ভালোবাসা ভালো বাসা

Image: mycteria/Shutterstock

Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla font properly.

আমার পড়ার ঘরের ঠিক সামনেই অতসীদের শোবার ঘর। কোলকাতা শহরে মধ‍্যবিত্ত পাড়ার বাড়িগুলোতে আবার ড্রইং, ডাইনিং-এর কনসেপ্ট কই? এ পাড়ার বাড়িগুলোতে সব ঘরই শোওয়ার, খাবার, বসার। এই যে অতসীর বছর বারোর একমাত্র ছেলে পাপান, পাড়ার যতো উঠতি হুল্লোড়বাজগুলোর সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ক্রিকেট পিটিয়ে এখন ওদের শোবার ঘরে ঢুকেই গাঁক গাঁক করে টিভি চালিয়ে দিয়ে ম‍্যাগি সাঁটাচ্ছে, সেটা চাই বা না চাই আমি দেখতে এবং শুনতে বাধ‍্য।

গলির মধ‍্যে গায়ে গা লাগানো সব বাড়ি। আব্রু বলতে আধ হাত পর্দার আড়াল। ফ‍্যানের হাওয়ায় পর্দা ফুরফুরালে না চাইতেও চোখে পড়ে যায় এর ওর সংসারের টুকিটাকির দৈন‍্যদীনতা। ছেলেগুলোকে হাজার বার বলেছি, “তোদের বল পেটাতে হয়, একটু সরে খেল না!” সামনে পূজো আসছে। নয় নয় করে আমার ঘাড়ে ছ’ সাতখানা লেখা জমা দেওয়ার অঙ্গীকার। তা, কে কার কথা শোনে! বার বার আমার বারান্দায় বল পড়বে আর গ্রীলে আঙুল বাজিয়ে, “মাসিমা! ও মাসিমা, বলটা দাও না,” বলে উৎপাত করবে। বুঝিয়ে বলেছি, “দ‍্যাখ বাবারা, আমি লেখাপড়ায় ব‍্যস্ত থাকি, বার বার আমার পক্ষে এরকম ভাবে উঠে আসা সম্ভব নয়। তোরা ওই পিণ্টুদের বাড়ির দিকে সরে খেল না!”

দলের মাতব্বর গোছের ছেলেটা বলেছে, “আর কত ল‍্যাখাপড়া করবেন, মাসিমা?” আমার কঠিন মুখ দেখে অতসীর ছেলেটা তাড়াতাড়ি বলে উঠেছে, “কাকীমা, আর হবে না। আসলে পিণ্টুদা এই সময়টা কোচিং করে তো! ওদিকে গেলে হেব্বী ক‍্যালাবে। আর হবে না, প্রমীস্!”

লাভ হয়নি। ওদের প্রমিস্ টেঁকেনি। আমার বোঝানো, রাগ দেখানো সবই বৃথা গেছে।

এমনিতে আমার অভে‍্যস হয়ে গেছে। লিখতে বসলে কবে যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে লিখে যেতে পেরেছি, তা জানি না। সকাল থেকেই ফেউ লাগে পিছনে। বিয়ে থা করিনি, একার সংসার। তবু সংসার তো!  তাই প্রথমেই জমাদার, তারপর ঝি। বেলা গড়ালে রান্নার মেয়ে মালতী। তারপর ফলওয়ালা, ফেরিওয়ালা, পুরনো খবরের কাগজ বিক্রিওয়ালা কি সেল্সম‍্যান, না হোক পিওন কি কেবলওয়ালা — অন্তহীন আসা যাওয়া, অন্তহীন বাধা, আর আমার অন্তহীন চরৈবেতির প্রয়াস।

তবে আজকাল সবকিছু ছাপিয়ে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়াদিকে বিশুদ্ধ করে তোলে একটি মাত্র বাক‍্য। “হাঁ করো। হাঁ করো বলছি! হাঁ করো!”

দুপুরে পাড়াটা একটু ঝিমিয়ে আসে। ছেলেপুলেরাও ইস্কুলে কলেজে থাকে। এই অবসরে আমি দিবানিদ্রার আবেশ শিকেয় তুলে রেখে কাজ এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। সম্পাদক মশাইদের তাড়না আর এ বয়েসে সইতে ভালো লাগে না।

অতসীটার গলা সামান‍্য চাঁছাছোলা সে আমি জানি। ওদের পরিবারের সাথে কি আর আমার আজকের পরিচয়! সেই গলা সপ্তমে তুলে ও হুমকি দিতে থাকে ওর শাশুড়িকে। অর্থাৎ আমাদের শুভ্রাদিকে। শুভ্রাদি আর অভ্রভূষণদার একমাত্র ছেলে অংশু। ওর বৌ-ই হল অতসী। ওদের বিয়েতে আমি নিমন্ত্রিতও ছিলাম।

লেখক হিসেবে পাড়ায় আমার অল্পবিস্তর নামডাকও আছে। সেই সুবাদে আমি অতসীকে ডেকে একটা কথা বলতেই পারি। কিন্তু পরক্ষণে ভাবি, তাহলে এটাও তো ভাবতে পারে যে ওদের পারিবারিক কথাবার্তায় আমার কান খাড়া থাকে সর্বদা। অথচ এত তীক্ষ্ম আর কর্কশ গলায় চেঁচায়, না শুনেই বা থাকি কি করে?

বিকেলের দিকে চা-এর কাপ হাতে কখনো অতসী দাঁড়ায় ওদের জালনায়। চোখাচোখি হলে হেসে বলে, “কী লিখছো, কাকীমা?”

পাশ কাটাই — “এই-ই তো, গল্প একটা। পড়িস’খন পূজাবার্ষিকীতে।”

অতসী হেসে বলে, “তোমার লেখায় বেশ একটা ডেপ্থ আছে। বেশ লাগে পড়তে।”

ভাবি, বলি যে পাপানদের আমার জালনাটার সামনে হুল্লোড় করতে একটু মানা করে দিস। লেখার সময়টা খুব অসুবিধে হয়। কিন্তু আদৌ বলতে পারি না। লেখক হলেই কি আর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ বিকারগ্রস্ততার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়? তাছাড়া ওদের দোষ দিয়েই বা করবো কী? পাড়ায় ফাঁকা মাঠ ঘাট বলে আর কি কিছু আছে?

তাছাড়া বয়েসের ধর্ম মেনে ভাবি, তিনকুলে কেউ নেই আমার। বয়েস হচ্ছে। বিপদে আপদে হয়তো এরাই পাশে দাঁড়াবে। তাই অম্লমধুর কথাগুলো আর মুখ দিয়ে বার করি না। কিন্তু রোজ দুপুরে এই কান বিদীর্ণ করা “হাঁ করো, হাঁ করো বলছি!” আমার সমস্ত সত্তা যেন বিবশ করে দেয়।

এক সময় শুভ্রাদিদের বাড়িতে আমার একটু যাওয়া আসা ছিল। চিরটা কালই ভদ্রমহিলার একটু পিট্পিটানর বাতিক। কোনোদিন ওকে খালি হাতে বসে জিরোতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাড়িটা শুভ্রাদির শ্বশুরমশাই-এর তৈরী করা সেকেলে বাড়ি। পিছন দিকে বেশ খানিকটা খোলা জমিতে একটা বাগান করেছিল শুভ্রাদি। উঠোনে ছিল বিশাল একটা নীমগাছ। লাল সিমেণ্টের বেদী ঘেরা। শুভ্রাদির শাশুড়ি ছিলো মেদিনীপুরের লোক। গ্রীষ্মের চড়া রোদে নীমের আলো-ছায়ার জাফরি কাটা উঠোনে সাদা ধুতি পেতে শুভ্রাদিকে সাথে নিয়ে বড়ি দিতো। সে আবার যে সে বড়ি নয়, গয়না বড়ি! আমি তখন জনপ্রিয় একটা বাংলা ম‍্যাগাজিনে আমার প্রকাশিত গল্পখানা বগলে চেপে, গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখি, হাতের কি অপরূপ শৈলীতে ধুতির চাদরে একে একে ফুটে উঠেছে নানা রকম গয়নার ডিজাইনের বড়ি। ঝুমকা, কুন্দন, পাশা কলকে!

আসলে, শুভ্রাদি আমার সৎ পাঠক ছিলো। আমার লেখাগুলো শুধু যে মন দিয়ে পড়তো তাই নয়, রীতিমতো সমালোচকও ছিলো। তবে এইসব কথোপকথন আলোচনা কখনোই একেবারে আসর সাজিয়ে যে হতো, তা নয়। ওই জালনার শিক ধরে দাঁড়িয়ে শুভ্রাদি হয়তো অংশুকে ‘আয় রে পাখি, লেজ ঝোলা’ বলে চড়াই দেখিয়ে দেখিয়ে কলা খাওয়াচ্ছে, আমি হয়তো বারান্দার গাছে জল দিচ্ছি। কিংবা চড়া রোদে শুভ্রাদি ঘোমটা মাথায় ছাদে জামা কাপড় মেলে আলসেতে রাখা নয়নতারা গাছে জল দিচ্ছে আর আমি হয়তো কোনো পত্রিকা আপিসে বেরোচ্ছি — এই সব মুহূর্ত। একটু আধটু কথা, ভাবের বিনিময়। বেশ লাগতো কিন্তু। কারণ ভদ্রমহিলার কথাবার্তা, চিন্তা ভাবনায় একটা সাহিত‍্যিক বোদ্ধার ভাব ফুটে উঠতে দেখেছি।

ওদের তিন কামরার ঘর, রান্নাঘর, ভাঁড়ার, কলতলা, বাগান-উঠোন সব সময় ঝাঁটিয়ে নিকিয়ে তকতকে করে রাখতো শুভ্রাদি। ওর পিট্পিটানির কথা আগেই বলেছি। মাঝে মাঝে শেষ বিকেলে গিয়ে দেখতাম নীমের বেদীতে বসে উল বুনছে। সেদিনও কি কাজে গেছি তা আজ আর মনে পড়ছে না। আমাকে দেখে একগাল হেসে মোড়া এগিয়ে দিলো। দেখলাম এলো চুল ভিজে, পিঠে ছড়ানো । “এ কী! শীতের বিকেলে তুমি মাথা ভেজালে!” আশ্চর্য‍্য হলাম।

শুভ্রাদি বাগানের কোণে রাশিকৃত ঝরা পাতা, নীমের ফুল, কাঠি সকড়ি দেখিয়ে বললো, “আর বলো কেন! বাগান ঝেঁটিয়ে এমনিতেই ধুলো খেলাম। তার উপর দামাল ছেলের দস‍্যিপনা। দু’ ঘণ্টা ধরে ওই পাখি দ‍্যাখরে, এই পিঁপড়ে দ‍্যাখরে করে যেটুকু ভাত খাওয়ালাম, কেশে কেশে দিলে সব উগরে। এত্তো কষ্ট বিফলে গেলো, ছেলেটা পেট খালি করে দিলো। এদিকে সন্ধ‍্যেবাতি দেখাবো, তাই নেমে এলাম। চা খাবে তো?” বলে শশব‍্যস্ত হয়ে চা বানাতে বসলো শুভ্রাদি।

ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁত লাগছে সে ভ্রুক্ষেপ নেই, ছেলের পেট খালি থাকলো, সেটাই মাথা ব‍্যথা! কী বলি? এমন অপরূপ মাতৃত্ববোধের আগে কথা কওয়া সাজে না, তাই চুপ রইলাম।

চা খেতে খেতে উদাস মুখে বাগানের টগর গাছটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুভ্রাদি। হেসে বললাম, “কী হল?”

শুভ্রাদিও হাসলো। ম্লান হাসি। তারপর মাথা উঁচু করে নীমের মাথার উপর হালকা গোলাপী-কমলা হয়ে আসা সন্ধ‍্যের আকাশটাকে ভালো করে পরখ করে বললো, “বিশালাক্ষীর দঁ।”

ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “মানে?”

এবার চওড়া হেসে শুভ্রাদি বললো, “সংসার ভাই সংসার! এই দঁ-এ পড়োনি তো, দিব‍্যি আছো। এই দঁ-এ পড়লে নিজের হাত পা বুদ্ধি, ইচ্ছে অনিচ্ছে আর নিজের থাকে না ভাই!”

দু-চার ঘরে শঙ্খে ফুঁ পড়লো। নীমের ডালে ঘরে ফেরা পাখিদের কাকলিতে কান পাতা দায়। শুভ্রাদির শাশুড়ি ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় হাঁকলে, “বৌমা!”

ইশারাই যথেষ্ট। উঠে পড়লাম। শুভ্রাদি হাতে চাপ দিয়ে বললো, “লেখো ভাই, খুব লেখো। এগিয়ে যাও।” তারপর ওর স্বপ্নের উঠোন ছেড়ে এগিয়ে গেলো বাস্তবের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশালাক্ষীর দঁ-তে।

অংশুটা লেখাপড়ায় ভালোই হয়েছিলো। মাথা মুখ তুলে খুব একটা কথা বলতে দেখিনি বড় হওয়ার পর। ইঞ্জিনীয়ারীং পাশ করলে গোটা পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়েছিলো ওরা। তারপর বদ‍্যিবাটির থেকে মেয়ে আনলো সম্বন্ধ করে। কী, না কোলকাতার মেয়েরা না কি ঘর ভাঙানী হয়। আসলে, অংশুকে অনেক আগলে আগলে বড় করেছিল শুভ্রাদি। যুক্তি শুনে হাসি পেয়েছিলো। খোদ শুভ্রাদি তাহলে কী? সে তো একেবারে আদি কোলকাতা, বাগবাজারের মেয়ে! যদিও বছরে দু’বছরে কচ্চ্বিৎ কখনো বাপের বাড়ি যেতে দেখেছি ওকে।

সত‍্যি কথা বলতে কি, আমি কোনোদিন ভাবিনি যে শুভ্রাদি আমার মানসপটে এমন দুর্নিবার ছবি হয়ে ফুটে উঠবে যার অপ্রতিরোধ‍্য টানে আমি কলম ধরে বসবো।

রোজ দুপুরের অতসীর নিত‍্য ওই ধমকি হুমকি “হাঁ করো! হাঁ করো!” সেদিনও দুর্মর হয়ে উঠেছিলো। লেখার টেবিলে মনোনিবেশ করতে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছিল আমায়। উপন‍্যাসটা এমন একটা সংবেদনশীল জায়গায় ঘুর্ণি খাচ্ছে যে চরিত্রগুলোর সাথে আমিও অবিরাম ওই ঘূর্ণনে মেতেছি। মনের চিন্তাসমুদ্রের তীরে অবিরাম কথামালার ঢেউ উঠছে, পড়ছে। তাল পাবার আশায় ছ’ কাপ চা খেয়ে নিয়েছি। মালতী বার তিনেক, “ভাত খাবে কী! চা খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে যাবে।” বলে গজগজ করে শেষে রণে ক্ষান্ত দিয়ে বাইরের ঘরে মেঝেতে থেবড়ে বসে বাংলা সিরিয়ালে মজেছে। হঠাৎ গলির বুক বিদীর্ণ করে সে কী এক আকুল বিলাপ উঠলো — “না, খাবো না! খাবো না! যখন তখন আমাকে খেতে বলিস না তোরা।”

সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ম সুরে অতসীর চীৎকার, “যখন তখন মানে? দুপুর হয়েছে, খাবেন না?”

“না, না, না। আমাকে মেরে ফেলো এর চেয়ে। খেতে বলো না।”

“আহা! ন‍্যাকামি দেখো! গেলো বিষু‍্যদবার, লক্ষ্মীবার, ভাতের থালা ঠেলে দিলেন। বলি, সংসারের মঙ্গল চিন্তাটুকু তো শত্রুতেও করে! আর আপনি না এদের মা, ঠাকুমা?”

ধীরে এসে জালনায় ঠেসে দাঁড়ালাম। জানি, অন‍্যায় করছি। লোকের ব‍্যক্তিগত কথা লুকিয়ে শুনছি। কিন্তু সেদিন শুভ্রাদির গলাই আমাকে আকর্ষণ করে জালনায় টেনে এনেছিলো। বছর ঘুরে শুভ্রাদি পক্ষাঘাতে শয‍্যাশায়ী হয়েছে, কিন্তু কখনো তাকে মুখ ফুটে একটা রা কাড়তে শুনিনি। অভ্রদা চলে যাওয়ার পর থেকে এমনিতেই সে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো খুব।

আমি যে বারদুয়েক দেখতে গিয়েছিলাম ওকে, নির্নিমেষ শুধু তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। সে দৃষ্টিতে না ছিলো আহ্বান, না বিসর্জন। যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ কথা তো কিছু হতো না, আর অমন কর্মঠ মানুষটাকে নিথর শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে ভালোও লাগতো না।

সেই দুপুরে শুভ্রাদি দুর্বল গলায় সমানে তর্ক করলো। চলতে লাগলো তীব্র চাপান, সাথে দুর্বল উতোর। “না, আমি হাঁ করবো না!”

“কিছুতেই না? এত্তো জেদ? এদিকে ফিরুন! ফিরুন বলছি! এই শুনছো? শুনে যাও একবার। কি মহা জ্বালা! দ‍্যাখো মা কী করছে আজকে।”

কিছু পরে অংশুর গলা কানে যেতে আমি স্তম্ভিত। রাস্তার ধার ধরে গোবেচারা মুখে অফিস চলে যাওয়া ছেলেটা যে এইভাবে নিজের অসুস্থা মাকে কথা শোনাতে পারে, তা আমার স্বপ্নের অতীত ছিলো। “কী দিল্লাগী হচ্ছে এসব, অ‍্যাঁ? খেয়ে নাও না! মহা ঝামেলা মাইরি! একটা মোটে ছুটির দিন, দুপুরের খাওয়াটা সবাই মিলে একসাথে করবো, ব‍্যাগড়া দিও না তো! গেলো গেলো!”

bongdhong-newsletter-banner-1 2

অংশুর ওই “সবাই মিলে”-র দলে যে শুভ্রাদি নেই তা বুঝলাম। তা তো হবেই। বিছানায় পড়া, রোগে ক্ষত, ব্রাত‍্য অকোজো শরীরটার কী বা দাম আজ পরিবারে? রোগের পুঁটলিটাকে কোনোক্রমে গিলিয়ে দায় ছুটাতে পারলেই বাঁচা যায়। কিন্তু তাই বলে মানুষকে খাবার জন‍্য এত অশ্রদ্ধার আহ্বান! কাঙাল ভোজের সারিতে বসা কাঙালীরাও এর থেকে বেশী আদর সম্ভাষণ পায়।

আমার কেমন যেন মনে হল, এক অদম‍্য সুতীব্র অভিমানের অপ্রকাশ‍্য কান্নায় শুভ্রাদি এমন জেদীপনা করছে। ব‍্যস্ত অমনোযোগী পিতামাতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সন্তানরা যেমন দুষ্টুমি করে, অনেকটা সেরকম। তবে বুড়ো মা আর কোলের ছেলে কি এক হল? “চ‍্যাংড়ামো হচ্ছে? জিদ্দীপনা? দাঁড়াও, সব জিদ্দীপনা আজ তোমার ঘুচিয়ে দেবো। এই মাসি, তুমি উঠে ঠ‍্যাং দুটো ধরো তো! অতসী, কুইক! আমি চোয়ালটা খুলছি, ঢেলে দাও গলা ভাত। দেখি, কেমন না গেলে!”

জালনার এপারে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে প্রমাদ গুনলাম। এভাবে শোওয়া অবস্থায় দুর্বল রুগীকে জবরদস্তি খাবার গেলানোটা কি নিরাপদ? শেষে একটা কেলেঙ্কারি না হয়। শুভ্রাদির অনবরত অঁ অঁ আঁ উম্ ম্ ম্ ইত‍্যাদি নানা প্রতিবাদ ভেসে আসতে লাগলো। আমাকে অমন উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসার ঘর থেকে মালতী উঠে এলো। “আবার শুরু হয়েছে? সত‍্যি চোখে দেখা যায় না গো।”

ওকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। হঠাৎ শুভ্রাদির তুমুল কাশি শুরু হল। সাথে অংশুর প্রচণ্ড চীৎকার, “ধ‍্যাত্ শালা! দিলো রোববারের বিরিয়ানীটার পিণ্ডি চটকে। সব বমিটা আমার এই দামী লুঙিটাতেই করতে হল? ইশ্শ, কতো শখ করে অতসীর মা জামাই ষষ্ঠীতে আমায় দিয়েছিলো! দেখলে অতসী? ইটস্ অলমোস্ট নিউ!”

লুঙির শোকে অংশু কাতরাতে লাগলো। শুভ্রাদির কাশির ধরণটা আমার একেবারে ভালো লাগলো না। রুগীর ঘর থেকে ওই বুকবিদীর্ণ কাশি ছাড়া আর কোনো আওয়াজ এলো না।

স্মৃতির সরণি পথে ভেসে এলো সেই শীতের পড়ন্ত বিকেলে ছেলের ওগড়ানো ভাতের বমি পরিষ্কার করে অবেলায় স্নান সেরে ছেলেরই খালি পেটের চিন্তায় দুঃখী মা’র নির্মল মুখখানি। ছেলেকে খাওয়াতে কত যে সুলুক সন্ধান করতো শুভ্রাদি। আমাকে বলতো, “ভাই, তুমি তো লেখক মানুষ। নাছোড়া বাচ্চাকে খাওয়ানোর কি কি পন্থা আছে, ভাবো তো!”

শুনে হাসতাম। কখনো ভারি মিঠে গলায় ছড়া গেয়ে ছেলেকে ভুলাতে শুভ্রাদি —

বক্ বক্ দিন রাত
পায়রার দল, ঘোরে দোরে
ঘুরে ফিরে, বড় চঞ্চল।
কত দূর দেশে ওরা উড়ে উড়ে যায়
ফিরে আসে পথ চিনে আপন বাসায়।

এরপর আর বেশীদিন বাঁচেনি শুভ্রাদি। সংসারের খাঁচার দাঁড়ে ওর দেহটা পড়ে থাকলেও মনটা কোন শূন‍্যে লক্কা পায়রার স্বাধীনতায় উড়ে উড়ে বেড়াতো। “হাঁ করো, হাঁ করো” করে শত চীৎকারেও ওর মুখ খোলানো যায়নি। চারাপানি হেলা ভরে ছড়িয়ে না দিয়ে ভালোবেসে যত্ন করে মুখে ধরলে হয়তো বা খেতো। কে জানে?

শেষে একদিন চঞ্চু থেকে দৈন‍্যদীনতার খড়কুটো ফেলে উড়ে গেলো। মুক্তির ডানা মেললো। মেয়েদের যা জীবন! সে কি তার নিজের জন‍্য বাঁচার মতন বাঁচার জীবন?

ওদের জালনার শিকগুলো ধরে দাঁড়িয়ে কত সুখস্মৃতি, কত দিনপঞ্জীর খুঁটিনাটির কথকতা করতো শুভ্রাদি। কালো লোহার শিকগুলো শূন‍্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই তো পদ্মপাতার জীবন। অথচ তাতো কত বীজকুড়ি কাটে মানুষের অহং, স্বার্থ, দ্বেষ, হিংসার। ভাবে, এগুলোই চরম সত‍্য বুঝি!

ভাবি, মা হইনি তাই জানি না মায়েদের স্বরূপ কী। মায়েদের নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ‍্য, আরাম স্বার্থ, কিছুই কি থাকতে নেই? মাংসের রোলের শেষ কামড়টা, বিরিয়ানীর হাতার শেষ অংশটা, বড় মাছের টুকরোটা, ফ‍্যানের হাওয়ার ভালো জায়গাটা, বিছানার আরামদায়ক বালিশটা — সবই শুধু অন‍্যের প্রাপ‍্য। আর আছে মায়েদের বুক জোড়া এক অনন্ত আশার সামিয়ানা বিছনো। আমার সন্তান আমাকে ভালোবাসবে, দেখবে, যত্ন নেবে। এই আশা, এই আকাঙ্খা। যখন আশা আকাঙ্খার সযত্নে রচিত গাছ বাস্তবের কঠোরতায় মুখ থুবড়ে পড়ে তখন অভিমানে বুক পাথর হযে যায় মায়েদের। মাতৃসত্তা চূড়ান্ত ঘা খেয়ে চলৎচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে যায়, তাই মায়েরা হাঁ করে না আর। কী লাভ অপমানের খাবার খেয়ে, শুধু দেহসর্বস্ব হয়ে জড়বৎ বেঁচে থেকে? সন্তানের স্নেহহীন, ভালোবাসাহীন বাঁচাকে কি বাঁচা বলে?

খুব ঘটা করেছিলো ওরা শুভ্রাদির কাজে। হল ভাড়া করে। বিরাট ফটো। ধূপ দীপ অগুরুতে ম’ ম’। মোটা মোটা মালা। আজও দেখলাম তাকিয়ে আছে শুভ্রাদি। তবে চাহনিতে মরা মরা বোবার দৃষ্টি নয়। বরঞ্চ বেশ যেন একটা বেঁচে গেছি টাইপের কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি।

শ্রাদ্ধবাড়ির চারিদিকে বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে। একধারে মহিলাদের গল্পের জমাটি আড্ডা চলছে। শুনলাম অতসীর মা বলছেন, “অতসীদের এই ঝামেলাটা না হলে এই অঘ্রাণেই ওর ভাই আর সুলেখার চার হাত এক করতাম।” কেউ বা দক্ষিনাপণে শপিং-এর কাহিনী ফেঁদে বসেছে। কেউ গৃহশান্তি বজায় রাখতে ফেং শুই-এর জ্ঞান দিচ্ছে। অতসী কার সাথে যেন বসে দই আলুদমের রেসিপি বুঝে নিচ্ছিলো। আমাকে দেখে উঠে এলো। হঠাৎ “কাকীমা, খেয়ে যাবেন কিন্তু!” — শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি অংশু দাঁড়িয়েছে পিছনে।

খাওয়ার কথায় কেমন যেন কেঁপে উঠলাম। “হাঁ করো! হাঁ করো বলছি!” ভেসে এলো কানে। বললাম, “এই টাকাটা রাখো। শুভ্রাদির কাজে লাগিও। আজ আমার শরীর বিশেষ ভালো নেই। আজ আসি। জোর কোরো না।”

আনমনে রাস্তা দিয়ে চলেছি। শুভ্রাদির চোখের ভাষা বোধগম‍্য হয়েছে এখন। মনে গুন্গুন্ উঠছে শুভ্রাদির গাওয়া ছড়ার গান —

দূর দেশে ওরা উড়ে উড়ে যায়
ফিরে আসে পথ চিনে আপন বাসায়।

শুভ্রাদি কি তাহলে এতদিনে পথ চিনে ফিরে গেছে ভালোবাসায় ভরা ভালো বাসায়? এই প্রথম মাতৃত্বহীনতার জন‍্য মনে বড় স্বস্তি পেলাম। বাঁশ নেই, তাই বাঁশুরিও নেই। মন্দ কী? বাঁশুরিতে ললিত বসন্ত রাগ নাও তো বাজতে পারতো।

শুভ্রাদিকে মনে মনে স্মরণ করে বললাম, “যাও শুভ্রাদি! ওড়ো। স্বাধীন ডানায় ভর করে। যাও দূর থেকে দূরে। পথ চিনে ফিরে যাও ভালোবাসায়, ভালো বাসায়।”

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

2 comments
Add Your Reply