Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.
চিলেকোঠার নিজের ঘরে বসে আছে নন্দ। তার প্রতি সবার দুর্ব্যবহারের কারণটা বুঝলেও শেষে কিনা দাদুর হাতে এহেন হেনস্থা! বাঁ কানটা টাটিয়ে আছে এখনো। কিছুক্ষণ আগেই বাঁ কানটা আচ্ছাসে মুচড়ে দাদু বললো – ‘দামড়া ছেলে! কালিদাস হয়েচো? যে ডালে বসেচো সেই ডালই কাটচো?’ অপমানে নন্দর চোখে জল এসে গেছিলো আর কি! সংসারে সবাই তাকে বোকা হাবা গবা বলে তাচ্ছিলে্যর চোখে দেখে। মরুভূমির বুকে একটুকরো মরুদ্যানের মতো দাদুর ভালোবাসাটুকু। শেষে কিনা সেখানেও এমন মোক্ষম গুঁতো খেতে হল!
পাক্কা বছর পাঁচেক পরে বিদেশ থেকে ব্যারিস্টারী পড়া শেষ করে দেশে ফিরেছিল নন্দর মামা। সবার জন্য কতো কি এনেছিল, তবে সেরা জিনিসটা পেয়েছিল নন্দ – একটা আই-ফোন। দশ ক্লাসের ছাত্র হিসেবে নন্দের একটা ঘড়ি আছে বটে, কিন্তু মোবাইল ফোন, তাও আবার আই-ফোন – সে ভাবতে পারেনি। বিস্ময়ে বিহ্বল তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মামা বলেছিল, ‘এই আই-ফোন কাছে থাকা মানে বিশ্বের দরজা খুলে যাওয়া। পাতি ফোনের মতো ব্যবহার না করে মেক আ গুড্ ইউজ্ অফ্ ইট্! দেখবি তোর আস্ত গোটা পার্সোন্যালিটি বদলে গেছে।’
অতি যত্নে আই-ফোন খানা প্রায় বুকে ধরে বাড়ি ফিরেছিল নন্দ। তাকে দেখে সবার মুখে মিচ্কে হাসি ফুটে উঠেছিল। ভাবটা – ‘হুঃ, বাঁদরের বুকে মুক্তাহার, দ্যাখো শোভে কি বাহার!’ দাদু কিন্তু খুশী হয়েছিল। নন্দকে কাছে ডেকে বলেছিল – ‘এই হল লোকের সাথে মেলামেশা বাড়াবার একমাত্র চাবিকাঠি। চারপাশের লোকজনকে দ্যাখ, চোখ কান খোলা রাখ, মতামত চালা, তবে কিনা লোকের চোখে সম্মান পাবি!’ একমাত্র ছোটবোন নমিতার মনে কিছু সন্দেহ ছিল, সে সংশয় ভরা চিত্তে শুধিয়েছিল – ‘দাদা, তুমি এর ব্যবহার পারবে?’
‘কেন, না পারার কি আছে?’ বিজ্ঞ মুখে শুধিয়েছিল নন্দ। স্মিত মুখে বোন বলেছিল – ‘না, মানে হাই ফাই তো! সব লেটেস্ট্ টেকনোলজির ব্যাপার।’ হাত উল্টে নন্দ বলেছিল – ‘যাঃ যাঃ লেটেস্ট্ টেকনোলজি! সব শিখে নেবো।’
শিখে নিয়েছিল নন্দ সব মামার কাছে। দেশ বিদেশের খবর চেক্ করা, আবহাওয়া সার্চ করা, মেলবক্স দেখা, ক্যালেণ্ডারের ব্যবহার, ক্যামেরায় ছবি তোলা, পছন্দের গান রেকর্ড করা, ভিডিও গেম খেলা থেকে শুরু করে মায় ফেসবুক্ খোলা পর্য্যন্ত। নন্দের নামে অ্যাকাউণ্ট্ খুলে ফেসবুকের দুনিয়ার সাথে তাকে পরিচিত করালো মামা। বুঝিয়ে দিলো কিভাবে বন্ধুত্বের জন্য অনুরোধ পাঠাতে হয়, তারপর সেই ব্যক্তি মত দিলেই ব্যস্ – বন্ধুত্বের ডোরে আবদ্ধ হয়ে দুজনায় যতো খুশী কথা চালাচালি, ভাব ঢালাঢালি করো, কোন বাধা নেই! নিজের ছবি, জন্মতারিখ ঠিকুজি কুলুজি সহ একটা প্রোফাইল খুলল নন্দ। মামা বলল, ‘স্ট্যাটাসে কি লিখবি?’
‘মিডল ক্লাস?’
হো হো হেসে মামা বলে – ‘না রে বোকা, এ স্ট্যাটাস্ সে স্ট্যাটাস্ নয় – এ হল সম্পর্কের স্ট্যাটাস! এরপর আছে ‘আবাউট মি’। সেখানে তোর নিজের ব্যাপারে লেখ। তুই কে, তুই কি করিস, তোর স্বপ্ন, তোর চিন্তা ভাবনা – এই সব আর কি! যা, লেখ গে, দেখি তোর চিন্তাশক্তি কেমন!’
মামার কথা নন্দের মনে ঘোর আনলো। সত্যি তো, সে কে! সে কি! সে কি শুধু পশুপতিনাথ সরখেলের নাতি, উমানাথ সরখেলের পুত্র বোকাটে নন্দ? এই কি তার একমাত্র পরিচয়? উত্তেজনায় ভাবের আবেগে মথিত হয় নন্দের সত্তা। তারও যে আলাদা সত্তা আছে, নিজের পরিচয়ের ঢাক বাজানোর জায়গা আছে, তাই সে জানতো না! বাংরেজি হরফে নন্দ ‘আবাউট মি’-তে লেখে –
‘নহি আমি শুধু নন্দ! ধন্ধ, এ মহা ধন্ধ!
আমার আমিকে আনিব খুঁজিয়া এ নহে আমার সন্দ!!
খুলিব দরোজা বিশ্বের আমি যেথায় যা আছে বন্ধ।।’
লেখাটা পড়ে মামা দু মিনিট কথা বলতে পারলো না। শেষে পিঠ চাপড়ে বললো, ‘টেরিফিক হয়েছে। ফাটিয়ে দিয়েছিস। মানুষের সাথে কমিনিউকেশান বাড়া। মামীকে দিয়ে শুরু কর, নতুন নতুন বন্ধু পাতানো তারও শখ!’
কোচিং ক্লাসে সেদিন তার পাশে বসেছিল অর্কলাল দত্তগুপ্ত। বড়লোকের ট্যাঁশ ছেলে। নন্দের কাছে আই-ফোন দেখে সে আলাপ শুরু করে। এমন হিরোমার্কা ছেলেকে তার সঙ্গেঁ যেচে আলাপ করতে দেখে নন্দ বিগলিত হয়। সেদিন রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পরে ফেসবুকে হাজির হয়ে নন্দ দেখে অক্ষয়কুমারের ছবি দেওয়া এক অনুরোধ পত্র – ‘অর্কলাল ওয়াণ্টস টু বি ইওর ফ্রেণ্ড।’ প্রবল সংশয় নিয়ে মামাকে ফোনে ধরে নন্দ।
মামা বলে – ‘আরে ওটা মানুষের মনের ইনফাচুয়েশান। যে যা হতে চায়, স্বপ্ন দেখে হবে বলে বা যা কল্পনা করে নিজেকে সুন্দর লাগে তার ছবি দিয়ে নিজেকে ইণ্ট্রোডিউস করে। অনেকে নামও বদলায়। যেমন ধর কারো চোখ ট্যারা, সে প্রোফাইলে পদ্মফুলের ছবি ছেপে নাম নিলো ‘পদ্মপলাশ’, এই রকম আর কি!’
‘বাঃ, বেড়ে তো,’ মনে মনে ভাবে নন্দ। পরদিনই কোচিং ক্লাসে অর্কলালের সাহায্যে নিজের আত্মপরিচয়ের বলি দেয় নন্দ মহাভারতের মহাবীর চূড়ামণি ঘটোৎকচের হাতে। নিজের ভেবলু মার্কা ছবি সরিয়ে কথকালির এক ভয়াল মুখোশের ছবিখানা বড্ড মনে ধরল তার। যেমন নাম, তেমন রুপ – এ যেন মানিকজোড়!
ফেসবুকের নেশা সর্বনাশা। দিব্যি পাঁচ-ছ ঘণ্টা মৌজ হয়ে থাকে নন্দ এই দুনিয়ায়। কি বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড চলছে এ জগতে! কেউ ফার্ম খুলে তাতে মহানন্দে চাষবাস করছে, ফুল ফল সবজী লাগাচ্ছে। কেউ খামার খুলে গোরু মোষ পালছে, আস্তাবলে ঘোড়া চরাচ্ছে। ‘আহা, এরা বোধহয় কেউ চাষা, কেউ গোয়ালা বা কাউবয় হতে চেয়েছিল জীবনে,’ ভাবে নন্দ।
কমিউনিকেশানের কাজ নন্দ এতো মন দিয়ে করেছে যে মাত্র ক’দিনে তার ফেসবুকের বন্ধুসংখ্যা রক্তবীজের বংশের ন্যায় এলোপাথাড়ি ছড়িয়ে গেছে। আসমুদ্রহিমাচলে নন্দের বন্ধু ছড়ানো। এই ক’দিন হল কে এক মিস্ রাকা বারবার তাকে লিখছে – ‘হেই ঘটোৎকচ, প্লিজ জয়েন মাই কোঅপরেটিভ ফার্মিং। প্লিজ টোমাটো লাগাও!’ তারপর রীতিমতো হুমকি – ‘কি হচ্ছে কি, বলছি না টোমাটো লাগাওওওওওওওওও!’
এদিকে এনার টমাটো লাগাতে লাগাতে সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে আর এক অজানা বন্ধু গুরুগাণ্টুর চীৎকার – ‘হেল্প মি ইন স্টেবল!!’ এনার ঘোড়ার চানা জল দিতে না দিতে মুম্বইএর মুরলীমোহন চাকলিরাম চিল্লায় – ‘ভাইয়া ঘটোৎকচ, গোরু বাছুরগুলোকে কুছু দেখো!’ চারিদিকে তাকে নিয়ে এই টানাটানির বহরে স্কুলের পড়া, স্যারের কোচিং মাথায় উঠল। সে দিনে ছ’ সাত বার ফেসবুকে ঢুঁ না মারলে চারিদিক থেকে গেলো গেলো রব ওঠে। ঘটোৎকচ রূপের আড়ালে নিজের পরিবারের মহিলা সদস্যদেরও সে মন কেড়েছে, যা নন্দ নামধারী হয়ে জন্মইস্তক অর্জন করতে পারেনি। ছোড়দিভাই, মামী, এমনকি বোনেদের বন্ধুত্বের বিশ্বস্ততাও সে অর্জন করেছে।
এইভাবে কমিউনিকেশান পর্বটা জমে উঠলে সে দাদুর পরামর্শ মতো চারপাশের লোকজনকে জরীপের কাজে মন দিলো। কিন্তু এ কি ব্যাপার! দুনিয়া যতো সাদা দেখায় তা তো নয়! সকালে স্কুলে যাবার সময় সে শুনলো মা দিদিকে বলছে ক’দিন থেকে দিদার শরীর ভালো নয় একবার দেখে আসতে। সেজেগুজে পায়ে চটি গলাতে গলাতে দিদি ব্যস্ত গলায় বলল – ‘আজ একেবারে সময় হবে না মা। কলেজ ফেরত লাইব্রেরীতে যাবো, সেখান থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস আটেণ্ড করে ফিরবো।’ অথচ কোচিং সেরে ফিরতি পথে দেশপ্রিয়র মোড়ে ট্রাফিকে আটকে থাকা নন্দ বাসের জালনা থেকে পরিষ্কার দেখলো কে এক ঢ্যাঙা ঝাঁকড়াচুলোর হাত ধরে হাসতে হাসতে দিদি সিনেমা হলে ঢুকে গেলো। রাত্রে নন্দ নিজের মনের দুঃখ ফেসবুকে লিখলো – ‘অসুস্থ দিদিমা নাহি পায় পাত্তা, লম্বুর হাত ধরে সরখেল প্রমীতার সাত্তে পে সাত্তা!’
পরদিন সরখেল বাড়ির সবাই নাকউঁচু মেজাজি প্রমীতার চোর চোর ভাবে অবাক। দুপুর নাগাদ ভাইবৌ-এর আচমকা ফোন বড়গিন্নীর কাছে – ‘দিদি, প্রমীর কি এ বাড়ি আসার ছিল মাকে দেখতে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু সে কাল পড়ার চাপে যেতে পারে নি।’
‘ইয়ে, প্রমীকে একটু নজরে রেখো, দিন কাল ভালো নয়। ও বোধহয় কোন ছেলের পাল্লায় পড়েছে।’
‘অ্যাঁ, সে কি কথা, তোকে কে বললে?’
‘ঘটোৎকচ!’
বিভ্রান্ত অপমানিত বড়গিন্নী আর কোনঠাসা প্রমীলার চীৎকারে সন্ধ্যে নাগাদ সরখেল বাড়ির দালানে কোঠায় রোজকার রাত্রের আশ্রয় নেওয়া কাক চিলগুলো ভবঘুরে হয়ে ব্যাকগ্রাউণ্ডে বিচিত্র অর্কেষ্ট্রা জুড়ে দিলো। নন্দ তখন চিলেকোঠার ঘরে মিস্ রাকার বাগানে টমাটো চারা পুঁততে বেজায় ব্যস্ত।
পরদিন রবিবার। নন্দ বেলা নটার আগে বিছানা ছাড়তে নারাজ। ঢুলুতে ঢুলুতে কাকা কাকির ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় কাকার ফিসফিসে আওয়াজে অবাক নন্দ শোনে – ‘কাক পক্ষীতে যেন টের না পায়, বাপের বাড়ি যাওয়ার নাম করে বেরোবে।’ উত্তরে চাপা গলায় কাকি বললো – ‘ক্ষেপেছ? নৌকোডুবি বলে কথা!’
ঘুমের পিত্তি চটে গেলো। এই নৌকোডুবি কি ব্যাপার যে কাকা কাকি এতো হাইলি সাসপিশাস অ্যাটিচিউড করছে, দাঁত মাজতে মাজতে ভাবে নন্দ। অনেক ভেবে অর্কলালকে ধরে। অর্ক বলে – ‘ধুস্, ও একটা ফালতু বাংলা মুভি। ঐ যে শরৎচন্দ্র বলে কে একটা রাইটার ছিল কেবল চোখের জলে নমকীন লেখার ধান্ধা। আমার মা, বৌদি, দিদিও সব দৌড়চ্ছে – ঘ্যাম হয়েছে বলে।’
বাঃ, এই তো মেঘ না চাইতেই জল। ফেসবুকে আধুনিক সংস্কৃতি কালচার সাহিত্য নিয়ে এ পর্য্যন্ত তো কিছুই লেখা হল না। অমন কাকার মতো জাহাঁবাজ লোক সেও কি না গোপনে দৌড়চ্ছে!! –
‘বাংলা ছবির জগতে কি রেনাসাঁ এলো!
সরখেল নিশানাথে কি বা নেশা পেলো,
সস্ত্রীক ছুটিল নিশা বায়োস্কোপ ঘরে
শরতের নৌকোডুবি হেরিবার তরে !’
নিজের কবিত্বগুণে মশগুল নন্দ ঘুণাক্ষরেও জানলো না ভাইবৌ-এর দ্বিতীয় ফোন বড়গিন্নীর বুকে কি জ্বালামুখী তৈরী করলো। সপ্তাহ শুরুর সকালটা সরখেল বাড়িতে কি বিচ্ছিরি ভাবে শুরু হল। ছি ছি, ফুটন্ত ডালের হাতা গদার মতো বাগিয়ে ধরে মা এমন জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করছিল কাকিকে। কাকিও ছাড়বার পাত্র নয়। গলার শির ফুলিয়ে কেবল একই মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে – ‘ছি ছি, এ কি স্পাইগিরি! এ কি স্পাইগিরি!’
স্কুলের দেরি হবে দেখে নন্দ সবে মুখ খুলেছে – ‘মা, জলখাবারটা দাও।’ বাপস্, ঘরে যেন ফুকুশিমার নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লাণ্ট ব্লাস্ট হল। – ‘পারব না। যেখান থেকে মর্জি গেল গে যা। সংসারে আমার একটা মান সম্মান নেই? অ্যাঁ!’ মানে মানে রান্নাঘর থেকে কেটে পড়ে নন্দ। এই সাত সকালে কে আবার মা’র মান সম্মানে হাত বাড়ালো ভেবে কুল পায় না সে। বড়দের ভাবগতিক ঠিক যেন আবহাওয়া দপ্তরের মতো।
আজকাল বেশ সব মজার মজার মেসেজ আসছে ফেসবুকে। ‘ডজ্ ঘটোৎকচ লভ্ ফ্রগস্!’ – ‘ডু ইউ থিঙ্ক ঘটোৎকচ হাজ এভর বিন এ মিন ফ্রেণ্ড!’ – অথবা মোক্ষম প্রশ্ন যা নন্দকে একটু বিপাকেই ফেলে – ‘ডু ইউ থিঙ্ক ঘটোৎকচ ইজ এ স্টুপিড ফুল!’
এই নতুন ধরণের মেসেজ চালাচালিতে মেতে ওঠে নন্দ। সদ্য বিয়ে হওয়া বড়দিকে মেসেজ পাঠায় – ‘হাও অনেস্ট ডু ইউ থিঙ্ক ইওর হজব্যাণ্ড ইজ!’ ওর বড়দি শমিতা বরাবরই একটু ভালোমানুষ, ভীতু টাইপ। তার স্বামী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে এদিক ওদিক ভালোই ম্যানেজারি করে সেটা শমিতা জানে। সব্বোনাশ! এসব ব্যাপার ধরা পড়লে মহা মুশকিল। তড়িঘড়ি কর্তাকে মেসেজটা দেখায় শমিতা।
মেসেজ পড়ে জামাই বাবাজীর মুখ গোমড়া। সন্দেহের তীর বৌ-এর দিকে। শমিতা যতো বলে ব্যক্তিগত ভাবে সে এই ঘটোৎকচকে চেনে না, কস্মিন কালে চোখে দেখেনি, তবু তার কর্তা চেপে ধরে। ‘সে নিশ্চয়ই তোমার পুরনো বন্ধু হবে,’ বাঁকা সুরে বলে কর্তা। তারপর শুরু হয়ে যায় গজগজানি। ‘একে তো বাইরে এখন সৎসঙ্গেঁর হাওয়া লেগেছে। বাবা বামদেব আর হাজারি মশাইয়ের সততার গুঁতোয় প্রাণ ওষ্ঠাগত, এখন ঘরেও সততার কেলেঙ্কারি। শেষে কি না আমার কাছা কোঁচা ধরে টানাটানি!’ বৌ-এর ভেবলু মার্কা মুখের সামনে আঙুল নাচিয়ে কর্তা হাঁকে – ‘আমাকে ফাঁদে ফেলা অতো সোজা নয়। এ লাইনে এক্সপেরিয়েন্স ক’ বছরের জানো? পুরো পাঁচ! আমিও দেখে নেবো।’
সেদিন বিকেলে ঝোড়ো কাকের চেহারা নিয়ে শমিতার পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন এবং অশেষ ক্রন্দনের ফলে বাড়িতে রীতিমতো একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হল। বড়কর্তা জরুরী মিটিং ডাকলেন। উপর্যুপরি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় সরখেল পরিবারে সবার মধে্য একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে বটে, কিন্তু এটাও ঠিক যে পরিস্থিতি এখন খুব বিপজ্জনক। মেজো কর্তা গলা খাঁকড়ে বললো, ‘আমিও এক মত। কেউ বা কারা চব্বিশঘণ্টা আমাদের পরিবারের উপর নজর রেখে চলেছে। আজকাল এমন ঘটনা আকছার হচ্ছে। এখনই সাবধান না হলে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটবেই।’
বাড়ির বুড়ো কর্তা পশুপতিনাথ চিন্তিত সুরে বললেন – ‘শমি, একবার নন্দকে ডেকে আনো তো!’
‘সে হতভাগাকে এখানে কেন? একটা গুড ফর নথিং।’ বিরক্ত হন নন্দপিতা উমানাথ।
‘না মানে, সারাদিন বাড়ির বাইরে ঘোরে টোরে তো, যদি সন্দেহজনক তেমন কিছু নজরে পড়ে থাকে।’ যুক্তি দেখান বুড়োকর্তা ।
মেজো ‘ফোৎ’ করে নাক ঝাড়া এবং ‘ঘোৎ’ করে অবজ্ঞার হাসি, যুগপৎ একসাথে করে বললেন – ‘তাহলেই হয়েসে, নন্দ রাখবে ওর চোখ কান খোলা!’ বলতে বলতে ঘরে ঢোকে নন্দ এবং একসাথে এতো লোক দেখে একটু গুটিয়েই যায়। দাদু বলে ওঠে – ‘শোন নন্দ, এ ক’দিনে কোন অচেনা লোককে সন্দেহজনক ভাবে আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছিস?’
‘না তো!’ বোকা সুরে বলে নন্দ।
‘দেখলে?’ গর্জে ওঠেন উমানাথ। ‘চোখ দুটো ড্যাবডেবে – বলি, ওই আই-ফোনের আগাপাশতলা দেখা ছাড়া আরো কিছু দেখার আছে জীবনে, এটা জানো কি?’
এরা কি বলছে তা মাথায় ঢোকে না নন্দের, তাই চুপ করে থাকে। দাদু সহানুভূতির সুরে বলেন – ‘এবার থেকে আরো ভালো করে বাড়ির এদিক ওদিকে নজর রাখবি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ঘড়ি ঘড়ি দেখবি কেউ ফলো করছে কি না।’
‘কেন দাদু?’ জানতে চায় সে।
‘চোওওওপ!’ গর্জে ওঠেন বড়কর্তা । ‘তোমাকে যা বলা হচ্ছে উইদাউট কোয়েশ্চেন তা পালন করবে। গট দি মেসেজ? নাও গেট লস্ট!’
সেদিন সকালের টিপটিপে বৃষ্টি ঝমঝমে রূপ নিলো দুপুরের দিকে। ভূগোল ক্লাস শেষ হতেই অর্কলাল নন্দকে বলে আজ এই ওয়েদারে কোচিং ক্লাস হবে না। অগত্যা বাড়ির দিকে রওনা দেয় নন্দ। এরই মধ্যে রাস্তায় বেশ জল জমেছে। অনেক জায়গায় ম্যানহোলের বুকে লাল পতাকা বা ভাঙা গাছের ডাল গোঁজা। পাড়ায় ঢুকতেই দাদুর পরামর্শ মতো সতর্ক হলো নন্দ। মণ্টুর তেলেভাজার দোকানে বেশ ভিড়। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ চলে যায় কালো ছাতার আড়ালে একটু একটেরে হয়ে বাড়ির বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে কে ও? হাতের শালপাতার ঠোঙায় আলুবড়া, পেঁয়াজি তেলেভাজা গোগ্রাসে মুখে পুরছে। দাদু না?
রাত্রে নন্দ পাকা দার্শনিকের মতো মানুষের জীবনের দ্বিতীয় শৈশবাবস্থা অর্থাৎ বৃদ্ধকুলের দুঃখকাহিনী লেখে ফেসবুকে –
‘বৃষ্টিভেজা নিঝুম দুপুর তেলেভাজার ডাক।
পশুপতির জিভের ডগায় সুড়সুড়ি হাঁকপাক।।’
সরখেল পরিবারের টেকটনিক প্লেট নড়েই ছিল। এবার আশু ভূমিকম্পের ভয় এড়াতে জরুরী তলব দেওয়া হল বড়কর্তার ব্যারিস্টার শালাকে। এসে বৃত্তান্ত শুনলেন সব। এবার তাঁর মনে পড়ছে সপ্তাহ দু-এক আগে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেছিল বটে কে এক ঘটোৎকচের ওয়ালে নাকি সরখেলদের নামে কিছু গুপ্ত রহস্য ফাঁস হচ্ছে। তখন পাত্তা দেননি শালাবাবু এবং স্ত্রীকেও সাবধান করেছিলেন অচেনা মানুষের মতামতকে তোল্লাই না দিতে।
বড়গিন্নী কেঁদে পড়ল ভাইএর কাছে – ‘একটা কিছু কর। শমিতার বিয়েটা না ভেঙে যায়। জামাই ক্ষ্যাপা ষাঁড় হয়ে আছে।’ নিশানাথ তুম্বো মুখে বলেন – ‘অডাসিটিটা একবার ভাবুন। আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো না যাবো সব সে জানে। সব সে দেখেছে।’ বুড়োকর্তার কপালে এমনিতেই দুই বৌ-এর কাছে যথেষ্ট লাঞ্ছনা জুটেছে এ বয়সে লোভ সামলাতে না পারার জন্য। তাঁর কিছু বলার মুখ নেই, তিনি মাথা নীচু করে বসে আছেন। ওদিকে প্রমীতার চোর ধরা পড়ার পুরনো রাগের গরগরানি আর স্বামীর লাঞ্ছনায় কাতর শমিতার ফোঁস ফোঁসানি। নাঃ, কোন এক ঘটোৎকচ মহাভারতের পাতা থেকে উঠে এসে গোটা পরিবারের উপর যেন দুরমুশ চালিয়ে দিয়েছে। তবে তিনিও খান লোক চড়িয়ে। প্রথমেই যা করতে হবে তা হল এই বিধ্বস্ত পরিবারকে সান্ত্বনাদান।
শালাবাবু মুখের চুরুটের গোড়া দাঁতে কামড়ে ধরে গলগলে ধোঁয়ার সাথে বললেন – ‘তোমরা ফ্যাশান মেনটেন করতে ফেসবুকে যাও। কোন কাজের কোয়েন্সিকোয়েন্স বোঝো না বলে ফল ভোগো। পই পই করে সবাইকে বলি স্ট্রেন্জারস আর নট আলাওড্। কিন্তু বন্ধুত্বের সংখ্যা সাড়ে ন’শো দেখাতে পারলেই তোমাদের গর্ব। যাই হোক, পরিস্থিতি এমন কিছু ভয়ঙ্কর হয়নি। আজকাল যতো ঘুঘু ততো ফাঁদ। প্রথমেই সেফ্টি কজ্ শো করে ট্রেসপাসিং এণ্ড স্টকিং এই মর্মে একটা রিপোর্ট করে দিতে হবে। তাহলেই ঘটোৎকচ বধ!’
‘বলো কি, একেবারে বধ?’ বড়কর্তা নড়ে চড়ে বসেন।
‘এক্কেবারে।’ বলে মাতব্বরী চালে হাসেন শালাবাবু।
দুদিন নন্দের মন ফেঁপে আছে। নেশার দ্রব্যে আচমকা এ কি বাধার বিপদ। যতোবার ফেসবুকের দরজা ধাক্কায় ততোবার এক উত্তর – ‘ইওর আকউণ্ট হাজ বিন টরমিনেটেড ফর দি ফলোইং রিজন্স। ১. স্টকিং ২. ট্রেসপাসিং ৩. ডেস্ট্রয়িং দি প্রাইভেসি অফ আন এনটায়ার ফ্যামিলি।’
এ সব কি লম্বা লম্বা ফিরিস্তি! নন্দ তো বুঝেই উঠতে পারছে না এ সব অভিযোগ কেন। অগত্যা মামার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি কি? গেলো সে মামার বাড়ি পরদিন সন্ধ্যেবেলা কোচিং ফেরত। মামা বললেন – ‘ফোনটা দেখি!’ তারপর ক্রমশঃ তাঁর মুখের পটে বিভিন্ন রঙ রূপ খেলা করতে লাগলো। বাংলার পাঁচ থেকে জিলিপির প্যাঁচ। অমাবাস্যার ঘোর কালো থেকে আগ্নেয়গিরির বুক থেকে ওঠা জ্বলন্ত লাভার আগুনের মতো। নন্দের বিবশ হয়ে যাওয়া মুখের উপর তীব্র সার্চলাইটের মতো চোখ দুটি এবার ভাঁটার বলের মতো ঘুরতে লাগলো। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন মামা। তর্জনী তুলে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন নন্দের দিকে ‘ক্কি! ক্কি!’ করে। একি রে বাবা, মামার হল কি? পাগল হয়ে গেলো না তো? চোখে খিমচে দেবে না কি?
ঘর ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠলেন মামা – ‘তুই?? ওফ ঘটোৎকচ! সরি, ওফ ভগবান!! শেষে কি না তুই?!!’
ঐ বসে আছে নন্দ। একাকী বিষন্ন। সমাজের কাঠগড়ায় ঘটোৎকচের বধ পালা সাঙ্গঁ হয়েছে কখন। এখন কি নন্দকুমারের ফাঁসি?
(ছবি সৌজন্য: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য/‘উনিশ কুড়ি’ পত্রিকা)
(প্রথম প্রকাশিত: ‘উনিশ কুড়ি’ পত্রিকা, ৪ ডিসেম্বর ২০১২)