দুগ্গা দুগ্গা

Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.

পাঠক বন্ধুরা,
লক্ষ‍্য করে দেখেছেন কি, বর্ষার ঘন কালো মেঘের আড়াল থেকে প্রায় প্রায়ই উঁকি দিচ্ছে বৃষ্টি ধোওয়া নীল আকাশ। সূর্য‍্য মুখ তুললেই সোনা সোনা রঙে ছেয়ে যাচ্ছে গাছপালা, পথঘাট, বর্ষার জলে শ‍্যাওলা পড়া নোনা দেওয়ালের বাড়িঘরগুলো। এই আলোর কোনো তুলনা হয় না। জানেন, বছরের আর অন‍্য কোনো সময়ে এই আলোর উদ্ভাসিত রূপ দেখাও যায় না। কী যে জাদু আছে এই শরতের আলোয় তা কে জানে? বাড়ির পাশের ডোবাটায় হঠাৎ চোখে পড়ে দুটো লাল টুকটুকে শাপলা। বুকে আবার হীরের কুচি শিশিরবিন্দু। সূর্যের সোনার আলোয় টলটল করছে। দুধসাদা হাঁসগুলো কি আরো একটু ফরসা হয়েছে? ওদের জলধোওয়া ডানাগুলো নবারুণের আলো পড়ে কমলা-সোনা রং! পানা সবুজের জল কেটে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে ওরা।

ডোবাটার ওপারে গোয়ালাদের ঘর। ছোটবেলায় একবার লক্ষ্মীপূজার সময় কী প্রলয়ঙ্কর ঝড় জল! আকাশ ফালা ফালা করে দিচ্ছে বিদ‍্যুৎ। মেঘের জান্তব গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। কতই বা বয়েস? জালনার গরাদের ওপারে সভয়ে তাকিয়ে দেখি উন্মত্ত হাওয়ায় বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়া পথঘাটায় প্রায় নুয়ে নুয়ে পড়ছে তাল সুপুরি নারকোল গাছগুলো।

কি সাদাটে পর্দা বৃষ্টির! চরাচার ছেয়ে ফেলেছে যেন। উন্মত্ত জলপ্রপাতের মত লাফিয়ে নামছে আকাশের বুক চিরে। তার উপর সোনায় সোহাগা — লোডশেডিং। সেই বিখ‍্যাত লোডশেডিং-এর যুগ সেটা। ঘণ্টা ঘণ্টা আঁধারে থাকা। চোখ, মন, শরীর অবশ করে, যাবতীয় নিত‍্য কর্ম, সৃষ্টির উদ্দীপনা জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা শুধু।

এমনি প্রলয় ঝড়ে ঘরে ঘরে বঙ্গঁবধূরা পেতেছে মা লক্ষ্মীর আসন। সারাদিন ধরে চলছে পূজার আয়োজন। বুনো হাওয়ার খ‍্যাপাটেপনা উপেক্ষা করে দেখলাম পাশের বাড়ির তিন্নির দাদা নারকোল গাছ বেয়ে উঠছে। তিন্নির ঠাকুমার হাতের নারকোল তক্তি খেতে স্বর্গ থেকে নেমে আসেন সাক্ষাত মা লক্ষ্মী, এমনই শুনে আসছি আমরা। ঠাকুমার হাতের প্রসাদ বিকোয় পাড়ার প্রতিটা বাড়িতে। সাদা থান কোমরে তেত্রঁটে করে পেঁচিয়ে ঝড়ের উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাঁধা বড়ি খোপা এক হাতে চেপে অন‍্য হাতে নেড়ে নাতিকে উস্কান, ‘আরো এট্টু, মনু রে! তর ডাইন কান্দা!’

ঝুপ ঝুপ ঝুপ ঝুপ — বাগানের কাদা মাঠে নারকোল পড়ে। শোঁ শোঁ বাতাসে নীল ফ্রক উড়িয়ে কোঁচর করে তিন্নি। ঘরের ভিতর থেকে বাইরের ঝড়ের তাণ্ডব বেশ লাগে দেখতে। কিন্তু এই ঝড় জলে ফ‍্যাসাদ বাঁধালো মা। মুখ শুকিয়ে বললো, ‘ওরে, গোয়ালপাড়া থেকে পোয়াটাক দুধ না আনলেই নয়। পরমান্নে কম পড়লো। স্বাদ খুলবে না। ছুটে যা বাপ!’

কী করি? বীর বিক্রমে অঙ্গঁ সাজালাম এক বিঘত পলিথিন শিটে। ছাতার কি কাম? সে তো একটিপ নসি‍্য মাত্র এখন। খালি পা। ভদ্র সাজার এই কি সময়! হাঁটু জলে জুতো করবেইটা কি?

বেরুনো মাত্র বাজ হাঁকলে — কড্ কড্ কড্ কড্। মেঘ বোমা ছুঁড়লে, গুদুম্ গুদুম্ গুম্ গুম্ গুম্ গুম্। এনাদের হাঁক ডাকে মায়ের মিহিগলার ‘দুগ্গা দুগ্গা’ সঙ্গঁত করতে পারলো না। পাগলা হাওয়ায় ভেসে গেল তেপান্তরের মাঠে।

টিনের ক‍্যান হাতের মুঠোয় থাকতে চায় না। সে বলে, ‘হা রে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে/ আমি উড়ব আকাশ ফুঁড়ে/ আমি ঘুরবো দূরে দূরে/ আমি মরব না ওই গোয়ালঘরে দুধের বোঝা বয়ে।’ এ তো মহা আপদ। যত তাকে আঙুলের গেরোয় গেঁথে রাখার চেষ্টা করি, সে লাট খেয়ে হাওয়ার পাকে পাকে কেবল শূনে‍্য ওড়ে। শেষে তাকে বুকে চেপে ধরি। কোনোরকম ডোবার ধারে এসে দেখি এক হাত বাকি ডোবা আর রাস্তার কোলাকুলিতে। গোয়ালারা ব‍্যস্ত লাল শালু বাঁধা বাঁশ পুঁতে দিতে ডোবাকে আলাদা বোঝাতে। তাদের কালো কুঁদে কুঁদে পাথুরে গা বেয়ে বৃষ্টির ঝর্না ঝরছে। সাদা ধুতি খাটো বাঁধা গায়ে লেপ্টে আছে। তাদের হাঁক ডাক ব‍্যস্ততার সীমা নেই। কেউ আনছে বালি বস্তা। কেউ আনছে বাঁশ।

আমি দুধের ক‍্যান বুকে চেপে এক কোণে দাঁড়াই। আমার মতন অকিঞ্চিৎকরকে তারা খেয়ালও করে না। শেষে এক গোয়াল বৌ লাল শাড়িতে ভিজে দোপাটি হয়ে আমাকে শুধোলে, ‘খাড়ায়ে ক‍্যান রে, মা?’ বললাম বৃত্তান্ত। শুনে সে বললে পুরুষরা এখন পারবেনি, কারণ পুকুরের জল উঠল বলে। ইশারায় সে নিজেই ডেকে নিল গোশালে। দর্মার বেড়া ছাওয়া। কাদা গোবর লেপা। মাচার মাথায় ভিজে খড় বেয়ে টুপটাপ। নিরীহ চোখে বাইরের তাণ্ডব জরীপ করছেন গো মাতা। পেলাম তাঁর কৃপা। কৃপাকণাকে আবার বুকে চেপে ফিরে যেতে হবে আরও সাবধানে। এবার আর রশি ছাড়া নয়। বেয়াদপ ক‍্যানটাকে এতটুকু প্রশ্রয় দেওয়া নয়। সাত রাজার ধন মানিক পোয়াটাক দুধ নিয়ে বীর বিক্রমে যখন পেছন ফিরলাম, গোয়ালনী মায়ের কণ্ঠে বলে উঠলে, ‘দুগ্গা দুগ্গা।’

আজ শরতের পুণ‍্য এক সকালে ওই গোয়ালপাড়ার দিকে তাকিয়ে ভাবি, কি এক অপার্থিব আলোক সামান‍্য সম্পর্কের সূতোয় আমরা পরস্পরের সঙ্গেঁ বাঁধা। যেন একটাই চিত্রবিচিত্র বাহারি নক্সাদার কার্পেট এই জীবনের পটচিত্র। আর আমরা সেই ঠাস বুনটের হাজার হাজার রঙীন রেশম সূতো। পরপর জোড়া বাঁধা। বুনন মসৃণ হলে কার্পেটও গড়ে ওঠে সুন্দর, নক্সাদার। বুননে ফেঁসো থাকলে কার্পেট হয় ফোঁপরা।

বুনন মসৃণ রাখা যায় কিভাবে? পরস্পরের সাথে সরল সহজ অকৃত্রিম সম্পর্ক স্থাপনের মাধ‍্যমে। নিজে ভালো থাকা শুধু নয়, অনে‍্যও যাতে ভালো থাকে, মঙ্গঁলে থাকে, সেটা দেখা।

সেই বৃষ্টিবিধূর প্রলয় দুপুরে অচেনা অজানা একরত্তি আমাকে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রেখে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল এক গোয়ালনী। কিন্তু কেন? তার দরকার কী ছিল? সে পয়সা বুঝে নিয়েছে, জিনিস দিয়েছে। লেন-দেন শেষ। কিন্তু শেষ হয়েও যা শেষ হয় না, তা হল আমাদের মনের এই মাধুর্য‍্যটুকু। স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা — এই সুকুমার বৃত্তিগুলো। যা ফুলের মতন ফুটে থাকে আমাদের মনের কাননে। সৌরভ ছড়ায় মানবতাবাদের।

মেঘহীন সোনাঝরা আকাশ, ফুলেল মৌতাতে ভরা বাতাস বুক ভরে টেনে নিই। রোজকার খুঁটে খাওয়া ওই কাক চড়াই শালিক পাখিগুলোকেও অলৌকিক মনে হয়। রূপের হাটের ওরাও যেন দামী পসরা। ওই সবজেটে ডোবা, লাল শালুক দুটি, সোনাগলা রঙে গলা উঁচিয়ে সাঁতরে যাওয়া হাঁসের পাল, আকন্দের ঝোপ, ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ, তিন্নিদের নারকোল বাগান, ডোবার ধারে লাল টুকটুকে গামছা গায়ে খুকীর চৈঃ চৈঃ সুরে হাঁস চরানো, মায়ের লাগানো অতসী গাছের হলুদ রং — সব ভালো লাগে এক মুহুর্তে। মনে হয় স্বর্গ আর অন‍্য কোথাও নয়। এই এখানেই আমার দৃষ্টিপথের চার দেওয়ালের মধে‍্যই। কারণ, স্বর্গ-নরক আমরাই তো বানাই। শুভ মন আর অশুভ মন নিয়ে।

বছর ঘুরে আবার আসছেন উমা। আমাদের মনকে মন্দির করে তোলার এই তো শ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের মনের আঙিনায় স্নেহের শিশির ভেজা শিউলি ফুলের জাজিমে আলতা পরা পা ডুবিয়ে মা আসবেন। বসবেন আমাদের হৃদমাঝারে — সিংহাসনে। আমাদের সকল শোক তাপ দুঃখ হরা হয়ে তিনি আসবেন। চপলা হবেন অচলা আমাদের ভক্তির প্রসাদগুণে।

জ‍্যোতির্ময়ী, সর্বভয়হারিণী, জগৎজননী চিন্ময়ী মাকে চিনতে যেন ভুল না করি। তিনি আছেন সর্বত্র, সর্বরূপে, সর্ববেশে। চিন্ময়ী বা মৃন্ময়ী হয়ে আছেন ওই তুলসীতলায় গরদপেড়ে হলুদের ছোপ ধরা শাড়ি পরা, শঙ্খ বাজিয়ে সংসারের মঙ্গঁলকামনারত গৃহবধুরূপে। মা আছেন ওই যে সবজির ঝোরা নিয়ে ক্লান্ত মুখে বাজারের গলিপথে বসে থাকা সবজিওয়ালীর বেশে। ঝাড়ু হাতে মহানগরের রাস্তা ভোরবেলা নিকিয়ে রাখছেন মা। হাতে আবার শখে পরা একরাশ বেলোয়াড়ি চুড়ি। মা চলেছেন সংসারের ঊনকোটি কাজ সামলে ঘেমো মুখে ত্রস্ত পায়ে ছেলেকে ইস্কুলে ছাড়তে। কলতলায় একরাশ বাসন পেতে বসেছেন বসনময়ী মা। মা ছুটে চলেছেন ভিড়ে ভরা বাসে, ট্রেনে, অটোতে। কর্মব‍্যস্ত, হুঁশিয়ারী ভঙ্গীঁতে। মা আছেন ওই শস‍্যশ‍্যামল মাঠে। আমাদের জঠরানল জুড়োবার জন‍্য হেঁটমুণ্ড হয়ে সমান ব‍্যবধানে পুঁতে চলেছেন ভরা ধানের শিষ।

মায়ের নৈবেদে‍্যর ডালি সর্বত্র সাজানো। ‘মা বলিতে প্রাণ, করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।’ এই চোখের জলে পুণ‍্যস্নানে মুছে  ধুয়ে যাক সকল গ্লানি। মা বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা হয়ে আসুন আমাদের হৃদয় মন্দিরে। বং ঢং ডট্ কম্-এর কর্মক্ষেত্র থেকে আমাদের সকল পাঠকবন্ধুদের জানাই শারদীয়া শুভেচ্ছা, ধন‍্যবাদ আর ভালোবাসা।

বিদেশের মাটিতেও বড় ধূমধামে পালিত হয় দূর্গাপূজা। পূজার পূর্বে আয়োজনে ‘পূজো আসছে পূজো আসছে’ ভাবটাই বড় সুন্দর। কত আয়োজন, কত উদ্দীপনা। কত মন, কত রং ঢং। মানুষের চিত্রবিচিত্র মনের অসংখ‍্য বিচ্ছুরণ। সেই বিচিত্রতার আলোর উৎস সন্ধানী আমি বরাবর। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে কত ঘটনার দিনলিপি। কোনোটা হাস‍্যরসে মুচমুচে তো কোনোটা আবার ঝালটকে রগরগে। ন‍্যাতানো মিয়োনোও আছে কিছু। সবই বিদেশে বাঙালীর দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে বিচিত্রমনের রং ঢং। তাই আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হবে বং ঢং ডট্ কম্-এর এক মাস ব‍্যাপী নতুন প্রকাশনা। পূজা স্পেশাল হাস‍্য সমগ্র “বিদেশে বাঙালীয়ানা” পড়ুন। মতামত লিখুন এবং শেয়ার করে অন‍্যদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

4 comments
Add Your Reply