বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কুল খেতে উৎসাহিত নয় বলে তুমি ভাবছ বিদেশে বাঙালীয়ানার তরী ডুবল বলে। পূজার দিনের নিষ্ঠাটুকু দেখ, কালু। বিবিধ অনুষ্ঠানের দিকে তাকাও। শিশুদের হাতেখড়ি থেকে আরম্ভ করে বসে-আঁকো প্রতিযোগীতা, নৃত্য বাদ্য গীত আবৃত্তি, কী না হচ্ছে? অতএব কুল না খেয়েও এই বিদেশে বাঙালীর কুল যে সুরক্ষিত তাতে আমার অন্ততঃ কোনো সন্দেহ নেই। তাই তোমাকে বলি, তোমার মনে যদি বাঙালীয়ানার ঐতিহ্য নিয়ে এত গর্ব, তাহলে তোমার শক্তি নিয়ে তুমিও এগিয়ে এস। বাঙালীয়ানার ধ্বজা আরও শক্ত করো, পুষ্ট করো।’
কালুকে যথেচ্ছ জ্ঞান দিয়ে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। কাজে ফিরতে হবে। দেখলাম কালু গভীর চিন্তামগ্ন। তাকে তার চিন্তা মধ্যে ছেড়ে দিলাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘কালু, দেশে ঘুরে এসো। মনে বল পাবে। না হয়, সরস্বতী পূজা কাটিয়েই এসো!’
কালু তড়িঘড়ি বলল, ‘না ভাই, অত ছুটি পাবো না! হপ্তা দুয়েকের ছুটির জন্য আজই দরখাস্ত দেব।’
শুক্রবারের সন্ধ্যাটা এখানকার মানুষ বিলম্বিত লয়ে চলে। সামনে দু দিন ছুটি। কর্মশেষে কালু আর আমি পথচলতি হাজার মানুষের ভিড়ে গা ভাসালাম। নু্য হাভেনের কাছে একটি ক্যাফের কফি আমাদের বড়ই প্রিয়। সকালে কালুর প্রতি কিঞ্চিৎ কঠোরতা করেছি ভেবে মনে মনে ঠিক করলাম তাকে কফিটা আজ আমিই খাওয়াবো। সূর্য্য তখন পাটে বসে গেছে। বল্টিকের বুক থেকে নির্গত অসংখ্য ক্যানেল এই শহরের কণ্ঠে উপকণ্ঠে ছড়ানো। নু্য হাভেনও এইরকম একটি ক্যানেলের ধারে বেশ জমজমাট এলাকা। ক্যানেলের জলে সূর্যের অন্তরাগ রশ্মি। ছেট ছোট তরঙ্গে সারি বাঁধা সেলবোটগুলো নাচছে। সার বাঁধা একগোছা রং বেরঙের বাড়িঘর। বেশ পুরনো। পথ পার্শ্বের খাদ্য পানীয়ের দোকানে মৌতাতের সন্ধানে সবে লোক জমতে শুরু করেছে। মাথার উপর তীক্ষ্ণস্বরে পাক খেয়ে যাচ্ছে সী-গলের দল। আজ বাতাসের লুটোপাটি নেই। রাস্তায় সকালের ঝরা খুচরো বরফ। তারই মাঝে দেখি তিন চারটি হলদে ড্যাফোডিল ফুটেছে এক কোণে! উৎসাহিত হয়ে কালুকে দেখাই, ‘ওহে, বসন্ত এসে গেছে!’
কালু মুখ ভেটকে বলে, ‘বরফের বুকে আবার বসন্ত! বসন্ত বিলাপ বলো!’
মেজাজটা ঘেঁটে গেল। কথাবার্তা বিশেষ জমল না। দুজনেই উঠে পড়লাম। দিন দুই পরে কালু স্বদেশযাত্রা করল। ফোনে কথা হল। মনের বিরাগ কেটে গেছে। খুশী মনে তাকে বললাম, ‘পূজা কাটিয়ে আসতে পারবে না ঠিকই, তবে পূজার আমেজ বুকে করে এনো।’
কাল ই-মেলে সরস্বতী পূজার নির্ঘণ্ট পেলাম। শনিবারে পূজা। ছুটির ভাবনা নাই। মহানন্দে সান্ধ্যকালীন লেবু চায়ে চুমুক দিয়েছি কি, ফোন বেজে উঠলো। হ্যালো বলতেই কালুর হাউ-হাউ কান্না। ‘শিগ্গীর এয়ারপোর্টে চলে এসো। মাদক দ্রব্য পাচারের অভিযোগে এরা আমাকে জেলে ভরতে চায়।’
বিস্মিত হলাম। কালু আর মাদকদ্রব্য! এ যে সোনার পাথরবাটির মতন অসম্ভব। তক্ষুনি ফোন করলাম আমার এক পরিচিত বান্ধবীকে। জানতাম তার ভাই এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করে। বান্ধবী আশ্বাস দিলে চা-ফা ছেড়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লাম এয়ারপোর্টে।
গিয়ে দেখি কাস্টম্স্ আপিস ঘরে শুম্ভ নিশুম্ভের ন্যায় দুই কালাপাহাড়ের মতন অফিসারের সামনে ধরা পড়া নেংটি ইদুঁরের মতন বসে আছে কালু। চোখের জলে নাকের জলে তার বিধ্বস্ত অবস্থা। সামনে খোলা হাট করা একটা সুটকেস। এক ছোকরা গোছের অফিসার দুই কালাপাহাড়কে নানা কথায় ভোলাবার বৃথা চেষ্টা করছে। বুঝলাম বান্ধবী তার ভাইকে কালু উদ্ধার কর্মে লাগিয়েছে।
আই কার্ড দেখিয়ে রুমে ঢুকলাম। কালু আমাকে দেখে ফোঁপাতে লাগল। ব্যগ্র হয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে কালু?’
কালু করুণ চোখে ইশারায় টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল। দেখি গোটা কতক তুলসীপাতা, মুঠা কয়েক দুব্বোঘাস আর খুচরা কতকগুলো গাঁদাফুলের প্যাকেট ছড়ানো। ব্যাপার কী?
এমন সময় এক নম্বর কালাপাহাড় বাজ ডাকা গলায় বলল, ‘তো? এর কী ব্যাখ্যা তুমি দেবে? এক, আমাদের দেশের গাভীদল ভারতীয় গ্রাসাচ্ছনের জন্য কি মরে যাচ্ছিল যে তুমি কয়েক মুষ্টি ভারতীয় গ্রাস্ বয়ে নিয়ে আসলে?…’ কালু তো-তো করতে লাগল। ‘অথবা উহা গ্রাসই নয়। ভারতীয় মাদক পাতা, যা তুমি পাচার করছ…!’ কালু প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগল। ছোকরা অফিসার ব্যস্ত হয়ে বোঝাতে এল, আমি কাঁপতে লাগলাম। ‘…তিন, তুমি নিজেই একটি গাভী ছাড়া আর কিছু নও। নিজের খাদ্যদ্রব্য বেঁধে এনেছ, নিজের দেশের ক্ষেত হতে!’
কালু ডুকরে উঠে বলল, ‘স্যর, সত্যি বলছি, আমাদের… মানে বাঙালীর পূজায় একরকম গ্রাস লাগে যা অতি স্পেশাল। তাহা আপনাদের দেশে হয় না, স্যর!’
‘বটে?’ বলে দ্বিতীয় কালাপাহাড় দুব্বোদলগুলো পটাপট ছিড়তে ছিড়তে শুঁকতে লাগল। ‘কী এমন স্পেশাল, শুনি!’
কালু সে দৃশ্য দেখে কাকুতিভরে বলল, ‘স্যর, এর ডগা তিন মাথা বিশিষ্ট। এমন স্পেশাল গ্রাসগুলি দয়া করে ছিড়বেন না স্যর!’
ক্রোধে কালাপাহাড়দের মুখ রাঙাবর্ণ হয়ে উঠল। তারা সামান্য কিছু ঘাসের জন্য এক ধরা পড়া বিদেশীর আস্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। ঘাস ছেঁড়া স্থগিত রেখে তারা এবার তুলসীপাতাগুলো চিবোতে শুরু করল। বেসিল বুঝে তাদের মুখের রেখা কিঞ্চিৎ নরম হল কি হল না, পলিথিনস্থ খুচরো গাঁদাফুলগুলো দেখে তাদের পিত্তি পুনরায় চটে উঠল। তীব্র স্বরে কালুকে বলল, ‘আর এই ফুলদল? এগুলোও খুবই স্পেশাল, কেমন? ভারত ছাড়া পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না, তাই তুমি তোমার দেশ থেকে কিছু নিয়ে এলে এদেশের মানুষকে দেখাতে যে মেরীগোল্ড কাকে বলে দেখে যাও! তাই না?’
কালু কঁকিয়ে উঠল, ‘স্যর, আমাদের মানে বাঙালীদের কালকে একটা পূজা আছে স্যর। তাতে স্যর গাঁদাফুল একেবারে মাস্ট। আপনাদের ফুলবাজারের ভরসা নেই। থাকে কি না থাকে!’
‘চোপ রও!’ কালাপাহাড় নম্বর দুই গর্জন করে উঠলে। আমার ঠ্যাং দুটো ঠকাঠক লেগে গেল। দাঁতে দঁত চিপে কালাপাহাড় নম্বর এক বলল, ‘আমাদের দেশের প্ল্যানটেশান এবং ইকো সিস্টেমকে তখন থেকে তুমি অপমান করে চলেছ! আমাদের গ্রাস, গ্রাস নহে। মেরীগোল্ড, মেরীগোল্ড নহে। এমনকি গোটা কয় চিমসে মার্কা বেসিল পাতা এনে তুমি আমাদের নধরকান্তি বেসিলগুলোকে হেলা করার দুঃসাহস করছ! তবে শোনো, তোমাদের গ্রাস, গ্রাস নহে। আমি বলিতেছি ইহা একপ্রকার মাদক পাতা। তুমি আমাদের সঙ্গে চল!’
এমন সময় ওই ছোকরা অফিসারটা টেবিলে যে ক’টি আস্ত দুব্বোঘাস পড়েছিল সবগুলো খাবলে তুলে একসাথে মুখে পুরে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা চমকে উঠলাম। চিবোতে চিবোতে সে কালাপাহাড়দের বলল, ‘স্যর বিলিভ মী। ইহা গ্রাস বই অন্য কিছু নয়। খাইয়া দেখুন। ইটস্ ডিলিশাস!’ এই বলে সে অকাতরে কালাপাহাড়দের ঘাস এবং তুলসীপাতার নৈবেদ্য সাজিয়ে দিলো। তারাও পরমানন্দে তাহার সদব্যবহার করতে করতে মুখ দিয়ে হুম্-হাম্ আওয়াজ বের করতে লাগল।
এইবার কালু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কালাপাহাড়রা বেগতিক দেখে যত তাকে বেকসুর খালাস দেয়, সে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। মহা গেরো দেখে কালাপাহাড়রা আমাকে বলে, ‘তোমার সঙ্গীকে ছেড়ে দিয়েছি, তবু সে কাঁদে কেন? যাও! একে নিয়ে যাও! যাও!’
কালুকে নড়ায় কার সাধ্য! সে টেবিল চাপড়ে বুক চাপড়ে কেবলই বলে, ‘গেল, পূজার সকল উপাচার এই তিনটে মুষকো বিধর্মী গোরুতে সাবড়ে দিলো!’
আমি হিড়হিড় করে কোনোমতে তাকে টেনে বাইরে আনি। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলি, ‘কালু, এ কী নির্বুদ্ধিতা তোমার? একে তো এই সকল বস্তু হ্যাণ্ডব্যাগে ভরে এনেছ, তায় ছাড়া পেয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদছ? জেলে যাওনি এই কী ভাগ্য তোমার!’
কালু তীব্র স্বরে বলল, ‘এর থেকে জেলে যাওয়াও ছিল ভালো। সকলই আমার দুর্ভাগ্য। নইলে এমন ভুল হয়! মায়ের দেওয়া মটরশুঁটির কচুরির ডাব্বাটা সুটকেসে ঢোকাবার জায়গাই করে উঠতে পারছিলাম না ভাই। কাজের বৌটা কখন “দিদি, দুব্বোঘাস দিলুম” বলে এই হ্যাণ্ডব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। আহা, এখানকার ঠাকুরমশাই এই সময় আমি দেশে যাচ্ছি সংবাদ পেয়ে কটি পবিত্র জিনিস আনতে বলেছিলেন। আমি পূজার উপাচারের যোগানদারের দায়িত্ব নিয়েও বহন করতে পারলাম না।’ কালুর কান্না আবার উথলে উঠল— ‘বর্তমান প্রজন্মদের আমি কী শেখাব, কী দেখাব? হায় হায়!’
দেখে শুনে আমি হাসবো কি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারলাম না। বিদেশের পূজায় বাঙালীর বাঙালীয়ানার অমূল্য কটি ধন সম্পদ — মুঠো কয়েক দুব্বোঘাস, খান কয়েক তুলসীপাতা আর খুচরো কিছু গাঁদাফুল — খুইয়ে সর্বস্বান্তের মতন আমরা দুজনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম।