(পূর্বানুক্রমে)
Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly .
ক্যাম্পে ফিরে দেখি বেশ জমজমাট ব্যাপার। স্লেজিং-এর দল সব জুটেছে। এসেছে স্নো মোবিলের দলও। সবাইকে একসঙ্গে ডিনার দেওয়া হবে। আমরা ইতিউতি ঘুরছি আর রয়ে রয়ে আকাশ পানে চাইছি। গাইড এসে বললেন, “পাত পড়েছে, ভেতরে চলো।”
এক-একটা বেঞ্চিতে চার-পাঁচজন। দূরে উনানে বড় বড় গামলায় ধোঁয়া উঠছে। তার সুগন্ধে ম-ম করছে তাঁবু। খানিক পরে কালো অ্যাপ্রন বাঁধা পরিবেশকরা কাঠের বাটিতে গরমাগরম সু্যপ আর স্পেশাল স্থানীয় রুটি দিয়ে গেল। আমিশাষীদের জন্য রেনডিয়ারের মাংসের সু্যপ আর নিরামিশাষীদের ভেজিটেবল সু্যপ। সেই সু্যপের স্বাদ এত চমৎকার যে খেতে খেতে মনের গ্লানি ভুলে গেলাম। আমাদের টেবিলে বসেছেন অষ্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যাণ্ড থেকে আসা দু’জোড়া দম্পতি। সবারই আলোচ্য বিষয় আজকের ক্ষীণ অরোরা।
তাঁবুর মধ্যে গল্পের মৃদু গুঞ্জন, কাঠের বোলে কাঠের স্পুনের ঠক্ঠক্ শব্দ, হা হা হাসি, পরিবেশকদের ব্যস্ত ছোটাছুটি — “আর রুটি চাই? সু্যপ?” একুশ শতক ছেড়ে কখন চলে গিয়েছিলাম চতুর্দশ শতকে। মেরুভল্লুকদের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে পাওয়া তার ঘন লোমের তৈরি পোশাক পরে যেন বসে আছে কয়েকজন আদি অধিবাসী, ভাগ করে খাচ্ছে রেনডিয়ারের মাংস, বাইরে এই পাহাড়, ফিয়র্ড, বরফ-উপত্যকা।
ভাবনায় মজে আছি, দেখি ট্রাইপড বাগিয়ে আমার কর্তাটি গুটি গুটি বাইরে চলে গেলেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মেয়েকে বললাম, “দ্যাখ তো!” কিন্তু উঠে এলাম নিজেও। বেরোতেই শীত কামড়ে ধরল। স্বামীটি তখিন বরফের স্তূপে ক্যামেরা ফিট করছেন। দু’-চারজন ইতিউতি ঘুরছেন। আমাদের ক্যাম্পের উত্তর-পশ্চিম একঝাড় পাইনের বন। এতক্ষণ অরোরার দুর্বল আলো পেঁজা তুলোর মতো তারই মাথায় আটকে ছিল। এখন আলোর দিকে তাকাতে হঠাৎ মনে হল পাইন বনের মাথায় যেন সবুজ রংমশাল জ্বলছে। কে যেন বললেন, “ইটস গেটিং ষ্ট্রং!”
ধীরে ধীরে সবুজ আলোয় এল দু্যতি। কারও মুখে কোনও কথা নেই। সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে মন একাগ্র করেছি ওই আলোতে। সেই সবুজ দু্যতি মাখানো আলো ক্রমশ আরও ঘন হয়ে একটা লম্বা সবুজ পর্দার মতো আকাশের পশ্চিম থেকে পুবে ছড়িয়ে পড়ল। আর দুলতে লাগল ধীরে ধীরে। সারা গায়ে তার অসংখ্য তারা হিরে কুচি। আলোর কী ছটা! যেন সবুজ বিদু্যৎ চমক দিচ্ছে তার গায়ে। বেদের বাঁশি শুনে মোহিত সাপ যেমন হেলে দুলে নাচে ঠিক তেমনই করে অরোরার সবুজ আলো ঝলক দিয়ে দিয়ে নাচতে শুরু করল। আবার ফিসফিস, “ড্যান্সিং অরোরা!”
এই সব পর্বগুলো একটার পর একটা এমন স্বাভাবিক অথচ দ্রুত লয়ে হতে থাকল যে প্রকৃতির এই অপ্রাকৃত অবর্ণনীয় রূপে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ মনে এল, দলের বাকি সবাই এখনও তাঁবুতে। কেউ জানে না বিগত ছ’সাত ঘণ্টার কৃপণতার পর প্রকৃতি এখন অকাতরে মাধুরী বিলোচ্ছে। যদিও আমার তখন একচুলও নড়তে ইচ্ছে নেই, এক ছুটে এসে দড়াম করে তাঁবুর দরজা খুলে উত্তেজিত ভাবে বললাম, “আলো দেখবে যদি সব বাইরে চলে এসো!”
গোটা চত্বর মানুষের সিলু্যয়েটে ভরে উঠল। পাইনের বন তখনও সবুজ আলোয় উদ্ভাসিত। এই অলৌকিক আলোর দিগন্তজোড়া শামিয়ানায় চমকাতে লাগল হাজার তারার সলমাজরি।
প্রায় পনেরো মিনিট সবাই বাক্যহারা। ধীরে ধীরে আলোর দু্যতি ম্লান হয়ে এল। হাজার বার “কাম অন! কাম অন!” শুনেও গলল না। ইতিমধ্যে স্নো মোবিলের দল ভয়ানক উৎকট আচরণ শুরু করল। অকারণে তীব্র হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখে, মোটর বাইকের এঞ্জিন স্টার্ট রেখে হাসি তামাশা করতে লাগল। এই কৃত্রিম আলোর প্রভাবে অরোরার যে ঝড়তি পড়তি রূপ তখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। কী মন নিয়ে যে এর আসে বুঝি না।
যাক, মিনিটি দশেকের মধ্যে আপদের দল বিদায় নিতে আমরা আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে এলাম। দেখা গেল আমার স্বামীর ক্যামেরায় অরোরার আলো দ্বিগুণ উজ্জ্বলতায় ধরা পড়েছে। দলে সে আর তার ক্যামেরা হিরো বনে গেল।
গাইড সবাইকে পাততাড়ি গুটোতে তাড়া দিলেন। রাত প্রায় এগারোটা। তিনদিনের চাপা ষ্ট্রেসের ক্যাথারসিস হয়ে এখন শান্ত লাগছে। বাসে উঠে দেখি গাইড বসেছেন পাশেই। চেপে ধরা গেল। — “বলুন তো, কোন সময় এলে নর্দার্ন লাইট দেখা যাবেই? বেড়াতে এসে এরকম উদ্বেগ ভাল নয়।”
গাইড হেসে বললেন, “কী বলি বলুন তো! প্রকৃতির লীলা প্রকৃতিই জানে। নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চ এই হল নর্দার্ন লাইটের পিক সিজন। তবে এখন যেমন দিন রাত শুধু আঁধারই আঁধার, ফেব্রুয়ারির শেষে বা মার্চে এলে আমাদের এই সাগর, পাহাড়, ফিয়র্ড, উপত্যকা-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর দেশটার একটা অনুপম নীল সাদা সবুজের রং মেশানো ছবি দেখতে পারবেন।”

সামুদ্রিক উদ্ভিদ । দেখতে সুন্দর হলেও হাত দেওয়া বিপজ্জনক
পরের দু’দিন ঘুরলাম ট্রমসোর নানা কোণে। উত্তর নরওয়ের অন্যতম প্রশাসনকেন্দ্র ট্রমসোয় প্রায় ৬৬০০০ লোকের বাস। অনেকগুলো গবেষণাকেন্দ্র আছে, যেমন বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউট। মাছ ধরা, তা প্রসেস করা এবং চালান দেওয়া — এটাই এখানকার লোকেদের মূল ব্যবসা। তবে হোটেল ব্যবসাও বেশ রমরমা। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম ‘পোলারিয়া’-তে। উত্তর মেরু অঞ্চলের পশু-পাখি-মাছ, অন্যান্য প্রাণী, নানা প্রজাতির গাছপালা দিয়ে সাজানো গ্যালারি। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সামুদ্রিক পরিবেশে রয়েছে বেশ কয়েকটা সি-লায়ন। জলে ডিঙি মেরে মেরে খেলা করছে। ঝুঁটো গোঁফ উঠিয়ে গলা তুলে দেখছে, ভাসছে, আবার চোঁ করে ডুব দিচ্ছে সাগর জলের গভীরে। কোথাও বা শোকেসে থরে থরে রাখা স্টারফিশ, জেলিফিশ, সি অ্যানিমোনি সহ বিচিত্র রঙের আকর্ষক সব সামুদ্রিক প্রাণী। কী রূপ, কী রং! কিন্তু হাত দেওয়া মানা। হাতের আঙুল নাকি ছিঁড়ে নিতে পারে। বাপস!
যতই ঘুরি আমার মনপ্রাণ পড়ে রয়েছে শেষদিনের সন্ধ্যায়। আগের রাতে খেতে বসে মেয়ে বলল, “জানো মা, নর্দার্ন লাইটের কিন্তু সাউণ্ডও আছে বলে শোনা গেছে।” শুনে তো আমি অবাক। — “তাই নাকি রে?” স্বামী ফুট কাটেন, “আমি তো কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর মোবিল পার্টির হাউ হাউ ছাড়া কিছুই শুনলাম না।”
মেয়ে বোঝায়, “একদম পিনড্রপ সাইলেন্স থাকলে কেউ কেউ শুনেছে, অরোরা একরকম ক্র্যাকিং, সুইশিং, হিসিং সাউণ্ড করছে।” বললাম, “দেখা যাক। মন বলছে কাল হয়তো আরও ভাল দেখতে পাব।”
হ্যাঁ, কালও অরোরা শিকারে যাব আমরা। এবার যাব ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে। ফোটোগ্রাফার মশাই নিজেই টু্যর আয়োজক, এঁর কোম্পানি ‘ক্রিয়েটিভ ভেকেশনস’। এঁরা ছ’ ঘণ্টায় দু’দফায় ফোটো সাফারি করাবেন, নর্দার্ন লাইটসের ফোটো তোলার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবেন। মাথাপিছু ১২০০ ক্রোনার। তবে মেয়ে আর আমি ফোটোগ্রাফির প্রশিক্ষণ নেব না বলে আমাদের লাগবে মাথাপিছু ৬৫০ ক্রোনার।
ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক, তাঁর নাম ভাইডার, ঠিক সাড়ে পাঁচটায় একটা নীলরঙা গাড়িতে চেপে এলেন। দলে মাত্র ছ’ জনকেই নেন কেন তা গাড়ি দেখে বুঝলাম। গাড়িতে উঠলেন আরও এক দম্পতি। ভদ্রলোক গাড়িতে মাথা গলিয়েই আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আজ শুধু নর্দার্ন লাইটসই নয়, আরও একটা ব্যাপার আছে। আজ আকাশে অজস্র উল্কাপাত দেখতে পাবেন।” তারপর গাড়িতে বসে সিট বেল্ট বেঁধে গলা ঘুরিয়ে বললেন, “তা বলে আমাকে যেন আবার অ্যাষ্ট্রোনমার ভেবে বসবেন না। আমার বিদ্যের দৌড় ইণ্টারনেটের জানালা অবধি।” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হাসলেন। বেশ হাসিখুশি সঙ্গী। গোমড়ামুখো প্যাটার্নের হলে বড় অস্বস্তি হত।
আমাদের সঙ্গী অভিযাত্রী দম্পতির ভদ্রলোক নিজেকে অষ্ট্রেলিয়ান বলে পরিচয় দিলেন, তবে ওঁর স্ত্রী হংকং-এর মানুষ। ভাইডারের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি নাতিদীর্ঘ পথের ওপাশে কোমর সমান বরফের পাঁচিল। তারপর নানা গোছের ঝোপঝাড়ের বেড়া পার হয়ে খোলা দিগন্ত গিয়ে ঠেকেছে পাহাড়শ্রেণির সিলু্যয়েটে। ডানদিকে সমুদ্রের জল একটা বড়সড় লেকের মতো। তার একধার আলোর মালায় ঢাকা বন্দর, অন্য ধার নিঃসীম অন্ধকারে অস্পষ্ট। ঘন কালো আকাশ আজ একেবারে মেঘশূন্য। মুঠো মুঠো হিরের দু্যতি নিয়ে তারারা হাসছে।
বাড়ির ভিতরে এসে ভারী জ্যাকেট, স্নো বুট খুলে হালকা হলাম। একমুখ হাসি নিয়ে ফোটোগ্রাফারের স্ত্রী সিলভিয়া বেরিয়ে এলেন। ভারী অতিথিবৎসল। প্রথমেই সবাইকে এককাপ গরম হার্বাল টি দিলেন। অন্যদের যখন ফোটোগ্রাফির ক্লাস চলছে, আমাকে আর মেয়েকে ফোটোগ্রাফির কিছু বই দেখতে দিয়ে ভদ্রমহিলা বাইরে বেরোলেন। পিছু পিছু আমরাও।
রাস্তাঘাটে আলো নেই। রাতের আকাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বেরোতেই দেখি সামনের পাহাড়শ্রেণির কোল ফুঁড়ে দুটো আবছা সবুজ আলো। কেউ যেন সবুজ রঙের টর্চবাতি ফেলছে। তখন বাজে প্রায় সাতটা। সিলভিয়া সেই আলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “উঠছে অরোরা, কিন্তু এখনও দুর্বল!”
আমি আর মেয়ে অর্থপূর্ণ চোখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কতকটা এই ভেবে — এই রে, আবার সেই! মহিলাটিকে বললাম, “দেখুন, গত পরশুর আগের দিন পাঁচ ঘণ্টা বরফে দাঁড়িয়ে মাত্র মিনিট দশেকের আলো দেখেছি। তাও ভাগ্যে তাঁবুর আরাম ছেড়ে সময়মতো বাইরে বেরিয়েছিলাম বলে। আজ শেষে এমন না হয় যে আলোর ছবি তোলার প্রশিক্ষণ নিতে নিতে ওদিকে আলো উঠে আবার ভ্যানিশ হয়ে গেল। তার চেয়ে দুবলা পাতলা যা উঠছে এখনই ওদের ডেকে নিলে হয় না?”
মহিলা শুনে খুব এক চোট হাসলেন। বললেন, “কিচ্ছু ভেবো না। ওই এল বলে। দ্যাখো দ্যাখো! শুটিং স্টার!” বলেই বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমি যখন দিগন্তে ছুটন্ত ‘তারা’ হাতড়াচ্ছি, দেখি ফোটোগ্রাফার মশাই সাঙ্গোপাঙ্গ সহ হাজির। আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে কিছু জরিপ করে আমাদের গাড়িতে চড়ে বসতে বললেন। ইতিমধ্যে সিলভিয়া আরও বারকতক “শুটিং স্টার” বলে চেঁচিয়েছেন। গাড়িতে উঠতে উঠতে শুনলাম — “শুভ যাত্রা! উইশ করছি তোমাদের ভাগ্য প্রসন্ন হোক।”
গাইড আমাদের ওই সবুজ আলোর নীচের পাহাড়টির কোলে নিয়ে চললেন। ওঁর ধারণা আজ অরোরা বেশ তেজি হবে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি। উনি মাঝে মাঝে আকাশ দেখছেন আর স্টিয়ারিং-এ দৃঢ় হাত রেখে গাড়ির গতি বাড়াচ্ছেন। সবাই স্পিকটি নট। বহু বছর আগে জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে কাকভোরে হাতির পিঠে চেপে এক দক্ষ মাহুতের সঙ্গে ব্যাঘ্র দর্শনে বেরিয়েছিলাম। বাঘ দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম শুধু গোটা অভিযানটার টানটান উত্তেজনায়।
পাকদণ্ডী কেটে উঠছি, হঠাৎ — ঘ্যাঁচ! শুনশান রাস্তায় এমন আচমকা ব্রেক! গাইড সামনে ইশারা করলেন। দেখি একটা বড়সড় রেনডিয়ার দুলকি চালে রাস্তা পার হয়ে ওপাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। আরও কয়েক মিনিট চলার পরে একটা বাঁক ঘেঁষে গাড়ি থেমে গেল। এ কী জায়গা! ভাবার সময় নেই, ভদ্রলোক ততক্ষণে নেমে এগিয়ে গেছেন। ওঁকে অনুসরণ করতে করতে হঠাৎ দেখি আমরা বাঁধানো, উঁচু একটা চত্বরে চলে এসেছি, আর আমাদের বেশ নীচে সমুদ্র। সামনে কেবল পাহাড়শ্রেণি। ডানদিকেও পাহাড়। শুধু বাঁ দিকে বহুদূরে কিছু আলোর বিন্দু।
এই মিশকালো অন্ধকার রাতে আকাশ-জল-পাহাড় ঘিরে আমরাই ক’জন মাত্র মানুষ এখানে রয়েছি। কী আশ্চর্য সুন্দর এই জায়গা। আমাদের নাক বরাবর সমুদ্রের জলরাশি ঘেরা রয়েছে যূথবদ্ধ পাহাড়ের কোলে, আর ঠিক মাঝখানের দু’টি পাহাড়ের কোল ফুঁড়ে সবুজ আলোর দুটো সমান্তরাল রেখা ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। বরফের উপরেই জুতসই জায়গা বেছে ট্রাইপড বসানোর তোড়জোড় শুরু হল।

বহুক্ষণের আকাঙ্ক্ষার ধন অরোরার আলো, সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত
আজ অসম্ভব হাওয়া আর ঠাণ্ডা। যত আকাশ পরিষ্কার তত বেশি ঠাণ্ডার কামড়। আকস্মিকভাবে আকাশের এ পিঠ-ও পিঠ জুড়ে সবুজ আলোর দু’টো পর্দা কে যেন বিছিয়ে দিল! আর সেই আলোর ভিতর চমকাতে লাগল সবুজ বিদু্যতের মতো দু্যতি। ধীরে ধীরে শুরু হল আকাশ জুড়ে আলোর কাঁপন। ঘনকালো আকাশে অজস্র তারার সলমাচুমকি আর এক বিচিত্র সবুজ বর্ণের সামিয়ানা। এবার অসংখ্যবার চোখে পড়তে লাগল তারা খসা! পুব থেকে পশ্চিমে, কখনও পশ্চিম থেকে পুবে।
অরোরা আজ এত তীব্র হল যে, সমুদ্রের জলে তার প্রতিফলন পড়ল। মৃদু স্বরে গাইড সবাইকে ডান দিকের পাহাড়ে চোখ ফেরাতে বললেন। চেয়ে দেখি সেই পাহাড়শ্রেণির পিছনেও চলছে সবুজ আলোর খেলা। পাহাড়ের কোল ফুঁড়ে ঝলকে ঝলকে দেখা দিচ্ছে আলোর দু্যতি। মনে হচ্ছে বুঝি বা সেখানে সবুজ রঙের আগুন লেগেছে। এদিকে আমাদের সামনের পাহাড় ফুঁড়ে বেরনো আলোর দুই সমান্তরাল রশ্মি বিরাটাকার হয়ে মাথার উপর দিয়ে গোটা আকাশের মাঝ বরাবর চিরে সোজা চলে গেছে কতদূর!
স্বপ্নরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরলাম অসম্ভব পায়ের যন্ত্রণা বোধ হওয়ায়। আজ আকাশ মেঘমুক্ত বলে তাপমাত্রা মাইনাস ১৪ ডিগ্রি সেণ্টিগ্রেড-এর কাছাকাছি। এদিকে একমাথা অরোরা ফেলে যাই বা কী করে? মনের সব আকাঙ্ক্ষা পুরে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছি আকাশ ভরা অলৌকিক আলোর নীচে। আধ ঘণ্টার উপর হয়ে গেল, অরোরা তেমনই তেজি। গাইড বললেন অরোরা তেমন তেজি হলে শুধু উত্তর নয়, গোটা পুব-পশ্চিম আকাশ তার দখলে চলে যায়, তাকে দেখা যায় বহুদূর দক্ষিণেও, এমনকি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকেও।
এবার সকলেরই পায়ের যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় গাইড আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে চললেন। ওঁকে বললাম, “আপনার জবটা বেশ, না?” উনি সঙ্গে সঙ্গে বিনীতভাবে বললেন, “নিজেকে আমি অসম্ভব ভাগ্যবান মনে করি। দীর্ঘ প্রফেশনাল জীবনে এখনও যতবার এই অলৌকিক আলো দেখি, হৃদয় ভরে যায়। প্রতিবার মনে হয় নতুন করে দেখলাম।”
অষ্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বলছিলেন, তিনদিন আগে ওঁরা সবুজের সঙ্গে সামান্য লালের আভা দেখেছেন। গাইড বললেন, “সবুজ আর লাল আলোটা বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন গ্যাসের সংস্পর্শে তৈরি হয়। বেগুনি-নীল রংটা আসে নাইট্রোজেনের সংস্পর্শে। ওটা খুব রেয়ার।”

ফোটোগ্রাফার গাইডের বাড়িতে ডিনার টেবিলে আমরা
ঘরে ফিরে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। প্রথমত, আমরা অরোরার অরোরার আলো দু’চোখ ভরে দেখতে পেয়েছি শুনে সিলভিয়ার মুখ উচ্ছ্বাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দ্বিতীয়, আমাদের সবার পায়ের অতীব করুণ অবস্থা জেনে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। নরম ফোনের বিশেষ ইনসুলেটর দেওয়া জুতো পরতে দিলেন সবাইকে। ঘরে কাঠের ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে পা সেঁকছিলাম। ওই জুতো পরতেই ধড়ে, থুড়ি, পায়ে যেন প্রাণ এল। আসল বিস্ময় ছিল ডিনার টেবিলে। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর পাতলা মুরগির ঝোল! উঃ, ভাবা যায়! সঙ্গে অপূর্ব স্বাদের মুচমুচে মেক্সিকান রুটি, সবজি সেদ্ধ আর চিজ স্যালাড। গ্লাসে ভরা স্বচ্ছ টলটলে জল। বললেন, বাড়ির কুয়োর জল। সে জল এত স্বাদু আর মিষ্টি যে, শরবতের মতো প্রায় দু’-তিন গ্লাস খেয়ে ফেললাম!
সিলভিয়াকে কৃতজ্ঞতা জানাই। উনি বললেন, “এই শীতে এত ঘণ্টা বাইরে থেকে এসে গরম ভাত পেলে তোমাদের চোখে যে আলো ফুটবে তা আমি জানতাম। ওটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা।” সাবাস! আমরা প্রকৃতির অরোরা আলো দেখে তৃপ্ত আর ইনি আমাদের চোখের উদ্ভাসিত আলো দেখে খুশি! বছরের প্রথম দিনটাই কেমন আলোকময় হয়ে উঠল!
খাওয়ার পরে আরও একবার বেরনো হল। আমরা এলাম অপেক্ষাকৃত নির্জন আঁধার-ভরা এক উপত্যকায়। এখানে পাহাড়ের কোলে সবুজ দু্যতি দেখতে পেলাম ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যেবেলার মতো সেই চরাচরপ্লাবী আলোকরশ্মি ফুটে উঠল না। তার বদলে মসীকৃষ্ণ রাতের আকাশে দু’ চোখ ভরে দেখলাম আকাশের এ পাশ থেকে ও পাশে ছিটিয়ে দেওয়া হিরে-কুচির মতো মিল্কি ওয়ে। পরিষ্কার দেখলাম প্রশ্নবোধক চিহ্ন সপ্তর্ষিমণ্ডলের মুখে। যেন বলছেন, “এখনও ঘুর ঘুর করছ! আর কী চাও হে?”
চৌঠা জানুয়ারির সকাল। ফিরতি ফ্লাইটে চড়ে বসেছি। সকালের আকাশে সোনাঝরা আলো। জানলা দিয়ে নীচে তাকাই। শ্বেতশুভ্র পাহাড়শ্রেণিতে ঘেরা নরওয়ে। তেমনই বিছানো রয়েছে শান্ত সমুদ্র। ফিয়ডের গায়ে মায়াময় ছোট ছোট বাড়িঘর। সাদা আর নীলের কী নিবিড় মিলমিশ এই দেশে! হঠাৎ প্লেনের জানলার শার্সিতে কমলালেবু রং! ওফ্! সূর্য! সূর্য! কতদিন বাদে? মুখটাকে শার্সিতে প্রায় চেপে ধরি আর কী! আলো আর রং খেলা করতে থাকে মনে।
(সমাপ্ত)
ছবি: কান্তি কুমার ও সোহিনী কুমার
প্রথম প্রকাশিত: ‘দেশ’ পত্রিকা, ১৭ মে ২০১১