ফুলের নাম অপরাজিতা

Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla font properly.

(এই লেখাটি প্রতিলিপির ‘উজান – নতুন বোধন’ প্রতিযোগীতায় পুরস্কৃত হয়েছে।)

আমি পেশায় একজন ক্রাইম রিপোর্টার। কাজের সূত্রে প্রতিনিয়ত কত শত অপরাধী আর ভাগে‍্যর হাতে বিড়ম্বিত মানুষের অশ্রুজলে গাঁথা জীবন কাব‍্যের সাক্ষী হলাম। কত কেস হিস্ট্রি বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসলো। কিন্তু একটি কেস হিস্ট্রি আমার চেতনায় বিলুপ্ত হয় না। আমাকে এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়। মানুষ যে ক্রমাগত চরৈবেতির মন্ত্রে দিক্ষীত অমৃতের সন্তান, তার চলা যে কেবল উত্তরণের পথে, সেই কথাই বার বার আমাকে মনে করিয়ে দেয়। আমার ভঙ্গুঁর মনের বল, হতাশ প্রাণের আশা আর দুর্বল মনের শক্তি শতধারায় বিচ্ছুরিত হয় যখন আমি এই কেস হিস্ট্রির অন‍্যতম ভিক্টিম লক্ষ্মীর কথা ভাবি।

সাল ২০০৫। সারা দিল্লী তো বটেই, গোটা দেশ নড়ে চড়ে বসেছিল লক্ষ্মী আগরওয়াল বনাম নঈম খানের কেসে। অ‍্যাসিড অ‍্যাটাক ভিক্টিম লক্ষ্মী। পনের বছরের কিশোরী, সর্বোদয়া বিদ‍্যালয়ের ছাত্রী ছিল সে। এই কেসে রিপোর্টারের দায়িত্ব নিয়ে প্রায় দু বছর আমি যাতায়াত করেছি কোর্টে। কাছ থেকে আলাপ করেছি লক্ষ্মী ও তার পরিবারের সাথে। মানুষ তার জীবনের প্রৌঢ়ত্বে এসেও যে উদার জ্ঞান, মনের শক্তি আহরণ করতে পারে না, ওই এক রত্তি মেয়েটা কেমন করে তা আয়ত্ত করেছিল তা ভাবলে অবাক লাগে। অথচ কোনোদিন ওর মধ‍্যে এতটুকু আতিশয‍্য দেখিনি। না দুঃখের, না শোকের, না আনন্দের। হার না মানা হার গলায় পরেছিল যেদিন সে, সারা বিশ্বের অভিনন্দনে ভেসে গিয়েছিল, সেদিনও এতটুকু গৌরবে ডগমগ করতে দেখিনি তাকে। বরং দ্বিধাহীন কণ্ঠে সে জানিয়েছিল তার উত্তরণের পথ ছিল কাঁকর বিছোন। কাঁটায় ভরা। চলতে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সহস্র বার সে পড়ে গেছে, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। দগ্ধ-দীর্ণ হয়েছে। তার বলা কথায় আরো কত দগ্ধপ্রাণ বুকে বল পেয়েছে, চোখে আবার লাগিয়েছে আশার সুর্মা। আজ সেই কথাই বলবো।

সাদা সুতী কাপড়ে মুখ মাথা পেঁচিয়ে বাবার সাথে কোর্টে এসে শান্ত হয়ে বসে থাকত লক্ষ্মী। উকিলদের চাপান-উতোর, বেআক্কেলে প্রশ্ন, বাক‍্যবাণ কিছুই ওকে উত্তেজিত করতে পারত না। শুধু জাজ বা উকিল যতবার নঈম খানের নাম নিত ততবার লক্ষ‍্য করে দেখেছি মেয়েটা কেঁপে উঠত। ওর বাপুজী ওকে শক্ত হাতে ধরে থাকতেন কাঁধে বের দিয়ে।

কেস চলেছিল প্রায় দু বছর। হতভাগ‍্য মেয়েটার সাথে কি হয়েছিল, কেন হয়েছিল তার সবই জেনেছিলাম। আর হতভম্ব হয়ে গেছিলাম যখন দানবটা প্রথম কেস হিয়ারিং-এর আগে অমন জঘন‍্য ক্রাইম করেও বেল-এ ছাড়া পেয়ে শাদি করে বসল। মেয়েটার দেহ তো পুড়েইছিল, এই ঘটনায় তার মনের ক্ষত যে কি পরিমাণ দগদগে হয়ে উঠেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি? আমাদের সমাজটা তো রূপের পূজারী। গুণের বিচার আসে অনেক পরে। সমাজ এই নিপীড়িত বিকৃত চেহারার মেয়েগুলোকে ভয় আর ঘৃণার চোখে দেখে। একবারও ভাবে না দেহের সীমাহীন যন্ত্রণা ছাড়াও প্রতি পল প্রতি ক্ষণে পুড়ে যেতে থাকে এদের আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রেম। রোজ এরা কোনোরকমে একটা দিন টেনে পার করে দেয়। নিজের মৃত‍্যু কামনায় বিভোর থাকে। তারপর আসে আরও একটা দিন। তারপর আরও এক। আরও। এইভাবে উদ্দেশ‍্যবিহীন, লক্ষ‍্যহীন হয়ে জীবোন্মৃত মেয়েগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে রূক্ষ শুকনো প্রেমের ছায়াহীন ঊষর জীবনপথে কাপড়ে মুখ ঢেকে শুধু চলে। অন্তবিহীন চলা। একদণ্ড সুস্থির বিশ্রামের ছায়া নেই কোথাও।

কার দোষে মুখ ঢেকে চলে এরা? কি দোষে নিজেদের শাপ শাপান্ত করে বুঝিনা।

আমি অনেক ভেবেছি। মানুষের নিষ্ঠুরতার কোন তল পাই না। স্টপ অ‍্যাসিড অ‍্যাটাকস্ বা SAA প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেঁ জড়িত থেকে কাছ থেকে দেখেছি এই সহজ সরল মেয়েগুলোকে। দেহের ক্ষত সারাতে এরা পকেটের রেস্ত ফুরিয়ে ভিখিরি হয়ে যায়। আর মনের ক্ষত? তা আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মত কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলে এদের। গোটা গোটা হাত পা মুখওয়ালা ক’জন মানুষ ভাবে এদের কথা?

মার খাওয়া মেয়েগুলো সমাজের ঘৃণা, অবজ্ঞা, ভীতির ভয়ে বোবা হয়ে থাকে। বিকৃত মুখ, অন্ধ হয়ে অক্ষিকোটর থেকে নামে বেদনার বন‍্যা। সমাজের লোক দেখানো চাকচিক‍্যময় অচলায়তনের বালুভূমে মুহূর্তে সেই বেদনার জল উপে যায়।

আমার মতন কোর্টরুমে উপস্থিত অসংখ‍্য মানুষ চমকে উঠেছিল যেদিন লক্ষ্মীর কেসে রায় দিলেন জাজসাহেব। দোষীকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড শুনিয়ে জাজ লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করলেন তার কিছু বক্তব‍্য আছে কি না। ভেবেছিলাম আর একবার নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গেঁর সাক্ষী হয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমের ওষুধ গিলে রেহাই পাব। কিন্তু লক্ষ্মী রেহাই দিলে না অত সহজে। সবার চোখে ঘুম চিরতরে উধাও করার ফন্দিতে সে একটানে সভামাঝে খুলে ফেলল তার মুখের উপর থেকে সাদা সুতীর ঢাকনা। শিউরে উঠলেন জাজ, হা হয়ে গেল আসামী পক্ষের উকিলের মুখ, মুন্সীর মুখ গেল ঝুলে। আমি নিথর, লক্ষ্মীর বাবা চাদরের খুঁটে মুখ ঢাকলেন। তারপর কানে এল লক্ষ্মীর বলা কথা যার এক বর্ণও ভুলব, এমন সাধ‍্য আমার কই?

“ধর্মাবতার, আমার পোড়া ঝলসানো অর্ধেক মুখ দেখিয়ে আপনাকে চমকে দিয়েছি বলে ক্ষমা করবেন। দোষীকে দশ বছরের শাস্তি দিলেন। তাতে আমার কি? আমি সর্বোদয়া বিদ‍্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। বড্ড ইচ্ছে ছিল গান শেখার, অল ইণ্ডিয়া কম্পিটিশানে গান গাইবার। থাক, আপদ গেছে। মুখই নেই তো গাইব কি! দুটো ডাল রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলতে কষ্টে জান বেরিয়ে যায়, তার আবার লেখাপড়া, গান করা!

“খান মার্কেটে একটা বই দোকানে পার্ট টাইম কাজ পেয়েছিলাম। বাপু সামান‍্য রাঁধুনীর কাজ করেন। খুশী হয়ে বলল, ‘ওই টাকায় তুই গান শেখ লছমী। গানের দিদিকে বলে কালই ভর্তি হয়ে যা ক্লাসে।’ তারপর এল আমার স্বপ্নপূরণের সেই দিন। ২২শে এপ্রিল ২০০৫। ব‍্যাগে ছিল গানের স্কুলের ফর্মটা। বই দোকানের ডিউটি সেরে দাঁড়িয়েছিলাম খান মার্কেটের জমজমাট রাস্তায়। বাস স্টপে একা থাকলেও রাস্তাভরা লোক ছিল, যানবাহনের স্রোত ছিল। কিন্তু ওই দিনদাহাড়ে, হাজার মানুষের চোখের সামনে সূর্য‍্যের আলোয় ওই দানব আমার স্বপ্নটাকে জ্বালিয়ে দিল আমার সঙ্গেঁ। আমার দুগুনা বয়েস। কুপ্রস্তাবে না বলেছি, এই আমার অপরাধ হুজুর।

“বাসটা সময় মতন এলে আজ আমার পোড়ামুখ আপনাকে দেখতে হত না। আপনি নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে নিদ্রা যেতে পারতেন। আচমকা ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়লাম একটা দেবদারু গাছের গোড়ায়। দেখি স্কুটার থেকে থামছে ওই লোক আর ওর সঙ্গিঁনী। কিছু বোঝার আগেই আমাকে ‘স্বাহা’ করে আগুনে আহুতি দিয়ে দিল ওরা। ফুটন্ত লাভাস্রোত নিমেষে গ্রাস করল আমাকে। জ্বলছে মুখ, পুড়ছে চুল, বুক। খসে গলে পড়ছে হাত পায়ের চামড়া। আমাকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে আমার সাথে দাউ দাউ জ্বলছে ওই দেবদারু গাছ। বলির জন্তুর মত গড়াগড়ি দিচ্ছি আমি। চীৎকার করছি আকাশ ফাটিয়ে।

“এক পশুর বিপদে অন‍্য পশু ছুটে আসে দেখেছি। চীৎকার করে সাহায‍্য জোগাড় করে। আমরা না কি জীবশ্রেষ্ঠ। মান আর হুঁশ দিয়ে ঈশ্বর গড়েছেন তাঁর সেরা জীবকে। একটা জ্বলন্ত পোড়া আবর্জনার বস্তার মতন পা দিয়ে আমাকে ঠেলে গেল ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। কেউ তামাশা দেখে হেসে গড়াল। কেউ বা ভয়ানক বিরক্ত হয়ে নাকে মুখে দোপাট্টা চাপা দিল ঘৃণায়। কেউ বা তড়বড়িয়ে হেঁটে পেরিয়ে গেল ফালতু ঝামেলার ঝঞ্ঝাট থেকে। কেউ সন্দেহ করল ভদ্রবাড়ির মেয়ে বৌ এ নয়। কোনো ছোটলোকের ছেনালিপনার নতিজা।”

টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে জল খেতে থামল লক্ষ্মী। কোর্টরুমে সবাই স্তব্ধ। নির্নিমেষে চেয়ে আছেন জাজ। আর আমার মন তখন খোলা আগল। পাষাণ প্রতিমারা তবে কি এতদিনে কথা বলতে শিখল? তবে কি অন‍্যায়ের প্রতিবাদ হবে? খুলবে সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন চোখ?

“জানেন ধর্মাবতার, আমার বাপু সামান‍্য রাঁধুনী। আমার জন্মের সময় বাপুর তো কোনো ঘরও ছিল না এ শহরে। জন্মের পর তুমুল বৃষ্টির হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে মা কাঁথায় জড়িয়ে নিয়েছিল আমায়। বাপু আমাদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল একটা বাস আড্ডায় চার দিন। মা বলেছিল, অত অনটনেও বাপু ভরসা হারায়নি। মাকে বলেছিল, ‘সাক্ষাত মা লছমী এসেছেন, আর ভয় কি আমাদের?’

“আমি আমার বাপুর লাডলী লছমী জাজ সাব। আমি কোনো রাস্তার রাঢ়ী নই। আমি লেখাপড়া, গান, সংসারে মাকে সাহায‍্য করা, বিমার ভাইয়ার দেখভাল, ইস্কুলের বন্ধু, গোলগাপ্পা চূরণ গোলি, হোলী দিওয়ালী নিয়ে মেতে থাকা একটা তিত্লির মত ছিলাম। কোন দোষে আমার ডানাগুলো ছেঁটে দেওয়া হল, বলুন!”

কার ঘাড়ে কটা মাথা ছিল যে কথা বলবে লক্ষ্মীর কথা পৃষ্ঠে? লক্ষ্মী ঘুরে দাঁড়াল আসামীর দিকে। নিজের মুখে হাত বুলিয়ে আনমনে বলল, “আমি কিছুতেই ভয় করবো না আর।” তারপর জাজকে উদ্দেশ‍্য করে বলল, “হুজুর, আমার মত আরও প্রজাপতিরা আছে বাইরে। ওদের সাথে যাতে এই না-ইন্সাফি না হয় তার জন‍্য দয়া করে খোলা বাজারে অ‍্যাসিড বিক্রি বন্ধ করে দিন। তাহলেই আমি খুশী হবো। শক্তি পাবো, হয়তো শান্তিও।”

আমাদের মহান ভারত তো! লক্ষ্মীর আবেদন, আশা পূর্ণ করে খোলা বাজারে অ‍্যাসিড বিক্রি বন্ধের রায দিতে দিতে কেটে গেল আরও বছর তিনেক। ততদিনে কোর্টরুম থেকে লক্ষ্মীর উত্তরণ ঘটেছে এই পৃথিবীর মুক্ত আকাশে একটা রঙ্গীঁন তিতলির মতই।

আমি তাকে সঙ্গেঁ করে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের সামাজিক কর্মক্ষেত্র স্টপ অ‍্যাসিড অ‍্যাটাকস্-এর দফতরে। সংস্থার কর্ণধার ও কর্মী আলোক দু’হাত বাড়িয়ে শুধু গ্রহণই করল না, লক্ষ্মী পেল ক‍্যাম্পেনিং কোঅর্ডিনেটারের চাকরি। পরিচিত হল রূপা, স্বপ্না, সুস্মিতাদের সাথে। ওর দগ্ধ বুকে তখন উথলে উঠছে অরূপ সায়রের প্লাবণ। রূপের সীমারেখা ছাড়িয়ে মনের অরূপরতন সায়রে ডুব দিলে একমাত্র ওই অমৃতরসের অধিকারী হওয়া যায়। বুঝলাম লক্ষ্মীর বাহ‍্যিক রূপ পুড়ে মন হয়ে গেছে খাঁটি সোনা। কি অফুরন্ত শক্তি আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা মেয়েটার। নিজের সাথে লড়াই তো আর ওর কম কিছু হয়নি। ঘটনার তিন মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সারাদিন ঘরে বসে থাকত। আমাদের SAA-এর কাউন্সেলিং ক্লাসে লক্ষ্মী আমাদের জানিয়েছিল সেই সব দুঃসহ দিনের কথা।

এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং-এর অন‍্যতম মন্ত্র হল মনের আগল খুলে ভেতরে যত ক্ষোভ, রাগ, দ্বেষ আছে সব বের করে আনা, যাতে মন গুমরায় কম। মনের আবর্জনা কমে গেলে তবে তো হালকা হবে মন। মন যত সুস্থ হবে, দেহও সাড়া দেবে সুস্থতার আশ্বাসে। আমরা লক্ষ্মী, স্বপ্না, ঋতুদের বললাম, যারা তোমাদের এই ভাগ‍্যবিপর্যয়ের জন‍্য দায়ী, তাদের চিঠি লেখ। সেই চিঠি জেলে পাঠানোও হবে যদি তোমরা চাও।

শুনে মেয়েদের মধ‍্যে গুঞ্জন উঠল। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে এমনটা হতে পারে। “চিঠি লিখব আমার সৎ মাকে? যে আমার এই হাল করে ছেড়েছে? কভি নেহী,” গর্জে উঠল স্বপ্না। তাকে যত বোঝানো হয় সে রুখে উঠে। রাজি নয় ঋতুও। লক্ষ্মী চিঠি লিখবে কি, ওই দানবের নাম শুনতেই তার শরীর ঝিমঝিম করে। মেয়েদের ভাবতে সময় দেওয়া হল। শেষ পর্য‍্যন্ত রাজি হল মেয়েরা। আর সে সব কি এক একখানা দলিল! সমুদ্র সেঁচে তোলা মুক্তো যেন এক একটি মনের শুক্তি। চিঠিগুলো পড়ার দায়িত্বে ছিলাম আলোক, আমি আর লক্ষ্মী নিজে।

চিঠির বয়ানে ভেসে উঠল বিকৃত মুখের মেয়েগুলোর স্বর্নবরণ মনের আলোকসামান‍্য রূপ। স্বপ্না জন্মাবধি মাতৃহারা। সবাই বলত মেয়ে যত বড় হচ্ছে একেবারে মায়ের মত দেখতে হচ্ছে। সৎ মায়ের তাণ্ডবে তটস্থ স্বপ্না দিনশেষে রাতের বিছানায় শুয়ে শুয়ে এক রত্তি আয়নায় মাকে দেখত। মনে হত মা যেন তার ভেতরেই আছে। সেই মাকে তেজাবে পুড়িয়ে ছারখার করে দ্বিতীয়বার তাকে মাতৃহারা করল সৎ মা। আর কোনোদিন সে নিজের মুখের প্রতিচ্ছবিতে মাকে পাবে না, এটাই তার সবচেয়ে বেশী দুঃখ।

স্বপ্নার স্বপ্ন সে মস্তবড় সেলাই দোকান দেবে। ফ‍্যাশান ডিজাইনে নাম কামাবে। সে লক্ষ্মীদিদির জীবন কাহিনী শুনেছে। সে জানে এই সমাজ তাকে সহজে চাকরি দেবে না। তার বিকৃত মুখ যার জন‍্য সে নিজে বিন্দুমাত্র দায়ী নয়, সে দ্বারে দ্বারে ফিরবে তবু আশ্বাস পাবে না। তাই সে স্বাধীন ব‍্যবসা করে নিজের পায়ে খাড়া হয়ে স্বাবলম্বী হতে চায়। আর তার একান্ত ইচ্ছে সহেলী ঋতুর মনে লাল রং নিয়ে ভয় দূর করার জন‍্য নিজের হাতে তাকে লাল রঙ্গেঁর একটা লেহেঙ্গাঁ বানিয়ে দেওয়া। আক্রমণকারীকে সে মনের কোণে আজ আর স্থান দিতে চায় না। তার প্রতি স্বপ্নার মনে আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই।

ঋতু যদি সেদিন লাল লেহেঙ্গাঁয় নিজেকে সাজিয়ে সহেলীদের সাথে মুভি দেখতে বের না হত, তাহলে পাড়ার ওই বজ্জাতটা তার এই কাণ্ড ঘটাতে পারত না। ঋতু তার এক চোখের বন‍্যায় চিঠির পাতা ভিজিয়ে নিজেকে কোষতে থাকে। তার স্বপ্ন কবে সে লক্ষ্মীদিদির মতন ঘোমটায় মুখ না ঢেকে বড় রাস্তায় হেঁটে যাবে এক পশলা বৃষ্টি শেষের রোদ্দুরে সোঁদা গন্ধ গায়ে মুখে মেখে। আক্রমণকারীকে তার প্রশ্ন, অ‍্যাসিড ঢাললে যে কি যন্ত্রণা হয় তা যে ঢালে সে কি বোঝে না?

লক্ষ্মীর চিঠি — “আমি, আমার তনহাই আর এই খাতা, আমরা যেন পরস্পরের ডোরে কবে থেকে বাঁধা পড়েছি। হাসপাতালে যে রুমে ছিলাম, একটা আয়নাও ছিল না। অথচ নিজেকে দেখার প্রবল বাসনা। ভোরের সিস্টার মুখ ধোওয়ার জন‍্য যে জলপাত্র আনতেন তাতেই মেলে ধরতাম মুখ। শুধু ব‍্যাণ্ডেজ বাঁধা। মন ভোলাতে আমার হাতে তারা ধরিয়ে দিলে এই খাতা আর কলম। সেই শুরু। আমি লিখতাম। মনের যত কথা, বোঝা না বোঝার ব‍্যথা উজার করে লিখতাম। শুধু লিখতে পারতাম না একটা নাম। একটা দানবের পাষাণ নৃশংস নাম। তোমার নাম। অথচ আজ লিখতে বসেছি সেই দানবকেই। নঈম খান, এই খত্ তোমাকে লিখছি আজ আমি।

“আমার চিকিৎসায় বাপু সর্বস্বান্ত হল। সাতটা অপারেশান হল। শেষেরটায় ভেণ্টিলেটারে ছিলাম। যে কোনো অপারেশান কষ্টকর। কিন্তু মনে যা আঘাত পাচ্ছিলাম সমাজের থেকে, তার ক্ষত বাড়ছিল দিনে দিনে। কোর্টরুম ছাড়া প্রথম তিন বছর কোথাও বেরোইনি। তিন বছর এমনি কেটে গেল। চোখের পাতা জ্বলে গিয়েছিল, তাই ‘পলক পড়ার মতন’ লিখতে পারলাম না।

“আমার যে থোঁতা মুখ ভোঁতা করবে বলে পণ নিয়ে তেজাব ছুঁড়েছিলে, সেই মুখ নিয়ে গর্বে মাথা উঁচু করে বাঁচব বলে সেলাই শিখলাম, বিউটিশিয়ান কোর্স করলাম, ফায়দা হল না। লোকে ভয় পেল, কিন্তু সাহায‍্য করল না। আর তোমার মতন লোক নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল, বেল পেয়ে শাদি রচালো, তাকে ভয় পেল না কেউ!

“উল্টে আত্মীয় বেরাদরি যারা হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসেছিল, মুখ বেঁকিয়ে বাপুকে বলল, মুখে না পড়ে দেহের অন‍্য জায়গায় তেজাব পড়লে কম সে কম আমার বেহা তো হতে পারত। তাছাড়া এই তো তাদের মেয়ে বোনেরাও তো আছে, কই এমন তো তাদের সাথে হল না! বিটিয়াকে ঢং-সে পালতে জানতে হয়। শুনে শুনে মন অবশ হয়ে গেল। এই তো মানুষ, এই সমাজ আমাদের। তাই তোমাদের মতন কুকুররা দিব‍্যি ঘুরে বেড়াতে পারো রাস্তায় রাস্তায়।

“একটু সুস্থ হয়ে চাকরির খবর পেয়ে একটা স্কুলে গেলাম। সেখানে শুনতে হল, বাচ্চারা ভয়ে ভিরমি খাবে আমাকে দেখে। শুনে নিজেই পালাতে পথ পেলাম না।

“কোর্টে যতবার দেখা হত তোমার সঙ্গেঁ আর তোমার সঙ্গেঁ নাম নেওয়া হত আমার, ততবার মনে হত পুড়ছি অপমান আর অবসাদের হোমানলে।  ভাবতাম এই যন্ত্রণাদায়ক মৃত‍্যুর কি কোনো শেষ নেই? শেষ হল সেই অত‍্যাচারের। পরে বুঝলাম আমি নিজের সাথে রক্তাক্ত মনন যুদ্ধে লড়ে লড়ে লোহার মতন শক্ত হয়ে গেছি। তাই তো ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছি ওই সুতীর ওড়না। নঈম খান, তোমাকে বলছি, তুমি শোন : তোমার কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে মিটিয়ে দেবার, শেষ করে ফেলার। আমি আবার ভালোবেসেছি নিজেকে। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। আমি আবার স্বপ্ন দেখেছি। আমি ভয় জয় করেছি। আমি তোমাকে ভয় পাই না, নঈম খান।

“আমি একা নই। আমার মতন আরও আছে ডানা ভাঙা তিতলি। আমি লড়ব ওদের জন‍্য। বাঁচব ওদের জন‍্য। ওদের ফিরিয়ে দেব ডানার জোর — আত্মপ্রেম, আত্মবিশ্বাস। আমরা বাঁচব। উড়বো ফুলে ফুলে, মুক্ত বাতাসে।”

লক্ষ্মীর চিঠি যেন জ্বলন্ত অঙ্গাঁর জ্বেলে দিল আমার মনে। কি গভীর আত্মপ্রত‍্যয়ী হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু খারাপ ভালো নিয়েই জীবনচক্র চলে। আলোক আর লক্ষ্মী কাজের মাধ‍্যমে পরস্পরের কাছাকাছি এসে যখন নিজেদের আরও ভালো করে জেনেছে, বুঝেছে, হঠাৎই চলে গেলেন লক্ষ্মীর বাপুজী। সেটা ২০১২ সাল। ভদ্রলোক মেয়েকে এত হিম্মত জোগাতেন, ভেতরে ভেতরে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। বাবাকে আলোকের কথা জানাতেও পারল না লক্ষ্মী।

Laxmi Agarwal with First Lady Michelle Obama to receive International Women of Courage Award.

Laxmi Agarwal with First Lady Michelle Obama to receive International Women of Courage Award.

ভদ্রলোক এটাও দেখে যেতে পারলেন না যে পরের বছরেই আমেরিকা থেকে ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার নিমন্ত্রণে তাঁর মেয়ে International Women of Courage Awards অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেল। বিশ্বের বাছাই করা দশজন মহিলার মাঝে আলোর শতদল হয়ে ফুটে রইল বাপুজীর লছমী। সারা বিশ্ব শুনল লক্ষ্মীর বক্তব‍্য এক কবিতার মোড়কে। লক্ষ্মীর বলা সেই জ্বলন্ত সত‍্য অভিজ্ঞতা, “যে মুখ তুমি একদিন পুড়িয়ে দিয়েছিলে অ‍্যাসিডের বিষাক্ত বহ্নিতে, সেই মুখ আমি ভালোবাসি। আমি আবার প্রজাপতির মতন উড়তে শিখেছি, বনে বনে, ডালে ডালে।” হাততালির বন‍্যায় ভেসে গেল লক্ষ্মীর যত গ্লানি, বেদনা। গোটা বিশ্ব সসম্মানে অভিবাদন দিল এই সাহসিকাকে।

আমরা ভোর রাত্রি অবধি SAA-এর অফিস ঘরের টিভিতে দেখলাম আমাদের বিজয়িনীর অভিযান। গৌরবে, আনন্দে হৃদয় উদ্বেল হল আমাদের। দেশে ফিরে লক্ষ্মীর কাজ বাড়ল বই কমল না। শুরু হল টিভি চ‍্যানেল শো ‘উড়ান’, স্কুলে স্কুলে কাউন্সেলিং। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান, এনজিও সবাই তাকে চায়। এছাড়া তার আছে Shoot Acid-এর পরিকল্পনা মাফিক কাজ। সুপ্রীম কোর্টের রায় ধরে বসে না থেকে লক্ষ্মীরা ভলেণ্টিয়ার নিয়ে চলে যেত গ্রামে গ্রামে, মফঃসলে সরজমিনে তদন্ত করতে খোলা বাজারে অ‍্যাসিড কিভাবে বিকোচ্ছে তা জরীপ করতে। এতে কাজ হয়েছিল। বেপরোয়া অ‍্যাসিড বিক্রি অনেক কমে গিয়েছিল।

২০১৪-এর এক ভোরে নবারুণ রাগে সেজে লক্ষ্মী ঘর বাঁধল আলোকের সাথে। বিবাহ মানে না তারা। সমাজের প্রথাগত রীতি রেওয়াজও মানে না। ভালোবাসে দুজনে দুজনকে, আমরণ সাথে থাকবে এই অঙ্গীঁকার। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম কিভাবে জীবন দেবতা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিচ্ছিল লক্ষ্মীর জীবনপাত্র। আজ ভাবি, লক্ষ্মী তার সমস্ত হৃদয়ের অণু পরমাণু দিয়ে চেয়েছিল সেজে উঠতে, ভরে উঠতে। তাই সে চেষ্টা করেছিল জীবনের প্রত‍্যেকটা দিন, প্রত‍্যেকটা ক্ষণের রং বেরং-এর সুতো তার জীবনের মাকুতে গেঁথে ফেলতে। আধ পোড়া গলিত মুখ উঁচু করে সমাজের বুকে হেঁটে চলে যেতে অনেক মনের জোর লাগে। লাগে তিল তিল আত্মপ্রস্তুতি। মানুষের চোখ দাঁত মুখ ভঙ্গিঁমা তো পড়েই থাকে পথে, অন‍্যের দুঃখ ক্ষত খুঁচিয়ে দিতে আমাদের তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের জুড়ি মেলা ভার।

অথচ মানুষ দিয়ে ঘেরা মনুষের সমাজেই তো বাস আমাদের। পারস্পরিক বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা না থাকলে বাঁচি কি নিয়ে? SAA-এর মেয়েগুলোকে দেখি আর মন পাথর হয়ে ওঠে। অবিরাম চলে ওদের যাওয়া আসা। জাজ হাতুড়ি ঠোকে, অ‍্যাসিড বিক্রিও হয়, ছোঁড়াও হয়। হতাশ হই মাঝে মাঝে। হাল ছেড়ে দিয়ে এলিয়ে থাকি চেয়ারে মাথা রেখে। ঘরে মৃদু পায়ের আওয়াজে তাকিয়ে দেখি মুখে শিউলি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্মী।

“কি রে ডুমুরের ফুল! আছিস কেমন?” বলতেই কপট রাগ দেখায়। “আরে ছোড়ো তোমার যত্তো সব ডুমুরের ফুল মূল! চল, ঘুরে আসি।”

নাঃ, দেশ-বিদেশে ক্রমশঃ সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা মেয়েটা সেই একইরকম সরল পাগলি রয়ে গেল। “চলো দিদি, আজ আমার তোমাকে কিছু দেখাবার আছে।”

বেরলাম পথে। প্রথমেই গেলাম ওর মানসকন‍্যা ‘ছাওঁ’-তে। অ‍্যাসিডে মুখ শুধু নয়, সত্তার আত্মা পোড়ানো মেয়েগুলো বেশীরভাগই আর ঘরে ফিরতে পারে না। বিভিন্ন ইণ্টারভিউ, কাউন্সেলিং, সর্বোপরি পরিশ্রমে জমানো টাকা দিয়ে লক্ষ্মী বানিয়েছে এই ছায়ার আশ্রম। দগ্ধ অনল শান্ত হয় ছায়ার শীতলতায়। “এমন মিষ্টি নাম,” হেসে বলতে ও হাসল না। বলল, “স্কুলে স্কুলে আমাকে ডেকে বলে এসব ঘটনা বন্ধ করার উপায় কি? আমি বলি আগে বাবা-মাদেরও ডাকাও। যত দোষ নন্দ ঘোষের তো নয়। শুধু ছাত্রদের দোষ দেখে লাভ কি? না ভেবে চিন্তা করে তাদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে কারা? আর আছে বিষাক্ত নাগিনীর মতন সমাজে ছেলে-মেয়ের তফাত দেখা। এগুলো বন্ধ হোক আগে। জানো দিদি, শুধু ছায়ার আশ্রয় নয়, চাই কর্মব‍্যস্ততা। ওরা বাঁচবে কি নিয়ে? সবাই তো আর আমার মতন বই কলম ধরে উঠবে না! তুমি ঠিকই বলতে। যত লিখেছি তত আগল খুলে গেছে গো!”

‘ছাওঁ’ থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মী ছাড়ল না। চেপে বসলাম অটোতে। লক্ষ্মী খোলা চুল মুখের ওপর থেকে সরাতে সরাতে বলল, “মেয়েগুলোকে হাতের কাজ শেখাবো। স্বপ্নাটাকে এখন বোলো না, ওকে একটা দরজি দোকান দেব।”

“কিন্তু টাকা?” চিন্তায় পড়লাম। আমার হাতে চাপ দিয়ে বলল, “হয়ে যাবে। আলোক জোরদার ক‍্যাম্পেনিং চালাচ্ছে আমাকে নিয়ে। সমাজের চোখ খুলছে দিদি। তাছাড়া একটা ফ‍্যাশান ডিজাইনিং অর্গানাইজেশান থেকে মডেলিং-এর অফার পেয়েছি। তুমি ভাবতে পার?” বলে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল।

আমি অভিভূত। ঈশ্বর পরম করুণায় ওকে দেহ মনের সুদূর পারে নিয়ে যাচ্ছেন। জানি, ও ভাবছে ওর বাপুজীর কথা, তাই বিরক্ত করলাম না।

এ কি! এ তো খান মার্কেটের সেই অলুক্ষুণে বাস স্টপটা! “লক্ষ্মী?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি। মেয়ে দেখি মৃদু মৃদু হাসছে। কাঁধের ঝোলা থেকে বার করল একটা কালো গোলাপ। লাল টুকটুকে রং ছিল, কালো কালি স্প্রে করেছে বুঝলাম। ধীরে গিয়ে গোলাপটা রাখল একটা দেবদারু গাছের গোড়ায়। পাতাগুলোকে খুব আদর করল। তারপর বলল, “মানুষের মঙ্গঁলের জন‍্য এখনও কিছু কেন করতে ইচ্ছে হয় জানো? কারণ পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষই বেশী আছে দিদি। যতবার নিজের গলা পচা মুখটাকে শারশিতে দেখতাম, ভাবতাম আমি কেন? আমাকেই কেন? মনে হত সবাইকে শেষ করে নিজে শেষ হয়ে যাই। মনের এই অবস্থায় তুমি আমাকে নিয়ে গেলে স্বপ্না-রূপাদের সাথে মেলাতে। সবার সাথে দুঃখ বাঁটলাম, মন জুড়িয়ে গেল। এল অসুরের মতন কাজ করার শক্তি। মানুষের উপর যতবার বিশ্বাস হারাতে গেছি, চোখের ওপর ভেসে এসেছে সাদা চুল দাড়ি ঢাকা এক বুড়ো ট‍্যাক্সি ড্রাইভারের আকুল মুখ। আমি তখন পথচারীদের পায়ের ঠেলা খেয়ে আপ্রাণ চীৎকার করতে করতে ক্রমশঃ ঢলে পড়েছি মৃত‍্যুর মুখে। হঠাৎ একরাশ শান্তি বারি পড়ল আমার পোড়া দেহে। বোতলের জল আমার গায়ে মুখে ছিটিয়ে বুড়ো পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল আমায়। মনে হল মা যেমন আমায় কাঁথা মুড়িয়ে অঝোর বৃষ্টি থেকে বাস স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল সেই ক্ষণটুকু। সারা রাস্তা আমাকে তার স্বান্তনা, হিম্মত দেওয়া — ‘ওয়ে পুত্তর! কুজা রি বাপারিআ হৈ। ম‍্যায়নু অসপাতাল করানাল তুহানু লাই জাঙ্গা। কী হয়ে আ! চিন্তা না করো!’”

বহুদিন পর দেখলাম চোখের ঢাল বেয়ে কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী। “আমি উড়তে শিখে গেছি, দিদি। মন থেকে ভয়ের কাঁটা উপড়ে ফেলেছি বহুদিন। আজ প্রতিশোধের কাঁটা তুলে ফেললাম ওই কালো গোলাপ দিয়ে। সামনের মাসে জেলছুট হচ্ছে লোকটা। নঈম খান। আমি ওকে আর ভয় পাই না। আমি কিছুতেই আর ভয় পাই না।”

অস্ত রবির রং লেগেছে লক্ষ্মীর এক ঢাল পিঠ ছড়ানো চুলে। ওর দৃপ্ত ভঙ্গিঁ, আত্মবিশ্বাসের দিপ্তীতে কি অপরূপা দেখাচ্ছে ওকে। ওই সোনার আলোর মতন আলোকের ভালোবাসা ওকে পূর্ণ করুক। মনে পড়ল, আজ ২২শে এপ্রিল ২০১৫। ১০ বছর পূর্ণ হল লক্ষ্মীর তিতলি অভিযানের।

Stop Acid Attacks-এর ওয়েবসাইট

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

1 comment
Add Your Reply