Download this blog post in PDF format if your browser does not display Bangla script properly.
এয়ারপোর্টের চত্বরে দাঁড়িয়ে ফেলফেলিয়ে দেখছিলেন কাত্যায়নী। স্বামী বগলে নতুন বৌমা বুনি কেমন দিব্যি চলে গেল চেক-ইন বর্ডারের ওপারে। চোখে আঁচল চাপা দিয়েছেন কি দেননি, কর্তার ব্যাগড়া, ‘আঃ কাতু!’
কাত্যায়নীর গোমড়াপনা মুখের দিকে তাকিয়ে বেয়াই হাসেন। ‘দুঃখু করবেন না, বেয়ান! আজকাল গায়েগায়ে থাকাটা কোনো থাকা নয়। ওই যে বুনি বলে গেল, মা ফেসবুকে থাকবেন। ওইটেই হল মোক্ষম থাকা।’
ফোঁত করে নাক ঝেড়ে কাত্যায়নী বললেন, ‘কিন্তু আমি তো ওতে নেই!’
‘সে কি! সব্বোনাশ!’ আঁতকে ওঠেন বেয়াই। বেজার মুখে কর্তা বলেন, ‘কাতুর সবতাতে বাড়াবাড়ি। আজ নেই তো কি হয়েছে, কাল আছো!’
‘না, না, বেয়াই,’ হাত নেড়ে কর্তাকে বলেন বুনির বাবা। ‘বেয়ানকে ডিসকারেজ করবেন না। চলুন না, কোথাও বসে এট্টু চা-ফা খাওয়া যাক। আমাদের এখানে আর কিস কাম কি!’
কফিশপের কর্ণারে দুই প্রৌঢ় পত্নীসহ গুছিয়ে বসলেন। ততক্ষণে বেয়ান ওনার ঢাউস ফোনখানা বাগিয়ে ধরে কাত্যায়নীকে বললেন, ‘এই যে দেখুন, দেখুন, আমার নাতি কোকো।’ কাত্যায়নী দেখেন লাল প্লাস্টিক পটি চেয়ারে বসে আছে এক গোবদা শিশু। গর্বিত সুরে বেয়ান বলেন, ‘কোকোর ফার্স্ট টয়লেট সীট এক্সপেরিয়েন্স স্ন্যাপ! অ্যামেজিং না?’
কথাকলি স্টাইলে মাথা দোলালেন কাত্যায়নী। চা আর চিকেন পকোড়া অর্ডার করা হয়েছে। তারই অপেক্ষার ফাঁকে স্রোতের মতন ফোনস্ক্রিনে আসতে লাগল কোকো দ্য গ্রেটের ফার্স্ট স্নিজিং-এর ‘কিউটি পাই’ ছবি, ফার্স্ট ওঠা একদন্ত ছবি, ফার্স্ট চুল ছাঁটার ছবি।
বেয়াই বিজ্ঞ হেসে বললেন, ‘বড় মেয়ে পিকুর ছেলে। নরওয়েতে থাকে। সে কি একেনে মশাই! দেখলেন তো বুনির বিয়েতে আসতে পারল না। আমরা কিন্তু ওদের মিস্ করি না। শুধু ওই ফেসবুকে আছি বলে।’ একটি মস্ত চিকেন পকোড়া গলাধঃকরণ করলেন বেয়াই।

ততক্ষণে বেয়ান আবার হামলে পড়েন ‘পিকুর ডেলিভারির ভিডিওটা দেখুন,’ বলে। ‘এ মা! না! না! ও সব থাক,’ আপত্তি জানান কাত্যায়নী। কর্তা বিব্রত। এদিকে মস্ত এক ধোঁয়া ওঠা চিকেন পকোড়া মুখে পুরে বেজায় বিপাকে পড়েছেন বেয়াই মশাই। ‘উলল্… উশশ্’ করে তীব্র মাথা নেড়ে কোনোরকমে বললেন, ‘উঁ-হু-হু-হু, যা ভাবছেন তা নয়।’ কফির চুমুকে পকোড়াটাকে ম্যানেজ করে উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটা কিন্তু হচ্ছে একটা ওয়ার্ম ওয়াটার সুইমিং পুলে। হট ওয়াটার প্রেশারে একটি পেইনলেস বার্থ প্রসেস।’
বেয়ান গদ্গদ্ হয়ে দেখালেন, ‘এই দেখুন! ল্যাঙট পরে জলে নেবেছে জামাই। আহা! কি উদ্বেগ দেখুন! কি জেইণ্টলি পিকুর হাত ধরে বলছে “পুশ, বেবি পুশ!” আহা, চোখে জল এসে যায়।’
গরম কফিতে পরপর চুমুক মেরে স্বচ্ছন্দ সুরে বেয়াই বললেন, ‘এটা রকেট যুগ মশাই! একই ছাতের তলে বাপ মা ছেলে মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী। অথচ দেখুন, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, অন্নপ্রাশন হাল আমলের বাপ দিবস, মা দিবস, প্রেম দিবস, সবই পালন হচ্ছে ফেসবুকে। একে অপরকে মুখোমুখি নয়। শুভেচ্ছা বার্তা ছাপাচ্ছে ফেসবুক ওয়ালে। মুখোমুখি ওসব ভ্যানতাড়ার সময় কোথায় মশাই!’
কর্তার এসব মনঃপূত নয়। ব্যাগড়া দিয়ে বলেন, ‘সে আপনি যাই বলুন, মুখোমুখি শুভেচ্ছা অভিনন্দন প্রণাম আলিঙ্গঁনের মহিমা আলাদা।’
টেবিলে এক চাপড় মারেন বেয়াই। ‘আরে রাখুন আপনার মহিমা!’ ভুরু তুলে স্ত্রী-এর দিকে তাকান। ‘এই তো টুলু বসে আছে সামনে। জিজ্ঞেস করুন না, ওর ছোট বোন নুটু কি করে!’
কর্তার চোখে বিরক্ত ভাব দেখে অগত্যা কাত্যায়নীই হাল ধরেন। ‘কি করেন উনি?’
বেয়ান এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুশী। তাঁর কর্তাটি যা! মুখের ব্যাট চালানো শুরু করলে কাউকে সহজে পাস্ দিতে চান না। ‘নুটুটা এক নম্বরের সিরিয়ালের পোকা। সারা সন্ধ্যে অক্যুপাইড। এদিকে ফ্রিজ ঢুঁ ঢুঁ। বাজার যাবার উপায় নেই। বজ্জাতের ধাড়ি কাকি শাশুড়িটা যে অন্যায্যতা শুরু করেছে আশালতার সাথে। তাতে কখন কি ভালো মন্দ হয়ে যায়, নুটুটা হেভী টেনশানে থাকে।’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান,’ কাত্যায়নী ব্যস্ত গলায় শুধোলেন। ‘আশালতা আপনার বোনের মেয়ে না কি?’
খুক্ খুক্ খ্বিক্ হাসতে লাগলেন বেয়ান। ‘আরে দূর! ওসব না। চোকের বালির আশালতা। সিরিয়াল!’ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন কাত্যায়নী। ‘তাই বলুন!’
বেয়াইমশাই টুথপিকে খোঁচানো দাঁতগুলোতে জিভ বুলিয়ে এবার বললেন, ‘বাজারের ফর্দ ফেসবুকে লেখে স্বামীকে। “আনবে — কিলোটাক আলু। পোয়াটাক ভিণ্ডি। শুঁটকো এনো না। খাবলা দরে গাটি কচু। ডিম ৪টে। দেকে এনো ফাটা। চারাপোনা ভালো দেখে।” কি বুঝলেন, বেয়াই?’ দরাজ হাসলেন বৌমার বাপ। কর্তা চুপ।
‘ফোনে স্বামীরা অধরা হলেও হতে পারে। কিন্তু ফেসবুক? মোক্ষম কল মশাই! জীব ধরা পড়বেই। আমারই আপিসের এক সাবঅর্ডিনেট। ছোকরার নতুন বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তা বলে ওয়ার্ক প্রেশার তো কম নয়। বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরী। এরই মধ্যে এল নতুন বৌ-এর জন্মদিন। সেদিনই আবার কোম্পানীর মাল ডেসপাচের দিন। বেচারা তো দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু! এসে ধরলে আমাকে। “ভট্টদা, উপায়?” ক্ষেপা নতুন বৌ সাঙ্ঘাতিক জিনিষ! দিলুম বাতলে।’
কাত্যায়নীর কৌতুহল রাশ মানছিল না। ‘ফুল কিনে ঘরে গেল বুঝি?’
‘নো ম্যাম!’ তর্জনী হেলান বেয়াই। ‘ও সব ফুল টুল বৌ-এর বার্থ ডে নাইটে লেট নাইট অ্যারাইভারদের সারভাইভিং মড্যুল নয়। নিমেষে ঝাঁটা মেরে ফুল ফেলে দেবে ডাস্টবীনে।’
‘তা হলে কি করলেন আপনি?’ চিন্তিত শোনায় কর্তাকেও।
‘সির্ফ এক্ ক্যাপশান্ কা কামাল! ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় বাছাধনকে বললুম, “ওহে, আনো দিকি তোমার ফোন যন্তরখানা।” কাঁচুমাচু মুখে বললে, “মেসেজ করে লাভ নেই দাদা। আজ কপালে কালবৈশাখী, ঠেকায় কে!” উত্তর করলুম না। একখানি চিরকুটে আমার মগজাস্ত্র মেলে ধরলুম। পড়ে তো বাবাজীর চক্ষু ছানাবড়া। বললুম, “ফ্যাল ফ্যাল করে দেখচো কি! চট্পট্ লিখে ফেল গিন্নীকে ফেসবুকে।” তক্ষুনি বসে সে লিখলে — “আগুন! লেগেছে লেগেছে বাজারে/ কিলো!! নব্বুই ছাড়ালো পিঁয়াজের / তা হোক, তবু আমি নোবো / গোটা দুই কিলো / ওগো আদরের হানি, যায় যাক মানি / কষা বিরিয়ানী / আজ রেঁধে দোবো তোমারে।” ’
‘ফ্যাণ্টাস্টিক!’ কর্তা হেসে ফেললেন। কাত্যায়নীর মুখেও এতক্ষণ পরে নির্মল হাসি। শুধোলেন, ‘তারপর?’
গর্বিত হেসে বেয়াই বললেন, ‘তার আর পর! বাবু আপিস ফেরতা সিরাজের বিরিয়ানী চাঁপ কিনে নিয়ে গেল এ শর্মার পরামর্শ মাফিক। সেই চাঁপের চাপে পড়ে গিন্নীর রাগ গলে মাখন! মানিকচাঁদকে নিজ হাতে রাঁধতে হল না, শুধু মোক্ষম টাইমে একখানা ক্যাপশান ঝেড়ে পগার পার হল! তাই বলছি বেয়ান, ফেসবুকে আসুন! রসে বশে থাকুন!’
স্বামী গর্বে গর্বিতা বেয়ান খুনসুটির সুরে বললেন, ‘আর ওঁর বসের দামড়া ছেলের কীর্তি তো জানেন না! কস্মিনকালের মায়ে-পোয়ে কথা নেই। ছেলের খিদে পেলে চিলেকোঠার ঘরে বসে ল্যাপটপ থেকে মাকে ইমেল করে, “অ্যাই অ্যাম হাংগ্রী।” ভদ্রমহিলা নিজ মুখে দুঃখু করেছেন এনাকে। অথচ কি আশ্চর্য্য পেত্যয় যাই, সেই ছেলের জন্মদিনে কোন কালের ডায়াপার পরা ছেলের ফটো ফেসবুকে ছাপিয়ে মায়ের কি আহ্লাদীপনা — “টাইম ফ্লাইস!” আচ্ছা বলুন তো, এইসব ন্যাকামিতে লাইক দিতে ইচ্ছে করে?’
‘এই তো তোমাদের দোষ!’ স্ত্রী-এর দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বেয়াইমশাই বললেন। ‘নিজে লাইকের আমটি খাবে অথচ তার দামটি দেবে না। আরে বাবা, যারা তোমাকে নিয়মিত লাইক ভোটে ছাপ্পা দেয় তাদের আপডেটে চটে গিয়ে এটা তুমি বলতে পারো কি, যে তার বরের আাজ হপ্তাখানেক কন্স্টিপেশান তো আমার তাতে কি! এই যে তোমার ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া ইস্কুলের বান্ধবী গ্রীসে গেল। সেখেনে সব আবার নীল সাদায় বাড়ি, বুঝলেন?’ কাত্যায়নীর দিকে তাকান বেয়াই। তারপর গিন্নীকে ধমকে বললেন, ‘তখন নীল গেঞ্জী আর সাদা হাফপ্যাণ্ট পরে তোমার বান্ধবীর বর দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো আর বান্ধবীটি নীল জাঙ্গিঁয়া সাদা বগলাকাটে বরের বগলের তলায় — এই ছবি দেখে নেকুপুষু! মরণ! এসব বললে চলবে না কো! বরং তখন লিখতে হবে: “বরের পাশে কে হ’টি? / যেন চেনা চেনা, ন’টি ন’টি!” তবেই তো তুমি যখন সাগু-বার্লি খেতে খেতে সেলফি দেবে, “হ্যাভিং নিউট্রশাস্ নাস্তা, ফিলিং ব্লেস্ড্” তখন একশো থাম্স আপ্ পাবে!’
‘এসব কি বলছেন বেয়াইমশাই?’ কর্তা হতবাক! এসব জানকারি তাঁদের কাছে অত্যাশ্চর্য্য। ব্যাপার বুঝে ছেলে ভুলানো সুরে বেয়াই স্তোক দেন, ‘আরে স্যর, সিম্পল! সেই যে আমাদের সুপার জিনিয়াস রবি ঠাকুর! আঃ ভদ্রলোক একখানা কি জিনিষ ছিলেন মশাই! সবেতেই দূরদৃষ্টি ছিল। সেই যে সেই লাইনটা, কি যেন ছাই, মিলাবে মিলিবে —’ মাথার টাক চুলকান বেয়াই।
মৃদু হেসে কাত্যায়নী বললেন, ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে / যাবে না ফিরে।/ এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।’
‘ব্যস্! ব্যস্!’ একগাল হেসে হাত দেখিয়ে কাত্যায়নীকে থামালেন বেয়াইমশাই। ‘এ একেবারে এই জিনিষ। দিবে আর নিবে, মিলাবে আর মিলিবে, বুঝলেন স্যর!’
কাত্যায়নী বললেন, “সে কি! এখানে তো কবি ভারতকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন তীর্থ হিসেবে জ্ঞান করে কবিতাটা রচনা করেছেন। তার সঙ্গেঁ ফেসবুক-টেসবুকের কি সম্পর্ক?’
‘আছে, বেয়ান, আছে। খুঁজে দেখতে হবে। কেবল লাইন ধরে পড়ে গেলেই কাব্য পড়া হয় না। বর্তমান সোসাইটির কোন খোপে বিখ্যাত কবিতার কোন খাপ মিলে যাবে, তার জন্য রিসার্চ করার দরকার নেই। ও আপসে বোঝা যায়। কবি যে সিচুয়েশানে বসে কবিতাটা লিখেছিলন তার থেকে বর্তমানের ফেসবুকের সিচুয়েশানটা অনেক বেশী অ্যাপ্রুভাল পাবে।’ বিজ্ঞ হাসেন বেয়াই। ‘আচ্ছা, এবার আপনি একটু ঘুরে বসুন তো! শুধু খেয়াল রাখতে হবে আপনার ব্যাকগ্রাউণ্ডে যেন এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ আর এই বারিস্তা কফিশপটা আসে। আপনার একখানা ঘ্যামা প্রোফাইল পিকচার তুলে দিই। স্যরের থেকে বাকিটা হেল্প নিয়ে এই ছবিটা আপলোড করে দিন। তারপর দেখুন কি হয়!’ মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন বেয়াইমশাই।
ঘাবড়ে গিয়ে কাত্যায়নী শুধোলেন, ‘কি হয়?’
টেবিলে আবার চাপড় পড়ে। ‘আরে সিস্টার! লাইকের হিড়িক পড়ে যাবে। আপনার স্টেটাস আপলোড দেখে সবাই থ মেরে যাবে। আপনার সেল্ফ এস্টিমের ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করে উঠবে। আনরেজিস্স্টেবল হয়ে আপনি তখন শুধু নিউজ ফিডব্যাকের ট্র্যাকে মিলখা সিং, স্যরি, পি. টি. উষা হয়ে দৌড়বেন। লাইফের ছোট বড় আপকামিং ইভেণ্টগুলো শুধু খেয়াল রেখে যাবেন বুঝেছেন?’ উত্তেজনার বশে হাঁপিয়ে বললেন বেয়াইমশাই। ‘শুনুন, শিবরাত্রি আসছে সামনের উইকে। আপনাদের বাড়ির ছাতের কোনে ধুতুরা ফুলের গাছটার ঝুঁটি ধরে একটা সেলফি নেবেন গরদ গায়ে। ক্যাপশান দেবেন — “হ্যাপি শিবরাত্রি।” এইভাবে শুরু করুন। তারপর আমি তো আছি। আইডিয়ার কমতি পাবেন না। এই তো গেল রোববার বুনি যখন অষ্টমঙ্গঁলায় গেল বেশ জমাটি আড্ডা বসল বাড়িতে। বিকেলে ঢালাও মুড়ি পেঁয়াজি। বুনি আর জামাইকে দিলুম বসিয়ে ল-এর উপর প করে। আমি স্বয়ং গ হয়ে বুনির ফেসবুক ওয়ালে গান ফায়ার দাগলুম — “এক কাপ চায়ে আমি পেঁয়াজি চাই/ পেঁয়াজির সাথে আমি তোমাকে চাই/ তোমার সাথে আমি ভাজা মুড়ি চাই-ই/ মুড়ি ভাজা-পেঁয়াজিতে তোমাকেই পাই।” আঃ! যা রেসপন্স এসেছিল না! ফাটাফাটি!’
কর্তা অনেকক্ষণ বেয়াই-এর বিজ্ঞতায় কিঞ্চিৎ ফিকে পড়ে যাচ্ছিলেন। এখন চেপে ধরলেন। ‘সে সব বুঝলুম। কিন্তু হ্যাপি শিবরাত্রিটা কি জিনিষ মশায়? বাপের জন্মে কাউকে বলতে শুনিনি!’
‘হোঃ হোঃ, বাপের জন্মে তো এসব অবিশি্যই শুনবেন না স্যর। এসব হল এ যুগের প্রডাক্ট। আজকাল দোল, দুর্গোৎসব, বিজয়া, জন্মষ্টমী মায় নীল ষষ্ঠীর শুভেচ্ছা সবই হ্যাপিতে কাটে।’
‘শ্রাদ্ধও?’ বলেই জিভ কাটেন কাত্যায়নী। বেয়াই কিন্তু চটলেন না। বরং গম্ভীর চালে বললেন, ‘ওটা একটু আলাদা ম্যাডাম। যিনি টসকেছেন তাকেই সমীপেষু সহকারে একটি চিঠি দিতে হবে।’
‘মানে?’ ধমকে উঠলেন কর্তা। ‘কি আলটু ফালটু বকছেন?’
‘দাদা! এ যুগে ওটাই শোক জানাবার দস্তুর।’ হাত বাড়িয়ে ওয়েটারকে ডাকলেন বেয়াই।
চার প্রৌঢ় কফিশপ থেকে বেরলেন। অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেয়াই বোঝালেন, ‘এ যুগে শোক জানানোটাও একটা আর্ট। খালি রুদালি হয়ে বুক বাজালেই চলে না। ধরুন, আপনার চেনাজানা কেউ গত হলেন। আপনি সরাসরি লিখুন, “ভায়া অমুক! এটা কি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিলে! এই কি ভোঁ কাট্টা খেলার সময়? এখন ভবের হাটে তোমার করা বাজারের মোট বওয়ার মুটে জোগাড় করি কোত্থেকে?” — ডিসেণ্ট! হার্ট টাচিং! নয় কি? তা বাদে, এই যে টুলুরা, আট বোন! কোনটি কখন মাউণ্ট আবুর চালে চড়ে চা-পাঁপড় সাঁটাচ্ছে, কোনটি পাছার কার্বাঙ্কলে কোঁকাচ্ছে, কার ছেলেকে ন্যাবায় পেল, এসব খবর আমাদের নখদর্পণে। তাই বলছিলুম মিথ্যে শোক না করে এইবেলা ছেলে আর ছেলে-বৌকে ট্র্যাকে ধরে ফেলুন। ফেসবুকে থাকুন!’
গাড়িতে কর্তা বেয়াই-এর পাশে বসে গাঢ় গলায় বললেন, ‘ভট্ট! দিনকাল যা দেখছি তাতে পাড়ার মুচিটাও এবার ওয়াট্সঅ্যাপে মেসেজ দিল বলে, গিন্নী মা! জুতো জুতে দিইচি, নে যান!’
কাত্যায়নী আর বেয়ান পেছনের সীটে বসেছেন। কাত্যায়নী মৃদু হেসে বললেন, ‘কাল বারান্দা মুছতে ভোলার মা এত দেরী লাগাচ্ছে কেন, দেখতে গিয়ে দেখি এক ঠ্যাং রেলিঙে তুলে সে ফোন মিটিং-এ মহাব্যস্ত।’
এত সব কথার মাঝে বৌমার মা চুপটি হয়ে আছন। সেই থেকে ফোনে খুটুর খাটুরে ব্যস্ত। জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘আজ হপ্তাখানেক হল ভ্যঙ্কুভারে আমার এক বান্ধবী ফেসবুকে ছবি ছেপেছিল, নতুন বারমুডা পরে সামার সিজনের প্রথম তরমুজ খাচ্ছে। বাগানের ঘাস ছাঁটতে ছাঁটতে। বুনিদের জন্য ব্যস্ত ছিলুম, লাইক দিতে পারিনি। জলদি জলদি নাইস পিক্ লিখে একটা লাইক মেরে দিই। বুনিরা ওখানেই যাচ্ছে। কাকে কখন দরকার লাগে।’
জালনার বাইরে মুখ ফেরালেন কাত্যায়নী। আকাশের জলভারহীন সাদা তুলো মেঘ, সবুজ গাছের ঘন ছায়া, দুব্বোঘাসের ডগায় ওড়া ঘাসফডিং, এই সবগুলোকেই মনে মনে লাইক দিতে দিতে এগিয়ে চললেন।