Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla font properly.
কাল সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ গুম্গুমে পায়ে ঘরে ঢুকে সেই যে নাতনী গোঁসাঘরে খিল দিলো, সারা সন্ধ্যে নট্ নড়ন চড়ন, নট্ কিচ্ছু! আমিও বসে রইলুম গ্যাঁট হয়ে ইজি চেয়ারে বডি ফেলে। আবার কি ঝগড়া করে এল নাকি কপোতাক্ষটার সঙ্গে? এ তো মেলা ফ্যাচাং দেখছি! আরে বাপু, আজ বাদে কাল ওর সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধতে চলেছিস, ফি মাসেই তোদের কিছু না কিছু নিয়ে ঘচাং ফু লেগেই আছে?
আমাদের দু’ জনের দুই মেরুর বোম্বাগড়ের রাজা মার্কা মুখ দেখে কী করবে ভেবে না পেয়ে না চাইতেই বাড়তি দু’ কাপ চা দিয়ে গেল খাঁদু। আমাদের দাদু-নাতনীর সংসারে ও-ই একাধারে সব। বাজার হাট, রাঁধাবাড়া, ধোওয়া মোছা সবই সামলায়।
দশটা বাজল। কোনো মানে হয়? এরপর দেরী করে খেলে তো বুকে ভিসুভিয়াস নাচবে! চুপ করে বসে থাকা গেল না। দরজা ধাক্কাতে গিয়ে দেখি ভেজানো মাত্র। আস্তে হাতের চাপে দরজা খুলে দেখলুম বিছানায় শুয়ে ফোঁস ফোঁসাচ্ছে মেয়ে। কাছে গিয়ে মাথায় হাতটি রাখলুম। বললুম, “হ্যাঁ রে, দশটা তো বেজে গেছে। খাবি না?”
নীরবে মাথা নেড়ে বললে ‘না’। ততোধিক মিহি গলায় বললুম, “তোকে ফেলে কোনোদিন খেয়িচি কি?”
নাতনী কাষ্ঠগলায় বললে, “তুমি খেয়ে নাও, দাদু! আমি আজ খাবো না। কালও খাবো না। ইন্ ফ্যাক্ট, আমি আর কোনোদিনই খাবো না। কারণ খেলেই বেঁচে থাকতে হবে। আর আমি বাঁচতে চাই না।”
বুঝলুম কেস কেঁচে জণ্ডিস্। বললুম, “ঠিক আছে, যা তোর ইচ্ছে। আমাকে বুড়ো বয়সে মোক্ষম মার মেরে আধমরা করে ফেলে রেখে গেল তোর বাবা-মা। এখন বাকি আধাটা না হয় তুই-ই মার।”
শোনামাত্র ভ্যাঁ করে উঠে বসলো মেয়ে। সেই ছোট্টবেলার মতো ‘দাদু’ বলে গলা জড়িয়ে ধরলে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললুম, “খাবার টেবিলে চল, সব শুনি আগে। হেন সমস্যা নেই যার সমাধান নেই।”
উল্টে থাকা চপ্পল ঠিক করে পা ঘষটাতে ঘষটাতে এল পিছু পিছু। সশব্দে চেয়ার টেনে বসে ওড়নায় নাক মুছে বললে, “না! এই প্রবলেম সলভ্ড্ হবার নয়। আমি ট্রাই করে দেখেছি।”
খাঁদু ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দুটোর বদলে তিনটে রুটি গছিয়ে গেল। তার ধারণা হয়েছে কত্তাবাবার শরীর নাকি দিন দিন “শুকায়ে যাইতাসে”! তারদিকে কটকটিয়ে তাকানো ছাড়া আর কিছু কত্তে পারলুম না। কারণ তখন আমার ব্রেন গারাজে নাতনীর মরচে ধরা সমস্যা-গাড়ি ভিড়ে গেছে। বুড়ো হয়েছি, ওয়ান প্রবলেম অ্যাট্ এ টাইম! খাঁদুর খাঁড়া কাল নামাবো ভেবে নাতনীকে মাখন সুরে বললুম, “প্রবলেমটা কী, কাকে নিয়ে, সেটা বলা যাবে কি?”
রুটির টুকরোটাকে মিনি রোল পাকাতে পাকাতে নাতনী বললে, “দাদু, আমি বিয়ে করবো না। ক্যানসেল এভরিথিং!” বুঝলুম আমার নিশানার তীর অব্যর্থ। শ্রীমান কপোতাক্ষর উপর সৃষ্ট নিম্নচাপের ধাক্কা সামলাতে হবে এখন এই অশীতিপর বৃদ্ধ অমিয়ভূষণকে।
বারান্দার ডেক চেয়ারে বসে আছি, পূর্ণিমার আলোয় আর আমগাছের ফুরফুরে হাওয়ার মাঝে। নাতনীকে ডেকে নিয়েছি। মন শান্ত করার দরকার। না হলে ঘুমের ব্যাঘাত, লেখাপড়ায় গোল্লাছুট আর আমার উপর খাঁদুর অনিয়ন্ত্রিত গার্জেনগিরি বাড়বে। তবে হ্যাঁ, এসব ক্ষেত্রে হুড়োহুড়ি চলবে না। কথার ছিপ ফেলে খেলিয়ে খেলিয়ে টোপ খাওয়াতে হবে।
নাতনী এলে বললুম, “বোস! বিয়ে করতে চাস না, ভালো কথা। কিন্তু তার একটা কারণ তো বলতে হবে? নইলে ধর, অ্যাদ্দিন ধরে যারা তোদের একসঙ্গে দেকেচে, শুনেচে, তারা কি বলবে? কপোতাক্ষর মতন অমন একটা খাসা ব্রিলিয়াণ্ট, বিত্তবান, রুচিশীল…”
“থামো, থামো,” ঝেঁঝে উঠল নাতনী। আমার সামনে মোড়া টেনে বসে বললে, “রুচিশীল না মুচিশীল! কোন রুচিশীল মানুষের অমন বিটকেল শখ থাকে বলতে পারো?” আবার ওড়নায় মুখ ঢাকে সে।
“শখ?!” চেয়ারে ঢেলানো শরীরটা সোজা করে বসলুম। “ইণ্টারেস্টিং! তা কী শখ আছে বাবাজীর যে বিয়ের আগে থেকেই তুমি গলায় কাঁটা বেঁধার মতন তিড়িং বিড়িং করছ?”
মুখের ওড়না সরিয়ে মোড়া ঠেলে উঠে দাঁড়াল নাতনী। “তিড়িং বিড়িং করছি! তিড়িং বিড়িং করছি? তুমি শুনলে না, তুমিও এক্ষুনি এই দোলনা চেয়ারের আরাম ভুলে কিরিং কিরিং করে ফোনে ধরবে ওকে আর বলে দেবে জীবনে যেন এ বাড়িমুখো না হয় কোনোদিন!” ফুরফুরে হাওয়ার নেশা কেটে গেলে রোয়াব দেখিয়ে বললুম, “বেশ, কই বল শুনি!”
নাতনী কাঁদো কাঁদো সুরে বললে, “দাদু, ওর নাকের চুল জমানোর শখ! ক্যান ইউ বিলিভ দিস্?”
“চু — মানে, চুল — না — মানে নাক! মানে, না। আই জাস্ট্ ক্যাণ্ট বিলিভ দিস্!” দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও গিলে নিলুম। বদলে কয়েক সেকেণ্ড সময় নিলুম। কোনো মানে হয়? এই একটা খুঁতের কারণে কপোতাক্ষর মতন ছেলেকে হাতছাড়া করে দেব? তাই হঠাৎই হো হো হো হো করে হেসে উঠলুম। চমকে গিয়ে নাতনী রেগে উঠল। “কী হচ্ছে কী, দাদু? মাঝরাতে অমন খোক্কসের মতন হাসছ যে!”
শখ মানুষের কত রকমের হয়! কিওরিও কালেকশানের শখ, কুকুরের ডাক ডাকার শখ, পাখি দেখার শখ, গীর্জায় ঘণ্টার দড়ি টানার শখ। শখটা কি কারুর মাথায় গজাল মেরে গুঁজে দেয়? ও আপনিই ফলে, বড় হয়, আশ্রিত মানুষটাকে স্বস্তি আনন্দ মুক্তির ছায়া দেয়। আপাতদৃষ্টিতে যে শখগুলোকে গুবলেট মনে হয়, আদতে তারা হয়তো তেমন নয়।
আমার তখন কিই বা বয়েস! দড়ি দিয়ে প্যাণ্টুলুন বেঁধে ঢোলা শার্ট হাওয়ায় ফুলিয়ে মাস্তানি করে বেড়ানোর ছেলেবেলার দিন। আমাদের বাড়ি ছিল গড়পারে। পাড়াটা ছিল একেবারেই গেরস্ত টাইপ। শুধু একখানা বাড়ির তমক জমক ছিল দেখার মতন। সারি সারি একতাল টিনের চাল, অ্যাসবেসটসের চালওয়ালা বাড়িগুলোর সামনে কাঁচা হলুদ রং আর সবজেটে দরজা-জানলার দোতলা ছাতি চওড়া বাড়িটা সবার নজর কাড়ত। বাড়িটা ছিল ভ্যাবলদের। ও ছিল আমাদের একনিষ্ঠ বন্ধু। কানাঘুঁষোয় শোনা যেত ওর বাপ ঠাকুর্দা না কি কোন জমিদারের দেওয়ান ছিল।
ভ্যাবল লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল। অঙ্ক, ইতিহাস, বাংলা সবেতেই তার সমান দক্ষতা। পরীক্ষার পালে পার্বণে এটা সেটা সাহায্যও করে দিত খুব। এ হেন ভ্যাবল গরমের ছুটির পর দু’ একদিন ইস্কুলে এসে আর এল না। গরজ বড় বালাই। হাফ্ ইয়ারলি এক্জামে কি সাহায্যটাই না পেয়েছিলুম। তিন দিন কোনোমতে সবুর করে এক শুক্কুরবার ইস্কুল শেষে দাশু, পাকুড় আর আমি গেলুম ওদের বাড়ি। শুনতে পেলুম একটা বিনবিনানি সুর ভ্যাবলের ঘর থেকে — “বহুত দিন বিতে হুয়ে, সঁইয়া নহীঁ আওবে…” শুনেই দাঁত কিড়মিড় করে দাশু বললে, “শালার সঁইয়া আওয়াচ্ছি দাঁড়া!”
আমি হাসি চাপতে না পেরে বললুম, “আওয়াচ্ছিটা আবার কী রে?”
“কেন?” তিরিক্ষি হয়ে দাশু বললে, “ওই যে শালা আওবে, আওবে করছে না!” তারপর দরজা খুলে আমরা সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে তো স্তম্ভিত। তক্তপোষ জুড়ে রাজ্যের খবরের কাগজের ক্লিপিং, জামাকাপড়, মোটা মোটা কতগুলো খাতা, গুচ্ছের গানের রেকর্ড আর ঘন কালচে বাদামী চামড়ার সু্যটকেস হাঁ হয়ে রয়েছে। আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না ভ্যাবল। “আয়” বলে মৃদু হাসল। দাশু খিঁচিয়ে বলল, “তুই কি কোথাও যাচ্ছিস না কি? সামনে ফাইনাল একজাম সে কথা মনে নেই বুঝি?”
তেমনি হাসি মুখেই ভ্যাবল বললে, “হ্যাঁ ভাই, আমি চলে যাচ্ছি। ওসব একজাম-টেকজাম আমার আর দেওয়া হল না। আমার গুরুবচন পালন অনেক বেশী ইম্পর্টাণ্ট।”
“গুরু?” সমস্বরে চেঁচাই আমরা। “সেডা আবার কেডা,” পাকুড় ফেলফেলে হয়ে জিজ্ঞাসা করলে — “আইর মাত্তর মাসখানেক বাকি আসে একজামের, তর গুরু তরে কই পাঠাইতাসে?”
“মুলো বনে…” বেশ খেলিয়ে খেলিয়ে গান ধরল ভ্যাবল।
“মু-মুলো বনে?” আমরা তো হাঁ।
“বাঁশি বাজে মুলো বনে… শুনেছিস গানটা? বল তো, জৌনপুরী না তোড়ি?”
ভ্যাবলের কথাবার্তা কিছুই চেনা ঠেকল না। সে তার সুটকেসে জিনিসপত্র পুরে তক্তপোষে গুছিয়ে বসে বললে, “এতে না বোঝার কী আছে? আমার পরমগুরু মুলো গোপাল” — বলে নিজের কান মুচড়ে —
“আমাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন। আমি কাল বেনারস চলে যাচ্ছি, কালোয়াতী সুর সাধনার তপস্যায়।”
দাশু হতভম্ব হয়ে বললে, “এই মুলো কোত্থেকে গজালো ভাই?”
“ছিঃ দাশু!” ভ্যাবল ধমকে বললে। “মাস দুই আগে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে একটা দোতলা বাড়ির জালনা দিয়ে এক অলৌকিক সুর মূর্ছনার গান শুনে আমি মোহিত হয়ে যাই। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ হুঁশ হলে শুনতে পাই কে যেন বলছে, ‘তোমার কী চাই হে, ছোকরা?’ দেখি দোতলার বারান্দায় এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে জোড়হাত করে বলি, ‘আজ্ঞে, কার গান শুনছি যদি বলেন!’
“‘তোমারেও ধরিলো কি ও রোগে? গোপাল চকোত্তি হে! মুলো গোপাল। ক্ষ্যামতা থাকে তো স্বাদ বর্ণ গন্ধ শোষণ করো। আমার বাড়ির সামনে থেকে বিদেয় হও বাপু!’ বলে তিনি তো চলে গেলেন। পেঁচোয় পাওয়া জীবের মতন আমি ফিরে এলাম। ব্যস্, নাওয়া খাওয়া ভুলে চলল অনুসন্ধান। জানতে পারলাম, বুঝলি, মুলো গোপাল নজরুল কাজীর দোস্ত ছিলেন। সহপাঠী। ঠুংরি, টপ্পা, খেয়ালের সংগীতগুরু। ঠাকুর্দার গ্রামোফোনখানা ঘরে এনে দেদার জোগাড় করতে লেগে গেলাম গুরুদেবের রেকর্ড। সে কি অত সহজ! কোলকাতার পথ চষে চষে হন্যে হয়ে গরু খোঁজা খুঁজে তবে আমি কিছু কিছু গুরুকৃপা পেলাম।”
বলতে বলতে তক্তপোষ ছেড়ে খোলা জালনার সামনে রড ধরে দাঁড়ালে ভ্যাবল। “এখন আমার যা অবস্থা খেতে শুতে উঠতে বসতে ইমন-কল্যাণ, সিন্ধু-ভৈরবী, কেদারা, রামকেলি, কালাংড়া, জয়জয়ন্তী, ভৈরব, ঝিঁঝিঁট, সাহানা, বাগেশ্রী, বেহাগ, ইমন-ভূপালী এরাই আমাকে দিবারাত্র নাচাচ্ছে। আড়াঠেকা, তিওট, কাওয়ালি, ধামার, ধামাল, ঠিমে-তেতালা লয় তাল আমার নিশ্বাস প্রশ্বাস। আমার পক্ষে এখন আকবরকে কেন মহামতি বলা হত তার উত্তর খোঁজা অসম্ভব।” এই না বলে ভ্যাবল ধরলে — “কে ভুলালে হায়/ কল্পনাকে সত্য করি জানা এ কী দায়!”
বুঝলুম একজাম সিন্ধু পার হতে হবে নিজেদের কুকুর সাঁতারের জোরে। পাকুড়টা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বেমক্কা বলে ফেললে, “আইচ্ছ্যা, উনি কি মুলো খ্যাইয়া কল্জের জোর বানাইয়াসিলেন?”
ভ্যাবল গান বন্ধ করে পাকুড়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। পাকুড়ের দেহকাণ্ড পুড়ব পুড়ব করছে, ব্যাপার বুঝে আমি সামাল দিতে বললুম, “না, ভাই, মানে, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের লেখা থেকে জানা গেছে কি না, যে মিশরের রাজা ফু ফু-র পিরামিড তৈরির সময় শ্রমিক ও দাসেরা শরীরের শক্তি বাড়াতে রসুন, পেঁয়াজ আর মুলো খেয়েছিল। তাই…ই… পাকুড় বোধ হয় ইয়ে, মানে তোর গুরু সম্বন্ধে ওরকম বলে ফেলেছে।”
ভ্যাবল রক্তচক্ষু ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে এল। নিয়মিত ডন বৈঠক মারা ছোলা-ছাতু চিবনো শরীর। ওর এক ঘুঁষি খেলে মুলো বন কেন খানাকুলের ফুলকপি বনেও পড়তে পারি। ভ্যাবল কিন্তু মারধোর করলে না, এক ঝটকায় দরজার কপাট খুলে ধরে বেরিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে বললে, “গণ্ডুষমাত্র জলেন সফরী ফরফরায়তেঃ।” তারপর মুখের উপর দরজা আটকে দিলে।
পাকুড় রুদ্ধশ্বাসে বললে, “কী কইল রে ফরফর কইর্যা?” আমি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চললুম। গলিতে নেমে বোঝালুম — “যার বিদ্যাবুদ্ধি কম, মানে যে তোর মতন আস্ত একটা গবেট, সে যখন নিজেকে পণ্ডিত জাহির করতে যায়, তখন ব্যাপারটা যেরকম হয় আর কি, এটাই বললো।” বাঙাল পো-র গোঁসা গেল চড়ে। সে ভ্যাবলকে তারস্বরে বাছা বাছা গাল পাড়তে শুরু করে দিল। আমরা কোনোমতে ওকে জাপটে ধরে সে যাত্রা চম্পট দিলুম।
ভ্যাবলাটা কিন্তু চলে গেল। কানাঘুঁষোয় শুনতে পেতুম সে না কি ইলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, কাশী করে বেড়াচ্ছে কালোয়াতী জ্ঞানকলস পূর্ণ করতে।
আমরা যুবক হলুম। কর্মসূত্রে কেউ গেল বাইরে, কেউ রইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমি ততদিনে সংসারী হয়েছি। বাবার গৃহেই বাস করি। পুরনো বন্ধু বলতে একমাত্র পাকুড়টাই রয়ে গেছে একই পাড়ায়। সেও বিয়ে থা করেছে বটে, তবে সেল্সের কাজ তো! তার বৌ নিতা-কে সময় দিতে পারে না বলে আমার গৃহিনী সরমার কাছে নিতার নিত্য অভিযোগ লেগেই থাকতো।
এক বিকেলে গিন্নী চায়ের কাপটা এনে এগিয়ে ধরেছেন, আর আমিও নোবো বলে হাত বাড়িয়েচি, এমন সময় যেন ভীমসেনের গদার মতন এক প্রচণ্ড ধ্বনির গদাঘাতে সারাটা গেরস্তপাড়া তার মরচে ধরা কড়ি বড়গা, শ্যাওলার ছোপদাগভরা জ্যালজেলে উঠোন, ছাল চামড়া জৌলুষহীন দুর্বল দরজা জালনা নিয়ে থরথর কেঁপে উঠল। বেমক্কা চমকে চা চলকে পড়ল ধুতিতে। ছ্যাঁকা খেয়ে লাফিয়ে উঠে বাকি চা ছিটিয়ে দিলুম এক্কেরে গিন্নীর শাড়িতে। ততক্ষণে ধুন্ধুমার তান ঠাট গমকের এ-এ-এ-এ গিটকিরিতে আমরা পরস্পর দোষারোপ করতেও ভুলে গেলুম। কোন সন্দেহ রইল না মনে যে ভ্যাবল ফিরেচে।
ওখানেই শেষ নয়। সবে কলির সন্ধ্যে শুরু হল। আগেই বলেচি আমাদের পাড়ায় ওদের বাড়িটাই ছিল একমাত্র দশাশই দোতলা। সেই দোতলার একটি বিশেষ কক্ষ থেকে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল হরেক কিসিমের আ-আ-এ-এ-ই-ই-অ্যা-অ্যা। আবার কখনো হাতের সুবিক্রম চাপড়ে বোলতান ফুটতো — “ধা গে না তি, না ক ধি না/ধা গে তে টে, না ক ধি না/ ধা ধিন্ না, না থুন্ না/ ধা ধি না, না তি না/ ধা নে কৎ তা, ধাগে ধিন ধা ধা।”
উপর্যুপরি ওই ধ-এর ধাক্কায় দু’ দিনেই আমার কর্ণ এবং বক্ষপীড়া শুরু হল। আবার এতাবৎ সরমা দেদার বেসুরো গলায় ভোরে ঠাকুরঘরে ঘণ্টাখানেক ‘ভবসাগর তারণ কারণ হে/ রবি নন্দন বন্ধন খণ্ডন হে’ করতো, সেটি বন্ধ হয়ে গেল বলে প্রাণে আরামও পেলুম। পাশে মণ্টুর বুড়ো বাপ দীনেশখুড়ো ভোর না হতেই জিভেছোলা ঘষে অ্যা অ্যা করতেন, সাথে ফাউ ওয়াক থুঃ — সেটাও আর শুনতে পেলুম না কয়েকদিন যাবৎ। ঢেঁষীদের বাড়িতে নতুন বৌটাকে বড্ড ঠ্যাটা করতো শাশুড়ি। ভ্যাবলের গানের গুঁতোয় একদিন নকল দাঁত কপাটি এমন লাগলো যে বুড়ি সারাদিনে রা কাড়তে পারলে না। ক্ষান্তমণি কাজে এসে কলতলায় অকারণ গজগজাতো, তাও আর শোনার সৌভাগ্য রইল না সরমার। ফলে তার প্রেশারটা ক’দিনেই ইম্প্রুভ করলো, আমারও ট্যাঁক গরু সংসারের অকারণ হাম্বা ডাকে সাড়া দিলে না।
তা বাদে গলিপথের বেওয়ারিশ কুকুরগুলো প্রাণভয়ে চম্পট দিলো কোথা কে জানে! ভিখিরিদের যাওয়া আসা কমে গেল। কারণ তাদের ওই আধপেটা খাওয়া হাড় জিরজিরে শরীরে এমন তাকত কই যে ঔ জাঁহাবাজ বুলন্দশাহী স্বরধনির তোপের মুকাবিলা করবে! কাক শালিখ চড়ুই পারতপক্ষে ধার মাড়ালো না ভ্যাবলদের কড়িকাঠ বা ছাত আলসেতে। ফেরিয়ালাদের হাঁকাহাঁকিও কমে গেল। এতে পড়শি নকুড়বাবু যারপরনায় খুশী হলেও নকুড়গিন্নী উঠতে বসতে ভ্যাবলকে কথার বাড়ি মেরে কলতলার পাটে কাপড় আছড়া আছড়ি করে ছাড়লে। শনি রোববারের সন্ধ্যেগুলো পাড়ার গিন্নীদের কাছে সন্ত্রাসময় হয়ে দাঁড়ালো। ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘জয় জয়ন্তী’, ‘গঙ্গা’, ‘হারানো সুর’ ভোগে গেল। সারা পাড়া কাঁপিয়ে ভ্যাবল তখন গিটকিরি বায়না ধরেচে “মুঝে বাড়ি বনোয়ারী সেঁইয়া কো জানে দো…”।
মনে মনে নিজেকে অনেক প্রস্তুত করেও কিছুতেই ভ্যাবলের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পাচ্ছিলুম না। তার সাথে যে আমাদের শেষ সাক্ষাৎটা প্রিয় সাক্ষাৎ ছিল তা নয়, কিন্তু তখন আমাদের বালক বয়েস। তবু বাধাটা যে কোথায় তা বুঝে উঠতে না উঠতেই পাড়ার সবাই এসে ধরলে যে আমাকে না কি গিয়ে ওই ‘হ্যা হ্যা-বাবুকে’ বলতে হবে যে এমনধারা যখন-তখন, সময়-অসময় গলাবাজি করা চলবে না।
আমাদের দলের গোটা পনেরজন মানুষকে এক টিপ নস্যি জ্ঞানে নাকে পুরে নিল ভ্যাবল পনের মিনিটের মধ্যে। কত বছর পর দেখছি ওকে! পরণে রক্তাম্বর। চুলে বাবরি কাট। কপালে সিঁদূর ফোঁটা। হাতের তাগায় কবজিতে ধাগার ধমক। আমি যখন তাকে সপার্ষদ আসার কারণটি বললুম, সে নিস্পন্দ হয়ে জালনার লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রইলে। তারপর সটান ঘুরে আমাকে বললে, “বারো বছর কাশীতে কি শীত কি গ্রীষ্ম কি বর্ষা, গঙ্গায় গলা ডুবিয়ে ভোর চারটে থেকে আদি অনাদি ব্রহ্ম ওঁ জপ করতাম। তারপর একে একে তিন মিনিট দম ধরে গঙ্গায় ডুবে থাকার অভ্যাস। এক একটা গান শরের মতন বিঁধে আসতো আমার দিকে। সঠিক নিশানায় ধরতে না পারলে সব তপস্যা বৃথা। লক্ষাধিক বার শুনতাম। পঞ্চাশ হাজার বার গাইতাম। দিনের বিভিন্ন প্রহরে, রাতের বিভিন্ন যামে কালোয়াতী গানের রহস্য উন্মোচন বিদ্যা আয়ত্ত করে তবে ফিরেছি দীর্ঘ তিরিশ বচ্ছর পর। আর এখন তোমাদের কথায় আমায় সাধনা ত্যাগ করতে হবে?” একদৃষ্টে আমার পানে চেয়ে রইল ভ্যাবল।
আমার কেমন জানি কিঞ্চিৎ নিজেকে অবহেলিত মনে হল। এত বছর পরে দেখা, কই, না কোন ব্যক্তিগত সম্ভাষণ না কোন বাড়তি অভ্যর্থনা! আমিও যেন ভ্যাবলের কাছে পাড়ার ক’জন অভিযোগকারীর একজন মাত্র। ভ্যাবলের যুক্তি অকাট্য। আমরা সব চুপ রইলুম।
দীনেশখুড়ো বয়সের সিনিয়রিটি ভাঙিয়ে বলতে গেলেন, “আসলে বাবা, তোমার ওই নাদের ঠেলায় আমার রাতের ঘুমটি…” তাঁকে হাতের চেটো তুলে থামিয়ে ভ্যাবল বললে, “নাদ বলতে আপনি কী বোঝেন?”
খুড়ো তখন “নাদ মানে, ইয়ে মানে…” করতে লাগলেন। ভ্যাবল জলদগম্ভীর সুরে বললে, “নাদ অর্থাৎ শব্দ বা ধ্বনি। ন আকার অর্থাৎ প্রাণ বা বায়ু এবং দ আকার অর্থাৎ অগ্নি। তা নাদ অগ্নিবৎ হওয়াই স্বীকৃত। ভেড়ুয়াদের চিহিঁ ডাককে নাদ বলা চলে না।” এই বলে সে গটগট করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, এবং পালা খুলে ধরে বেরিয়ে যাবার ইঙ্গিত করলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল তিরিশ বছর আগে ভ্যাবলের সংস্কৃত উচ্চারণের শাসানির ফরফরানি। তবে এবার আমাদের শুদ্ধ বাংলা ভাষায় শেষ দাবড়ানিটা দিলো — “সঙ্গীতে নাদ দু’ প্রকার। শ্রুতিমধুর এবং শ্রুতিকটু। শ্রুতিকটু নাদকে বলে কোলাহল যা বলা বা শোনার অভ্যেস আমার নেই।” ভ্যাবল কপাট বন্ধ করে দিলে। ফিরতি পথে বুঝলুম বাল্যবন্ধুত্যের কোন রেশ আর বোধহয় সে ধরে রাখতে চায় না।
লোকেরা নিজেদের মতন সুলুক সন্ধান করে নিল ভ্যাবলের শখের নাদ সামলাতে। কেউ ফেরিঅলাকে বলে দিলে, “ওরে, অমুক সময় আসিস, তখন হ্যা হ্যা হাগতে যায়।” কেউ আবার উত্তম-সুচিত্রাকে বাঁচাতে খিড়কি জালনা বন্ধ করে দিতে লাগলো শনি-রবির সাঁঝে।
আমাদের শোবার ঘরে এসি মেশিন লাগানোর পর আমারও কান-বুক একটু যেন থিতিয়েছে, হুড়মুড় করে একদিন পাকুড় এসে হাজির। এক পাড়ার বাসিন্দা হলেও দু’জনেই ব্যস্ত আমরা জীবনের নাটমঞ্চে। দেখা সাক্ষাত খুবই কম হতো, যদিও স্ত্রীদের আনাগোনা ছিল। এক নিশ্বাসে একেবারে হামলে পড়ে বললে, “ভবা, হালার পো এ ত আমাগো সংসারটা খাইলো দেখতাসি! এহন্ করুম কী তা ক’!”
অত্যাশ্চর্য্য হয়ে বললুম, “তোর সংসার কোন হালার পো খাচ্ছে?” হাত বাড়িয়ে ভ্যাবলদের বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে পাকুড় বলে, “ওই যে! হালার হালা, ভ্যাবলা! হালায় আমাগো একবার কি দুইবার আরঙ্গজেবের হাত থিক কি উদ্ধার করসে, তাই বইল্যা এইভাবে এহন পসাইবে!” ওকে শান্ত করে জিজ্ঞাসা করি ব্যাপারটা কী।
পাকুড় বললে, “ক্যান? তুমি রাতে শোনো নাই কিসু্য?”
একটু দ্বিধাভরে বললুম, “না। আসলে সরমারও বহুদিন ইচ্ছে ছিল একটা ঠাণ্ডা মেশিন শোয়ার ঘরে লাগানোর। তা কিনবো কিনছি করে হচ্ছিল না। এবার ওটা কিনেই ফেললাম। মানে রাতের ঘুমটা ঠিক মতো না হলে…”
পাকুড় শুধু বললে, “বুঝছি… ভ্যাবলাটা এহন থাকে অর মায়ের ঘরে। সিকান থিকাই অবরে সবরে খাড়াইয়া খাড়াইয়া আমার বৌ-রে দেখে।”
“কী সব বকছিস! ও গান পাগল লোক, তাই বলে…”
পাকুড় ধমকে ওঠে — “অরে থাম! অ্যাঁ, কী মোর গাইন পাগল লোক! রোজ রাইতের বেলা ঐ গরাদ ধইর্যা তার যত্তো হ্যাহা্যকার সব বুজি না আমি? কখুনো ‘এই কি গো শ্যাস দান, বিরহ দিয়া গেলে’ কইর্যা, কখুনো ‘তুমি আইজ কত দূরে’, কাইল রাতে বৃষ্টি পড়তেসিলো, তদের গাইন পাগল তয় গাইল — ‘শাওন রাইতে যদি স্মরণে আসে মোরে!’ গাইন শুইন্যা নিতা ফুঁইপ্যা ফুঁইপ্যা কান্দলো। আমি কিসু বুঝি না?”
চিন্তার ব্যাপার বটে! “তা তুই সরাসরি ভ্যাবলকে গিয়ে বললেই তো পারিস?”
“বলুম না তো কি, ছাইড্যা দিমু? গেসিলাম তো তার লগে কথা কইতে। তেলে বেগুন ছাইড্যা দিলে কেমন লাগে কও? তার কথা শুইন্যা আমার অহন তেমনই লাগতাসে।” এরপর পাকুড় যা বললো তার সংক্ষিপ্ত ভাষণ হল এই — পাকুড় ভ্যাবলকে বুঝিয়ে বলতে গিয়েছিল তার রাতবিরেতের গানে তাদের দাম্পত্য জীবনে অশান্তি দেখা দিচ্ছে। গান শুনে লোকে আনন্দ পায়, সেখানে লোকে যদি গান শুনে প্যানপেনে কাঁদে তো কেমন লাগে! এই কথা শুনে মুচকে হেসে ভ্যাবল না কি পাকুড়কে বলে, “কাঁদে কে?” পাকুড় জানায়, তার স্ত্রী। শুনে ভ্যাবলার হাসি না কি চওড়া হয়। সে বলে, “বাঃ, বেশ তো! ঐ কান্নাটাকে যদি স্ক্যান করো তার মধ্যেও দেখবে কতো রাগ রাগিণী লুকিয়ে আছে।”
শুনে পাকুড় ক্ষেপে গিয়ে বলে, “সে শুধু কাঁদে না, অকারণ চিল্লামিল্লি রাগারাগিও করতাসে!” ভ্যাবলা না কি তখন হো হো হেসে বলেছে, “তুমি রাগের রসটাই দেখছি বোঝনি! তা রাগের বাদী-সমবাদীটি কে? তুমি না আমি? আচ্ছা, তার রাগের সময় মুখে কোন ভাবটি ফুটে ওঠে বলতে পারো? শুদ্ধ না কোমল? নাঃ, তোমার মতো মাথামোটা তার কী বুঝবে! শোন পাকুড়, তুমি তোমার স্ত্রী-র রাগের পকড়টাই দেখছি বুঝতে পারোনি, তাই তোমার সঙ্গে কথা বলব কি! তুমি এখন এসো,” বলে দরজা খুলে বিদায় করে দিয়েছে।
পাকুড়ের অবিশ্যি কালোয়াতী প্রেমের কলকব্জা সম্বন্ধে তখনো সম্যক ধারণা হয়নি। হয়েছিল সেইদিন রাত্রে। মধ্যযামে গগনবিদারী সুরে ভ্যাবলা না কি ঘণ্টা দুই ধরে প্রেমের বাণীর জাবর কেটেছিল জালনার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে —
“তোমার রাগের সময় তোমায় বড় ভালো লাগে!
শুদ্ধ সাদা নয় গো সে রাগ, নয় সে নরম কোমল।
রাগলে তোমার কপাল কপোল নাকের অগ্রভাগে
সোনার বিন্দু ঘাম যে দেখি শিশির টলোমল।
রাগকে আমি ভয় করি না, রাগ নয় তো মন্দ
রাগের মালা বরণ করে এসো, জীবন করি ধন্য।
রাগের রবি রশ্মি রেখায় করবো তোমায় বরণ।
না যদি পাই রাগিণী তোমায় করবো তবে হরণ
বলো যদি – মরণ! সেটাই আমার শুদ্ধ রাগের ধরণ।”
সরমার কাছে সপ্তাহ পর খবর পেলুম, পাকুড় না কি বৌ বাঁচাতে পাড়াছাড়া হয়েছে। বৌকে সময় দিতে সেলসের কাজ ছেড়ে পাকুড় অন্য চাকরি দেখছে। ভ্যাবলার উপর রাগতে গিয়েও পারলুম না। কেমন যেন মনে হল ওর ঐ গান দুটি বিরহী প্রাণকে তো মিলিয়ে দিয়েছে।
পাকুড়দের কথা শুনে মনটা শান্ত ছিল। সারাদিন সেদিন বৃষ্টির তাড়না। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলুম। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকাতে এসি খুলিনি সে রাত্রে।
রাত তখন কত গভীর কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ তীব্র এক চীৎকারে সরমাই হাঁকপাঁক করে উঠে বসেছিল আগে। আমাকে ধাক্কিয়ে যখন তুলল, আমি শুনলুম কে যেন হাউমাউ করে কাঁদছে। আওয়াজটা আসছে পাশের মণ্টুদের বাড়ির দিক থেকে। বারান্দায় এসে দেখলুম পাড়ার অনেক বাড়িতেই ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। ছাতা টর্চ নিয়ে অনেকে বেরিয়ে পড়েছে। আমিও ছাতা হাতে গেট খুললুম।
আর্তনাদ আসছে মণ্টুদের উঠোন থেকে। গিয়ে দেখি মণ্টুদের পুরো পরিবার এসে ভিড়েছে উঠোনে। আর সিড়িঙ্গে মার্কা একটা লোক মাটির কাদা জলে গড়াগড়ি দিতে দিতে “হেই মা রে, মোর কাঁক্কাল ভেইঙ্গে দিসে রে” বলে কান্না জুড়েছে। তার নাক ফাটা, চোখ ফুলে ঢোল। মণ্টুই তুলে ধরে বসালে। মণ্টুর মা গরম দুধ এনে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে বাপু? এত রাতে এখেনে এলে কি করে?”
লোকটা এক নিশ্বাসে দুধটা গলাঃধরণ করে মুখ মুছে বললে, “মা ঠাইরুণ, আমি সোর।”
অ্যাঁ? চোর? যার বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল তাদের হাতেই সেবা খাওয়া! সবাই তাকে জুতো খুলে এই মারে কি সেই মারে। সে আবার ভয়ানক গলায় কেঁদে উঠে বললে, “আমারে ছাড়ি দ্যান বাবুরা, আমি জন্মের লগি সুরি করা ছাড়ি দিমু। এ পাড়ায় যে উনার বাস আসে, তা তো মুই জানতুম না বাবুরা!” উনার বাস মানে? কার বাস? নাক কান মলে চোর বলে, “ব্রেহ্মদত্যি!”
আমরা তাকে ধমকে বললুম, “বল শালা, কী ব্যাপার? নইলে পুলিশে দেব তোকে!” সে হাতজোড় করে বললে, এক বর্ণ মিথ্যে বলছে না। মণ্টুর বোনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে এমন একটা খবর তার কানে গেছিল, বাড়ির রং মিস্ত্রীদের কাছ থেকে। চোরেদেরও খবরি থাকে কি না! তক্কে তক্কে থেকে আজকের বৃষ্টিভেজা রাতটাকে খুব মনে ধরেছিল তার। নগদ টাকা, সোনা পাওয়ার আশায় আচ্ছাসে তেল চুকচুকে হয়ে গুঁড়ি মেরে উঠে গিয়েছিল মণ্টুদের টালির ছাদটায়। রাত ঘনাতে বৃষ্টিও নামলো তোড়ে। সারা পাড়া অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাকে কেঁপে যাচ্ছে চরাচর।
টালিগুলো জলে ভিজে পিছল, তার দেহও তেলতেলে। সাবধানে এগুচ্ছিল। মোক্ষম ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগে যেন একশো ঢাকের পেটে কাঠি পড়লো এমন গুমগুমে গলায় কে যেন গেয়ে উঠলে — “হে রি রি রি রি রি জানে না দুঙ্গি” বলে। ব্যস, চোর বাবাজি ভয়ে ভিরমি খেয়ে নাক থেতলে পপাৎ ধরণীতলে। “আজ তিরিশ বছর এ লাইনে আসি, এমন হুজ্জুতি কখনো হয় নাই। ও গলা রাক্ষস বা দানবের হুজুর। মাহনষের অমন গলা হতিই পারে না।”
অকস্মাৎ হো-হো-হো-হো হাসির গমকে আমরা গলিপথে এসে দেখি জালনা জুড়ে হ্যা-হ্যা-র অবয়ব। আর সেই হাসি শুনে চোরটা তো ভয়ে লেংটি ইঁদুরের মতো মণ্টুর মায়ের প্রায় কোলে উঠে কাঁপছে। মণ্টুর মা তাঁর পায়ের চপ্পল খুলে এক ঘা দিতে সে হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠে দাঁড়িয়ে হাওয়া। আমরাও যে যার বাসায় মাথা নীচু করে ফিরে গেলুম। মণ্টুদের এত বড় ক্ষতির হাত থেকে আজ যে ভ্যাবলই বাঁচিয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী!
“কত্তাবাবু, দেড়টা বাজলো।” খাঁদুর গার্জেনগিরিতে গল্পের চটকা ভাঙলো। নাতনীর মুখটা দেখলুম সৌম্য। তাকে আরো হালকা করতে বললুম, “আর এই খাঁদুটার শখ কী বল তো মা?” নাতনী হেসে বললে, “পরের ধনে পোদ্দারি?” আমিও হেসে বললুম, “রাইট!”
পরের রবিবার রাত্রে খেতে বললুম কপোতাক্ষকে। তার শখের ইতিবৃত্তটিও সঙ্গে আনতে বললুম। নয়ন সার্থক করতে চাই। সে ও মহা উৎসাহে মালমশলা সমেত হাজির। বেশ গর্ব করেই বললে, “অস্ট্রেলিয়ার গ্রাহাম বার্কারকে দেখে আমার এই শখ জাগে বলতে পারো, দাদু। ১৯৮৪ সাল থেকে গ্রাহাম তার নাকের চুল জমাতে শুরু করে এবং প্রায় ২২ গ্রাম চুল সে জমিয়ে ফেলেছিল। ভাবা যায়?”
খুব তদ্গতচিত্তে মাথা নেড়ে বললুম, “সত্যি ভাবা যায় না। তা গ্রাহামবাবুর রেকর্ড ভাঙবে নাকি?”
নাতনী রাতের ডিনারের আয়োজনে খাঁদুকে সাহায্য করছিল। সেদিকে আড়ে আড়ে তাকিয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগলো কপোতাক্ষ। ব্যাপার বুঝে আমি বললুম, “আপাততঃ ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে’, কোন চিন্তা নেই। তবে ভবিষ্যতে তোমার শখের নাসারন্ধ্রের চুলে আর পুপুলের মাথার চুলে চুলোচুলি হবে কি না তার দায়িত্ব নিতে পারলুম না।” প্রাণখোলা হাসিতে ঘর ভরিয়ে দিলো কপোতাক্ষ। নাতনীর গালেও লজ্জার অরুণিমা।
যাক, শখের সৌখীনতা আজব হলেও তাতে তাজ্জব হওয়ার কিছু নেই। যেমন আমার এই বুড়ো বয়সে এসে শখ চেপেছে, আমি যা সময়ে পারিনি তা যেন এই শখধারীরা পারে, অর্থাৎ তাদের শখ যাতে মেটাতে পারে তারই রাস্তা যেন আমি সুলভ করে দিতে পারি। আরে বাবা, জীবনটা তো শুধু আর খাওয়া-কর্ম-রমণ মাত্র নয়!
তাই প্রথম ক্লায়েণ্ট হিসেবে বেছে নিয়েছি পাড়ার ইস্ত্রিঅলা পাসোয়ানকে। “কী রে ব্যাটা, তোর শখ কী বল তো?” একদিন জিজ্ঞাসা করতে সে বলে, “আজ্ঞে বাবু, পঞ্ছি হতে বড় শখ যায়!” বোঝ কাণ্ড! আরে বাপু শখ জিজ্ঞাসা করেছি বলেই শক্ দিতে হবে! কিন্তু আমারও শখ বলে কথা!
খাঁদু, কপোতাক্ষ আর পুপুলকে দিয়ে লতাপাতার একটা মাচা বেঁধে দিয়েছি আমগাছের ডালে। পাসোয়ানটা ওর উপর চড়ে লাল প্যাণ্ট-কালো শার্ট পরে ট্রানজিস্টারে গান শুনতে শুনতে ভঁস্ ভঁস্ করে যখন আয়রন চালায় ওকে একটা বুলবুল পাখির মতনই লাগে।
কপোতাক্ষ আর পুপুলও খুব খুশী। “গ্রেট দাদু! পাসোয়ানের এক্সট্রিম আয়রনিং-এর বেড়ে ব্যবস্থা করে দিয়েছ দেখছি।” খাঁদু তার শখে যেই বেড়ে ওস্তাদি করে বলেছে, “সেটা কী গো, দাদাবাবু?” অমনি খপ্ করে ধরেছি আমার সেকেণ্ড ক্লায়েণ্টকে। “আয় ব্যাটা! আজ থেকে তোকে ইংরিজি শেখাবো।” শুনেই চায়ের কাপ-ডিশ গুটিয়ে খাঁদু যে রেটে দৌড় দিলো, ভাবছি ওকে অলিম্পিক্সে নামানোর জন্য কাল ভোর থেকে মাঠে নিয়ে গিয়ে ছোটার অভ্যেসটাও করাবো কি না। দেখা যাক। আমার ক্রমশঃ উর্ধ্বচাপসঙ্কুল শখের ব্যারোমিটার কী বলে!