চিঠি লেখা

Download this blog post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly

সাথীরা,
ছেলেবেলায় কোলকাতার বাইরে আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লেখার মরশুম আসত এক বারই। দূর্গাপূজোর পর পর পোস্টাপিস খুললে বাবা একগোছা হলুদ পোস্টকার্ড আর নীল কাগজের ইন্ল‍্যাণ্ড কিনে আনত। রবিবারের দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হালকা রোদের তাপে ছাদে মাদুর বিছিয়ে চুল শুকাত মা। আর চিঠি লিখত। দিল্লী, নাগপুর, যাঁরা যাঁরা কোলকাতার বাইরে আছেন, তাদের জন‍্য ইনল‍্যাণ্ডের নীল খাম। আর যাঁরা কোলকাতার আশেপাশে মফঃস্বলে থাকেন তাদের জন‍্য বরাদ্দ হলুদ পোস্টকার্ড। মা নিজের কথা লিখত চিঠির সিংহভাগে। বাকিটা ছেড়ে দিত আমাদের ভাইবোনেদের জন‍্য। আমরা সেই স্বল্পপরিসরে গোটা গোটা অক্ষরে বড়দের প্রণাম জানাতাম। বেশী কি লিখব ভেবে পেতাম না। তখন মা বুদ্ধি দিত — ‘এই লেখ, এবার কটা দুগ্গাঠাকুর দেখলি, ভাইফোঁটায় রাঙাপিসি কি দিল, এবার ঠাকুমা আমলকীর আচারটা বেশ বানিয়েছেন, পড়াশোনা কেমন করছিস, এই-ই যথেষ্ট!’ অর্থাৎ চিঠিগুলো সব ছিল তথ‍্যে ভরা। তবু চিঠি তো!

তারপর বড় হলাম যখন, তখন দেখি মনের কথা আরো বলার ইচ্ছে জাগছে। তখন মাকে মেজাজ দেখিয়ে বলতাম, ‘আমাদের জন‍্য এইটুকু জায়গা ছাড়, কি লিখব এইটুকুতে!’ মা হেসে বলত, ‘মন ডানা মেলে উড়তে শিখছে তাহলে!’

তখন এ কথার মানে ধরতে না পারলেও পরে বুঝেছি মনের ডানা মেলা কাকে বলে। জীবনের পথে কত কি ঘটে। সব কথা ভাষা পায় না, প্রকাশের আলোও পায় না। তখন চিঠি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেঁলের মতন প্রকাশের বাতি হাতে আসে আমাদের মনের দরজায় দরজায়। খুলে যায় আগল। আমরা আমাদের যত না বলা বাণী বলি!

‘দেবযানীর চিঠি’  আর ‘ভোলানাথের’ চিঠি-র বক্তব‍্য বিষয় আমার জীবনের দুটি বিষাদময় অভিজ্ঞতার উপাখ‍্যান। দুটি ঘটনা আমার মনকে নাড়া দিয়ে গেছে ভীষণভাবে। কি এক অব‍্যক্ত বেদনায় প্রতিবাদ করতে চেয়েছি সমাজ, সম্পর্ক, জীবনের রীতিনীতির মানদণ্ডের উপর। ভালো কি আর মন্দ কি, তা কারা ঠিক করে? উচিৎ-অনুচিৎ বিচারের যোগ‍্যতাই বা মাপা হয় কিসের নিক্তিতে?

পারিনি। আমার প্রতিবাদ শুনবে কে? এবং কেনই বা শুনবে? তাই এবার যখন চিঠি লেখার প্রতিযোগীতার সুযোগ এল, তখন মনের আগল খুলে দিলাম। প্রকাশের আলোয় ধারাস্নান করালাম মনের হতাশা, গ্লানি, বেদনা আর সহমর্মিতাকে।

debjanirchithiদেবযানীর চিঠি: ‘বন্ধুরা, বাচ্চারা মিলে পিকনিকে বেরিয়েছি সবাই। তুমি ফাঁকা রাস্তায় যথারীতি দিগ্বিদিক ভুলে হাই স্পিড তুললে। সাথে বাচ্চারা আছে! বললাম, ‘অনি, একটু আস্তে!’ তুমি বললে, ‘তুমি আমাকে গাড়ি চালানো শিখিও না!’ সংযত সুরে বললাম, ‘সাবধানের মার নেই।’ তুমি আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি সাইড করলে। পেছন ফিরে বললে, ‘তোমার অসুবিধে হলে নেমে যাও!’ বন্ধুরা চুপ। বাচ্চাগুলো অবাক। তাতুন বিরক্ত। আর আমি? বোবা।’

bholanatherchithiভোলানাথের চিঠি: ‘১লা এপ্রিলের পূর্বদিন বেস্পতিবারের বারবেলায় বিবেকানন্দ সেতু ভেঙে পড়ে এতগুলো নিরীহ লোকের প্রাণ গেল। আর ‘রণে বনে জলে জঙ্গঁলে’ সর্ব দোষের দোষী ‘নন্দ ঘোষ’ হয়ে রয়ে গেলুম আমি! সোর্সের কাছে খবর পেয়েই অকুস্থলে যখন ছুটে গেলুম, ততক্ষণে সেতু খান খান। এমনিতেই তো এই শহরটায় রাস্তা বলে কিছু নাই। দোকান বাজার, হাজার কিসিমের যানবাহন, ঠেলাগাড়ি, গোরুগাড়ি, মানুষ-কুকুর-গোরু সব এক সাথে চলাচল করছে। দুটো অ‍্যাম্বুলেন্স যে ঢোকাবো তার উপায় নাই।’

ব‍্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করে চিঠি দুটো পড়ার জন‍্য সবাইকে আগাম ধন‍্যবাদ আর ভালোবাসা জানিয়ে এই চিঠি শেষ করছি।

ইতি
মৈত্রেয়ী

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

2 comments
Add Your Reply