‘আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কেউ আছেন যিনি শেক্সপীয়রের সনেট একটু আবৃত্তি করে শোনাতে পারেন? আসলে আমরা আর কিছু ক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব ওনার গ্রামে। তার আগে একটু পরিবেশ তৈরী করে নিতে চাইছিলাম।’ দোহারা চেহারার ব্রিটিশ গাইড ভদ্রলোক বড় আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন বাসের যাত্রীসকলের দিকে। লজ্জা, ভয়ের পাশে বাঁধা মানুষ সহজে কি আর পাশমুক্ত হতে চায়? অগত্যা মৃদু হেসে মানুষটি নিজেই দেখি পকেট থেকে একটি লাল টুকটুকে মলাটের ছোট বই বার করলেন। কিছুক্ষণ এ পাতা সে পাতা উল্টে উদাত্ত গলায় পড়া শুরু করলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়রের বিখ্যাত সনেট নাম্বার ১8:
Shall I compare thee to a summer’s day?
Thou art more lovely and more temperate.
Rough winds do shake the darling buds of May,
And summer’s lease hath all too short a date.
চলেছি শেক্সপীয়রের জন্মভিটে স্ট্রাটফোর্ড অপন অ্যাভনে। আনমনে চেয়ে আছি বাইরে বসন্তের উজ্জ্বল ইংলিশ কাণ্ট্রিসাইড। তকতকে নীল আকাশ। ফসলী মাঠ প্রান্তর কখনো ফসল কাটায় খয়েরী বাদামি কখনো সবুজ শাক সব্জীতে ভরা। গোল করে বাঁধা খড়ের আঁটি সাদা প্লাস্টিকে বেঁধে ক্ষেতের এক কোনায় রেখেছে চাষী। চালকবিহীন জঙ্গম ট্রাক্টর পড়ে আছে আর কোণে। কোথাও চোখে পড়ে গোরু ভেড়ার পাল সবুজ নরম ঘাসে জলযোগে ব্যস্ত। কালো কুচকুচে তাগড়া ঘোড়াগুলোর পিঠে সূর্যের আলো পিছলে যায়। ক্ষেত সংলগ্ন অবস্থাপন্ন চাষীদের ঘরবাড়ি, গাড়ি। দুধ চিজ মাখন ডিম সবই তো গ্রাম থেকেই শহরে আসে।
শেক্সপীয়রের জন্মভূমি ছোট্ট মফঃস্বলী শহরতলিতেও প্রতি বৃহস্পতিবার আশে পাশের গ্রাম থেকে চাষী কারিগররা নানা জিনিষ বেচা কেনা করতে আসত। তবে শহর কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ ছিল বেচাকেনা যেন সৎভাবে হয়। লোক ঠকানো ব্যবসা বুদ্ধি চলবে না। মাপের কৌটো, খাবারের গুণ, সঠিক দাম তদারকি করার লোক থাকত। থাকতেন স্বয়ং স্ট্রাটফোর্ডের মেয়র, জন শেক্সপীয়র। উইলিয়াম শেক্সপীয়রের পিতা। জনের ছিল চামড়ার গ্লাভ্সের রমরমা ব্যবসা। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন বীয়ার টেস্টার।
‘সে যুগ ছিল টিউডর যুগ। ১৪৮৫ থেকে ১৬০৩ টিউডরদের রাজত্বকাল। সে যুগে সাধারণ মানুষ লিখতে পড়তে জানত না।’ গল্পের সুরের টানে মন ফিরল জালনার বাইরের চারণ ভূমি থেকে গোল্ডেন ট্যুরের বাসের ভিতরে। বেশ আয়েসী ঢং-এ গাইড বলছেন সে সময়ের গল্প। জীবন তখন অত জটিলও ছিল না। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারলেই মানুষ খুশী হত। জন্ ও তাঁর স্ত্রী মেরী লিখতে পড়তে না জানলেও তাঁদের জৈষ্ঠপুত্র উইলিয়াম এবং কনিষ্ঠ পুত্র গিলবার্টকে অবশ্যই পাড়ার গ্রামার স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন।
বাস ঢুকে পড়েছে একটি ছবির মতন সুন্দর ছোট্ট জনপদে। গাইড দেখলাম বেশ তৎপর হয়ে উঠলেন। বুঝলাম শেক্সপীয়রের গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি। ‘ওই দেখুন অ্যাভন নদীর ছোট্ট সোঁতাখানি।’ পেরোতে না পেরোতে, ‘ডান দিকে পড়বে শেক্সপীয়র ভ্রাতৃদ্বয়ের গ্রামার স্কুল।’ — ‘এবার ফের ডান মোড়েই শেক্সপীয়র কন্যা স্যুজানা ও জামাতা ডাঃ জন হল-এর বসতভিটে।’
উপর্যুপরি ডানদিক বাঁদিক ঘাড় ঘোরানো আর চোখ কান সজাগ রেখে কাঠ হয়ে বসে রইলাম, পাছে কিছু দেখার ভুল হয়ে যায় এই ভয়ে। গ্রামার স্কুলখানি দোতলা কাঠের বাড়ি। ছাদ খড়ের উপর টালি ছাওয়া। দেওয়ালে টিউডর যুগের টিপিক্যাল ডিজাইন – কাঠের লম্বা বীম তেরছা বা লম্বাটে ভাবে বসানো। ১৫৫৩ সালে তৈরী। তখনকার যুগে মানুষের মনে সদ্য সদ্য স্কুলের ধারণা জন্মাচ্ছে। তবে ছেলেরাই কেবল সুযোগ পেত স্কুলে যাওয়ার। আজও এই স্কুলবাড়ি সোম থেকে শুক্র কচিগলার কলতানে ভরে ওঠে। কিণ্ডারগার্টেন স্কুল বসে।
স্যুজানার বাড়িখানি দেখলেই বোঝা যায় শেক্সপীয়রের কন্যা রুচিশীল ধনী গৃহস্থের বধূ ছিলেন। অবশ্য সে যুগের নিয়মানুযায়ী পিতৃসম্পত্তির বেশ ভালো অংশই করতলগত হয়েছিল তাঁর।
কবির ভিটের কাছাকাছি পার্কিং জোনে এসে বাস থামল। ছবির মতন সাজানো পাড়াপথখানি হেঁটে এসে দাঁড়ালাম ভিটেবাড়ির সামনে। শেক্সপীয়রের এইসব সম্পত্তির দেখাশোনা করেন শেক্সপীয়র বার্থপ্লেস ট্রাস্ট। যার অন্যতম কর্ণধার একদা ছিলেন বিখ্যাত সাহিতি্যক চার্লস ডিকেন্স স্বয়ং।
বেশ অবস্থাপন্ন দোতলা গৃহস্থ বাড়ি শেক্সপীয়রের সে যুগের প্রায় সব বাড়ির মতন শক্ত ইংলিশ ওক কাঠের বাড়ি। খড়ের ছাদ, টালি দেওয়া। পাথরের দেওয়ালে কাঠের ফ্রেমের ডিজাইন। বাগানের ভিতর দিয়ে পথ। বেঁটে বেঁটে আপেলগাছে সাদা সাদা ফুল এসেছে। মরশুমী ফুলের কেয়ারি দু’ধারে।
ভিতরে ঢুকেই চমকে গেলাম। এ কে দাঁড়িয়ে রে বাবা! গায়ে চামড়ার দড়ির ফিতে বাঁধা জার্কিন, মাথায় বাহারি পালক বসানো কালো চামড়ার টুপি, কোমরে চামড়ার বেল্ট ক্রীম রঙা রোব-এর উপর চেপে বসেছে। এ যে ষোড়শ শতাব্দীর এক মূর্তিমান চরিত্র! যুবকটি এই ভিটেবাড়ির মধ্যে নিযুক্ত গাইডদের থেকে একজন। সে হেসে আমাদের দলকে আমন্ত্রণ জানাল, ‘আমাদের এ বাড়ির কর্তা জন শেক্সপীয়র। সফল ব্যবসায়ী, শহরের মেয়র। কাঠই সস্তা এবং সুলভও – পাশেই আরডেন-এর জঙ্গল, তাই এই পাড়ার যত বাড়ি সবই কাঠের । তখনকার মূল্যাঙ্কনে এই বাড়িটির মূল্য ছিল গড়পড়তা বাড়ির সমান।’
বাড়ির মূল ফ্রেমের কাঠগুলো সবচেয়ে মোটা আর শক্ত। তবে তো পুরো দোতালা বাড়ির ভার সামলাবে। কাঠের বীমের আর পাথরের স্ল্যাবের মাঝখানের অংশগুলো মাটি, গম গাছের শুকনো খড় আর শুকনো ঘাসের লেই বানিয়ে ভর্তি করা হয়। শুকিয়ে গেলে দক্ষ কারিগর ডেকে প্লাস্টার করাতে হয়। যুবক হাত উল্টে হতাশ সুরে বলল, ‘জনের বাড়ির সামনের রাস্তাটার যে হাল! এবড়ো খেবড়ো কবল স্টোন বসানো। দু’ধারে কাঁচা নালা। তায় রাতদিন লোকজনের হৈ হৈ। ঘোড়ার গাড়ির খপ্খপ্, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ। পশুদের মলমূত্রে একাকার। পাড়ার ছোঁড়াগুলো কম যায় না। সারাদিন টো-টো পার্টি রাস্তায়।’ মাথার বড় টুপিটা সামলে নিজের গোঁফ চুমরে একটু হাসলো যুবক। আমরা গোটা দল তার গল্পের ঢং-এ সেই ষোড়শ শতাব্দীতে পাড়ি দিয়েছি।
‘সুয়েজ সিস্টেম বা টাইমের জল-কল নেই মশাই।’ হাত নাড়ে যুবক। ‘বালতি বালতি জল বারবাড়ির কুয়োতলা থেকে তুলতে হয়। তাই দিয়েই এ বাড়ির গিন্নী রাঁধেন, বাড়েন, কাচাকুচি, স্নানপর্ব, ধোওয়া মোছা সব কাজ হয়। এ বাড়ির কর্তার চামড়ার ব্যবসায়ে প্রচুর জল লাগে। ব্যবহৃত নোংরা জল পিছনের বাগানে বা সামনের বড় রাস্তার উপর ছুঁড়ে ঢেলে দেওয়া হয়। এ বাড়িতে টয়লেট নেই কিন্তু। চামড়ার কাজে মূত্রের প্রয়োজন হয় বলে শেক্সপীয়র পরিবারের সদস্যরা বাগানে একটি ব্যারেলে মূত্রত্যাগ করতেন।’
দলের প্রায় সবার অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নের স্বরূপ আগাম আন্দাজ করেই বোধহয় যুবক তড়িঘড়ি জানাল যে অন্য প্রকার বর্জ্যপদার্থ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মলাধারে জমা হত।
নীচের তলার মেঝেগুলো বড় বড় পাথরের স্ল্যাব দিয়ে তৈরী। হলের এক প্রান্তে ফায়ারপ্লেস। তার কালোভূসো দেওয়াল বহু আগেকার ঘরকন্নার ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। ফায়ারপ্লেসের সামনে ইতি উতি রাখা কাঠের ছোট খাটো টুল। দেওয়ালে স্টোরেজের তাক। দরজা জালনাগুলো মাপ মতন কাঠের ফ্রেম অনুযায়ী কেটে লোহার হিঞ্জ দিয়ে বসানো। কথায় বলে বাড়ির রান্নাঘর কর্ত্রীর স্বভাব চরিত্রের প্রতিফলন। সে দিক দিয়ে মেরী শেক্সপীয়র বেশ গোছানো স্বভাবের কর্মপটু মহিলা ছিলেন মালুম হয়। রান্নাঘরে একটা দেওয়াল ধরে ফায়ারপ্লেস তার উপর কাঠের মোটা তাকে রান্নার বিবিধ বাসনপত্র। কুলুঙ্গীঁতে রাখা ছোট গোলাকার পাত্র, তৈল জাতীয় কিছু রাখা হত মনে হয়। লোহার আংটা বসানো উনুনে উপর থেকে শিকেয় ঝোলানো এক বিশেষ ধরণের বড়সড় লোহার হাঁড়ি। আংটাটাকে রান্নার আগুনের তাপের কম বেশী প্রয়োজনে ওঠানো নামানো করা যেত। মেরী এই পাত্রে ‘পটাজ’ জাতীয় এক রকমের স্যুপ রাঁধতেন। মাছ, মাংস, সবজি, মাখন, সব রকমের মশলা এক সাথে চাপিয়ে এই রান্না হত। সকালবেলা পটাজ চাপিয়ে সারাদিন আগুনের হালকা তাতে চড়ানো থাকত। সারাদিনে যখন যার যে ফুরসত সে এসে গরম গরম বেড়ে নিয়ে খেত।
সে যুগে গিন্নীদের কর্মঠ এবং সুস্বাস্থের অধিকারিণী না হলে বড় বিপদ! যন্ত্র সভ্যতার সুবিধে নেই। আপনা হাত জগন্নাথ রীতি মেনে সারাদিন ধরে চলত ঘরগেরস্থালির কাজ। সে যুগে আশা করা হত বাড়ির মেয়েরা গৃহকর্মনিপুণ এবং একটি বিশাল পরিবারের জোওয়াল বওয়ার মতন শক্তিরূপিণী হবে। উইলিয়াম শেক্সপীয়র যখন ষষ্ঠবর্ষীয় বালক তখনই বাড়ির সদস্য সংখ্যা নয়। গোটা পরিবার কর্তা জন্ শেক্সপীয়রের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শন করতে বাধ্য থাকতেন। তিনিও পরিবারের সদস্যদের সমস্যা ও প্রয়োজন দেখাশোনার দায়িত্বে থাকতেন। এটাই ছিল টিউডর পরিবারের দস্তুর। জন্-এর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ছিলেন পরিবারের কর্ত্রী মেরী। এরপর পরিবারের পুত্র সন্তানরা বয়স অনুযায়ী এবং সর্বশেষে কন্যা সন্তানরা। সদস্যরা নিজেদের গুরুত্ব অনুযায়ী সমাজে, পরিবারে সম্মান ও সুবিধে পেতেন। খাবার টেবিলে একটিমাত্র আর্মরেস্টযুক্ত চেয়ার শুধু জন্-এর আরাম এবং সর্ব্বোচ্চ পদাধিকারীর সম্মানের প্রতীক হয়ে রয়েছে। বাকিদের বসার জায়গা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
মেরীর সংসারে মেয়েরা রাঁধাবাড়া, ঘর নিকোনো, কাচাকুচি, বাতিদান পরিষ্কার, ফলফুলের বাগান তদারকি করা ছাড়া সেলাই-ফোঁড়াই, উল কাটা বোনা সবই শিখত এবং করত। কর্ত্রীদের শোওয়ার ঘরের একপাশে থাকত আঁতুরের জায়গা, সেখানেই থাকত কাঠের তাঁত। পরিবারের মানুষদের জামাকাপড় বো: বিছানাপত্র, শৌখীন কুশন, সবই হাতে তৈরী করত মেয়েরা। মেরীর শোওয়ার ঘরেও কাঠের ছোট তাঁত, তার একপাশে বড় চুবড়ি ভর্তি সাদা তুলতুলে তুলো রাখা। জন্-এর দ্বিতীয় ব্যবসা ছিল উলের। তবে মেরী অবস্থাপন্ন ঘরের কর্ত্রী। তাঁকে বিছানাপত্র নিজে হাতে করে বানাতে হত না। তিনি ছেলেমেয়ে, স্বামী ও নিজের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় বানাতেন। ঘোড়ার চুল, পাখির পালক বা উল ভরে কুশন কাভার, এবং কাপড়ের টুকরো আর রঙীন সুতো দিয়ে শৌখীন ওয়াল হ্যাঙ্গিং — এসব শখের জিনিসপত্র বানাতেন।
গৃহের সবচেয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় মেরীর স্টোরেজ রুম। এখন যেমন ফল হোক কি সবজি, সবকিছু সব সময়েই পাওয়া যায়, সে যুগে তেমন ছিল না। ফল, সবজি সব মরসুমী। সময়েরটা সময়ে না ফলালে তা আর পরিবারের কারোর পাতে পড়ার সুযোগ ছিল না। সুগৃহিণীরা তাই সজাগ থাকতেন। মেরীর কিচেন গার্ডেনটি বেশ বড়। জায়গা নষ্ট না করে বুদ্ধি খাটিয়ে আপেল, নাসপাতি, অ্যাপ্রিকট জাতীয় ফলগাছগুলো লাগানো হত বাগানের পাঁচিল ধরে। সবজি আর ফুল চাষ হত ভেতর বাগানে। ভিয়োলা, কুমড়োর ফুল তো রীতিমত রান্না খাওয়া হত। খামারের দেখাশোনাও করতে হত মেরীকে। বাড়ির পোষা মুরগী যখন ডিম দেওয়া বন্ধ করত তখন তার মাংস খাওয়া হত। শুয়োরের মাংস অবশ্য তাজা খাওয়া হত। সাধারণতঃ শীতের শুরুতে বরাহ নিধন পর্ব সারা হত, সারা শীতকাল ধরে যাতে তাদের খেতে দেওয়ার ব্যবস্থা না করতে হয়। কারণ পশুর উপযোগী আহার তীব্র শীতে মানুষ ফলাবে কি উপায়ে! নিজেদেরই ঐ সময়ে পর্যাপ্ত জোটে না।
তাই শুয়োরের কচি মাংস নুনে জারিয়ে সারা বছরের জন্য সসেজ হ্যাম বানাতেন মেরী। স্টোরেজের ঠাণ্ডা ঘরে দেওয়ালের আংটায় ঝুলতে দেখলাম এরকম হ্যাম সসেজ আর স্মোক্ড্ বেকন। বাগানের ফলগুলো দিয়ে মেরী জ্যাম বানিয়ে সীল করা জারে তুলে রাখতেন। আর সবজিগুলো শুকিয়ে বেতের চুবড়িতে রাখতেন। রান্নার আগে জলে ভিজিয়ে নরম করে নিতেন। এভাবে বছরভর সবরকম মাছ মাংস ফলমূল সবজি খাওয়া চলত।
ট্যুডর যুগের ধনীরা তাদের খাওয়ার ঘর, বসার ঘর এবং শোওয়ার ঘরের দেওয়াল জুড়ে খুবই উজ্জ্বল ওয়াল হ্যাঙ্গিং-এ ঢেকে রাখত। রঙীন কাপড় আর উলের সুতোয় নানা রকম মোটিফ বানিয়ে, কেটে এবং আঠা দিয়ে জুড়ে তৈরী হত এই সুবিশাল ওয়াল হ্যাঙ্গিং। কেবল মাত্র অবস্থাপন্নরাই এ বিলাসিতার সুযোগ পেত, যা জন্-এর গৃহসজ্জাতেও দেখা যায়।
ট্যুডরদের জীবনে বিলাসবহুল বিনোদন অঙ্গ ছিল শয়ন কক্ষের পালঙ্ক। যার যা সাধ্য সেই অনুযায়ী এদের পালঙ্কবিলাস চলত। জন্-মেরীর খাটটা অবশ্যই কাঠের ফ্রেমের। তাতে দড়ি বুনে প্রথমে একটা বেস্ তৈরী করে নেওয়া হত, তারপর তোষক গদির বিছানা হত। কর্তা-কর্ত্রীর ছিল চৌস্তম্ভের পালঙ্ক। চতুর্দিক ঘেরা ভারী কাপড়ের পর্দা দিয়ে আর উপরে লেসের কারুকাজ করা চাঁদোয়া। ফায়ারপ্লেসের আগুন শেষ রাতে নিভে গেলেও ভারী পর্দার ঘেরাটোপে আটকে থাকা ওম্টুকু পালঙ্কে শোওয়া মানুষগুলোকে সুখের নিদ্রা দিত। পরিবারের বাকি সদস্যরা কিন্তু এই চৌস্তম্ভ পালঙ্কের সুবিধে পেত না।
প্রায় সব শয়নকক্ষের পালঙ্কের পায়ের দিকে একটা ভারী কাঠের চেস্ট্ জাতীয় আসবাব দেখলাম। মনে হয় দম্পতির সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া টাকাকড়ি, মূল্যবান কাগজপত্র বা গহনা রাখা হত। ঘরের মাঝখানে বলে সন্ধ্যাবাতি রাখার উপযুক্ত জায়গাও বটে!
জন্-মেরীর পালঙ্কের নীচে থাকত আর একটি ছোট খাট বা ট্রকল্ বেড। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যদের জন্য। সারাদিন ঢোকানো থাকত মুখ্য পালঙ্কের নীচে। রাত্রে শোওয়ার সময় টেনে বের করে আনলেই হল! এই খাটগুলো ছিল অনেকটা আমাদের খাটিয়ার মতন। দড়িগুলো ঢিলে হয়ে গেলে শোওয়ার অসুবিধে হত বলে প্রায়শঃই দড়ি শক্ত করে বুনতে হত। ‘স্লিপ্ টাইট্’ শুভ কামনা কি তখন থেকেই চালু হয়েছে?
বাড়ির জৈষ্ঠ্যপুত্র উইলিয়াম দশ বছরে পা দিতেই সে যুগের প্রথানুযায়ী তাকে বাল্যের তকমা ছেড়ে বয়স্কদের জগতে পা রাখতে হল। এখন থেকে সাজপোষাক, খাওয়া দাওয়া শুধু নয়, আচার ব্যবহারেও বড়দের উপযুক্ত হাবভাব আনা চাই। মেয়েরা এই বয়সে শিখবে গৃহকর্ম এবং ছেলেরা অর্থরোজগারের সুলুক সন্ধান। এই ‘টাইনি আডল্ট’-দের কক্ষ ছিল আলাদা। পালঙ্ক ছাড়া কাঠের আলমারী ও চেস্ট। বইপত্র, বাড়তি জামাকাপড় প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য্য জিনিস গুছিয়ে রাখতে হত ভিতরে। নয়তো ছুঁচো ইঁদুর পোকায় কেটে সব নষ্ট করবে। উইলিয়াম তার বয়সী অন্য ছেলেদের মতন এখন থেকে চামড়ার জারকীন পরত। জুতোর ফিতের মতন ফিতে বাঁধা বুকের কাছে। বড় বড় বোতাম। মাথায় চামড়ার কালো গোল টুপি তার চার্চে পরে যাওয়ার ক্রীমরঙা জার্কিনের পোষাকটি ভারী আকর্ষক — মেরী নিজহাতে তৈরী করে দিয়েছিলেন ছেলেকে।
উইলিয়ামদের ছেলেবেলা যে খুব সুখের ছিল তা বলা যায় না। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে কঠোর অনুশাসন। রীতিমতন কর্মময় জীবন। ছেলেমির আহ্লাদি দেখাবার সুযোগ কোথা? তাছাড়া ছিল হরেক কিসিমের রোগব্যাধি অথচ সুচিকিৎসার অভাব। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটত আকছার। মেরী কিন্তু এদিক দিয়ে ছিলেন ভাগ্যবতী। সাত সন্তানের মধ্যে চারজনকেই তিনি বাঁচাতে পেরেছিলেন। মেরীর আঁতুরটি ছিল একেবারে সাদামাটা। পাথরের মেঝেতে কেবল একখানি চাটাই পাতা, খান কতক টুল, চেয়ার। একধারে ফায়ারপ্লেস। একধারে বোনার তাঁতখানি। ঘরে একটি ছোট কাঠের দোলনা আর শিশুস্নানের কাঠের গামলাও শোভা পাচ্ছে। সাদা সুতীর নরম কাপড়ে গামলাগুলো ঢাকা যাতে শিশু আঘাত না পায়। মেরী কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এই সাধারণ ঘরে ১৫৬৪ সালে জন্ম নিল তাঁর যে পুত্র, সে-ই একদিন হবে সারা বিশ্বের বরেণ্য অসাধারণ সাহিতি্যক?
জনের ওয়ার্কশপটি একটু একটেরে বাইরের দিকে ছিল। কর্তার বিবেচনার প্রশংসা করতে হয়। বাড়ীতে বাইরের লোক, ক্রেতা কর্মচারীদের আনাগোনা লেগেই আছে। তাছাড়া বাগানের ভিতর দিয়ে জন্ সোজাসুজি কর্মশালায় প্রবেশের একটা পথ রেখেছেন। এই ঘরটি ফায়ারপ্লেসহীন। রাস্তার দিকের জালনাটা বেশ বড়। ওটাই জন্-এর কর্মশালার প্রধান আকর্ষণ। হরেক রকম চামড়ার গ্লাভ্স, পার্স, বেল্ট সব ঐ জালনায় জন ঝুলিয়ে রাখতেন, পথচলতি মানুষ যাতে বাইরে থেকেই দেখেশুনে পছন্দ করতে পারে। জালনার লাগোয়া চওড়া তাকটা তাঁর বিক্রিবাটার কাউণ্টারও বটে। কেনাবেচা, গালগল্প, হিসেব নিকেষ সবই দিবি্য চলে। শহরের মেয়র তিনি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাঁর সঙ্গেঁ লোকেদের বাতচিত লেগেই আছে। ঘরের ভিতর দেওয়াল জুড়ে বড় বড় কাঠের তাক। বড় টেবিল পাতা। তাতে হরেক রকম চামড়ার নানা আকৃতির টুকরো। ছুরি, কাঁচি, সুতোর গোলা, রঙ, তুলি, লোহার চিমটে, কাঠের জার, জল বা মূত্র ধরে রাখার বড় বড় ব্যারেল, মোমদানী, দু চারটে কাঠের টুল — সব মিলিয়ে এক ব্যস্ত কর্মশালা। দু-তিনজন কর্মচারী সাত বছরের শিক্ষানবিশির চুক্তিতে কাজ করে, কাজ শেখে। পয়সাকড়ি পায় না কিছু, কিন্তু থাকা, খাওয়া ও পোষাকপত্র পায়। সাত বছর পর নিজের ব্যবসা নিজে বুঝে নিতে পারে অথবা থাকতে পারে জন্-এর সঙ্গেঁ। অবশ্য ততদিনে দক্ষ কারিগর হিসেবে তারা টাকা পয়সা পাবে।
ধীরে ধীরে দিনবদলের পালা আসে। লেখাপড়া জানার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে স্কুল তৈরী শুরু হয় গ্রামে গ্রামে। ধর্মীয় পুস্তকের পাশাপাশি শুরু হয় লাতিন, প্রাচীন গ্রীক এবং ইংরিজি পড়ানো। ইংরিজিতে তখন বেশ কিছু বই, নাটক বা শুধুই প্রয়োজনীয় পাম্ফলেট্স লেখা শুরু হয়েছে। ছাত্রদের অনুবাদকর্মে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। আইন স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাচীন গ্রীক ভাষার প্রাধান্য। সম্পন্ন লোকেরা ঘরোয়া শিক্ষক রেখে সন্তানদের পড়াতে লাগলেন। জন্ ও মেরী শেক্সপীয়রও জীবনে লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা গেল উইলিয়াম ইংরিজি ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যে অসম্ভব মেধার পরিচয় দিচ্ছে। ভাবীকালের ইতিহাস অবাক চোখে দেখছে দেশ কাল যুগের অতিক্রমী সাহিত্যিক উইলিয়ামের ক্রমশঃ কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠার উত্তরণপর্ব।
স্ট্রাটফোর্ড অপন অ্যাভন-এর মাইলখানেক পশ্চিমে শটরি গ্রাম। সেখানকার হাথওয়েজ পরিবারের সঙ্গেঁ শেক্সপীয়রদের জানাশোনা, আনাগোনা। রিচার্ড হাথওয়েজ ছিলেন সম্পন্ন কৃষক। প্রায় ৯০ একরের বাগান জমির উপর কটেজ তাঁর। নামেই কটেজ, আসলে বারো কামরা বিশিষ্ট এক রীতিমত বাগানবাড়ি। সে আমলে এই জমিবাড়ি নিউল্যাণ্ড ফার্মস্ নামে পরিচিত ছিল। রিচার্ড বেশীদিন বাঁচেননি। মৃত্যুর সময় জৈষ্ঠা কন্যা অ্যান্-কে তিনি অ্যানের বিবাহের খরচাবাবদ ছয় পাউণ্ড তেরো শিলিং আর চার পেনী দিয়ে যান। আসা যাওয়ার সূত্রে উইলিয়াম আর অ্যানের মন দেওয়া নেওয়া। অবশেষে ১৫৮২ সালে অষ্টাদশবর্ষীয় উইলিয়ামের সাথে ছাব্বিশ বছরের অ্যান-এর বিবাহ। অ্যান্ তখন রীতিমতন গর্ভবতী। ঐতিহাসিকেরা তাই মজা করে এই বিবাহকে বলেছেন ‘শটগান ওয়েডিং’। বিবাহের ছ’মাস পরেই উইলিয়ামের জৈষ্ঠা কন্যা সু্যজানার জন্ম।
কবিপত্নী অ্যান্ হাথওয়েজের জন্মভিটে শটরি গ্রামের কটসওয়াল্ডে। ভিটে বাড়ি ঘিরে বিশাল সবুজ বাগান। হরেক রকম গোলাপ, লিলি, প্যানজি, জিরেনিয়াম, বেলীজ, ডেইজি, জাসমীন, আরো কত রঙীন ফুলের মেলা। ইংলিশ ওক, বার্চ, নরওয়েজিয়ান স্প্রুস্-এ ঘেরা বনপথ চলে গেছে কোন সুদূরের সবুজ বাঁকে। অজস্র পাখপাখালির গানে প্রাণমন জুড়িয়ে যায়।
এত সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কটেজখানি আজও যেন ষোড়শ শতাব্দীতে স্থাণুবৎ হয়ে রয়েছে। সেই পরিচিত ট্যুডর স্থাপত্যের গাঁথুনি। টালির ছাদে বেশ কতক চিমনি গাঁথা, অতগুলো ঘরের ফায়ারপ্লেসের ধোঁয়ার জন্য। ভিতরের অঙ্গঁসজ্জায় রুচির ছাপ। কর্ত্রীহীন গৃহে অ্যান্-ই ছিলেন সর্বেসর্বা। ভাই, বোন, পিতার তদারকি, ঘরের সাত সতেরো ঝক্কি সামলানো, অতবড় বাগানের দায়দায়িত্ব, ভাই বার্থেলোমিউ-এর সাথে হাত বাঁটানো। হাথওয়েজদের বসার ঘরের তাকে পোর্সেলীনের ওয়াল হ্যাঙ্গিং প্লেটসের সংগ্রহ নজর কাড়ার মতন। তবে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যাবার সময় বড় চওড়া সিঁড়ির ধাপ আর নীচু সিলিং খেয়াল রাখতে হবে।
ফলপাকুড় ফুল তরুলতায় ভরা স্ত্রীর বাড়ির বাগানখানি উইলিয়ামের কবিমনে এক বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন লেখায় এই হাথওয়েজদের বাগানখানি তার সৌন্দর্য্য ও পশুপাখির চর্চা নিয়ে উঠে এসেছে —
‘The bay trees in our country are all wither’d.’ [Richard III]
‘There’s a medler for thee, eat it.’ [Timon of Athens]
‘With sweet musk roses and with eglantire.’ [A Mid-Summer Night’s Dream]
‘As I did sleep under this yew tree here.’ [Romeo and Juliet]
১৯৮৮ সালে এই সুবিশাল উদ্যান পর্য্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। হাতে সময় থাকলে অপূর্ব মূর্তিকলা সমৃদ্ধ রবিন, ব্ল্যাক বার্ড, কাঠ ঠোকরা, ম্যাগপী, ব্লু টীট, শ্যাফিঞ্চ, ডনোক্, স্কুইরেল, হরিণ, শেয়াল আরো অজস্র পশুপাখিতে ভরা এই বাগানখানি ভ্রমণ করা সত্যই এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা।
১৫৮৭ সাল। উইলিয়াম তখন বাইশ বছরের যুবক। তাঁর সাহিত্যিক সত্তা যেন এই অ্যাভঁনের তীরে যথার্থ উৎসমুখ খুঁজে পাচ্ছিল না। স্থির করলেন লণ্ডন যাবেন। কিন্তু যাবো বললেই যাওয়া যেত না আজকের যুগের মতন। সে যুগের এক গ্রামের মেয়ের উপর সংসার সন্তানের সব ভার তুলে দিয়ে অবশেষে মনস্থির করলেন উইলিয়াম। অ্যান্ নিজের স্বামীর প্রতিভা জানতেন, তাই নীরবে এই বিচ্ছেদ অসীম সাহসিকতায় ভর করে মেনে নিলেন। উৎসাহ দিলেন স্বামীকে। অ্যান্ বুঝেছিলেন নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে এই গ্রামে স্বামীকে আটকে রাখা মানে তাঁর প্রতি অবিচার করা। তিন দিন ক্রমাগত পথ চললেন উইলিয়াম ঘোড়ার পিঠে চেপে। পথিমধে্য সরাইখানায় বিশ্রাম। পৌঁছলেন লণ্ডনে। প্রথমে শুধুই সংগ্রাম। খাওয়া, পরা, বাসস্থানের কোনো ঠিকানা নেই। তদুপরি পরিবারের চিন্তা। যতদিন না তিনি দি গ্লোব্-এর শেয়ার কিনে নিলেন এবং তার সঙ্গেঁ অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত হলেন, ততদিন জীবনপণ লড়াই চলেছিল শেক্সপীয়রের।
গ্লোব শেক্সপীয়রকে দুই অঞ্জলিপুটে খ্যাতি, মান, অর্থ সবই দিল। প্রিয় পত্নীর ত্যাগ ভালোবাসা কোনোদিন ভোলেননি কবি। তাই তো মৃত্যুকালীন উইলে স্ত্রীকে দান করে গেলেন এক অতুল্য সম্পদ, ‘ওনলি দ্য সেকণ্ড বেস্ট বেড্!’
হাথওয়েজদের ‘কটেজ’ ছেড়ে পার্কিং স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের দিকে যেতে যেতে গাইড মহোদয় শোনাচ্ছিলেন এই অনন্য গল্পটি। কিন্তু ওনার শেষ কথায় ধন্ধ লাগলো মনে। খান কয়েক দলের লোকও চেঁচিয়ে উঠলেন — ‘হোয়াট ?!’ প্রিয় পত্নীর প্রতি কবির এ কি ব্যবহার? সব ছেড়ে শেষে কিনা ঐ বেঁটে মোটা পর্দানসীন একখানা ট্যুডর খাট!
গাইড সরে দাঁড়ালেন বাসের দরজার এক পাশে। যার অর্থ, এবার বাসে উঠে পড়তে হবে। যে যার সীটে বসতে বাস ছেড়ে দিল। পেরিয়ে চললাম কট্সওয়াল্ডের ছবির মতন সুন্দর শ্যামল গ্রামখানি। পথে পড়বে বুরফোর্ড গ্রাম। সেখানে একটা সরাইখানায় খাস ইংলিশ মধ্যাহ্নভোজন সারবো আমরা। মনে মনে উত্তেজিত হচ্ছি শেক্সপীয়রের আজব ব্যবহারে, কিন্তু গাইড মশাই মৌন।
পেরিয়ে চললাম অ্যাভনের সোঁতা — যার তীরে শেক্সপীয়রপ্রেমীরা কবির এক মর্মর মূর্তি স্থাপন করেছেন। সামান্য ঝুঁকে চেয়ারে বসে আছেন কবি। চিন্তামগ্ন, উদাসী দৃষ্টিতে দেখছেন চিরকালের প্রিয় জন্মভূমি স্ট্রাটফোর্ড অপন অ্যাভঁনকে। লণ্ডনের বিলাসবহুল শহুরে জীবনের আরামে ডুবে না গিয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এসেছিলেন কবি তাঁর প্রিয় অ্যাভঁনের অপ্রতিরোধ্য টানে। অ্যাভঁনের স্নিগ্ধ তীরে জন্মভূমির মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
‘কল্পনা করুন আজকের যুগে কোনো স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীকে উইল করে কেবলমাত্র একটি বিলাসবহুল পালঙ্ক দিয়ে যান, তাহলে কি হবে?’ গাইডের কথায় ঘোর ভাঙলো। তাই তো, এই পালঙ্কের কেচ্ছা কি জানা হল না তো!
‘জটিলতা, তর্কবিতর্ক, কল্পনা জল্পনা না হলে আর বিখ্যাত মানুষের জীবনেতিহাস কি! উইলিয়ামের এই উইলে স্ত্রীকে প্রদত্ত সেকেণ্ড বেস্ট বেড্ পরবর্তীকালে কবির দাম্পত্য জীবন নিয়ে জনমানসে বিভিন্ন দ্বন্দ, সংশয়, অনুমান, সিদ্ধান্তের আকাশকুসুম রচনা করেছিল। কেউ বলে একদিনের জন্যও স্ত্রীকে নিয়ে খুশী ছিলেন না কবি। তাই শাস্তিস্বরুপ এমন উইল। কারো মতে গর্ভাবস্থায় জোর করে হাথওয়েজরা বিবাহে বাধ্য করায় ক্ষুব্ধ উইলিয়াম শোধ তোলেন এইভাবে। কিন্তু সহজ সত্যটা হল এই যে, ট্যুডর যুগে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের জীবনে পালঙ্কের ছিল অসীম গুরুত্ব। এ যুগের মতন ঘড়ি ঘড়ি আসবাব বদল হত না সেই যুগে। বংশ পরম্পরার গৌরব ও ঐতিহ্যবাহী পালঙ্ক তাই ট্যুডরদের জীবনে প্রায় একটি ছোট গৃহের মর্যাদাতুল্য ছিল। শেক্সপীয়র তাই তাঁর প্রিয় পত্নীকে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের মধুর স্মারক স্বরূপ জমকালো খাটটি দান করে পত্নীর প্রতি তাঁর অনুরাগই প্রদর্শন করেছিলেন। সে যুগে পিতৃদত্ত সম্পত্তির “দ্য বেস্ট” অর্থাৎ সেরা অগ্রভাগ পেত সন্তানরা। এবং বিধবারা পেত “দ্য সেকেণ্ড বেস্ট”। এমনই ছিল সে যুগের রীতি। প্রথম জীবনে পিতামাতারা নিজেরা দ্য বেস্ট-টুকু উপভোগ করে শেষজীবনে সেটুকু দিয়ে যেতেন বয়োঃপ্রাপ্ত সন্তানদের, যখন তাদের জীবনে ঐ বেস্টটুকুর বড় প্রয়োজন। বড়ই আকর্ষক এ প্রথা, কি বলেন !’ গাইডের কথার প্রতিবাদে কোনো যুক্তি পেলাম না।
বাস চলেছে লণ্ডনে ফেরার রাস্তায়। পিছনে কত শত বাঁকের প্রান্তে হারিয়ে যাচ্ছে শেক্সপীয়র ও অ্যান্ হাথওয়েজ-এর মধুর দাম্পত্যের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম দুখানি। আজকের আধুনিকতার অন্তহীন দৌড়ের মাঝে ইতিহাসের এক একটি পাতা যখন এমনি উদাসী দুপুরে হঠাৎ উল্টে যায় চোখের সামনে, মন কেমন করে ওঠে। সে যুগের মানুষের সুখ দুঃখ আশা স্বপ্নের আটপৌরে ভাবে মন একাত্ম হতে চায়। তাদের জীবনচর্যার প্রতিটি পরতে খুঁজে পেতে চায় বিস্ময়, আনন্দ, আশা-নিরাশার ছবি, যা শেক্সপীয়রের সাহিত্যেও ফুটে ওঠে নিরন্তর। এমনি করে পুরাতন জীবনবেদ বারে বারে নতুন যুগের পর্যটকের অবাক দৃষ্টিপথে আবিষ্কৃত হয়। এক যুগের পালা সাঙ্গ হয়ে আর এক যুগের অবাক হওয়ার পালা — এ পালা বদলের পালা চলে যুগ যুগ ধরে। মনে পড়ে গেল কবির অনন্য বাণী —
‘So long as men can breathe or eyes can see
So long lives this and this gives life to thee.’
***
অ্যাভনের ছোট সোঁতার ধারে মহাকবির জীবন নদীর যে উৎস শুরু হয়েছিল তা পরিপূর্ণতা পেলো লণ্ডনে টেমসের ধারে, দ্য গ্লোবে। আজকের ঝাঁ চকচকে পথ প্রান্তর, সবুজ গাছের ছায়ায় ঢাকা টেমসের শান্ত বুলেভার্ড, মরশুমি ফুলের কেয়ারি করা ফুটপাথে রঙবেরঙের ছাতার ছায়ায় মনোলোভা ক্যাফের মধুর হাতছানি, পর্য্যটককুলের অন্যতম আকর্ষণ ‘লণ্ডন আই’ — এসবের মাঝে চিরকালের মতন হারিয়ে গেছে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের কর্মক্ষেত্র, দেখা-চেনার পুরনো সেই সাউথ ব্যাঙ্ক। যে সাউথ ব্যাঙ্ক ছিল জঙ্গঁল ঝোপ ঝাড়ে ভরা, কদর্য নোংরা এক নিম্ন জলাভূমি। বেশীর ভাগ জেলেদের গ্রাম। বৃষ্টির জলে কাদায় মাখা। টেমসের সিঁড়িগুলো জন্তু জানোয়ারের পূরীষ আর অশিক্ষিত মানুষগুলোর প্রস্রাবের উগ্র গন্ধে ভরা। অথচ এই সাউথ ব্যাঙ্কেই ছিল সংস্কৃতি জগতের পীঠস্থান রঙ্গঁনাট্যালয় ‘দ্য গ্লোব’, যার সঙ্গেঁ কালজয়ী অনন্য প্রতিভার অধিকারী উইলিয়াম শেক্সপীয়রের নাম অঙ্গাঁঙ্গীঁভাবে জড়িত। এই গ্লোবের ছত্রছায়ায় শেক্সপীয়রের প্রতিভা পূর্ণ বিকশিত হয়ে শতধারায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল সারা বিশ্বে।
খাঁটি ইংলিশ ওক কাঠের গোল বাড়ি। দেওয়ালে সাদা লাইমওয়াশ। গায়ে ওক কাঠের বীমের ক্রিসক্রস কারুকৃতি আর খড়ের চালের গ্লোব প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নিল। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই চমক। ষোড়শ শতাব্দীর বদলে একবিংশ শতাব্দীর রমরমে আধুনিকতা। ক্যাফে, লবি, রেস্তোরাঁ, গিফ্ট শপ সবই আছে। নিদৃষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিলাম গাইডের। ইতিমধ্যে দলে বেশ কিছু পর্য্যটক এসেছেন। গাইড মহোদয়া এলেন সঠিক সময়ে। সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিনিময়ের পর শুরু হল আমাদের দ্য গ্লোব পরিভ্রমণ।
বাঁ দিকে টেমস্। নদীর অপর পাড়ে লণ্ডনের অপূর্ব সুন্দর দিগন্ত। সকালের নির্মল আলোয় পার্লামেণ্ট হাউস, বীগ বেনের লাইমস্টোন সমৃদ্ধ স্থাপত্য নীল আকাশের পটভূমিকায় কি সুন্দর লাগছে। নদীর এই পাড় ধরে হাঁটাপথে হাঁটলে একে একে দেখা যাবে নদীর ও পাড়ের ধবধবে সাদা সেণ্ট পল্স ক্যাথিড্রালের সোনার চূড়া, ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবীর সুবিখ্যাত ফ্রেস্কো, টেমসের বুকের উপর একের পর এক ঐতিহ্যপূর্ণ সেতুর মালা — লণ্ডন ব্রিজ, টাওয়ার ব্রিজ, ওয়েস্টমিন্স্টার বি্রজ, মিলেনিয়াম ব্রিজ।
দলের সবাই এলে গাইড বললেন, ‘যে গ্লোবের মঞ্চে স্বয়ং শেক্সপীয়ার অভিনয় করতেন, সে গ্লোব আজ আর নেই। ১৬১৩ সালে ২৭শে জুন গ্লোবের মঞ্চে অভিনীত হচ্ছিল “হেনরী দি এইট্থ”। নাটকের প্রয়োজনে কামান থেকে আগুনের ফুলকি অসাবধানে ছিটকে এসে লাগে কাঠের বীমে। চাল ছিল শুকনো খড়ের। দু ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ। কেবল বাঁচোয়া এই যে অভিনেতারা ও দর্শকরা প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮৯ সালে পার্ক স্ট্রীটের একটি কার পার্কিং-এর মাটি খুঁড়ে আসল গ্লোব থিয়েটারের একটি কাঠের বীম মাত্র তোলা হয়। বাকি সব ঐখানেই সমাধিপ্রাপ্ত।’ গন্তব্যের দিকে অঙ্গঁুলিনির্দেশ করে দেখালেন — ‘কাছেই, বড় জোর ১৫০ ফুট। সাইটে গেলে দেখবে কালো মোটা একটা অংশ জমিতে দাগানো। পুরনো গ্লোব ছিল ওখানেই। বর্তমান গ্লোব আমেরিকান অভিনেতা নির্দেশক প্রযোজক স্যাম ওয়ানামেকারের সারাজীবনের অধ্যবসায়ের ফল এবং হলফ করে বলতে পারি এই থিয়েটারের পুনর্নির্মাণে সেই সময়ের কারিগরি কৌশল একেবারে নিখুঁত ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।’
বিশাল এক ওক কাঠের দরজা পেরিয়ে একটি মুক্তাঙ্গঁনে পা রাখা মাত্র মনে হল যেন টাইম মেশিনে চড়ে এক মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছি সেই ১৫৯৯ সালে। এলিজাবেথান যুগের প্রাক্কালে। ভেতরটা অনেকটা অবস্থাপন্ন জমিদারবাড়ির দালানকোঠার মতো। খোলা উঠোনের মাঝখানে রঙ্গঁমঞ্চ। ‘আয়তাকার স্টেজটি দেখুন,’ বলতে বলতে গাইড এগিয়ে গেলেন স্টেজের সামনে। ষোড়শ শতাব্দীর এমন একটি জীবন্ত রেপ্লিকার মাঝে পড়ে প্রথমটা একটু দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। গাইডের কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। ‘স্টেজটি সামনের দিকে লম্বা প্রায় ৪৩ ফুট এবং ভিতরের দিকে গভীর ২৭ ফুট। মাটি থেকে এর উচ্চ্তা প্রায় ৫ ফুট।’ স্টেজের মেঝেতে দু হাতের মৃদু চাপড় দিলেন গাইড। ‘১০০ ফুট ব্যাসের এই ছাত খোলা অ্যাম্ফিথিয়েটারটিতে হাজার তিনেক দর্শক ধরতো।’
মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, স্টেজের ঠিক বিপরীতে গোটা উঠোন প্রাঙ্গঁনকে ঘিরে আছে তিন তলা নিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি স্টেডিয়াম স্টাইলে বসার ব্যবস্থা। কড়ি-বরগা-দেওয়াল-বসার বেঞ্চ সব কিছুই ওক কাঠের। পিছনের দেওয়ালে অজস্র ছোট ছোট চৌখুপি জালনা ফোটানো। প্রাকৃতিক আলোর রেখা সোজা এসে পড়ছে বেঞ্চগুলোর ওপর দিয়ে উঠোন প্রাঙ্গঁনে। স্টেজ এবং বসার জায়গাটি শুধু খড়ের চালে ঢাকা। স্টেজের দুধারে দুটি সুবিশাল কাঠের স্তম্ভ ছাদ ধরে রেখেছে। সিলিং-এ আঁকা নীল আকাশ, তাতে সাদা মেঘের ভেলা।
‘শেক্সপীয়রীয় আমলে এই সিলিং-কে বলা হত হেভেন,’ বললেন গাইড। ‘এই স্বর্গে আবার গুপ্ত দ্বারও ছিল। স্বর্গলোকবাসী অভিনেতাগণ নাটকের প্রয়োজনে সেখান থেকে দড়িদড়া দিয়ে বিবিধ সরঞ্জাম সরাসরি স্টেজে ওঠানো নামানো করতো। ভালো করে দেখুন এখান থেকেই, স্টেজে ওঠার নিয়ম নেই, স্টেজের পিছনের দেওয়ালে দু তিনটে দরজা আছে। সেখান থেকে সহজেই পৌঁছনো যেত টায়ারিং হাউস অর্থাৎ যেখানে অভিনেতারা সাজগোজ করে তাঁদের রাউণ্ডের জন্য অপেক্ষা করতেন। এছাড়া আরো একটা ট্রাপডোর ছিল, যা স্টেজের নীচে ভেতর থেকে সরাসরি স্টেজের উপরে যুক্ত ছিল। দু’পাশে দেখুন ব্যালকনি সিট। যন্ত্রবাদকরা ওখানে বসে যন্ত্র বাজাতেন এবং নাটকে যদি প্রয়োজন হত তখনও এই ব্যালকনি অভিনেতারা ব্যবহার করতেন।’ ফাঁকা প্রাঙ্গঁনে গাইডের স্বর গমগমে হয়ে বাজতে লাগল।
মনে পড়ে গেল জন্মভিটে ছেড়ে লণ্ডন শহরে কর্মসূত্রে আসা শেক্সপীয়রের প্রথম দিকের সংগ্রামের কথা। ইংরিজি ড্রামা কোম্পানীগুলোর তখন চালচুলোহীন অবস্থা। কখনো সরাইখানার উঠোনে তো কখনো কোন বড়লোক বাড়ির উঠোনে কিছু কিছু পালা নামত। ১৫৭৬ সালে অভিনেতা নির্দেশক জেমস্ বরবেগ প্রথম বিশেষ করে থিয়েটার হাউস তৈরী করেন। শেক্সপীয়র ১৫৮০ সালে যোগ দিলেন এই ট্রুপে। এই-ই গ্লোব, যার স্বর্ণযুগ শুরু হল শেক্সপীয়রের হাত ধরে। একের পর এক শেক্সপীয়রের ভুবনবিদিত নাটক নামছে গ্লোবের মঞ্চে। সাউথওয়ার্ক-এর ঘিঞ্জি নোংরা অশিক্ষিত জেলেদের গ্রামজীবনের প্রভাবে কখনো হ্যামলেট তো কখনো প্রেমিক কবির মনের আকর নিংরোন রোমিও জুলিয়েট।
কাঠের জালনার ফাঁকে এসে নাট্য প্রাঙ্গঁন আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে গ্রীষ্মের দীর্ঘসময়ব্যাপী আলো। ধীরে ধীরে দর্শকে ভরে উঠছে কাঠের গ্যালারি। ফুলেল গাউন, বাহারি টুপি, কনুই অবধি গ্লাভসে ঢাকা অভিজাত রমণী থেকে সাধারণ তাপ্পিমারা কোট হ্যাটের মানুষ। আজ গ্লোবে অভিনীত হবে ‘রোমিও এণ্ড জুলিয়েট’। সেই বিখ্যাত ব্যালকনি দৃশ্য, যেখানে প্রথমবার পার্টিতে জুলিয়েটকে দেখে পাগলপারা রোমিও জুলিয়েটের সাথে আলাপে উন্মুখ।
‘সবাই গ্যালারিতে চলে আসুন,’ গাইড অনুরোধ করলে চমক ভাঙে আমাদের। যে যার পছন্দমত সীটে বিনে টিকিটের দর্শক হয়ে বসলাম। সামনে অভিজাত পর্দার গাম্ভীর্য নিয়ে গ্লোবের স্টেজ। গাইড উঠোন পেরিয়ে স্টেজের সামনে পৌঁছে অত্যন্ত স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুনতে পাচ্ছ?’ আমরা বললাম, ‘পরিষ্কার!’ তিনি বললেন, ‘এই হচ্ছে গ্লোবের ম্যাজিক। তোমাদের বসার জায়গা থেকে স্টেজের দূরত্ব ৬০ ফুট হবে। অথচ আমি একটুও গলা উঁচু না করে কথা বললেও তোমরা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছ। কেন?’
আকাশ পাতাল ভাবছি, শেষে গাইডই মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘কারণ, গ্লোব সতি্যকারের গ্লোব নয়! মূল গ্লোবের আসল পরিমাপ জানা নেই, কিন্তু গত দু শতাব্দীর গবেষণা থেকে তার আকার এবং মাপ আন্দাজ করা যায়। তবে, ১৯৮৮-৮৯ সালে মূল গ্লোবের ভিতের এক ক্ষুদ্রাংশ আবিষ্কার হয়, যার থেকে জানা যায় যে আকারে এটি ছিল ২০-টি ধার বিশিষ্ট একটি পলিগন।’
২০-টি ধার বলেই উঠোনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত মঞ্চ থেকে অভিনেতাদের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নাট্যালয়ের কোনায় কোনায় ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে শেষ সারির দর্শকের কানেও পরিষ্কার শোনাত। আজও এই থিয়েটারে মাইক্রোফোন, স্পীকার বা অ্যামপ্লিফিকেশানের দরকার পড়ে না।
এখন আমরা যেখানে বসে এগুলো মধ্যবিত্তদের আসন। এই বাঁধানো খোলা প্রাঙ্গঁণ সে সময়ে এটা মাটি আর খড়ের ছিল। প্রচুর মানুষ এই উঠোনে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থিয়েটার দেখত। তারা ছিলো পাঁচ পেনীর দর্শক। বেশীর ভাগ লণ্ডনের খেটে খাওয়া মানুষ। শখ আছে, সঙ্গঁতি নেই। নাটকের দিনে এরাও দিবি্য ছেঁড়া-ফাটা তাপ্পিমারা হ্যাট কোটে শোভিত হয়ে, রাত্রের খাবার সেরে মুখশুদ্ধি হিসেবে রসুনকুচি চিবোতে চিবোতে রঙ্গঁলায়ে উপস্থিত হত। অভিজাত মহিলা দর্শককুল এদের গায়ের মুখের গন্ধে চোখমুখ কুঁচকে, বিকৃত করে, শৌখীন হাতপাখা নেড়ে রসুনের গন্ধ ভাগাবার চেষ্টা করত। আর ছিল এদের বাদাম ভাজা খাওয়ার বহর। খননের সময় স্টেজের সামনের এই প্রাঙ্গঁনে, যাকে সে যুগে ‘পিট‘ বলা হত, এখান থেকে মোটা এক পুরু চীনেবাদামের খোলার লেয়ার পাওয়া গেছে। আজও স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে থিয়েটার দেখার দর্শকশ্রেণী আছে। তবে সেই টিকিটের দাম পাঁচ পেনী থেকে হয়ে গেছে পাঁচ পাউণ্ড।
গাইডের সঙ্গেঁ নীচুতলার গ্যালারি পেরিয়ে এককোণের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় এলাম। আমরা এখন আর মধ্যবিত্ত নই। ব্যালকনির বক্সসীটের ধনপতিকুলাসনে বসেছি নীচের গ্যালারির এবং দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের দিকে মুখ করে। বক্সসীট থেকে স্টেজ ও গোটা গ্যালারির চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। ধনীদের আভিজাত্য দেখানোর সেরা জায়গা ছিল এই বক্সসীটগুলো। সবই রিজার্ভ করা থাকত। আরাম করে বসার জন্য কুশন ভাড়াতে পাওয়া যেত। সর্বাধুনিক ফ্যাশনসমৃদ্ধা রমণীকুল নিজেদের পোষাক ও গহনার যথোপযুক্ত প্রদর্শনী এখান থেকে সারতেন। মধ্যবিত্ত ও পেনীদর্শককুল তাঁদের এই দর্শনধারী ব্যবহারকে কোনক্রমেই বিফলে যেতে দিতেন না। গ্লোবের সবচেয়ে আকর্ষক দিক ছিল এই বসার ব্যবস্থা। অভিনেতারা দর্শকদের এবং দর্শকরা নিজেদের পরিষ্কার দেখতে পেত বলে নাটকের রস সমান ভাবে একটা গোটা পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে সবাই উপভোগ করত।
শেক্সপীয়র আর গ্লোব তখন গোটা ইংলিশ সংস্কৃতি জগতের এক বিখ্যাত মাইল ফলক। শেক্সপীয়র নিজে তাঁর প্রতিটি নাটকে কিছু না কিছু চরিত্রে অভিনয় করতে ভালোবাসতেন। তেমন প্রধান কিছু চরিত্রে নয়। যেমন, ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটকে বুড়ো অ্যাডাম-এর চরিত্র অথবা ‘হ্যামলেট’-এ ভূতের ভূমিকায়। নাটকের প্রধান চরিত্রাভিনেতাকে সপ্তাহে পাঁচ হাজার লাইন স্মরণে রাখতে হত। সবথেকে মজার ব্যাপার, চলমান নাটকের ক্লাইম্যাক্সে বাড়তি চমক আনার জন্য মাঝে মাঝে কুশীলবরা আগে থেকেই পাঁচপেনী দর্শককুলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তাদের হঠাৎ হাত পা নেড়ে গলার শির ফুলিয়ে চীৎকার বা হাসি বা ক্রোধপ্রকাশে দর্শকরা অভিনেতাদের আরো নিজেদের মাঝে নিজেদের মতন করে পেত।
ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে মঞ্চের ছাদঘরের দিকে দেখিয়ে গাইড বললেন, ‘ঐ চিলেকোঠার ঘরটাই ছিল নাট্য কোম্পানীর অফিস ঘর। তা বাদে নাটকের সাত সতেরো সরঞ্জাম সব ঐ ঘরেই রাখা হত। উঠোনের দিকে ফোটানো জালনা দিয়ে নাট্যকোম্পানীর লোকেরা বক্সসীটে এক ঝলক নজর মেরে দেখে নিতেন আজ নাটক দেখতে শহরের কোন কোন কেষ্ট-বিষ্টুর দল এসেছে। নাটক করতে করতে অভিনেতাদের তাঁদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে শিখিয়ে দেওয়া হত।’
মঞ্চ প্রাঙ্গঁন থেকে ফিরে চলেছি আমরা। সকালের সোনারঙের বদলে গ্লোবের জালনাগুলো দিয়ে বেলার সাদাটে আলোর রশ্মিরেখা। আবার টেমসের ধারে, গ্লোবের বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। বড় নির্ভেজাল এই গ্লোব। এক ফোঁটা ধাতু নেই এর গায়ে। চৌকাঠ ইংলিশ ওক কাঠের। দেওয়াল, দরজা, জালনাও তাই। পোকামাকড়ের থেকে বাঁচাতে দেওয়ালে পোড়া ইঁটের গুঁড়ো আর জলের মিশ্রণের লাইম ওয়াশ দিয়ে তার উপর প্লাস্টারের লেপন। ছাদে একরকম জলজ উদ্ভিদের শুকনো ফাঁপা মূল থেকে পাওয়া খড়। না আছে কোন কৃত্রিম স্পটলাইট, ফ্লাশলাইটের ব্যবহার। প্রাকৃতিক আলোয় নাটক হয়, তাই গ্রীষ্মকালই নাটকের সময়। তখন বৃষ্টিবাদলের ঝঞ্ঝাট কম, তাছাড়া সূর্য পাটে বসে দেরীতে। বোধহয় শীতের নিস্তব্ধ বরফবেলায় নির্জনে নাট্য কাব্য চর্চা করতেন কবি আর তার ফলভোগ করত গ্রীষ্মের উজ্জ্বল দিন। এ গবেষণাকারীদের অনুমান মাত্র, কারণ শীতে নাটক তখনও মঞ্চস্থ হত না। মার্চ থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত্য এখানে নাটক অভিনয় হয়। সেই শেক্সপীয়রের যুগ থেকে আজ অবধি চলে আসছে এই পরম্পরা।
বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত পর্য্যন্ত গাইড মহোদয়া আমাদের গ্লোবের গল্প শোনাতে থাকেন। ‘হাতে সময় থাকলে সংলগ্ন গ্লোব মিউজিয়ামটি দেখে নাও। ইতিহাসের অজস্র খোলা পাতা দেখতে পাবে।’
১৬১৩ সালে গ্লোব আগুনে পুড়ে যায়। ১৬১৪ সালে পুনর্নিমিত হয়। কিন্তু, এই দ্বিতীয় গ্লোবে শেক্সপীয়র অভিনয় করলেও নতুন নাটক আর রচনা করেননি। নানা কারণে তাঁর শিল্পীসত্তা ক্লান্ত, বিব্রত হয়ে পড়েছিল। পড়শি নাট্যালয় ‘দ্য রোজ’-এর চিরকালীন রেষারেষির কুরুচিকর অশান্তি, দেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের পিউরিটান শাসককুলের যখন তখন চোখ রাঙানি, নাটক ফাটক চলবে না! লণ্ডনের কৃত্রিম শহুরে জীবনের কেজোমার্কা ধরণধারণ, তার উপর স্বপ্নের গ্লোব পুড়ে যাওয়া — মনে মনে বিধ্বস্ত শেক্সপীয়র তৈরী হচ্ছিলেন নিজের শান্ত, ছোট, প্রকৃতির সবুজ ছায়ায় লালিত গ্রামখানিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। নিজের স্ত্রী, সন্তান, পুরনো বন্ধুবান্ধব আর নদী অ্যাভনের শান্ত সোঁতার তীর তাঁকে রীতিমতো আকর্ষণ করছিল। অবশেষে দীর্ঘ লণ্ডন প্রবাসে ইতি টেনে ফিরে গেলেন তিনি ১৬১৪ সালে এবং দু’ বছর পর এই মহান প্রতিভাবান সাহিত্যিকের মৃত্যু। ১৬৪৪ সালে পিউরিটান শাসককুলের দমন নীতি চরমে ওঠে। গ্লোব গুঁড়িয়ে সেখানে বাসস্থানের ফ্লা্যটবাড়ি তৈরি হয়। অবশ্য সে দৃশ্য দেখার জন্য ট্রাজেড়ির নায়ক সেজে বেঁচে থাকার পাত্র ছিলেন না উইলিয়াম শেক্সপীয়র।