মিঠে কড়া

Download this story in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.

‘এই হারান, দুটো লাল সুতোর বাণ্ডিল দে তো!’

খেটো ধুতির ঘর্মাক্ত হারান পানের ছোপ ধরা দাঁতে একগাল হেসে বললো,‘এই যে দিই বাবু।’ বলে, তাড়াতাড়ি হাতের পান সাজতে লাগলো। বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে যেতে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে এই পান বিড়ির দোকানটা কখনো খালি থাকে না। বিশেষ, ভর সন্ধে্যয় তো খদ্দেরে ঠাসা। বেশীর ভাগই কুলি মিস্ত্রি গোছের খেটে খাওয়া মানুষের ঢল, যারা মৃতু্যর পরোয়ানা নিয়ে আসা অসুখ বিসুখের ভয়কে কাঁচকলা দেখিয়ে বিড়ি, সিগারেট সেবন আর পানজর্দা পানমশলার চর্বিত চর্বণ করে যায়। শিক্ষিত ভদ্রগোছের খদ্দেরও যে নেই তা নয়। এই যেমন পরেশবাবু। রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক।  বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মানুষের পার্সোনালিটি এবং হাইজিন সম্পর্কে ওনার কতগুলো অদ্ভুত বদ্ধ ধারণা আছে। যেমন পুরুষকারের সঙ্গে ধোঁয়াটানা নেশার ওতোপ্রোত সম্পর্ক আছে বলে ওনার মনে হয়। আবার সিগারেটের চাইতে বিড়িতে ফুসফুসের ক্ষতি নাকি কম হয়। আজ বহু বছর যাবৎ পরেশবাবু হারানের লাল সুতো বাঁধা বিড়ির বাঁধা খদ্দের।

বৃদ্ধ পরেশবাবু মিতবাক কিন্তু অমায়িক। দীর্ঘদিনের এই খদ্দেরটিকে হারান কিছুটা স্নেহ ও সম্ভ্রমের চোখে দেখে। পানের খদ্দের বিদেয় করে দুটো বাণ্ডিল এগিয়ে ধরে সে। আবার দাঁতকপাটি মেলে বলে,‘তা বাবু, বড্ড ঘন ঘন হয়ে যাচ্ছে যে! এ বয়সে এতোটা টান নাই বা নিলেন। এই পরশুদিনই দু বাণ্ডিল নিলেন না?’

হারানের হাতে খুচরো পয়সা গুঁজে দিয়ে গম্ভীরমুখে পরেশবাবু ‘বৌমা এসেছেন’ বলে হাঁটা লাগালেন।

হারান পয়সা হাতে হাঁ করে কিছুক্ষণ বসে রইল ঐ ভিড়ের সময়। যাচ্চলে, বাবুর কি ভীমরতি ধরল নাকি! ঘরে বৌমা আসার সাথে বাণ্ডিল বাণ্ডিল বিড়ি ভ্যানিশ হওয়ার কি সম্পর্ক থাকতে পারে! কিন্তু মাছির মতো ভনভনে বিরক্ত করা খদ্দেরদের চাপে পড়ে মাথা ঘামাবার তার সময় কই রে বাপু!

পরেশবাবু হাঁটছেন। ক’দিন জ্বালাপোড়া গরমের পর আজ বিকেলবেলা ঝড় বৃষ্টি হয়ে বাতাসে শীতল আমেজ। কালবৈশাখীর সান্ত্বনায় শরীর জুড়োলেও মনের জ্বালা নেভে কই! শিক্ষক হিসেবে বরাবর একটা আদর্শের ছকে জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রী বিনতা আর ছেলে জ্যোতির্ময়কে নিয়ে তাঁর ছোট পরিবার ছিল। ছেলের নামকরণ অনেক আশা স্বপ্নের জাল বুনটের ফলপ্রকাশ। চিন্তায়, আচার-ব্যবহারে ছেলে হবে যাকে বলে পুরুষসিংহ। অথচ কি হল? শৈশব উত্তীর্ণ হতে ছেলের স্বভাবে, চলনে, বলনে, সাজ পোষাকে যেন মেয়েলীপনার ঢল নামলো। এ কি ছেলে ছেলে করে বিনতার অতিরিক্ত আদরের ফল? এই তো সেদিন পর্য্যন্ত বিনতা ঐ দামড়া ছেলের ফুলো গাল টিপে সকলের কাছে গর্ব করতো, ‘আমার জতুর গাল দুটো দ্যাখো! ঠিক যেন কাশ্মীরী আপেল!’

পড়াশোনায় মেধাবী হলেও অমন মেদীমার্কা আচার ব্যবহার দিনে দিনে ছেলের প্রতি পরেশবাবুকে বিরক্ত করে তুলেছিল। পারিবারিক আড্ডার মাঝে মহিলাদের মতন মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ওঠা বা ন্যাকা সুরে ‘আমি একটা কথা বলবো?’ বলে গৌরচন্দ্রিকা করে কথা বলা — দেখে শুনে পিত্তি চটে যেত পরেশবাবুর। আবার দেখেছেন কোথাও বেড়াতে গেলে পাক্কা দুটি ঘণ্টা লাগে তৈরী হতে। বাথরুমে একবার বাবু ঢুকলেন তো হয়ে গেল। হলফ করে বলতে পারেন, এর কারণ ছেলের সাবান আর শ্যাম্পু লাগানো শেষ আর হয় না। সেই অনেকটা বিজ্ঞাপনের মহিলাদের মত পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি সাবানের ফেনা তুলতেই আধঘণ্টা আর মুখমণ্ডলে ঐ গতিতে পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই। মাসের মধে্য আর না হোক বার চারেক তাঁকে শ্যাম্পু সাবানের জোগাড় দিতে হয়। চুলে আঙুল চালিয়ে চুল ফাঁপাচ্ছেন তো ফাঁপাচ্ছেন, পাউডারের পাফ বুলোচ্ছেন তো বুলোচ্ছেন। ছিঃ ছিঃ, পুরুষমানুষের আবার পাফ বোলানো! শুধু কি তাই, দু বগলে পারফিউমের ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ যেন শেষই হতে চায় না। ভুরু কুঁচকে চশমাখানা নাকের ডগায় ঝুল ঝুল ঝুলিয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছেন তো বাঁধছেন।

বিনতার সাথে এসব নিয়ে অলোচনায় লাভ হয়নি কিছুই। মেধাবী ছেলের কেরিয়ারে আশাতিরিক্ত ভালো ফল বিনতাকে গান্ধারী করে রেখেছিল। শুধু তিনি নিজে যদি ধৃতরাষ্ট্রের মতো পুত্রস্নেহে অন্ধ হতে পারতেন!! একটা দীর্ঘশ্বাস পরেশবাবুর বক্ষপিঞ্জর থেকে ফোঁস্ করে বেরিয়ে এল। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলেন অন্যমনস্ক হয়ে গোটা পথ হেঁটে বাড়ির দরজাতেই পৌঁছেছেন। ‘হুঃ, মোল্লা আর কোথায় যাবে,’ ভেবে গেট ঠেলে ঢুকে পড়লেন পরেশবাবু।

ছোট্ট একরত্তি বাগানওয়ালা বাড়িটা বালিগঞ্জ লেক থেকে বেশী দূরে নয়। স্কুল থেকে অবসর নিয়ে মনের সাধ মিটিয়ে কিছু আধুনিক কায়দায় রেনোভেশান করিয়েছিলেন। গাছপালা ভালোবাসেন বলে আজকাল বাগান নিয়ে পড়েছেন। মরশুমী ফুল, কিছু সবজি যখন যা পান লাগিয়েছেন। বেশ টুকটুকে চেহারা বাগানটির। বৃষ্টি ভেজা বেল জুঁইয়ের মিষ্টি গন্ধঢালা গলিপথ বেয়ে সদরে পৌঁছলেন। বসার ঘরে ঢুকে দেখেন চাঁদের হাট বসেছে। বিনতার বাপের বাড়ি এণ্ড কোং, বিনতা, ছেলে আর ছেলে-বৌ ম্যাটিলডা।

আজ দু বছর পর ছেলে আমেরিকান বৌ নিয়ে গত সপ্তাহের শনিবার বাড়িতে পদার্পণ করেছে। আর আজ দিন চারেক হল বিদেশী বউ দেখবার হুজুগে কেউ না কেউ এসেই যাচ্ছে বাড়িতে। হা হা হো হো যথেচ্ছ হাসি মস্করার সাথে দেদার চা-টা উড়ছে। বেশ একটা মজলিশি মজলিশি ভাব। অথচ ছেলে যখন প্রথম মাকে তার বিদেশিনী বিবাহের খবরটা ফোনে জানায় তখন এই বিনতারই সে কি উগ্রচণ্ডা-প্রচণ্ডা রূপ। কখনো নাদ হুঙ্কার ছাড়ে তো কখনো হাঁউ-মাউ কান্না। এই শোক পরিবারে ম্লেচ্ছ বৌ আসায় না কি এতাবৎকাল ছেলের প্রতি একচ্ছত্র মাতৃত্বের অধিকারবোধ ফলানোর গৌরব ধাক্কা খাওয়ায়, তা পরেশবাবু জানেন না। তবে এতদিনে ছেলে নিজের সিদ্ধান্তে অন্ততঃ একটা কাজ করেছে জেনে তিনি মনে মনে অখুশি হননি।

মাঝের কটা মাস গুমোটে ভাব ধরে রাখলেও শেষে হার মানলো বিনতা। তখন শুরু হল ছেলেকে বৌ নিয়ে আসার জন্য বারবার অনুরোধ। মা-ছেলের এই সব ভ্যানতারায় পরেশবাবু মাথা ঘামান না। একদিন মর্নিং ওয়াক সেরে সবে ফিরেছেন, বিনতা গদগদ হয়ে একখানা ফটো হাতে চা নিয়ে এলো। চেয়ে দেখলেন খানিক হাফ প্যাণ্ট, লাল স্যাণ্ডো গেঞ্জী, খাকি টুপি, পায়ে সাদা কেড্স্ আর চোখে কালো চশমা পরা কে একজন ছেলের গলা জড়িয়ে ধরে, আর তাঁদের ছেলে নবকার্তিকের মতো দাঁত ক্যালাচ্ছে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠেছিল ক্ষণিকের জন্য। মনে পড়েগিয়েছিল বন্ধু ফণিবাবুর অভিজ্ঞতা। ওফ্ ! ঈশ্বর! কাঁপা গলায় স্ত্রীকে শুধিয়েছিলেন,‘কে এই ছেলেটি ?’

বিনতা মুখটাকে বিকট রকম অবাক করে বলেছিল, ‘চোখের মাথা খেলে নাকি? এই-ই তো বৌমা! ডাক্তার!!’ তারপর গর্বে হেসে ফটোখানা নিজের নাকের ডগায় মেলে ধরে বলেছিল, ‘কী, স্মার্ট না?’

ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছিল পরেশবাবুর। মৃদু স্বরে বলেছিলেন, ‘তা মন্দ কি!’ পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ তিনি। হালফিলের অনেক বাস্তব মেনে নিতে, বুঝতে, হজম করতে বেশ বেগ পেতে হয়। স্বামীকে চুপ দেখে বিরক্ত হয়ে বিনতা বললো, ‘তোমার সবটাতে বাড়াবাড়ি। ছেলের কোন ব্যাপারে উৎসাহ নেই তোমার?’

‘না না, তা কেন,’ মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলেছিলেন পরেশবাবু। ‘কিসের ডাক্তার বললে?’

টেবিলে ঠক্ করে প্রায় জুড়িয়ে যাওয়া চা’টা নামিয়ে রাখলো বিনতা। ‘পাগলের,’ বলে দুম্ দুম্ শব্দ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বলে কি বিনতা! রাগ করে বলছে না কি? তখন এরকমটাই ভেবেছিলেন পরেশবাবু। এখন জেনেছেন বৌমা সাইকোলজিস্ট্। কোন গুণে তাঁদের মাকাল ফলটি বৌমার কাছে লোভনীয় হল তা নিয়ে বিলক্ষণ কৌতুহল আছে পরেশবাবুর।

তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই নড়ে চড়ে বসলো। এ ধরণের আড্ডায় তিনি যে ভগ্নদূত বিশেষ তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কোনকালেই তাঁর তেমন গা ঘষাঘষি নেই। সর্বদাই একটা আপেক্ষিক উদাসীনতা ধরে রাখেন তিনি। এখনও দেঁতো হেসে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন। এক কাপ চা পেলে মন্দ হত না কিন্তু ঐ বারো ভূতের আড্ডার মাঝে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে না। বরং আরামকেদারায় হাত পা ছড়িয়ে বসে বইয়ে ডুবে যাওয়া তাঁর কাছে অনেক বেশী লোভনীয়। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধে্যবেলাটা পড়াশোনা নিয়েই থাকেন। বিনতা এই সময়টা বিভিন্ন সিরিয়ালের বিচিত্র সমস্যার চোরাধাঁধায় মশগুল হয়ে থাকে। দশটা নাগাদ পরিমিত আহার, সাড়ে দশটায় বাতি বন্ধ। এই তাঁর দীর্ঘদিনের দৈনন্দিন রুটিন। এখন কিন্তু সংসারের পালে উলটো হাওয়া। খাওয়া দাওয়া বসা শোওয়া সবই চলছে ছেলে-বৌ-এর জেটল্যাগের খেই ধরে।

কালবৈশাখীর হাওয়ায় ঘামে ভেজা গেঞ্জীটা বুকেই শুকিয়ে গেছে। বাইরের পোশাক ছেড়ে ধুতি ফতুয়ায় বেশ মৌজ করে আরামকেদারায় বসলেন পরেশবাবু। বিনতাকে চায়ের জন্য হাঁক দেবেন কি না ভাবছেন, দেখেন ম্যাটিলডা দু হাতে দু কাপ চা নিয়ে ঢুকছে। বৌমার পরণে জংলা ছাপ বারমুডা, হাত কাটা নীল গেঞ্জী। এলো মেলো সোনালী চুল সন্ন্যাসিনীদের মত ব্রহ্মতালুতে ঝুটো করে বাঁধা। কাছে এসে মধুর হেসে ম্যাটিলডা বললো, ‘ড্যাডু  চাএ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!’ সশব্যস্ত হন পরেশবাবু। হুম, ঐ নামেই তাঁকে ডাকছে মেয়েটা। নিজের চা নিয়ে পরেশবাবুর মুখোমুখি বসল ম্যাটিলডা। তখনি পরেশবাবুর পেটে হাজার হাজার প্রজাপতি ওড়াউড়ির অনুভূতি শুরু হল। হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছেন তাই। অতঃপর যে বাক্যটি পরেশবাবু শুনতে চান না, তাই তাঁকে পুনরায় শুনতে হল।

হয়েছে কি, রোজকার মত এই রবিবারও সকালের চা’টা নিজেই বানিয়ে খেয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরোবার তোড়জোড় করছেন। বিনতা বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে গেছে ছাতের ঠাকুরঘরে। এখন পাক্কা ঘণ্টাদেড়েক ওখানেই লটকে থাকবে। দেখেন ছেলের ঘরের সামনের প্যাসেজে ম্যাটিলডা আলুথালু কৌপীনসদৃশ বেশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলছে আর গেঞ্জীর ভিতর দিয়ে পেটে হাত বুলোচ্ছে! এ আবার কি বিপদ রে বাবা! এখন যান কি করে ঐ প্যাসেজ পেরিয়ে। নতুন জায়গা, নতুন জল হাওয়া, মেয়েটার কিছু অসুবিধে হচ্ছে না তো? তা না হলে এত ভোরে… বিনতাটা শুধু মাতামাতি করতেই আছে। এ সব সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো কে দেখে, অ্যাঁ?

হালকা করে একটু গলা খাঁকারি দিলেন তিনি। ম্যাটিলডা ফিরে তাকালো। টলোমলো পায়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললো, ‘গুড মর্নিং ড্যাডু!’

‘গুড মর্নিং! গুড মর্নিং!’ সশব্যস্ত বললেন পরেশবাবু। ‘হোয়াট হাপেন্ড্? ইজ এভরিথিং অলরাইট্?’ শুধোন তিনি। মনমরা গলায় ম্যাটিলডা বলে, ‘নো ড্যাডু!’ তারপর আরো গোটা তিনেক হাই তোলার ফাঁকে ফাঁকে সে যা বললো, তার সারার্থ হল, ক্যালকুটায় আসার আগে ‘জটি’ তাকে বলেছিল এখানে নো ফোঁকাফুঁকি  বিজনেস্।  কিন্তু তার ফলে তার কোষ্ঠ জ্যামপাক্ট আটকে গেছে। এখন রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। পরেশবাবুকে সে ছোট ছোট ব্রাউন সিগার খেতে দেখেছে। সেটা হলেও তার চলবে। এরপর ম্যাটিলডা সরাসরি সাহায্য চেয়ে বসে, ‘মে আই বরো ওয়ান সিগার ফ্রম ইউ, ড্যাডু?’

সর্বজনসমক্ষে বারবার অগ্নিপরীক্ষারত সীতার মতো লাজুক অপমানে কাতর হলেন পরেশবাবু। এ প্রার্থনা শোনা তাঁর স্বপ্নের বাইরে। হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘ইয়ে, মানে, দ্যাট ইজ নো সিগার। দ্যাট ইজ বিড়ি, মানে নট্ সো সফিস্টিকেটেড!’ বেপরোয়া ম্যাটিলডা হাত নেড়ে বললো, ‘দ্যাট ডাজণ্ট ম্যাটর!’ অগত্যা গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে এলেন। খান দুয়েক বিড়ি হাতে ফিরলেন। এরপর, ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ, শ্বশুর হয়ে নিজের হাতে বৌমাকে বিড়ি দিলেন। কি কপাল তাঁর!

এই জটি হতচ্ছাড়াটাই বা কে? মনে মনে ভাবলেন। বিগলিত হয়ে বৌমা বললে, ‘ইউ হ্যাভ সেভড্ মাই লাইফ। থ্যাঙ্ক ইউ সো ভেরি মাচ্!’ তুম্বো মুখে পরেশবাবু বললেন, ‘দ্যাট্স্ অলরাইট্, দ্যাট্স্ অলরাইট্। ইয়ে, মানে, হু ইজ জটি?’ অবাক হয়ে তাকায় ম্যাটিলডা।‘জটি!? ইওর সন্!!’ এই বলে মুহূর্তমধ্যে টয়লেট পানে অন্তর্ধান করে সে।

‘অ!!’ জ্যোতির্ময়ের মার্কিনি রূপান্তরে যারপরনাই আশ্চর্য্য হন পরেশবাবু। ওই ব্যাটাচ্ছেলের ‘জ’-টিতে একখানা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় এই ভোরবেলা কষাতে অদম্য ইচ্ছে হতে থাকে তাঁর। ওই হতভাগার জন্য এই শেষ বয়সে আর কী কী করা বাকি রইল!  শ্বশুর হয়ে তাঁকে কি না বৌমার কোষ্ঠ পরিষ্কারের দায়িত্ব নিতে হল! নিজের হাতে তুলে দিতে হল নেশাদ্রব্য আর ওই দ্যাখো স্বামী হয়ে মর্কট কেমন খোকাছেলের মতো পাশবালিশকে গদাসম জাঁকড়ে ধরে হা হয়ে ঘুমোচ্ছে। তোর বৌ-এর সুখ সুবিধে তুই দেখবি না, দেখবে বুড়ো বাপ? হতভাগা! গজগজ করতে করতে বাজারমুখো হাঁটা দেন পরেশবাবু। মর্নিং ওয়াকের ইচ্ছেটাই যেন মরে গিয়েছে।

সে যাত্রায় উদ্ধার পেলেও সমস্যা এখানেই মিটল না। বিড়ির ধোঁয়ায় কি জাদু ছিল ঈশ্বরই জানেন, তারপর থেকে বৌমা চিনে জোঁকের মতো তাঁর পিছনে লেগে রইল। নিয়ম করে হয় সন্ধ্যায় নয় রাত্রে বৌমা তার সকালের কোষ্ঠ পরিষ্কারের ‘কোটা’ সংগ্রহে  উঠেপড়ে লাগলো। প্রতিবারই তার মুখে এক কথা, ‘স্প্লেনডিড ড্যাডু!! কোথায় লাগে সিগারেট!’ মরেছে! মনে মনে প্রমাদ গোনেন পরেশবাবু।

এই সন্ধ্যেয়  যেমন পরেশবাবুর চা নিয়ে ঘরে এসে বৌমা জুলজুলে চোখে তাকাচ্ছে সদ্য পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করে টেবিলের উপর রাখা দু বাণ্ডিল লাল সুতোর বিড়ির দিকে। এ একেবারে মোক্ষম মাছ খেগো বিড়ালের দৃষ্টি। অতঃপর সেই অশ্রুতপূর্ব অমোঘ বাণী, ‘খান দুয়েক বিড়ি হবে, ড্যাডু?’ (রক্ষে এই অমোঘ বাক্যের ইংরিজিটা অত কড়া শোনায় না।)

রাত্রে বিনতার কাছে নিজের অস্বস্তিকর ভূমিকার কথা বলবো বলবো করছেন, স্ত্রী মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘জ্যোতু বলছিল তোমাতে আর বৌমাতে না কি বেশ জমেছে!’

‘মানে?’ মুহূর্তে মেজাজ চড়ে গেল পরেশবাবুর। ‘ওই যে গো মৌতাত!’ আহ্লাদী সুরে বলে বিনতা। নাঃ, এ বাড়াবাড়ি অসহ্য। গুমগুমে গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক যেন চিটেগুড়ের নাগরিতে পিঁপড়ে!’

‘ও আবার কি কথা?’ সপাটে মুখ ঝামটা দেয় বিনতা।

আশ্চর্যে্যর ব্যাপার সকালে মর্নিং ওয়াকের বন্ধুরা পর্য্যন্ত ব্যাপারটায় কোন গুরুত্ব দিল না। উল্টে পরেশবাবুর হাঁড়িপানা মুখ দেখে উপদেশের কি বন্যা! ‘হ্যাঁ হে, ভোরের তাজা বাতাসে শুধু শরীর ফিট রেখে কী করবেটা কি?  মনে যে প্যাঁচ মেরে রয়েছো, বলি, শরীর আর মন কি আলাদা?‘ বিপিনবাবুর কথার খেই ধরে যোগেন মিত্তির বললেন,‘তোমার সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি। সে বিদেশিনী। তাদের ধাতটাই আলাদা। আর চেয়েছে তো তোমারই কাছে বাপু!’ নাঃ, এদের বক্ বক্ অসহ্য। মনে মনে বিরক্ত হন পরেশবাবু।

‘তুমি এর ভালো দিকটা দেখলে না?’ অমিতেশবাবুর মতো বয়োজেষ্ঠ্য সম্মানীয় অধ্যাপকের মুখে এ কি কথা! না, না, আর চুপ থাকলে চলবে না। উত্তেজনায় গলা চড়ান পরেশবাবু, ‘এর মধে্য আবার ভালো দিক কী, অ্যাঁ? ঘরের বৌমা তার শ্বশুরের কাছে দিনের পর দিন, দিনের পর দিন চাচ্ছেন কী?  না, বাণ্ডিল গোটা বিড়ি! ছিঃ ছিঃ, ঘরের কী শ্রী!’ হতাশায় হাতের আঙুলে মাছি তাড়াবার ভঙ্গীঁ করেন পরেশবাবু।

পরেশবাবুর প্রতিক্রিয়ায় বিন্দু মাত্র না দমে অমিতেশবাবু খোলসা করে বলেন, ‘আহা, চটছো কেন! ধরো রোজ যদি বৌমা, তোমার ঐ বারমুডা না কি ঐ ঢোলা প্যাণ্টের…’ বাধা দিয়ে পরেশবাবু বলেন, ‘বারমুডা আমি পরি না। বারমুডা বৌমা পরেন।’

‘আঃ ওই হল। ধরো, ঐ বারমুডার পকেট থেকে সিগারেটটি বের করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে তোমার কাছে লাইটারটি চাইতেন এবং তোমারই মুখে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তেন, তা হলে ব্যাপারটি কি খুব সুখকর হত? তুমিই তো বললে, বৌমা বিড়ি টানেন বটে কিন্তু তোমার বা বৌঠানের সামনে অসৌজন্য প্রকাশ পায়নি।’

পরেশবাবু চুপ করে থাকেন। উৎসাহ পেয়ে বিপিন বলে, ‘তাছাড়া ভাই শরীর বলে কথা। তাঁর যদি ধোঁয়া না গিললে ইয়ে না হয়, মানে ইয়ে পরিষ্কার না হয় তবে তিনি কী করবেন?’ মিচকে মনিলাল দলে বয়োঃকনিষ্ঠ। ফুট কাটে, ‘বাবা, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়।’

আজও প্রায় মাইল দেড়েক লেকে চক্কর মেরে রোজকার মত গুলমোহর গাছের ছায়ায় পাতা সিমেণ্টের বেঞ্চিটায় বৃদ্ধের দল এসে বসলো। বিরাট গাছের ঘন ছায়া আর নবারুণের আলো বিচিত্র নকশায় ঘাসজমিতে কাটাকুটি খেলছে।  ভোরের মিঠে বাতাসে কাছেপিঠের কোন বকুলগাছের গন্ধ। বেশ আমেজ লাগে মনে। চুপচাপ বসে লেকের জলে সোনালী আলোর মাতামাতি দেখেন পরেশবাবু। দুঃখ পুষে রেখে লাভ কি? সংসারে তিনি টাকা রোজগারের মেশিন বৈ তো কিছু ছিলেন না। তাঁর মনের শখ আহ্লাদ, তাঁর পছন্দ অপছন্দ কবে আর গুরুত্ব পেয়েছে! ছেলের ইস্কুল কলেজ থেকে কেরিয়ার নির্বাচন সবই হয়েছে বিনতা আর তার বাপের বাড়ির অঙ্গুলি হেলনে। ছেলের বিয়ে নিয়ে তাঁর মনের গোপন কোণে কোথাও একটা কলি সবে ধরেছিল। তা ফুটতে পারল কি?

ছেলে তখন বিদেশে যাওয়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত। বাজার সেরে ফিরছেন পথে দেখা বন্ধুপ্রবর অমিয়র সাথে। তবে পুরনো বন্ধুর সাথে থাকা এক লাবণ্যময়ী তরুণী মনটা কেড়েছিল বেশী। ভারি সুন্দর মুখ চোখ, লক্ষ্মী প্রতিমাটি। জিজ্ঞাসা করে জানলেন অমিয়র একমাত্র কন্যা। স্ত্রী বিয়োগের পর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এ অঞ্চলে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন অমিয়। এখন স্থানীয় ব্যাঙ্কে অ্যাকাউণ্ট খুলতে চলেছেন বাবা-মেয়েতে। মেয়ের নাম জানলেন — প্রতিমা। বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান রিলেশানস্ নিয়ে পড়াশোনা করছে।  বাঃ বাঃ, রূপে  লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী! এমন চিন্ময়ী মা’কে যদি ঘরে তোলা যেত! হুঃ, সে স্বপ্নের কলিতে তো কবেই কাঁচি চালিয়ে দিয়েছে হতভাগা ছেলে। আনমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন পরেশবাবু।

দলের মধ্যে ফনিবাবু কিছু বয়োঃবৃদ্ধ। কম কথার মানুষ। এককালে ব্যাঙ্কের ডাকসাঁইটে ম্যানেজার ছিলেন। এখন জরার ভারে আর জীবনের তাড়নায় সে দাপুটে ভাব আর নেই। লাঠিটা দু পায়ের ফাঁকে রেখে হাতলে চিবুক চিপে ফনিবাবু ‘পরেশ’ বলে ডাকতেই, সম্বিৎ ফিরলো পরেশবাবুর। ধীরে ধীরে ফনিবাবু বললেন, ‘খামোখা নিজের অহঙ্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে কেন জটিলতা বাড়াচ্ছো? যা আছে, তাও হারাতে চাও কি? আধুনিক যুগের তীব্রতা যদি মেনে নিতে না পারো তাহলে মুখ থুবড়ে পড়বে একেবারে আমার মতো। তখন সহানুভূতির কোনো হাত তোমাকে ওঠাতে আসবে না এটা জেনো।’ ফনিবাবুর কথায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন পরেশবাবু। বৃদ্ধের মনোব্যথার তুলনা কি আছে!

গেলো বছর গ্রীষ্মের মুখে ফনিবাবু আর তাঁর স্ত্রীর হঠাৎ বিদেশ ভ্রমণের একটা সুযোগ এসে গেল। তাঁদের একমাত্র ছেলে রনিত আজ বছর পাঁচেক আমেরিকার স্যানফ্রানসিস্কো শহরে আছে। তিনমাসের গ্রীষ্মের ছুটির আমন্ত্রণে বাবা মাকে এয়ার টিকিট পাঠিয়েছে সুযোগ্য পুত্র। গত পাঁচ বছরের মধ্যে একটিবারের জন্য দেশে না ফেরা বারমুখো ছেলেকে ঘরমুখো করার আশায় ফনিগিন্নী খান কতক বাছাই করা বঙ্গ সুন্দরীদের ফটোগ্রাফ সঙ্গে নিলেন। কিন্তু কী ভেবে গেলেন আর কী হল!

মার্কিনি কালচারের স্মার্টনেসের গুঁতোয় প্রথম থেকেই ধুঁকছিলেন বৃদ্ধ দম্পতি। ঘরে বাইরে মানুষের জীবনের উপর মেশিনের দাদাগিরি বুঝতে বুঝতেই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তদুপরি স্থানীয় বঙ্গসমাজের বাক্সে হাফ মার্কিনি আর হাফ্ বং কালচার গুলে যে মিশ্র জড়িবুটিরা শোভা পাচ্ছে তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ডোজ ঐ বুড়ো বয়সে সহ্য হয়নি ফনিবাবুর। স্বাধীন ভাবে বেড়াবেন, ফিরবেন সে গুড়ে বালি। গাড়ি ছাড়া জীবন চলে না। উইকেণ্ড ছাড়া জীবন থুড়ি, ছেলেকে পাওয়া যায় না। তবু কোনগতিকে এক মাস কেটে গিয়েছিল। এক বিকেলে কর্তাগিন্নি চা পান করছেন হঠাৎ দেখেন চাবি খুলে এক বকচ্ছপের আবির্ভাব। সে বক না কচ্ছপ অর্থাৎ পুরুষ না নারী তাই বুঝতে পারছিলেন না ফনিবাবু। ততক্ষণে সেই মূর্তি মাথা ভরা রঙ্গীন জটাঝুটি দুলিয়ে, কালো চশমা কপালে তুলে, চকরা বকরা শার্টের পকেট থেকে মোবাইল, চাবি রিং ইত্যাদি বার করতে করতে নাকের দুটো ফুটোর সামনে দিয়ে ঝোলানো একখানা ছোট নথ নেড়ে অসম্ভব মিহি গলায় বললে, ‘হে মেসোমশা-মাসিমা!! আমার নাম ব্যাডাল হচ্ছে। আমি বাঙালী হচ্ছি। রণো আমার পার্টনার হচ্ছে।’ এই কিম্ভূত ভাষার ধাক্কায় ফনিবাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। স্ত্রীর অবস্থাও তথৈবচ।

রাত্রে রণিত ফিরলে দেখা গেল ব্যাডালের অকস্মাৎ উদয় হওয়া নিয়ে তার বিশেষ হেলদোল নেই। সে শান্ত সুরেই তাকে পরিবারের সদস্যা হিসেবে মেনে নিতে অনুরোধ করল বাবা মা’কে। কিন্তু ফনিবাবুর পক্ষে এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া সোনার পাথরবাটির মতো অসম্ভব। ছেলের সঙ্গে সব সম্পর্ক খুইয়ে দেড় মাসের মাথায় দেশে ফিরে এলেন ফনিদম্পতি।

সে তুলনায় ম্যাটিলডা খারাপ কি?  আনমনে ভাবলেন পরেশবাবু। এরই মধ্যে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। শাশুড়ির সাথে মিলে নিতি্য দুবেলা লাউচিংড়ি, চিংড়ি মালাই কারি, দই দিয়ে কষা মাংস রাঁধছে। বাঙালী খাবার তার বেশ পছন্দের। এই তো সেদিন বাজারে কচি পুঁইডগা পেয়ে কটা গোছা কিনেই ফেললেন পরেশবাবু। বিনতা পুঁই চচ্চড়িটা বেশ করে। ম্যাটিলডা দেখা গেল আম বঙ্গবধূর মতো চচ্চড়ি গলাধঃকরণে রীতিমত ওস্তাদ। মাতব্বর ছেলে পাশ থেকে তাকে বোঝায়, ‘দিস ইজ অ্যা সাগ্ কলড্ পুইঁ!’ বিনতার ইচ্ছেয় একদিন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মায়ের মন্দিরে ওই অতখানি সাপের মতো লম্বা লাইনে ফুল প্যাঁড়ার খাঁচা বুকে জাপটে ধরে ঝাড়া দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পূজো দিয়ে প্রসাদী সিঁদূর কপালে মেখে বিজয়গর্বে বাড়ি ফিরল। শ্বশুর শাশুড়িকে প্রায়ই এটা দিচ্ছে, ওটা দিচ্ছে। দাঁত ঘষে জিভ উল্টে শ’ বর্গের সর্বনাশ করে বাংলা বলার আপ্রাণ প্রয়াস করছে। মাঝে মাঝে তিনি বিচার করে দেখেছেন তাঁর নিজের ঐ আলালের ঘরে দুলালের চাইতে ডাকাবুকো স্বভাবের উচ্ছল খোলামেলো মেয়েটিকে তাঁর খারাপ লাগে না।

মাঝে এক সন্ধ্যায় শ্বশুরের কাছে চা নিয়ে এলে বহুদিনের চাপা কৌতুহলটা মেটাতে চেয়েছিলেন পরেশবাবু। ‘ইয়ে, হাও ডিড মাই সন্  ফ্যাশিনেট ইউ?’ মুহূর্ত মধ্যে উত্তর দিয়েছিল বৌমা, ‘ওহ্, বাই হিজ্ ফেমিনিজম্!’ পুরুষের ভীতু ভীতু মেয়েলি ভাব নাকি তার নিজের টম্ বয় মার্কা স্বভাবের একেবারে বিপরীত বলে তাকে আকর্ষণ করে। বোঝ! কত মতি দিয়েছ এ সংসারে প্রভু! মনে মনে ভাবেন পরেশবাবু। তা না হলে সামান্য লাল সুতোর বাঁধা বিড়ি এই আধুনিকা মার্কিনির মন জয় করে!

ছেলে, ছেলে-বৌ-এর ছুটি প্রায় ফুরোবার মুখে।  রাত্রে বিনতা বিরিয়ানীটা রেঁধেছিল খাসা। লোভে পড়ে কিঞ্চিৎ বেশীই খেয়ে ফেললেন পরেশবাবু। খাওয়া দাওয়া চুকলে ম্যাটিলডা শুরু করল তার প্রফেশানের হাজার ইণ্টারেস্টিং কেস হিস্ট্রি। সভাভঙ্গঁ হতে হতে রাত বারোটা। ‘গুড নাইট!’ বলে ম্যাটিলডা তার সকালের কোষ্ঠৌষধ নিয়ে বিদায় নিলো। বিনতা আর ছেলের চোরা চাপা চোখ হাসাহাসি নজর এড়ালো না পরেশবাবুর। পাত্তা না দিয়ে তিনি শোবার উদ্যোগ নিলেন।

কি এক অস্বস্তিতে ঘুম এল না তাঁর। এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন। হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যথার সঙ্গে কুল কুল করে ঘামতে লাগলেন। ঘাড়পিঠ সব ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। জল খাবেন বলে হাত বাড়িয়েছিলেন, তারপর সব ব্ল্যাক আউট।

চেতনা যখন ফিরলো দেখলেন যন্ত্রপাতি ঠাসা এক অচেনা ঘর। চারপাশে পরিচিত জনের উদ্বিগ্ন মুখ। সাদা কোট পরা গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো এক ছোকরা হাসিমুখে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘কি, মিস্টার দত্ত! কেমন ফিল করছেন?’

মৃদুস্বরে পরেশবাবু বললেন, ‘ভালো।’ পাশে দাঁড়ানো বিনতার চোখে জল। হায়, কবে শেষ এই মধুর ছবি দেখেছিলেন! স্ত্রী হাতে হাত রেখে বললো, ‘যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! দেখালো বটে তোমার বৌমা। একেবারে মিলিটারি তৎপরতায় সব ব্যবস্থা করেছে সে। এখন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠো, ভালোয় ভালোয় ঘরে চলো।’ ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন তাঁর মেনীমুখো দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে কি গাম্ভীর্য্য নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শে  ব্যস্ত, পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বৌমা। এদিকে হাতে হাত রেখে বিনতা। কি এক অভূতপূর্ব আবেশে চোখ বোজেন পরেশবাবু। বোঝেন, সংসার বাগানে তিনি আগাছা নন। রীতিমতো মূল্যবান এক আদরণীয় অর্কিড।

আধা সুস্থ মানুষ হয়ে ফিরলেও পরেশবাবুর বাড়িতে ফের চাঁদের হাট। অ্যাটাকটা মাইল্ড ছিল তাই রক্ষে। এখন নিয়মাবলী মেনে জীবনযাপন করতে হবে। আজ বিকেলে তাঁর মর্নিং ওয়াকের সাঙ্গপাঙ্গরা এসেছেন। হাতে হাতে ঘুরছে চায়ের কাপ। বিনতা আর বৌমার বানানো মাছের চপ। তবে পরেশবাবুর জন্য এ সব নয়। তাঁর পথ্য সেবার দিকে অসম্ভব নজর রেখেছে বৌমা। সুরুয়ার বাটি হাতে এসেও পড়েছে শ্বশুরকে খাওয়াবে বলে। ইতিমধ্যে তার মাঝরাতে ওই বিপদের সময় মিলিটারি তৎপরতার খ্যাতি মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এখন শ্বশুরকে যত্ন করে গলায় ন্যাপকিন বেঁধে ধীরে ধীরে সুরুয়া খাওয়াতে দেখে পরেশবাবুর বন্ধুরা সপ্রশংস  তাকাতাকি করতে লাগলেন  নিজেদের মধে্য। পরেশবাবুরও কেমন যেন গর্ববোধ হতে লাগল বন্ধুদের সামনে। বিনতা বললো, ‘বন্ধুকে বলে যান খাওয়া শোওয়া সব নিয়ম মেনে করতে হবে। আমার কথা তো শুনবে না। আপনাদেরটা যদি শোনে। আর হ্যাঁ, বিড়ি ফোঁকা চলবে না।’

বিনতা কথাটা বাংলায় বললেও ‘বিড়ি’ শুনেই সচেতন হয়েছে ম্যাটিলডা। আর এই দেড়মাসে বাংলায় হ‍্যাঁ আর না তার ভালোই রপ্ত হয়েছে। অতএব শাশুড়ির বাক্যে দুই আর দুই চার মিলিয়ে সে বুঝলো পরেশবাবুকে বিড়ি খেতে নিষেধ করছেন শাশুড়ি। পরেশবাবুর ম্রিয়মাণ মুখখানি দেখে সে নিজের সিদ্ধান্তে আরো দৃঢ় হল। পরেশবাবুর জন্য তার বেশ কষ্ট হল। ‘আহা, অমন খাসা জিনিষের নেশাত্যাগ করা কি বিষম ব্যাপার শাশুড়িমাতা কি বুঝবেন!’ ভাবলে সে। আন্তরিক হয়ে পরেশবাবুকে আর এক চামচ সুরুয়া খাইয়ে সে স্তোক দিয়ে বললে,‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না, ড্যাডু ! তোমার বিড়ির মাহাত্ম্য আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝি। আমার প্রাণ দিয়ে তোমার এই রেড থ্রেড ব্রাউন সিগারের মাহাত্ম্য আমি রক্ষা করবো।’ হতভম্ব পরেশবাবু বন্ধুদের সামনে বৌমার এহেন সান্ত্বনা বাক্যে কী বলবেন বুঝে না পেয়ে কোঁত করে সুরুয়া গিলে ফেললেন। ফনিবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘তা বৌমা, সাগরপারে এই স্পেশ্যাল নেটিভ জিনিষ তুমি কেমন করে পাবে মা?’

বরাভয় মুদ্রায় হাত তোলে ম্যাটিলডা। চোখ বুজিয়ে হেসে বলে, ‘কিসু্য ভাববেন না, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ ড্যাডু ভালো হলেই সে হারানের দোকানে যাবে। হারানের সাথে বসে ছকে নেবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বিড়ির এক্সপোর্ট ব্যবসার নথিপত্র। তার দৃঢ় বিশ্বাস কালে এই ব্রাউন সিগার উইদ রেড থ্রেড গোটা মার্কিন দেশে ব্রাউন সুগারের চাইতেও চালু নেশা হবে। ব্যবসা জমে গেলে সে পাগলের ডাক্তারীতে ইস্তফা দেবে। চুটিয়ে বিড়ি ব্যবসাই ধরবে।

বৌমার এই ভবিষ্যৎ পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্তম্ভিত হয়ে গেল বৃদ্ধকুল। পরেশবাবু, বিনতা এমনকি আলমারীর গায়ে ঠেস্ দিয়ে ত্রিভঙ্গ মুরারী মার্কা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে পর্য্যন্ত স্পিকটি নট্। বন্ধুদের সামনে পরেশবাবুর  মুহূর্তপূর্বের গৌরববোধ সবে উড়ব উড়ব করছে এমন সময় বৃদ্ধকুলের সমবেত ঘর ফাটানো হা হা হাসিতে ঘরের অপ্রস্তুতভাব এক ঝলকে হাওয়া। বিনতা আর ছেলেও সে নির্মল হাসিতে যোগ দিল। পরেশবাবুই বা পিছে পড়ে থাকেন কোন মুখে!

ছবি: দেবাশীষ দেব/‘দেশ’ পত্রিকা

(প্রথম প্রকাশিত: দেশ পত্রিকা, ১৭ নভেম্বর ২০১১)

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

4 comments
Add Your Reply