রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশ : কৃষ্টচন্দ্রের কন‍্যা কষ্ট

Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.

(পূর্বানুক্রমে)

শ‍্যামবাজারের দেওয়ান কৃষ্টচন্দ্র। বেড়ে বোলবোলা। দেউড়ি, পূজাবাড়ি, লন-বাগান, নহবতখানা, ভিস্তিখানা, তোষাখানা, খাজাঞ্চিখানা, রান্নাবাড়ি, কাছারিবাড়ি, সেরেস্তা, বৈঠকখানা। সদর দ্বারে রোশনচৌকী। রোশনচৌকী থেকে চার প্রহরের সাত রাগ রাগিনী। তোড়ি, ভৈরব, দরবারি কানাড়া। ফি দূর্গাপূজায় গোটা বাড়িতে রং-চুন পড়ে। বেলোয়াড়ি বাতির সাজ লাগে। সুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের রামতনু দত্ত মশায় এনার খাস দোস্ত। মীর্জাপুর থেকে আনানো গোলাপ জল রামতনুবাবু পাঠান কৃষ্টচন্দ্রকে। তাতে আতর মিশিয়ে কৃষ্টচন্দ্রের ছড়া কাঁট, পরিষ্কারের সৌখীনতা চলে। বন্ধুর কতায় রাজি হয়ে নিজের একরত্তি মেয়ের গৌরীদান করেছিল কৃষ্টচন্দ্র কলুটোলার বাবুর বাড়ির ন’ ছেলের সাথে। বন্ধুর মধ‍্যস্থতায় সম্বন্ধ হয়েছিল। নইলে কৃষ্টচন্দ্রের যা তেত্রঁটে মেজাজ, তিনি যাবেন সেধে কারো দুয়ারে? তা মেয়েকে বড়ও করেছেন বটে সোনার কাঠি, রূপার কাঠিতে। মেয়ের মুখের কথায় আকাশের চাঁদ পেড়ে আনতেও পেত‍্যয় যাননি। তাবড় তাবড় বাবু, জজ মেজিষ্ট্রেট, দেওয়ান ছিল সব নিমন্ত্রিত জন। বাবুদের মধ‍্যে রেষারেষি তো কিছু কম ছিল না। সামান‍্য কিছু ছুতো পেলেই হল।

এই যেমন দুগ্গোপূজোয় খেলাত ঘোষবাবুর বায়না গেল ময়রা নলিনের কাছে — “দেকো হে, এমন হবে সন্দেশের ওজন যে সাতশো নাচুনী মাগীর পায়ের দাবড়ানিতেও ভাঙবে না কো!”

সত‍্যিই তয়ের হোত বিশাল বিশাল সন্দেশ! নাচতে হতো তার উপর নাচুনীদের ঢাকের তালে তালে। আর এক বাবুর শখ তিনি দুগ্গা ঠাকুর দেকে বেড়াবেন জোড়া জেব্রা টানা গাড়িতে। জোতা হল জেব্রা! শেষে সেই বন‍্যপ্রাণী মরে রেহাই পেলো নিত‍্যিকার এই লাঞ্ছনার হাত থেকে। আরে, যে যেটা করার জন‍্য জন্ম নিয়েছে তাকে দিয়ে উল্টো করালে সৃষ্টি কি চলে? “থালে তো গাছে গাছে মাচ ঝুলতো, আর দরিয়াতে পাতা ফল ফুলতো।” লোকে নিন্দে মন্দ কম করলে না, কিন্তু তাতে কি? লোকের কথা ধরলি বাবুর চলে না!

আমাদের কৃষ্টচন্দ্রবাবুই কি কম গা? দুগ্গা পিতিমে বিসর্জনের পর খালি পায়ে কলস মাথায় এক মাইল হেঁটে বাবু গৃহে ফিরতেন। সেই সময় যে কেউ তাকে পূর্ণ কলস দেখালেই ঝনাৎ করে গোটা একটা টাকা তার ঠেঙে ফেলে দেবেনই বাবু। তাই তাঁর পেছু পেছু সাত আট হাজার লোকের ভিড় লেগে যেতো কলস মাথায়। পাথুরেঘাটার মল্লিক কি চোরবাগানের বাবুদের “কালচারাল পোগ্গামের” নাম ভেসে যেতো কৃষ্টচন্দ্রের পঞ্চমী থেকে সাজানো মেহফিলের তোড়ে। হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, স্বয়ং নিধুবাবু আসর মাতাতেন টপ্পার টোপ ফেলে।

বিশাল বড় প্রতিমে দুগ্গা মায়ের আটচালায় কত কি ছবি! হুরি-পরী, পদ্মফুল, আবার খোদ স্কটিশ ধোড়সওয়ার দল। মায়ের সিংহ রূপোর। দুগ্গা মায়ের মুখের আদলে ফিরিঙ্গি বিবিদের ছাপ। চাঁদোয়ার পরীরা কেউ সানাই ফুঁকছে, কেউ আংরেজী প্রভুদের ঝাণ্ডা উড়োচ্ছে। রাজরাণী মাতা কুইন ভিক্টোরীয়ার রাজমুকুটের ইউনিকর্নটাও মা দুগ্গার আটচালাতে রীতিমতো শোভা পেতো!

সোনা রূপো হীরের গয়নায় আপাদমস্তক মুড়ে এ হেন মান‍্যগন‍্য কৃষ্টচন্দ্র যে গৌরীদান করলেন, সেই মেয়ে বিয়ের ছ’ মাস পেরুলো না বাপের ঠেঙে গমগমিয়ে এসে হাজির। কি, না “শ্বশুরকুল না ভিখিরির কুল! আমি গলা গঙ্গায় ডুবে মরবো তবু যাবো না এক পা ঐখেনে।”

সবাই যদি মুখের উপর কতা শোনাবার হিম্মত রাখতো তো কৃষ্টচন্দ্রকে শুনতে হতো — এত্তো আদর আর লাটসায়েবীর আদিখে‍্যতায় মেয়ে মানুষকে “নাই” দিতে হয়? উটেছে এখন বিষঝাড় হয়ে, কি হবে এমন দেমাকী, মেম-বৌ-এর! পান থেকে চুনটুক্ খসা পজ্জন্ত যে মেনে নিতে পারে না কো! মেয়ে মানুষের এমন দেমাক?

ঝি মানদা বাড়ির গিন্নীকে যে খপরটুকু জানায় তাতেই বাড়ির বৌ-ঝিরা জানতে পারে মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ির দেউড়ি মাড়াবে না যতক্ষণ না তার আদেরের মোতির জন‍্যে সেই কোন সুদূর ফ্রান্স দেশের পায়রার ডিম বৌ-এর আঁচলে বাঁধা না পড়ছে!

মেয়ে কি নিজমুখে কিছু বলে? সে এসে ইস্তক গোঁসাঘরে খিল দে আছে। মর্জি হলে কথা, দু কথা কয়, নয় চুপ থাকে। মানদা মেয়েকে বুকে কোলে বড় করেছে। যেটুকু উজাড় করার, সেখেনেই করে।

গিন্নীর রূপোর বাটায় সুগন্ধী এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জর্দা, কেওড়া আর গোলাপের সুগন্ধী, কাঁচা সুপুরি, ভাজা মৌরীর মিশেলে মিঠে পাতার শ’ তিনেক পান সাজতে বসেছিল মানদা ঘর বারান্দায় শেষ দুপুরের রোদে চুল শুকোতে শুকোতে। গিন্নী মুখে খান তিনেক পান পুরে দাসীকে দিয়ে চুলে ধূপের ধোঁয়া লাগাচ্ছিলেন দোলনা তাকিয়ায় গা ঢেলে দিয়ে। সমাজে কতা উটছে মেয়ের ব‍্যাভারে। গিন্নীর মন আনচান। যে বাপ সোহাগী মেয়ে! বাপ মেয়েকে পাটাতে না পারলেই বাঁচে, কিন্তু তা ন‍্যায‍্য হবে কি! সে ধিঙ্গি তো আর ঝিউড়ি নেই কো! তাঁর নিজের ঘরেই কি বৌমা-রা নেই? আজ বাদে কাল তারা এসব দেকে যে মাথা উলটাবে না তার  পেত‍্যয় আচে কি?

আর কি সামান‍্যি কারণে তুই দেমাক দেকালি মা! ঘর সোয়ামী সংসার থে তোর কাচে বড় হল মোতির পায়রার ডিম! তা কাহিনী শোনাই যাক!

হয়েছে কি, আর পাঁচটা বাবুঘরের বিবিদের মতোই বিয়ের পরে পরে আঁশ নিরিমিশ রান্নাঘর সামলে, বারো মাসের তেরো পাবন মিটিয়ে, মুক্তো মণির ঝালর দোওয়া হাতপাখার বাতাসে বসে পানের রসে ঠোঁট রাঙ্গিয়ে দেয়ালপটে ‘পতি পরম গুরু’ সিলে দাসীদের সাথে পুতুল খেলা, পুতুলের জামা-গয়না বানানো, তাশ পাশা খেলা, রূপোর কাঁটায় ধূপের ধোঁয়া খাওয়ানো খোঁপা সাজিয়ে সোয়ামীর প্রতীক্ষায় রাত জাগা, শেষে আবার সব অভিমান নতুন হীরের গহনায় ভুলে ধুমধাম করে বেড়ালের বে দোওয়া, এসব নিয়েই মেতেছিলো ন’ বৌ। সোয়ামীর বার বাড়ি আর ভেতর বাড়ির জীবনে তার মাতাব‍্যথা কমই ছিলো।

কারণ বাপের ঘর থেকে কোলে করে এনেছিলো সে তার হারানিধি, বুকের ধন মেনী, মোতিকে। মোতিকে নাওয়াতে খাওয়াতে সাজাতে ন’ বৌ-এর দিন কাবার হতো। সোয়ামীর বার বাড়ির হৈ-হুল্লোড় তার মনের আনাচে কানাচে কোন দাগ ধরতো না। গোল বাঁধলো বৌ-এর খাস দাসী ফুল্লরা হুলোর সাথে বৌ-এর মেনীর সম্বন্ধ পাকা হওয়ায়। হুলো কোলে ফুল্লরা যেদিন এয়েছিলো বৌ দেখতে তখুনি ন’ বৌ জামাইকে দেখে পচুন্দ করে ফেলেছিল ঘরজামাই হিসেবে। তাতে ফুলির মুখ কালো হয়ে উঠলেও বৌরাণীর ইচ্ছেয় না বলেনি। এই বৌ-এর দেমাক বেশী, মেজাজখানাও শান বাঁধা তলোয়ার! তায় আছে বাপের জমিদারী।

মোতির বিবাহ বাসরে লাখ খানেক লোক নেমন্তন্নে এসেছিলো। কি সে বাহার! কলুটোলার আশেপাশে চৌহদ্দিতে এমন বেড়াল-বে বাপের জন্মে লোকে দেখেনি কো! উপস্থিত আছেন দশটা মান‍্যগন‍্য বাবু!

মেনী কোলে বিবাহ বাসরে ঢুকেই ন’ বৌ দেকে ঝি-এর ছেলে মেনীর গলায় ও কি, ও! যেনো হাজার আলোর রশ্মিছটায় ম্লান হয়ে গেছে লাখবাতির বেলোয়াড়ি ঝাড়! হালকা সবুজ অনিন্দ‍্যসুন্দর দু‍্যতিতে ভরে গেছে হুলোর গলা বুক পেট। সেই আলোর উৎস হুলোর মাথার সোনার মুকুটের ঠিক মাঝখানে বসানো একটা সবুজ মণি। পায়রার ডিমের মতো! কি মায়াময় ঐ দু‍্যতি, কি যেন এক দুর্বোধ‍্য টানে চোখ টেনে ধরে রেখে দেয় তার রূপোর আলোয়। পাশে মোতিকে হীরে চুনি পান্নায় মুড়িয়েও এতো ম্লান লাগে?

 

কি আস্পদ্দা! কি হয়রানি! কি অপমান ঐ দাসীর! জামাইকে আশীব্বাদে সোনার সাতনরী হারখানা মুঠোয় চেপে দাঁড়িয়ে দরদরিয়ে ঘামতে লাগলো নতুন ন’ বৌ। জামাইএর গলা জোড়া ঐ সবুজ মানিক‍্যকে তুচ্ছ করবার হিম্মত হল না। একবারটি বলেনি কো এমন মনির মালিক সে, ঐ যে মিশিতে দাঁত ঘষে, ধোওয়া কাপড় পরে চুলে রিঠে ঘষে নবাবজাদী বসে আছে পাছাপেড়ে কাপড়ে!

মা ধরণী গো! দ্বিধা হও মা! এ পোড়ার মুখ নুকুবো কোথায়! আহা, মেনী আমার মিইয়ে গেচে গো মাগীর হুলোটার পাশে। চোখ জ্বালা করে ওঠে ন’ বৌ-এর। কাউকে কিছু বলা বোঝার সুযোগ না দিয়ে বিয়ের বাসর থেকে বৌকে এক টানে কোলে তুলে গুমগুমে পায়ে অন্দরে গিয়ে খিল দিলো বৌ।

তারপর শুরু হল বাক‍্যিবাণে সোয়ামী শ্বশুরের আদ‍্যশ্রাদ্ধ। অমন মণি তার মোতির গলায় চায়, নইলে হেলাভরে ছেড়ে চলে যাবে ঐ কলুটোলার দেউড়ি। এখন, চাই বললেই তো হয় না কো! আমার ঐ চাঁদটা চাই — বলতে কতখন্? কিন্তু পাড়া যাবে কি? ন’ ছেলে, খোদ কর্তা, বল্লাল তার আরো গুষ্টির খপরি দল লাগিয়েও ঐ মণির জন্ম বেত্তান্ত জানতি পারলে না। ফুল্লরা তার হুলো নে ঐ ঘটনার পর যেন কর্পূর হয়ে মিশে গেচে বাতাসে। তার আর কোন খপরই দিতে পারে না কেউ!

দশদিনের মাতায় নোক সমাজে কর্তার নাকটি কেটে মেনী কোলে সেই যে ন’ বৌ ষোল বেহারার উড়ে পাল্কিবাহকের ঘাড়ে চেপে শ‍্যামবাজারে বাপের ঘরে গেলো, বছর ঘুরে গেলো, আর ফেরেনি।

সমাজে কথা হয় বৈ কি! কিন্তু বধূর গুমর! ঐ পায়রার ডিমপারা সবুজ মানিক‍্য যেদিন মোতি পরবে, বৌ তদন্তে ফিরবে!

পূজার গোড়ায় গিন্নীর নথ নাড়া ঝাল কষা বাক‍্যি হজম করা ছাড়াও কলুটোলার বাবু এক মস্ত গেরোয় পড়েছেন বেয়াই কৃষ্টচন্দ্রকে চটিয়ে। বাগবাজারের পট্টিতে একটা চালের আড়তের ঠিকাদারি আটকে দেছে কৃষ্টচন্দ্র ঝুটা কারণ দেখিয়ে। সে দেওয়ান। তার ক্ষ‍্যামতা আছে বৈকি! প্রায় হাজার টাকার লোকসান খেতে খেতে বাবু নাজেহাল।

বাপ দাদার আমলের সে বোলবোলাও নেই। কেমন করে বেয়াই-এর চটকানো পিত্তি মসৃণ করবে ভেবে পায় না কলুটোলার কর্তা।

(ক্রমশঃ)

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment: