তীতুমীরের দিদা

Read this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.

বই বোঝাই গন্ধমাদন ব্যাগটাকে পিঠে ঠিকঠাক ব্যালান্স করে সাইকেলের প্যাডেলে জোরে কিক্ মারতে না মারতেই মা’র গলা, “সাইকেল চালাচ্ছিস না রকেট?” ফলোড বাই দিদার অভিযোগ, “আঃ বৌমা, কতবার বলিচি পেছুন হাঁকবে না!” দিদার দুগ্গা দুগ্গা নাম তিনবারের কোটা পুরোবার আগেই বড় রাস্তার মোড়ে তীতুমীর ধাঁ।

যবে থেকে হিস্ট্রির নতুন স‍্যর পিকে এসেছেন জীবনটা যেন পিন কুশন! দাদুর উপর নতুন করে প্রচণ্ড রাগ ধরে। হিস্ট্রি তোমার ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন ছিল, ভেরি ইম্পে্রসিভ! কিন্তু তাই বলে আমার নামের পেছনে ইতিহাসের ছুঁচোবাজি ছেড়ে যাওয়ার মানে কি! একে তো হিস্ট্রি সাবজেক্টটাই টপ টু বটম ঘোড়েল। কে কার দাদাকে মারলো, কাকাকে রাখলো, বাবাকে ল্যাং দিলো! কার কতো ভুরকুট্টে মার্কা উদ্ভট চিন্তা, প্যাঁচ পয়জার, সব একেবারে সাল তারিখ নথি দিয়ে মগজে ডাউনলোড করে রাখতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই কোলগেটের বিজ্ঞাপনী দন্তরুচিকৌমুদী দেখিয়ে হিস্ট্রি স‍্যর পিকে বলবেন —

“তীতুমীর! সে ছিলো এক বীর।
প্রাণ দোবো, মান দোবো না, এই প্রতিজ্ঞায় স্থির।
এ যুগের তীতুমীর! বুদ্ধি জমে ক্ষীর।
ভাঙবে, তবু মচকাবে না, গবেটের বেয়াদপি।”

স্যারের আবার পদ্যবাতিকে খাল খেঁচার অভ্যেস। সেদিনই তো রাণাকে কি ভাবে টার্গেট করলেন! “রাণা এক বোকা ছেলে, মহারাণা নয় / মহারাণা রাণা হলে, বাপ রে! কি ভয়!”

তেতো মুখে সাইকেলটা স্ট্যাণ্ডে রাখতে রাখতেই লাস্ট বেলের ঘণ্টা। সহযাত্রী কিছু লেট লতিফদের দুদ্দাড় ডিঙিয়ে ছুটতে থাকে তীতুমীর। পাশ থেকে হাম্বীর হাঁপায়, “বস্, মুখটাকে ম্যাডাগাসকারের ম্যাপ বানিয়ে রেখেছ কেন?” সিঁড়ির বাঁকে হারিয়ে যেতে যেতে তীতুমীর তীর ছোঁড়ে, “তোর তাতে কী রে সাইবেরিয়ার ভাল্লুক! বিকেলে ফুটবল কোচিং-এ দেখা হবে।”

তীতুমীরদের বাড়ি পাতিপুকুরে, ততোধিক এক পাতি পাড়ায়। থাকার মধ্যে বাবা, মা আর দিদা। বছর তিনেক হল কাকা জার্মানীতে চাকরি নিয়ে জার্মান মহিলাকে বিয়ে করে ডুমুরের ফুল। আর পিসি বছর দেড়েক আগে বিয়ে করে পাড়ি জমাল ওমানে। পিসেমশাই মন্দ মানুষ নয়। তেলের কোম্পানীর বড় চাকুরে। গুজরাটি হলে কি হবে, বাংলা বলে তরতরিয়ে। পিসেমশাইও কাকার মতন কোলকাতা আসার নামে হেভি ডরায়। উভয় ক্ষেত্রেই কারণ এক — তীতুমীরের দিদা।

দিদা এমনিতে মানুষ ভালো হলে কি হবে, আপাদমস্তক কুসংস্কার আর অসম্ভব শূচিবাই। গুজরাটি জামাই নিয়ে মনের খুঁতখুঁতানি জামাই-এর আয় অঙ্কের বহরস্রোতে ভেসে গেলেও বিয়ের আসরে দিদার ছুৎমার্গের কলকাঠিতে পিসেমশাইয়ের মনের বালিতে সেই যে ভীতির ক্যাকটাস জন্মেছিল, পিসির হাজার অশান্তির বালুঝড়েও সে ক্যাকটাস ওপড়ানো যায়নি। সুযোগ পেলেই পিসিকে শোনায় পিসেমশাই, “আরেব্বাস! শাদি করতে গিয়ে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছি। তোমার মা আমার মর্টালিটির দোহাই পেড়ে আমার ভেবলুমার্কা ফ্যামিলিকে কী পট্টি পড়িয়েছিল, খোদা মালুম! ভোর চারটের সময় সবাই মিলে ধরে আমায় গাণ্ডে পিণ্ডে কতোগুলো ভ্যাদভেদে চিড়ের মণ্ড গিলিয়ে দিলে। তারপর হোল ডে অ্যাবসোলিউটলি নো ফুড! বলে, আগে বিয়ে হোক, তারপর খাবে। আরে ভাই, জিন্দা থাকলে তবে না বিয়ে, তবে না খাওয়া! নেহাত ধরে পড়লাম তোমার ছোট ভাইয়াকে। বললাম, ব্রাদার! প্লিজ সেভ মি! সে তখন তোমার মার শকুন, স্যরি, চিলের নজর বাঁচাকে কখনো দুইটা আলুবোণ্ডা, কখনো রেশমী কাবাবের টুকড়া কখনো ভাঙা ধোকলা সাপ্লাই দিয়ে দিয়ে মাঝ রাত অবধি আমায় জিন্দা রাখল। আবার ওই স্টারভেশান টর্চার সেলে ঢুকবো আমি? কভি নেহি!”

পিসি যত বোঝায়, এবার গেলে জামাই আদর কাকে বলে তা দেখবে, কিন্তু পিসেমশাই নাছোড়। জামাই আদরের যে স্যাম্পেল সে দেখেছে তাতে তার মনে কোনো ভরসা নেই।

কাকার কেস আবার উল্টো। জার্মান কাকী ইণ্ডিয়া ভিজিট করার জন্য মুখিয়ে থাকলে কি হবে, কাকা উল্টোসুরে গীত গায়। “হানি, ইণ্ডিয়া ইজ নট অল অ্যাবাউট ট্যাজম্যাহাল অ্যাণ্ড কারি। মেইন প্রবলেম ইজ ইনসাইড মাই বাড়ি, আই মীন হোম। ওখানে যা একটি পিস অফ ওয়ার্ক আছেন না, ভেরি ডেঞ্জারাস।” স্ত্রীকে আর কত ভেঙে বলা যায়! কালই তো মার কি মুখনাড়া ফোনে। রোজ জানা চাই, “কী খেলি?”

“কী আবার, আলুসেদ্ধ।” বলেছিল কাকা।
“আজও আলুসেদ্ধ! ব্যাপার কি রে তোদের? শুধু আলুই ফলে ও অঞ্চলে?”

মাকে এখন বোঝাবে কোন সাহসে যে ম্যাশ পটেটো আর কারি উর্স্ট অর্থাৎ শূকর-সসেজ কারি, এটাই জার্মানদের রোজকার ডাল-ভাত। মুখে বলে, “মা, আমার তাড়া আছে। অফিসে বেরোবার আগে ডাস্টবীন রিসাইক্লিং করে যেতে হবে।”

মা হতবাক। বলে, “বিমলে, সেটা আবার কি র‍্যা? সাইকেলে করে ময়লা ফেলতে যাবি?”

ছেলে বোঝায়, “আরে না মা, এখানে অদরকারি কাগজপত্র ফেলতে হয় নীল ডাস্টবীনে। প্লাস্টিক ইয়োলেতে, টিনের জিনিস কালো রং-এর ডাস্টবীনে আর ফলপাকুড় সবজির খোসা, ডিমের খোলা সব সবুজ রঙে, বুঝেছ?”

“ম‍্যা গো, সাত সকালে ছিষ্টির ময়লা বাছবি?” ফুঁসে ওঠেন মোক্ষদা। এই হল মায়ের রিঅ্যাকশন। বৌ নিয়ে কোলকাতায় গেলে মান সম্মানের কিছু বাকি থাকবে আর! কিন্তু স্টেফানির জার্মান গোঁ। উঠে পড়ে লেগেছে বাংলা শিখতে। কাকা ভয় দেখায়, “শাশুড়ি মুখনাড়া দিলে করবে কী?”

সদ্য শেখা বাংলায় কাকি বলে, “কানে কুলা গুঁজবো।”

শুনে কাকা ভাবে, মায়ের কথার বোমশেল অ্যাটাক থেকে বাঁচতে কানে তুলা নয়, কুলাই দরকার। “বাঃ! ব্রাভো! গুট্। খুব শিখেছ তো!”

কাকি দ্বিগুণ উৎসাহে বাংলাদেশী প্রকাশনার বাংলা বই খুলে দুলে দুলে পড়ে — “আওফনামে বাড – গোসল, ওয়াসার – পানি!”

***

রোজ দুপুরে নিপাট একটি ভাতঘুম না দিলে তীতুমীরের মায়ের মাইগ্রেনের ব্যথাটা ঢুঁ মারবেই। মাইগ্রেনের আর কি দোষ! শাশুড়ির সঙ্গেঁ এতগুলো বছর একছাদের নীচে কাটানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। ঘুম ভেঙে উঠলেন কি শুরু হয় ওনার জবাইএর বকরি খোঁজা। কোন কোন দিন পূজাঘরে ছড়া ঝাঁট দিতে দিতেই তীতুমীরের বাবাকে বাছেন, “অ অমু! সেই তুই সোমবার দাড়ি কাটছিস?”

“তো কি করবো? তোমার তো সোম টু শনি ব্যাগড়াপার্টির ফুল প্যাকেজ। শনিবার বলবে, চুল কাটিস না। রবিবার না কি আমার জন্মবার। ছুরি কাঁচি আনটাচেবল। শুক্রবার তীতের জন্মবার, অথচ আমার চুলদাড়ি কাটা বারণ। এখন সোমবারের পেছনেও লেগেছ?”

প্যাঁচ খেয়ে বেজার মুখে দিদা নাতির ঘরে ঢোকে। “অ তীতে! যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।”

কানে বালিশ চেপে বাবার গজগজানির ডেনসিটি কমাবার ধান্ধা করছিল তীতুমীর। দিদাকে ঘরে ঢুকতে দেখে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, “ডোণ্ট ওরি দিদা! তোমার স্পিচ থেরাপির গুঁতোয় আমিই শুয়ে থাকতে পারি না, তো আমার ভাগ্য!”

রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে বাবার ব্রেকফাস্ট রেডি করতে করতে মায়ের কথার হুল ভেসে আসে, “আজকাল মঙ্গঁলও মায়ের স্নেহদৃষ্টিতে আছে। চুলে শ্যাম্পু বারণ।”

বাবার গজগজানির ভল্যুম লো-তে হলেও চলছে। “মঙ্গঁল-বুধ আমার আর্লি আওয়ারস মিটিং থাকে। আমি কি চুলদাড়ি কাটার জন্য ভোর পাঁচটার সময় উঠবো? আর তা না হলে বলো, গালে মাথায় অ্যামাজনের জঙ্গঁল নিয়ে দা-কাটারি হাতে রে-রে করে বসের রুমে সেঁদিয়ে যাই!”

ছেলে, ছেলে-বৌ-এর অবিমৃশ্যকারীতায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয় দিদা। এদের মঙ্গঁল চিন্তাতেই না সারাদিন পাঁজি পুঁথি ঘাঁটা। তিথি নক্ষত্র দেখা, বাছ বিচার করা। যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর?

দিদা অভিমান ভরে রান্নাঘরে ঢুকে গড়গড়িকে বলে চা দিতে। গড়গড়ি ততক্ষণে রাতের বাসি বাসনগুলোকে একপ্রস্থ ধারাস্নান করিয়ে পবিত্র করে রেখেছে। দাদুর আমলের লোক। দিদার শতেক  মুখনাড়া আর বাছবিচারের বডিলাইন বলে বোলড আউট হয়ে দেশের বাড়ির প্যাভেলিয়ানে বোঁচকা কাঁধে হণ্টন দেবার লোকই সে নয়। তাই দিদা যখন কারণে অকারণে চেঁচায়, “তোরে কতবার বলিচি ছাদ ঝাঁট দিয়ে ঝ্যাঁটা খাড়ায় রাখবি নে। ঝ্যাঁটা সব্বোদা শুইয়ে রাখতি হয়। ঠাকুরের ফুল তুলতে গিয়ে মধুমালতীর ঝাড়ে দেখি খাড়ায়ে আছে ঝ্যাঁটা।”

অথবা, “আ মোলো যা, উঠোনের মইটার নীচ দে দুক্কুর বেলা হেঁটে এলি?” তখন গড়গড়ি মুখে শিশুর সারল্য এনে বলবে, “কিছু বলতেছো বড়মা?”

দিদা সপ্তগ্রামে সুর তুলে বলবে, “সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনলো এখন বলে সীতা কার বাপ!”

উত্তরে গড়গড়ির বিনীত ইনফরমেশান, “ছিঃ মা! সীতা মা জননী। বাপ হবেন কেমনি!”

দিদার লাস্ট বল্, “সবজির ঝুড়িতে মোচা দেখলুম। খবরদার শনিবার যেন রান্না না হয়।”

গড়গড়ির দিদার বলে দিদাকেই নকআউট, “ছিঃ মা, ভাদ্দর মাসে লাউ, শনিবার মোচা, খাওয়া অতি ওঁচা।”

অতএব তীতুমীরদের বাড়িতে নারদের বিশেষ শুভদৃষ্টি লেগেই আছে। দিদার গুরু থাকেন কৈখালিতে। সংসারের ঊনকোটি গোলমালে কাতর দিদা গোলটি ছেড়ে মালটি পাওয়ার আশায় মাঝে মাঝে গুরুর শরণাপন্ন হয়। গুরু বলেন, “কা তব কান্তা! কস্তে পুত্রাঃ! সংসারে সঙ সেজে ঘোরা বই তো নয়। এ সংসারে আছেটা কি? শুকনো আঁটি আর চামড়া। অতএব সাধন ভজন, গুরুসেবা, যাগ যজ্ঞ – এই হল মোক্ষলাভের পথ। এসবের আয়োজন করো, মন শান্ত হবে।”

সেই থেকে উঠে পড়ে লেগেছে দিদা। বাড়িতে ঘটা করে নারায়ণ পূজা স্বস্তি স‍্যস্তয়ন করবে। তীতুমীর অবশ্য পই পই করে বলে রেখেছে দিদাকে, “তোমার ওই উৎসব টুৎসব আমার পরীক্ষার পরে কোরো। তোমার গুরু আমাদের বাড়ি আসা মানে তো আমার হোমলেসদের দশা। নিজের ঘর ছেড়ে দাও। টয়লেট শেয়ার করো। গেলবার দেখি তোমার গুরু আমার পাজামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”

শুনে দিদা ভক্তিতে গদগদ হয়ে মাথায় হাত ঠেকায়। “অহৈতুকী কৃপা! এর মর্ম তুই কি বুঝবি তীতে? সে না হয় তোর পরীক্ষার পরেই হবে পূজো। কিন্তু দিদারে তোর একটা উপকার করে দিতেই হবে বাবা!”

পানের ডিবে খুলে তীতুমীরের বিছানায় বসার উদযোগ করে দিদা। তার মানে এখন প্রচুর ভাট বকবে। এদিকে হাম্বীরের সাথে তীতুমীরের ফুলফর্মে ফেসবুকে চ্যাট চলছে! দিদাকে কাটাতে ব্যস্ততা দেখায় তীতুমীর। “আমার এখন অনেক কাজ। রাত্তিরে বোলো।”

নাতির কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মেঝেয় পড়ে থাকা স্কুল ব্যাগটা চেয়ারে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে দিদা ধপ্ করে বসে পড়ল খাটে। একখানা খিলিপান মুখে চিবিয়ে বলল, “কতোবার বলিচি, মা সরস্বতীরে মেঝেয় ফেলে রাখবি নে। ঐ জন্য তোর বিদ্যে বুদ্ধি মুকুলেই রয়ে গেলো।”

তড়িৎ গতিতে হাম্বীরের সাথে মেসেজ চালাচালি চলছে। “ফুটবলের টুর্নামেণ্টটা কবে ফিক্স করলে বেটার হয়? হিস্ট্রির পিকের চোদ্দগুষ্টির এ্যায়সি কি ত্যায়সি! রাণার বোনের উপর আমার ক্রাশ্? সো আবসার্ড!”

এ সবের মাঝে দিদার বেআক্কেলে কমেণ্টে রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে তীতুমীর। “তাই বুঝি! তা দাদুরা তো সব মাটিতে ম্যাট বিছিয়েই লেখাপড়া করতো শুনেছি। অ্যাণ্ড হি ওয়াজ আ জিনিয়াস্! তাহলে?”

দিদাকে এদিকে প্যাঁচে ফেলে ওদিকে দেখে হাম্বীর লিখেছে, “জানিস, নেক্সট্ মান্থে সোলার একলিপ্স দেখা যাবে। বাট, পার্শিয়াল।”

পড়েই তীতুমীরের চোখে বাঞ্চ অফ্ সর্ষেফুল! দিদা এসব সময় যাকে বলে ভয়ঙ্করী! তীতুমীর তখন বেশ ছোটই যখন একবার সূর্য‍্য গ্রহণ হয়েছিল। সে কি কাণ্ড! জলত্যাগের প্রবল বেগে তীতুমীরের স্লুইসগেট প্রায় ফেটে যাচ্ছিল, তবু দিদা টয়লেট যেতে দেয়নি। বলে, “অন্ধ হয়ে যাবি।” দিদাকে বোঝাবে কে যে টয়লেট না যেতে পেরে বরং সে তখন চোখে অন্ধকার দেখছিল।

“মাই গড!” হাম্বীরকে সমস্যা জানিয়ে টেক্সট করে তীতুমীর। বাড়িতে যা হোক একটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে হাম্বীরদের বাড়িতেই থেকে যাবে ওই দিনটা। সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ বুড়ো আঙুলের কলা মার্কা ‘ওকে’ সিগন্যাল। সাথে লেজুড় কমেণ্ট, “ওঃ মাইরি! হ্যাটস অফ্ টু ইয়োর অ্যাবরিজিনাল দিদা!”

চোখ পিটপিটিয়ে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নাতিকে দেখছিল মোক্ষদা। সবে মাত্র দশ কেলাসের ছাত্র কিন্তু নাক চোখ কপাল সব সুলুক্ষুণে। মুখে যতই বুলি কাটুক মনটি নরম মাখনের তাল। “বলি, অ তীতুভাই! আমার কাজটা করবি নে?”

তীতুমীর তখন হাসি হাসি মুখে হাম্বীরকে লিখছে, “ওঃ! সেই দিনটা অনফরগেটেবল! নতুন ডেনিম আর মেরুন টি শার্ট লড়িয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকছিস, সজনে গাছের ডালে বসা তোর ফরচুন তোর ঘাড়ে তার কম্মোটি করে কাবার।”

হাম্বীর দু চোখের জল ঝরা স্টিকার পাঠায়। সাথে কমেণ্ট, “কোত্থেকে তোর দিদা এসে হাজির। খিক্ খিক্ হেসে বলে, ‘পাখির গু? খুব শুভ!’”

হাসতে হাসতে দু চোখ দিয়ে জলের ফুলকি ছিটোচ্ছে এমন স্টীকার পাঠায় তীতুমীর। কমেণ্টে লেখে, “তা আর নয়! যাচ্ছিলি তো আমার সাইকেল ধার করে মোনালির সঙ্গেঁ ডেটে। সেটা যে কত শুভ তা আজকাল তোকে দেখলেই মোনালির হিস্টিরিকাল অ্যাটিটিউডে বোঝা যায়।” হাম্বীর গনগনে রাগের মুখকে দূত পাঠায়। “চোপ।”

“লিখবি পড়বি কিছু, না কি ওই ফোন টেপা টেপিতেই  উতরে যাবি ফাইনাল?” দরজার বাইরে মায়ের খবরদারি নাক। তাড়াতাড়ি দিদাকে শিখণ্ডী খাড়া করে তীতুমীর। “মা, দিদার সঙ্গেঁ একটা ইমপর্ট্যাণ্ট ইস্যু ডিসকাস করছি। ডোণ্ট ডিস্টার্ব।”

“হুঃ,” বলে দুজনকেই তাচ্ছিলে্যর দৃষ্টিবাণ হেনে মা ভ্যানিশ। হাম্বীরকে সটকে পড়তে বলে একটা মেসেজ পাঠিয়ে তীতুমীর ভাবল, ব্যাপারটা এখনকার মতন মিটলেও রাত্রে বাবা অবধি গড়াবে। তা গড়াক। আপাততঃ দিদার জন্যই ঝামেলার হাত থেকে বাঁচলো। কৃতজ্ঞতার সুরে তীতুমীর বলল, “ও ক্কে দিদা, কি চাই বলো।”

দিদা গলে পড়ে। “তুই তোর কাকা আর পিসিরে বেশ জম্পেশ করে একখান চিঠি লেখ বাপ।” কম্প্যুটার দেখিয়ে দিদা বলে, “তোর এ যন্তরে। তোর বাপ-মা আমার কথা কানে নেয় না। নারায়ণ পূজায় ঘরের স্বস্তি স‍্যস্তয়ণ করবো, অগোরেও ডাক।”

দিদার কাতর মুখ দেখে একটু মায়াই হয়। পরক্ষণেই সম্বিত পায়। “তুমি যে সব ব্যাপারে এতো বাড়াবাড়ি করো, তার কি হবে? এই জন্যই তো আমাদের বাড়িতে কেউ আসে না।”

দিদা অবাক। “ওম্মা, আমি কি করলুম?”

তীতুমীর কাষ্ঠ হেসে বলে, “তুমি সামনের বাড়ির পাপিয়া মাসিকে কি বলেছো যে ওরা আর আমাদের সাথে কথা বলে না? আজ ট্রুথফুলি ঝেড়ে কাশো তো!”

চেবানো পানের রস গিলে দিদা মাছি মারার ভঙ্গীঁতে খাটে চাপড় মারে। “আরে, সে কি আমার দোষ? সে তো ওই মিচকে পচা!”

তীতুমীরও তেত্রঁটে। “তা তুমি তোমার ওই মিচকে ভাইকে বাঁশদ্রোনী থেকে ঘড়ি ঘড়ি আনাও কেন?”

দিদা দুঃখী গলায় বলল, “কি আমার ভাই রে! ‘লাউতলায় বিয়াইছে গাই/ সে সম্পর্কে মামাতো ভাই।’ নিজের ভাই হলে আমার মুখ পোড়াতো না হতভাগা। আহা, সে দিন গুরুদেব জীবনের শুভ অশুভ চিহ্ন নিয়ে কতো সোন্দর সোন্দর কথা বলছিলেন। পাড়া প্রতিবেশীর কতো আনন্দ। যেই বললেন, ‘কোনো শুভ কাজে বেরুবার সময় মাথায় ফুল, কপালে কুমকুম এয়ো স্ত্রীর মুখ দেখা খুব ভালো, আবার সাদা হস্তীনি দেখাও খুব শুভ। সাফল্য আসবেই।’ শুনেই পচা পাপিয়াকে বললে, ‘বৌদি, চাকরি খুঁজে খুঁজে জুতার শুকতলা পিচেগলে গেলো, অথচ এমন সুরাহাটি তুমি দিদির দরজার দোরগোড়ায় ঘাপটি মেরে আছো, জানতিই পারলাম না!’ শুনেই সবার চাপা হাসির রোল পড়ে গেলো। পাপিয়া গনগনে রাগে থলথলে চেহারায় মেঝে ঠেলে উঠলে আর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলে। সেদিন থেকে আর হদিক পানে তাকায় না। কথাও কয় না। এখন বল ভাই, এ আমার দোষ?”

হাসি চেপে তীতুমীর বলল, “আজ রাতে আমি ই-মেল করবো। এখন কাটো। এবার পড়তে না বসলে তোমার জৈষ্ঠ‍্যপুত্র আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করবে। অলরেডি নাকি পাতিপুকুর বাজারে ভালো একটা লোকেশান দেখে রেখেছে আমাকে ডিমের দোকান সাজিয়ে দেবে ফিউচারের জন্য। যাই বলো দিদা, তোমার ছেলের মধ্যে ডিসেন্সি নেই। নইলে, হোয়াই অন আর্থ ডিমের দোকান? আমি আর ডিম্ব, এটা কোনো কম্বো হলো?”

নাতিকে পটিয়ে পাটিয়ে মোক্ষদার মেজাজ ফুরফুরে। জাত সাপ কোন সুরে বশ হয় তা তিনি জানেন। সাধের ভাইপোর আকুল ডাক ফেলতে পারবে না পিসি-কাকা। বেশ একটা বড়ি খোঁপা বেঁধে, উঠে যাওয়া চুলের গুটলি জালনা দিয়ে পেছনবাগের বাগানে ফেলতে গিয়ে দেখেন ঝি বাতাসী দুধের ক্যান হাতে কলাঝাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে পাড়ার ধোপাটার সাথে হেসে হেসে কাঁধে পিঠে গলাগলি হচ্ছে!

দুমদুমে পায়ে বড় বৌ-এর ঘরের সামনে এসে হাঁকে মোক্ষদা, “বৌমা! কতবার বলিচি বাতাসীকে দুধ আনতে বেলাবেলি পাঠাবে! সূর্য্যাস্তের পর সাদা জিনিসের বিনিময় ভালো না।”

পর্দা সরিয়ে বাইরে এসে শাশুড়িকে পাশ কাটায় বড় বৌ। “আমি তো কখন পাঠিয়েছি। এতো দেরী দেখে ভাবছি!”

তুম্বো মুখে মোক্ষদা বললে, “মহারানী কলাবনে ওই ধোপাটার সাথে রাসলীলায় মগ্ন।”

তীতুমীরের মা সাবধানী গলায় বলে, “রমেশ ইস্ত্রীওয়ালা মা! ওকে আপনি ধোপা ধোপা করেন, ও খুব বিরক্ত হয়।” ধোপারও রাগ হয় শুনে তীতুমীরের দিদা যারপরনাই আশ্চর্য্য হন। কি কাল এল, অ্যাঁ!

***

সেদিন নিত্যদিনের তুলনায় বড়ছেলে একটু দেরী করেই অফিস থেকে ফিরল। দরাজ হেসে মাকে বলল, “ছোটকার ই-মেল এসেছিল। ভেরী পজিটিভ। ওরা ইণ্ডিয়া আসার তোড়জোড় করছে। তবে মা, একটা কথা, তোমার নাকি থেকে থেকে বুক ধড়ফড় করে আজকাল! চোখে নাকি একটার বদলে চারটে করে দেখ! এই ভরপেট খেলে আবার ‘খেতে দে’, ‘খেতে দে’ বলে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করো। আলমারীর চাবি ছাতের চিলেকোঠায় ফেলে সারা বাড়ির লোককে দারোগা দাবড়ান দাও! এসব সিম্পটম কবে থেকে গ্রো করলো আবার তোমার?”

নিজের এত গণ্ডগোল শুনে প্রথমে ভিরকুট্টি খেলেও মুহুর্তে পরিস্থিতির নাড়ির গতি চিনল মোক্ষদা। ‘উলুখাগড়ার বনে ছিল এক সাধু চালু/ ওলটানো চোখ মেলতো পাতে সেদ্ধ মেটে আলু।’ নাঃ, এ বাজারে নাতিটি তার কিছু করে খাবে বটে। তাড়াতাড়ি কথার পাশ কাটায় মোক্ষদা। “তা বাবা, ওসব বয়েস হলে একটু আধটু তো হবেই। শোন, ওরা আসার আগে বাড়িটায় একবার রঙছোপ মার।”

রাতে খাবার টেবিলে বসে সব খবর জ্ঞাত হল তীতুমীরের। আঃ! একখানা আইকিউ গিফ্টেড ব্রেন বটে তার! নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ায়। বোকা ইংরেজ আর ফ্রেঞ্চগুলো লড়ে লড়েই ফৌত হয়ে গেল। থাকত তার মত কোন জিনিয়াস্ মিডলম্যান। না হত এত মিনিংলেস কুস্তি না এত ফ্রাজাইল ট্রিটি। এবার পিসিকে সেণ্টুর গোলা মেরে দমদমে ল্যাণ্ড করাবে কাকা-ই।

রাত্রে তীতুমীরের মা আলোচনায় ঘন হয় স্বামীর কাছে। এতদিন তাঁর এ সংসারে সারভাইভালের মোটো ছিল ‘তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।’ কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে এই নীতি না বদলালেই নয়। দেবর-বৌ খাস জার্মান।  ফটো দেখেছে তীতুমীরের মা। লম্বা-চওড়া-পেটানো চেহারায় বাগানে হাফ প্যাণ্ট পরে কাপড় মেলছে। জার্মান দেশে সবই কি বড় বড়! কাপড় মেলার কিলিপগুলো পর্য্যন্ত যেন কুমীরের দাঁত! এদিকে শাশুড়ির তো কোনো তালজ্ঞান নেই। উঠলো বাই তো কটক যাই। সে কবেকার কথা তবু হয়রানি ভোলেনি আজও। সে তখন জ্যষ্ঠিমাসে বিয়ে হসে আসা সদ্য নতুন বৌ। ভাদ্র মাসে শুনল মল মাসে নতুন বৌ-এর পা দেখবে না শাশুড়ি। এ কি বিপদ! পা জোড়া কোথায় তুলে রাখবে? তীতুমীরের বাবা বুদ্ধি দিল, “এখন বাপের বাড়ি? নো ওয়ে! এক কাজ করো, পায়ে মোজা পরে থাকো।” ওই পচা ভাদ্দরেতে পুরো এক মাস পায়ে মোজা পরে ঘুরতে হল নববধূকে! এবারে এমন কিছু বিপদ হলে একে বিদেশী ভাদ্র বৌ। কি বলবে, কি বুঝবে কে জানে! শেষে মান সম্মান না খোয়াতে হয়।

এ যুগের তীতুমীরের তীরও যে ঠিক লক্ষ্যে চলে তার প্রমাণ পাওয়া গেল দু দিন পর। পিসি-পিসেমশাই সমভিব্যবহারে কোলকাতায় আসার দিনক্ষণ পাকা করে ফেলেছে। কাকার বাড়িতেও উৎসাহের চড়া পারদ। কেমন করে প্রণাম করবে তার ডেমো দিতে দিতে কাকির নাকি ক’দিন কোমরে ফিক ব্যথা। ওদিকে পিসেমশাই প্রচুর ড্রাই ফ্রুটসের প্যাকেট পাহাড় করেছে বাড়িতে। পিসির ‘এতো কি হবে’ প্রশ্নের উত্তরে অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলেছে, “জাস্ট ইন কেস্!”

আর পাতিপুকুরের তোড়জোড় তো সীমাহীন। তীতুমীরের মা ভাতঘুমের মোহ ছেড়ে ইংরিজি ক্র্যাশ কোর্সে দৌড়চ্ছে। তীতুমীরের বাবা রঙের মিস্ত্রীর সাথে দর কষাকষিতে মহাব্যস্ত। গড়গড়ির মালাইচাকি গোবর আনতে আনতে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে আর দিদা মহানন্দে সেই গোবর গঙ্গাঁজলে মিশিয়ে সারা বাড়িতে সকাল সন্ধ্যে ছড়া ছিটোচ্ছে। কি, না ম্লেচ্ছদেশ থেকে ছেলে বৌ, মেয়ে জামাই আসবে, তারই শুদ্ধিকরণ চলছে।

এরই মধ্যে একদিন ভরদুপুরে বেরিয়ে কোত্থেকে ঘাড়ে করে টবশুদ্ধু তুলসী গাছ এনে হাজির করেছে মোক্ষদা। বড় বৌ-এর বিরক্তিভরা মুখকে তোয়াক্কা না করে সজনে গাছের গোড়ায় পাতা ইঁটের বেদীতে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বৌকে বললে, “তুলসীর টব! পরির বন্ধু ছেলো ওই মিনতির বাড়ি থেকে বয়ে আনলুম। পারি কি! কোমর বেঁকা। পথে দত্তগুপ্তদের রোয়াকে রাখলাম। তারপর মধু পটনায়েকের দোরগোড়ায় এট্টু কোমর খাড়া করে এক্কেরে রায়গিন্নীদের মালতী গাছের গোড়ায় এনে ফেলিচি তা জালনা দে বৌ দেখতে পেয়ে চা খেতে ডাকলে। তাতেই দেরী।”

“তার মানে দুপুরের টো-টো টা ভালোই সেরে এসেছেন।” না বলে কয়ে শাশুড়ির বেপাত্তায় মনে মনে উদ্বিগ্ন হওয়ার রাগ উগরেই দিল বড় বৌ।

হাত দেখিয়ে বৌমাকে চুপ করালেন মোক্ষদা। গলা তুলে বললেন, “গড়গড়ি! কাল বিষু্যদ বার, শুভদিন। উটোনে নতুন মাটি গোবর ফেলবি। মাকে কালই স্থাপনা করবো।” গোবর ঘাঁটার গ্রহদোষ কবে যে কাটবে ভেবে ভেবে উদ্বিগ্ন হল গড়গড়ি।

উদ্বিগ্ন তীতুমীরের বাবাও। ঘরদোর নতুন রং হল, অথচ গোবর জলের ছড়া ছিটিয়ে ছিটিয়ে চারিদিক দুর্গন্ধ।

“ভালোই তো,  জার্মান বৌ ভাববে, বাঃ কি সুন্দর কাউশেডে থাকে আমার ইন-ল’জ-রা।” চাপা রাগে গুমরায় বাবা।

নিদৃষ্ট দিনে তীতুমীরের মাকে সঙ্গেঁ নিয়ে এয়ারপোর্টে গেল বাবা। সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে দিদার ঘরে ঢুকে তীতুমীর দেখে গোবর-গঙ্গাঁজলে চুবে ভেজা বেড়ালের মতো জুবুথুবু বসে প্রাণপণে জপের মালা ঘোরাচ্ছে দিদা। চোখের চাউনিতে টেনশানের ছাপ।

এক পাড়া উৎসাহী প্রতিবেশী পেরিয়ে ট্যাক্সি থেকে শাড়ি পরা মেম কাকি নামল। দিদার গঙ্গাঁ-গোবর মিক্সচার গায়ে পড়তে কিছুমাত্র বিভ্রান্ত না হয়ে নিখুঁত একটি প্রণাম সারলো। তীতুমীরের মায়ের এক গাল হাসি। স্বস্তির সুরে শাশুড়িকে দেখেই বলল, “মা, বাংলা বলে।”

পাশ থেকে ফুট কাটল তীতুমীরের বাবা, “এক্কেবারে শাহী।”

ছেলে বৌ আর তাদের আনা সব জিনিষপত্রকে গ্যাঞ্জেস বেদিং করিয়ে ঘরের ঘাটে ভেড়াল দিদা। খান দুই তুলসী পাতা গিলিয়ে কাকিকে শুদ্ধ করে নিল। তাতে অবশ্য কাকির কোনো হেলদোল নেই। “বেসিল? ওয়াও! ডিলিশাস্!” বলে সে তুলসী বৃক্ষকে রীতিমতো আক্রমণ করে বসলো। তাই দেখে দিদা ছলছল চোখে পাড়া পড়শি সবাইকে বলে বেড়াতে লাগল, “আহা! বাছা আমার জন্ম বৈষ্ণব। ভাগ্যদোষে ও দেশে জন্মেছে গো! সাধে কি আমার মন নারায়ণ নারায়ণ করছিলো!”

তীতুমীরদের বসার ঘরে জমাটি আড্ডা। পিসি পিসেমশাইও এসে গেছেন। সাদা ফুলকো লুচি, আলুর কষা দম, রাবড়ি রসগোল্লায় মোলায়েম জলখাবারটি সেরে পিসেমশাই জম্পেশ করে শোনাচ্ছেন ওমানের সুপার ডেলিকেসি বালির তলায় গর্ত করে ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে কাঠ কয়লায় ঝলসানো উটের মাংসের রেসিপি।

“বুঝলে হে,” তীতুমীরকে বলে পিসেমশাই, “উটের কুঁজের ভেতরের নরম গোলাপী মাংসটাই হল সবচেয়ে ডিলিশাস।”

পিসি ওমান থেকে কত কী না এনেছে। তার মধ্যে দারুণ ফিগের হালুয়া। পিসেমশাই বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেঁ মুড়ি মুড়কির মতন ড্রাই ফ্রুটসের প্যাকেট সবাইকে যথেচ্ছ বিলোচ্ছে।

দিন দুই পরে পূর্ণিমা। সন্ধ্যে লাগতে না লাগতেই দিদার তাড়া। বাড়ির মেয়েরা সারাদিন পূজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। “গরদ টরদ এই বেলা পরে নে সব। বৌমা, নৈবেদ্দ যেন হাতে তৈরী থাকে, গুরুদেবকে নিয়ে পচা এলো বলে।”

পিসির লঝঝড়ে মার্কা শাড়ি পরা দেখে তীতুমীরের মা ফুট কাটে, “এই দেড় বছরে সব ভুলে বসেছো!”

উদাস সুরে পিসি জানায়, “যস্মিন দেশে যদাচার। শাড়ি ফাড়ির পাট ফাট তুলে দিয়েছি আজকাল।”

কাকি নাক গলায়। “ইণ্ডিয়ান কম্যুনিটি টো আচে ?”

পিসি হেসে বলে, “তা আছে। আর মহিলারা দারুণ সব শাড়িও পরে খুব। তবে ওই পালে পার্বণে। যে চিমটি খেয়েছিলাম, বাইরে আর শাড়ি পরি না।”

দিদা, মা, কাকি আঁতকে ওঠে। “চিমটি?”

“ওর সঙ্গেঁ গেছিলাম এক ডিপার্টমেণ্টাল স্টোরে। নতুন নতুন তখন। জিনিসপত্র দেখছি কিনছি, হঠাৎ পিঠে এক মোক্ষম চিমটি। দেখি, তিন অ্যারাবিক মহিলা বোর্খার জালি জালনা দিয়ে ভাঁটার মতন গনগনে চোখে তাকিয়ে। ভাষা তো একবর্ণ বুঝি না। ও তাড়াতাড়ি কি সব বলে আমাকে এসকর্ট করে আনল। পিঠে লাল পিঁপড়ের কামড়। শুনি, পাবলিক প্লেসে গা দেখিয়ে ঘোরার অপরাধে ওমন শাস্তি পেলুম!”

পিসি তো হাসতে লাগল, বুক শুকিয়ে গেল মোক্ষদার। “এ কি গেরো! এবার কি মেয়ে-জামাই বোর্খা শেরওয়ানি ধরবে!” মনে মনে ভাবে।

গুরুদেব পূজায় বসেছেন। হোম যজ্ঞাদি হবে। লোকজন মন্দ জমেনি। নারায়ণের ভক্তিতে না বিদেশী বৌ দেখার শক্তিতে কে জানে। পিসি নৈবেদ্যর থালা হাতে ঢুকল। গুরুদেব মিঠে হেসে বললেন, “ভালো আছো, মা পরি?”

গাল বিস্তার করে পিসি বললো, “ইনসাল্লাহ্, গুরুদেব।”

ঘরে বুড়িমার দোদমা ফাটলো এমন চমক। গুরুদেব গম্ভীর। দিদা ফ্যালফেলে। পাড়া প্রতিবেশীর ফুসফুস-গুজগুজ। ঠিক এমন সময় কাকার কাঁধ জড়িয়ে ঘরে ঢুকল পিসেমশাই। পূজার উপাচার দেখে বড়ই আনন্দিত। দরাজ গলায় বলল, “দেরী কেন করছেন গুরুদেব? ইনসাল্লাহ বলে শুরু করে দিন।”

“ওম্মা গো! মিন্সে আল্লাহ আমার সদব্রাহ্মণ মেয়ের এ কি হাল করে ছেড়েচে গো!” বলে গোঁ গোঁ করতে করতে দিদা মুখ ভেটকে পড়বি তো পড় একেবারে নারায়ণের সিন্নীর গামলায়। যেন পোড়ামুখের এ কলঙ্ক থেকে নারায়ণের সিন্নীই মেকওভার করবে।

“যাঃ, এত সাধের সিন্নীটা ভোগে গেলো,” ভেবে তীতুমীর মনে মনে একটু দুঃখ করছে, এমন সময় নতুন কাকি তার কাঁধে ধাক্কা দিতে দিতে চিল চীৎকার জুড়ে দিল। “মাকড়া ভাণ্ড হইতে পানি স্প্রিঙ্কল করো জ‍্যালডি!” চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল।

তীতুমীরের কিন্তু আঁতে লাগল খুব। না হয় পিসেমশাই আর পিসির ইসলামি বুলির খিল্লি খেয়ে দিদার দাঁতকপাটি লেগেছে, তাই বলে একঘর লোকের সামনে নতুন কাকি তাকে ‘মাকড়া’ বলবে?

কাছা কোঁচা সামলে গুরুদেব ততক্ষণে পূজাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। রায়গিন্নী বোস-ঘোষ-গড়াইরা দিদাকে ধোয়াতে ব্যস্ত। সিন্নীর বিউটি রেজিমে চকচকে মুখে দিদা সামলে সুমলে উঠে বসেছে। পরি এখনো যে তিমিরে সেই তিমিরেই নৈবেদ্যর থালা হাতে হতবাক, দণ্ডায়মান। তীতুমীরের মা তাকে মৃদুস্বরে বৃত্তান্ত বললে কিছুমাত্র না দমে গুরুদেবকে দৃপ্তভঙ্গীঁতে বললো পরি, “ঈশ্বরকে আল্লাহ আর নারায়ণ বলায় তফাত কি? আপনিই তো বলেন, সর্বধর্ম সমন্বয়!”

অতএব ছুঁচো গেলা মুখে গুরুদেব আবার পূজাসনে থেবড়ে বসেছেন। পাড়া প্রতিবেশীর মুখের পেশীও কিঞ্চিৎ নরম। কেবল তীতুমীর ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

পূজা যজ্ঞ হোম শেষ হল। এবার শান্তিজল সিঞ্চন। দিদার আদেশে নতুন কাকি শূন্য গঙ্গাঁজল পাত্র পূর্ণ করে এনে হাত নেড়ে কাকাকে ডাকল, “হোলি মাকড়া পানি স্প্রিঙ্কল হইবে। শীঘ্র আইস।” ‘মাকড়া পানি’ শুনেই তীতুমীরের টনক নড়ে।

“মাকড়া পানিটা কি বস্তু?” বলতে বলতে মাথা পাতে কাকা। গুরুদেব মুচকে হেসে বলেন, “বৌমা হয়তো মকর পানি বলছেন?” কথাটা কানে যেতেই দম ফাটা হাসিতে পেট বুক মুচড়ে মাটিতে প্রায় গড়াগড়ি তীতুমীর। যজমানের নাতিকে আবার কি পেঁচোয় পেল এই আশঙ্কায় প্রাণপণে সকলের মাথা ঠাণ্ডা করার আপ্রাণ চেষ্টায় ঘড়া থেকে ‘মকর পানি’ বর্ষাতে লাগলেন গুরুদেব।

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

6 comments
Add Your Reply