রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশ : বাবুয়ানির ইতি কথা

Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla font properly.

(এর আগের পর্ব: বারোয়ারি পূজোর বারো কথা)

চুঁচড়ো পার্টি চুপ করে বসে থাকার মাল নয়। গুপ্তিপাড়ার সাথে রেষারেষির বাহানায় তার এবার পূজায় বলির বন‍্যা বইয়ে দিয়েচে। তিনটে বড় বড় মোষ, একশখানি ভেড়া, তা বাদে তিনশ পাঁটা বলি চড়েচে। শহরের যতো ঘোষ বোস দে মিত্তির, সিঙ্গি রাজা গজা, দুঃস্থ তেলী, পুঁটে বামুন — সবাই পেসাদ পেয়েচে। উদ‍্যোক্তা বারোইয়ারী বাবুরা বলির রক্তের বড় বড় ফোঁটা তিলক কেটে চাদ্দিক হুম্ হাম্ করে বেড়াচ্চে।

আজ এদেরও হাফ আখড়াই হবে। গুপ্তিপাড়ার সাথে সমানে সমানে লড়ে যেতে প্রস্তুত চুঁচড়ো পার্টি। হাফ আখড়াই লড়বে আজ ধোপাপাড়ার দল। সন্ধ‍্যা হবো হবো কচ্চে। বারোইয়ারীতলা লোকে লোকে ছয়লাপ। ক্রমে দু’ একটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দেওয়া হল। বেলোয়ারি বাতি জ্বালা হল। অধ‍্যক্ষবাবুরা একে একে ধুতি সামলিয়ে জড়ো হচ্চেন। থেলো হুঁকো ঘুরচে হাতে হাতে। এসেচে মণ দেড়েক গাঁজা, চরস, বড় বড় গামলায় দুধ। বারোইয়ারী সেবায় পাড়ার পঞ্চানন মুদী দোকানের এলাচ, কর্পুর, চারুচিনি মুফ্তে দিয়েচে। তামাকের ব‍্যবস্থাও যথেষ্ট রয়েচে।

একদিকে খাড়া হয়ে আচে কাঠগড়ায় ঘেরা চুঁচড়ো পার্টির মাটির সং। বড়মানুষেরা দেকে বেড়াচ্চেন, লোকেরা ঘুরে বেড়াচ্চেন, ছেলে ছোকরার দল অকারণে হো হো করে বেড়াচ্চে। ভরপুর বেলায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে চলতে লাগলো ধোপাপাড়া বনাম চকবাজার দলের হাফ আখড়াই-এর চাপান উতোর।

দর্শককুল সবে রসে মজো মজো, হঠাৎ পেছন থেকে মহা শোরগোল উঠলো — “ওহে, গুপ্তিপাড়ার জ‍্যান্ত সং, ল‍্যাজ ঝোলা বাবুর সং, সে না কি একটা দেখবার বিষয়! চলো চলো সব!” চুঁচড়ো পার্টির অধ‍্যক্ষরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মজলিশ চত্বর অর্দ্ধেক ফাঁকা হয়ে গেলো।

গুপ্তিপাড়ায় তখন জমে উঠেছে আসর। টুকলির দুঃখে আর সবজে মণি বেদখলের শোকে বাবু উথাল পাথাল। তাঁর কোনো জ্ঞানগম‍্যি, বোধবাদ‍্যি নাই যে কি ঘটনা ঘটচে। অতএব তিনি বিনা বাক‍্যব‍্যয়ে গোপীমোহনের দেওয়া পোষাকে সেজে দু’ বগলে দুটো বোতল নিয়ে মহানন্দে টলে টলে ইদিক থেকে উদিক আবার উদিক থেকে ইদিক করচেন।

বাবরি কাটা চুল, উল্কি কেটে, কানে মাকড়ি পরা যাত্রার অধিকারী দুটো দুটো ছেলেকে সখী সাজিয়ে আসরে পাঠালো। তারা  নাকি গলায় প‍্যানপ‍্যানানি ধরলে —

“ওলো সই, কালো জল খাবো না
কালো মেঘ দেখবো না
কালো কাপড় পরবো না।
ওলো আমার এক বুক পিপাস
আমার দু চোখ ভরা কালো
আমার গতর আগুন হোলো।”

আর আমাদের মাতালের শিরোমণি কলুটোলার বাবু, ইতর ভদ্রাদি জ্ঞান ভুলে, ল‍্যাজে গোবরে হয়ে উদোম গায়ে “কেষ্ট লাও! কেষ্ট লাও!” বলে মহা চীৎকার জুড়ে দিলেন। বাবু যতো চেল্লান, হুল্লোড় ততো বাড়ে।

বাবু জানেন না যে তাঁর ধুতির বেশ আসলে এক ল‍্যাজখসা কাকাতুয়ার! তাঁর মাথার চুলে সেঁটে দেওয়া হয়েচে সফেদ ঝুঁটি সমেত টুকটুকে লাল ঠোঁটের মুখোশ। বাবু যতো লাট খেতে খেতে সং-এর কাঠগোড়ায় ঘোরেন ফেরেন, ততো জোরে তালিবৃষ্টি হয়। লোকে জ‍্যান্ত সং-এর রং ঢং-এ মজে বাহবা দেয়। হাসির তুফান ওঠে। বাবুর সঙ্গী তোষামুদে কানাইকে বলা বাহুল‍্য প্রতিবাদ করার অবস্থাতেই রাখেনি গোপীমোহনের দল। তাকেও সুরার সমুদ্রে ডোবা পোত করে ছেড়েচে।

জ‍্যান্ত সং-এর কারসাজিতে চুঁচড়ো পার্টিকে জব্দ করে গোপীমোহনের দল যখন উল্লাস মানাচ্চে, তখন কলুটোলার বাবুর বিশ্বস্ত খাস চাকর বাসুদেবের তৎপরতায় ষোল উড়ে বেহারার দল কোনোক্রমে সুরা সাগরে নিমজ্জিত এই পোত দুটোকে উঠিয়ে নিয়ে কলুটোলার পথ ধরেচে।

তারপর অনেক চোয়াঁ ঢেকুর, গা মাটি মাটি, মাথা ধরা সামলে ঘরের লোক ঘরে ফিরেচেন। ঢুকেই বাবুর গোলাপী নেশা চৌচির। টুলোর দেখা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে সপ্তমীর রাত্রেই মা’কে বিসর্জন দেওয়া হয়েচে।

যে বল্লালকে প্রাণাপেক্ষা বিশ্বাস করে এয়েচেন, সেই না কি টুকলিকে নিয়ে টুকি টুকি খেলতে খেলতে মুল্লুক ছাড়া হয়েচে। এখন ন’ ছেলে মণিহারা ফণি হয়ে শ‍্যামবাজারে বধূর চরণামৃত ধুয়ে ধুয়ে খাচ্চেন আর বিস্তর সাধাসাধি কচ্চেন।

টুকলি তো গেলোই, সাথে গেলো মান ইজ্জত। বাইরের নকল বাবুয়ানির বেনোজলের স্রোতে পাক খেয়ে ঘুরে ঘুরে চলে গেলো ঘরের শোভনীয়তা, লক্ষ্মীশ্রী, আব্রু। এ তো শুধু কলুটোলার কাহিনী নয়, এ আপামর বাবু সমাজের পরিণতি।

কোলকেতা শহরে তখন নতুন করে বান ডাকছে সমাজে সংস্কৃতিতে। বাবু সম্প্রদায়ের বনেদীয়ানা  তখন আর প্রায় নেই বললেই চলে। নেই সারাদিন বসে লক্কা পায়রা ওড়ানো আর দশ টাকার নোটে পাকিয়ে বিড়ি ফোঁকার অকর্মণ‍্যতা। কোলকেতার বাবুদের রং ঢং রকম সকম নিয়ে সে যুগের দুর্গোৎসবের কাহিনী রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশের কথা এখানেই শেষ। আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে আমাদের এক মাস ব‍্যাপী এই ধারাবাহিক রচনাটি।

(সমাপ্ত)

পড়ুন ‘রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশ’ ধারাবাহিক রচনার সব পর্বগুলি

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

2 comments
Add Your Reply