ভোটের ভটভটি – লাইভ শো

Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.

শুভ সন্ধ‍্যা! আপনারা দেখছেন ‘নিকট দর্শন’ চ‍্যানেলের পপুলার ইলেকশানের লাইভ শো ‘ভোটের ভটভটি’। প্রচণ্ড গরমের তাপে চাঁদি ফুটিফাটা অবস্থা, তায় জীবন সাম্পানের পালে লেগেছে ভোটের গরম হাওয়া। আপনাদের ফানুস দশা উপলব্ধি করে আমার পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়ে শুরু করছি ‘ভোটের ভট্ভটি’।

পথে ঘাটের ভিড়ে ক্লান্তিতে বিপর্য‍্যস্ত মানুষ, শেষ বিকেলের হঠাৎ বয়ে আসা ফুরফুরে হাওয়ায় তৃপ্ত মানুষ, জীবনের রোচনামচায় ছুটে চলা মানুষ অথবা ধরুন ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ‍্যা হল, পার করো আমারে’- গোত্রের মানুষ। ভোট দিয়ে এরাই একটা সরকার বসায়, সরকার সরায়। এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী সাধারণ মানুষগুলোর ভোট নিয়ে কী ভাবনা চিন্তা আশা স্বপ্ন, আসুন এক নজরে দেখে নিই। আমার আজকের সফর সঙ্গীঁ ড্রাইভার কাম ক‍্যামেরামান শ্রী শঙ্কর জানা। আপনারা এতদিনে জেনে গেছেন এই অনুষ্ঠানের পুরোটাই ধরা থাকে লাইভ ক‍্যামেরায়। তাই কথাবার্তা ঘটনা সব যেমন ঘটে, যে ভাবে ঘটে, ঠিক তেমনটাই আপনারা শুনতে এবং দেখতে পাবেন।

আমি : ওক্কে! শঙ্করদা এখন আমরা কোথায় এলাম বলুন তো!
শঙ্কর : ওই যে নানা রঙের বাঁস্ পুতেছেন দিদি, ইকো পার্ক!
আমি : বেশ, সামনে চায়ের দোকানে থামবো। ক‍্যামেরা নিয়ে নেমে আসবেন।

চায়ের দোকানে…
আমি : মেসোমশাই, বট গাছের ছায়ায় বেশ ঠাণ্ডা, কি বলেন?
বৃদ্ধ : কেডা? কী চাই?
আমি : আজ্ঞে ভোট তো কড়া নাড়ছে দরজায়। কী ঠিক করলেন?
বৃদ্ধ : দুইটা টাকা ছাড়ো তো বাপু! মিনি মাগনায় কিসস্যু হয় না। হ’, কী কইতেসিলে? ভুট্? তা ঠিক করণের কী আসে? আমি পাইরলে পশ্চাদ্দেশ থিক‍্যা অগোরে ভুট্ দিই। ছুঁচো মাইর‍্যা আমাগো হাইত গন্ধ করণের দরগারডা কী?
চাওয়ালা : এই যে, ও দাদা, ক‍্যামেরাটা ইদিকে ঘুরাও, ঘুরাও! দাদু, কথা হচ্ছে তুমি জোট সরকারের জোড়া বাঁদরামি দেকবে? না, জোরা ফুলে ভোমরা হয়ে বসবে — সেইটেই এনারা জানতে চাচ্চেন। কেমন?
বৃদ্ধ : চোপ রও! হক্কাল বেলার চা-এর মৌতাতডা মাটি কইর‍্যা দিলো! যাঃ পালাঃ!
ক‍্যামেরা হাতে আমি ধরি এই দৃশ‍্য : চাওয়ালার হো হো হাসি, আশেপাশের কাঠের বেঞ্চিতে বসা দু এক জনের মিচকি হাসি, সকালের খবরের কাগজের এ হাত, ও হাত। চাওয়ালার কাছে গরম চা-এর ভাঁড় হাতে শঙ্করদার গান —
দু গাছি ঘাস্ নিয়ে জীবন আমার গোরুর গাড়ি/ ও মা রণকালি/ আমি জানি মা, আরো বাঁস্ খেতে হবে মোরে/ ঘাস ফুলে ডেয়োঁ পিমরে ভারি।

আমি : আমরা এখন ছুটে চলেছি শ‍্যামবাজারের উপর দিয়ে। তাই তো, শঙ্করদা?
শঙ্কর : হ‍্যাঁ, সামবাজারের পাঁচ মাতার মোড়। ঐ যে নেতাজী বসে আছেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে। ঘোড়ার পোঁদের দিকটা সেয়ালদা, মুখ দক্ষিণেশ্বর।
আমি : ওকে, ওকে! একটু সাইড খুঁজবেন! বিজি এরিয়া। বাইট্ নিতে বেশী দেরি করবো না। শঙ্করদা, রেডি উইথ ইওর ক‍্যামেরা। নাউ! — দিদি! স‍্যরি, জানি আপনি বোধহয় ছেলেকে স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছেন। খুব তাড়া, তবু দু মিনিট! ভোট আসছে, আপনার রাজনৈতিক মতামত যদি জানান প্লিজ!
মহিলা : (রুমালে মুখের ঘাম মুছে, কপালের সোয়েট টিপ ঠিক আছে কি না দেখে নিয়ে) কী বলবো বলুন তো! এ তো ঠগ বাছতে গাঁ উজার! (ওয়াটার বটল গলায় ঝোলানো ছেলেকে দেখিয়ে) দেখুন, ছেলের কানের কী হাল হয়েছে দেখুন! (ক‍্যামেরায় : ছেলেটার বাঁ কানটা টকটকে লাল ফোলা) সব ঐ মহিলার জন্যে জানেন! মুখ‍্যমন্ত্রী না মুখ্যু মন্ত্রী!

আমি : কী হয়েছে তোমার কানে?
ছেলে : মলে দিয়েছে।
আমি : কে?
ছেলে : দিদিমণি। ভূগোল ক্লাসে।
আমি : কেন গো?
ছেলে : এখন ছাদে লাট্টু খেললে মা বকে। বলে রোদ্দুরে সর্দিগর্মি হবে। তাই আমি দাদুর ঘরে লাট্টু ঘোরাচ্ছিলাম। দাদু টিভিতে খালি নিউজ দেখে। আমিও দেখি। তখন মুখ‍্যমন্ত্রী বলছিল, বেঙ্গঁল ইজ দ‍্য বর্ডার অব্ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান অ‍্যাণ্ড বাংলাদেশ ইজ দ‍্য বর্ডার অব্ পাকিস্তান। দাদু বললো, তোর ইশকুলে এসব বলে দেখিস কী হয়! শেম্ শেম্…
আমি : তাই তুমি…
ছেলে : হ‍্যাঁ, আমি ভূগোল দিদিমণির সাথে তক্ক করেছিলাম।
মহিলা : বাবা অত কিছু ভাবেননি, এখন পস্তাচ্ছেন!
আমি : (খোকাকে) খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। আর নিজে সত্যটা না জেনে কোনদিন তর্ক কোরো না কেমন! থ‍্যাঙ্ক ইউ, দিদি। শঙ্করদা, লেটস্ গো!

রাস্তায় আবার…
আমি : শঙ্করদা, অটোর মতন দেখতে ওগুলো কী গো!
শঙ্কর : হো হো, ওগুলো? দিদি ছেড়েছেন টোটো/ এবার সবাই মিলে ছোটো! কুমোরটুলি পেরিয়ে যাচ্ছি। এখেনে ঠাকুর তৈরী হয় জানেন তো? পুরনো কাপড়ও বিক্কিরি হয়।
আমি : হুমম্…
শঙ্কর : কী ভাবছেন অতো? খোকার কথা তো? দেখুন, রাজনীতি করা লোকেদের পেটে বেসি বিদ্যে থাকে না। ঘুসের টাকায় খাওয়া তো! হজম হয় না। রোজ রাত্তিরে ইসফ্গুল মারতে হয়। সকালে বিদ্যে বুদ্ধি সব এক সাথে ক্লিয়ার! নারদ! নারদ! সারদা! (দীর্ঘশ্বাস)
আমি : শঙ্করদা, এবার একটু মাটির মানুষ হয়ে যাক। তক্কে তক্কে থাকুন।
শঙ্কর : ওই ডাবওয়ালাটা চলবে?
আমি : ডাবওয়ালার কাছে ডাবল লাভ! চলুন, চলুন!

ডাবওয়ালার কাছে…
আমি : এই যে ভাই, দুটো শাঁসওয়ালা ভালো ডাব দাও তো!
ডাবওয়ালা :  (এক রিক্সাওয়ালাকে ডাব দিতে দিতে) একে ছেড়ে দিই আগে।
আমি : তা ভাই, ভোট তো এসে গেল। কি ভাবছো, দেবে তো?
ডাবওয়ালা : (মুচকি হাসি)…
রিক্সাওয়ালা : (ডাবের জলে চুমুক মেরে) হাঁ হাঁ দিবো না কেনো? জরুর দিবো।
ডাবওয়ালা : (আমাদের জন‍্য শাঁসওয়ালা ডাব বাছতে বাছতে) আর ভোট! (দীর্ঘশ্বাস)
আমি : (চোখের ইশারায় শঙ্করদাকে : ক‍্যামেরা!) কেন ভাই, দিদিতে আর আস্থা নেই?
ডাবওয়ালা : (ম্লান হেসে) দাদা-দিদির ব‍্যাপার না। আমি ছোটখাটো ব‍্যবসা করে খাই। আমার টাকা লয়ছয়? সারদা আমার হাতের নাড়ি কেটে নিয়েছে!
রিক্সাওয়ালা : (এক ছুঁড়ে খাওয়া ডাবটাকে ফেলে) সি জন্যিই তো ইবার মুদিজীর আসা উচিত!
শঙ্কর : (ডাবের শাঁস চিবোতে গিয়ে গিলে ফেলে, আমার হাতে ক‍্যামেরা ধরিয়ে) ইল্লি আার কি! কেনো রে? কে আনবে তোর মুদিকে রে ব‍্যাটা?
রিক্সাওয়ালা : (একটু পিছিয়ে) কে আনবে? হামরা আনবে!
শঙ্কর : (ক্ষেপে গিয়ে) তোদের বিহারীদের আসি বছর না হলে বুদ্ধি খোলে না। বঙালমেঁ আকে বড়া বড়া বাত! শহরটাকে ছিবড়ে করে দিলি সালা! গা থেকে তো পঞ্চাস্ গ্রাম ময়লা বেরোয় যখন দেস্ থেকে আসিস্। তেলচিটে ধুতি থেকে ডেড় কিলো। চটির ওজন আধ কিলো। হাওড়াতে নেবে পাঁচ টাকার একটা লাইফবয় আর এক টাকার পাউচ তেল কিনিস। তারপর ধুতি চটি গঙ্গাঁয় ফেলে চুলে কলকাত্তাইয়া ছাঁট মেরে বনে যাস কলকাতার বাবু!
আমি : (মাইক, ক‍্যামেরা সামলে) ওকে, ওকে, এনাফ্!
রিক্সাওয়ালা : এ বঙালী! মুখ সামলে!
শঙ্কর : (ডাবে চুমুক মেরে) যা যা যা!
আমি : শঙ্করদা, অ‍্যাকশন্, কুইক্!
শঙ্কর : ওক্কে, ওক্কে, চলুন!

আমি : আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই! আপনার তো দিদির বডিগার্ড হওয়া উচিত ছিল!
শঙ্কর : হে হে হে হে। টাইম আছে। এই তো সবে দিদি গাছ পুঁতেচে। ঐ বেহারি ব‍্যাটা যাই বলুক। বিজেপি আসা মুসকিল বুইলেন! ভাইপো আর পিসিকে যদি জেলে পুরতে পারতো, বিজেপি হর হর করে আসতো।
আমি : এত রাজনীতি শিখলেন কোত্থেকে?
শঙ্কর : জ‍্যোতিবাবুর থেকে। অ‍্যা…ই… চামচিকে! (গাড়িতে ব্রেক্, ক‍্যামেরা সামলাতে গিয়ে আমি হুমড়ি প্রায়।)
আমি : কী হল এটা?
শঙ্কর : (গাড়ির জালনা খুলে এক সাইকেল আরোহীকে) ঠাঁটিয়ে মারব চড়। কানা না কি রে উচ্চিংড়ে?
সাইকেল আরোহী : (ফুঁসে উঠে) তা মারুন না! মার খাবার জন‍্যে গাল পেতে বসে আছি তো! শালার সূর্য‍্য মারছে, দিদি মারছে আর তুমিই বা বাদ যাও কেন? (সাইকেলে উঠে পেডালে চাপ।)
আমি : অ‍্যাই, অ‍্যাই ভাই! রোককে! শঙ্করদা, ক‍্যামেরা!
শঙ্কর : এই চামচিকেটাকে?
আমি : গেট রেডি! ও ভাই, তুমি বাই প্রফেশান, মানে —
সাইকেল আরোহী : (হাত দেখিয়ে) বুঝেছি বুঝেছি। আমার টেলারিং দোকান। কেন? ফাটা ফুটি সিলতে দেবেন?
আমি : ভাই, তাড়া না থাকলে ভোট নিয়ে দুটো মতামত দিয়ে যেতে…
সাইকেল আরোহী : তাড়া আর কী? দুপুরে বেশী দেরী করে গিলতে গেলে গিন্নী এই এনার মতোই কথার ছিবড়ে ছিটোবে।(নিজের চপ্পল খুলে হাতে নিয়ে) আমার ক্ষ‍্যামতা যদি থাকতো সব শালার পাছায় এই পঁচিশ টাকার চটির বাড়ি মেরে ভাগাতাম, বুঝলেন!
আমি : কিন্তু আপনাদের এদিকে দিদি তো বেশ জনপ্রিয়?
সাইকেল আরোহী : দিদি এবার জনপ্পিও না হয়ে জুতোপ্পিও হবেন। বাড়িতে চাল থাকলে শালা ডাল নেই। আবার লেকচার! ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বদলা নেবেন ওনারা। (নিজের শার্ট তুলে ছিন্ন ভিন্ন গেঞ্জী দেখিয়ে) তাতে এ শর্মার কি লাভ? (এবার পকেট থেকে ন‍্যাতানো পাঁচশো টাকার নোট দেখিয়ে) এটা আমার ঘামের টাকা। আর ও শালারা ঠাণ্ডা ঘরে বসে কোটি টাকার হরির লুটে কী পাইনি তার হিসেব কচ্ছে! সিপিএম বাইশ কোটি নেয়। বিজেপি নেয় কুড়ি কোটি। আর আমি বারো কোটি নিলে লোকের চোখ টাটায় — দিদির কতা শুনুন! কোটি কারে কয়, কত্তা?

আশেপাশে দু একজন পথ চলতি মানুষ সাইকেল আরোহীর ভাষণে জড়ো হয়েছে। এক কালো চশমা পরা মোটরবাইক আরোহীও আছেন।
মোটরবাইক আরোহী : (বুক পকেট থেকে পান মশলার পাউচ খুলে গলায় ঢেলে) তাহলে কি জোট ভাবছেন দাদা?
সাইকেল আরোহী : (সাইকেলে মৃদু পেডাল মেরে) ধুস্! ওসব করাত-ফরাত দিয়ে বাংলা চলে না। (খোলা গলায় হেসে) বিজেপির কথায় নাচছো বাবারা? ভোটের পর কোথায় যাবে? লণ্ডন? দিদি শাসিয়ে রেকেচে — হয় জোড়াফুল শুঁকবি নয় পরিষ্কার হয়ে যাবি! ভ‍্যানিশ্!
আমি : শঙ্করদা, প‍্যাক আপ! লাঞ্চ ব্রেক!
শঙ্কর : এখুনি? চলুন বারাসতটা পেরিয়ে যাই। ভালো ধাবা আছে সামনে। এবার বইমেলায় গিছিলেন?
আমি : হ‍্যাঁ, ওই একদিনই।
শঙ্কর : দিদির কবিতার বই দেখলেন?
আমি : না তো!
শঙ্কর : সে কি! চল্লিস্ লাখ কপি ছেপেছে না কি! সুপার হিট! একন লোকে এমনি কিনেছে না গলায় গামছা পিঁচিয়ে কিনিয়েছে তা বলতে পারবো না।
আমি : শঙ্করদা, পেটে ছুঁচোর কেত্তন চলছে!
শঙ্কর : আর ধাবাও উঁকি দিচ্ছে। চলুন না, দেকবেন কেমন ফাস্টোকেলাস জাগা!

ক‍্যামেরা আমার হাতে। বাইরে সরে সরে যাচ্ছে হলুদ সর্ষেফুলের ক্ষেত। কোথাও বা পেঁয়াজকলির সাদা সাদা ফুল। ঢেঁড়শ চারা, মৌরীর গাছ। নীল আকাশ! দাবদাহ! এইবার বটের ছায়ায় সেরা ধাবা। স্রেফ ভাত ডাল পাতিলেবু আর পাঁচমেশালীর তরকারি। বেড়ে ব‍্যাপার!
শঙ্কর : (গলা তুলে) ভাই জলদি!
আমি : ধাবাওয়ালাকে ধরবো না কি?
শঙ্কর : শান্তিতে একটু খেতেও দেবেন না? এখেনেও মদন-মুকুলের মুড়িঘণ্ট চাই আপনার?
আমি : যত বাইট, তত লাভ! চ‍্যানেলওয়ালারা খুশ্, আমার পকেটও খুশ্!
শঙ্কর : ধু-উ-স্! অতো অধৈর্য‍্য কেন? হবে, সব হবে। আপনি ভগবান মানেন তো? ভালো কাজে তিনিই ভরসা।
আমি : ভালো মন্দ জানি না, কাজটাই বুঝি। আপনি মানেন দেখছি!
শঙ্কর : কী জানেন, দুঃখু হয় যখন দেখি ভগবানও শক্তের ভক্ত। এই যে মুকুল দত্ত, কারণ পূজো করে। মা সারদা মদনের বুক পকেটে থাকে। সালা, মাকে নিয়ে সেই যে জেলে গেলো এখনো সুস্থ হতে পারছে না। হাসপাতালে বুক চেপে ঢপের চপ হ‍্যা হ‍্যা করেই চলেছে। অ‍্যাই দ‍্যাকো, আবার আমাকে ধরলেন ক‍্যামেরায়?
আমি : আপনি তো জানেন, শো-এর শুরুতে ক‍্যামেরা চালু হলে শেষ হবে একেবারে কাট্-এ। বলুন, বলুন!
শঙ্কর : সালা, যতো বড় বড় নেতা সব সালা ডাকাত, সব সালা দেখবেন আবার মা-এর ভক্ত! ডাকাতিও করবে, বিলোবেও, এই যেমন দিদি চল্লিস লাখ সাইকেল বিলিয়েছে। হোক না, কোনো কোনোটাতে হ‍্যাণ্ডেল নেই, টায়ার নেই, তবু দিয়েছে তো! নিন, গরম গরম খেয়ে নিন।
আমি : এবার কোলকাতার দিকে ফেরা।
শঙ্কর : (ধাবাওয়ালাকে) ও দাদা! এট্টু টক্ হবে না?
ধাবাওয়ালা : আমড়ার। দোবো?
শঙ্কর : (আমড়া টক চেটে) মদন-মুকুল পোক্ত পাপী। পুরনো মাল। ছেলের বিয়েতে মদনা পাঁচ হাজার টাকার প্লেট করলো। মেনুতে আটাসটা রাজ্যের খাবার। টাকা কোথায় পেলো? এই যে (আমড়া আঁটি দেখিয়ে) আমড়া আঁটি, আমরা দিইছি। আঁটি চুসে ফেলে দিলেই হোল। কাজ সেস্। উটুন!
আমি : আর অপোজিশান?
শঙ্কর : ধু-উ-র! নকল দাঁত কপাটি লাগানো বুড়োর দল! চারসো কুড়ি সুগার! অম্বল! চোঁয়া ঢেকুর! গ‍্যাস! ব‍্যস করুন তো!

আমরা ফিরে চলেছি কলকাতার পথে। দিন শেষ হয়নি এখনো তাই আশাও শেষ হয়নি। আরো কিছু মানুষের কথা হয়তো ঝুলিতে ভরে নিতে পারবো। আসুন, চোখ রাখি জীবন পথে।
আমি : শঙ্করদা, চৌরঙ্গীঁ ধরে নেবেন।
শঙ্কর : হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, পথে আপনাকে ভালো ভালো জিনিস দেখাবো, চলুন!
আমি : এক মিনিট, একটু সাইড করুন তো! এই ট্র‍্যাফিক পুলিশটাকে একটু… দাদা! আগামী ভোট নিয়ে যদি কিছু বলেন…
পুলিশ : কী বলবো?  কিছু বললেই তো বাঁকুড়া পাঠিয়ে দেবে!
শঙ্কর : (আমাকে) চলে আসুন, চলে আসুন! এ ভরা ঘটি, নড়বে না!
আমি : নিন, স্পিড তুলুন। কথা আরো কিছু বাকি, শহরের বুক থেকে তুলে নেবো।

ইংরিজিতে একটা কথা আছে — চ‍্যারিটি বিগিনস্ অ‍্যাট হোম্। তাই মিশনে বেরোবার মুখে ধরেছিলাম আমার দিদিমাকে। ভোট নিয়ে উনি কী ভাবনা চিন্তা করছেন, আসুন এই ফাঁকে দেখে নিই এক ঝলক!
আমি : দিদা, ভোটের ভট্ভটিতে তোমার কথা দর্শক বন্ধুদের কিছু বলো!
দিদা : কী কমু ক’? যা সব দ‍্যাখত‍্যাসি কানা হওয়াই ভালো আসিলো। একডা পোলাপানরে চক্ষু বাইন্ধ‍্যা জঙ্গঁলে ছাইর‍্যা দিলো দলের পতাকা ছেড়নের লাইগ‍্যা! ঘোর কলি! আবার কয়, আমাগো ভোট দিবা তো?
আমি : ভোট দিতে যাবে না তুমি?
দিদা : যামু না ক‍্যান? আলবাত্ যামু। ছ‍্যামড়াগুলা আমার ভুটে ছাপ্পা দিবে, তা হবা না! তয় সমস‍্যা হইতেসে, দিমুডা কারে? চুরের সাক্ষী মাতালগুলা। ঐ সে বুড়াডা? কি নাম য‍্যান?
আমি : দিদা, বুড়োয় তো রাজনীতির মাঠ ভরা। কোন বুড়ার কথা বলছ?
দিদা : দ‍্যাশের প্রধান পাঁঠা! হ‍্যারে মিষ্টি খাওয়াইতে গেসিলো সিপিএম-এর ক‍্যারাটে?
আমি : তুমি এতো খবর রাখো!
দিদা : তা রাখুম না! সচেতন নাগরিক! টিভি-তে রাইত দিন এর লগেই তো কূটকাচালি! দিল্লীর দুই ছ‍্যামড়া — ডেরেক আর ব্রায়েন হাটে হাঁড়ি ভাইংগলো!
আমি : দিদা, দিদা, উনি একজনই ডেরেক ও’ ব্রায়েন। আর ক‍্যারাটে না, প্রকাশ কারাত! এনিওয়ে, এবার তুমি তোমার আশি বছরের ভোটটা দেবে, তোমাকে শুভেচ্ছা!
দিদা : হ হ, যার নাম চালভাজা, তার নামই মুড়ি!

শঙ্কর : দেকুন, লালবাজার। এ বাজার যতো কম দেখা যায়, ততো ভালো।
আমি : ঠিক!
শঙ্কর : এবার আসছে চোরবাজার! লোকে এখেনে হাঁড়ি কুড়ি গয়না বেচতে আসে।
আমি : দাদা, এ তো হাইকোর্ট!
শঙ্কর : তাই তো! এবার দেকুন, আমার বাবার বাড়ি!
আমি : হেঃ, রাজভবন!
শঙ্কর : হ‍্যাঁ! আমি রাজার ছেলে! ট‍্যাকসো দিই রীতিমতো! ঐ দেকুন নেতাজীকে আমার বাবা দারোয়ান রেকেচে বাড়ির সামনে। হাত উঁচিয়ে বলছে নেতাজী — এই, গাড়িওয়ালা ব‍্যাটারা ঐ দিক দিয়ে ময়দানে চলে যা। এই ভিভিআইপি রোডে খামোখা ভিড় করিসনি। — এই দেকুন আকাসবানী, ওখেনে আমি গান করি — ধনধান্যে পুস্পে ভরা/ আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেস এক/ সকল দেসের সেরা/ ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেস/ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। — এই যে ডানদিকে দেখলেন গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেল? ওখেনে আমার জ‍্যাঠামশাই রোজ দুপুরে এক ঘণ্টার জন‍্য লাঞ্চে আসতেন!
আমি : কে মশাই তিনি?
শঙ্কর : জ‍্যোতিবাবু! এই যে  এসে গেলো গড়ের মাঠ। এখেনে আমি রোজ গরু হয়ে চড়ি। দিদির নামের জাবর কাটি। আর ঐ যে দেকুন ভিক্টোরিয়ার পরি! আমার বাবা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছিলো ইংরেজদের থেকে। দেকুন দেকুন, কেমন ডানা মেলে আছে। এ শহরের ভালো না হয়ে পারে! সো-ব ঠিক আচে। টেনসন নেহী লেনে কা। রাজার ছেলে আমরা! আচ্ছা, বলুন তো, কোন ইস্ট‍্যাচুর গায়ে কাগে হাগে না?
আমি : শঙ্করদা!
শঙ্কর : না, না, মাইরি বলছি। জানেন না? উই দেকুন গান্ধীজী। ওনার মাথায়। কেন বলুন তো? গান্ধীর হাতের লাঠিটাকে কাগগুলো ভয় পায়। উচ্ছিস্টো মরা খুঁটে খায় যারা, তারাও গান্ধীজীকে ভয় পায়। আর গান্ধীজীর পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে নেতাগুলো হাজার হাজার লোকের সামনে কুকথায় গলা ফাটায়। ঐ যে সুনুন! আজও ফাটাচ্ছে!

নেপথ‍্যে গর্জন ভেসে আসে — ‘আমার হাতে মাইক আছে বলে আমি তো যা খুশি বলতে পারি না! আমার কথার দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু এটা কী হচ্ছে? কেরালায় চুলোচুলি, এখানে কোলাকুলি! এর নাম জোট? আমাকে জোটের যোগ দেখানো? চাব্কে ছাল ছাড়াবো। আবার আমাদের চোর বলা! বেশ করেছি চুরি করেছি। — আবার করবো। হাজার বার করবো। যা ক্ষমতা থাকে করো।’

আমি :  (ক‍্যামেরায়) দেখুন, গান্ধীজী ভয়ে জুজু! সত‍্যি তো, কাকেদেরও যে সাহস নেই সে সাহস আছে বটে ক্ষমতার। শঙ্করদা, চলুন এবার স্টুডিওতে ফেরা যাক!
শঙ্কর : কিন্তু আপনার তো আরো বাইট নেবার ছিলো!
আমি : (শঙ্করদার কাঁধ চাপড়ে) আপনিও তো মা মাটি মানুষ! না কি? বলুন কিছু!
শঙ্কর : জব্বর গালিটা দিয়েই দিলেন দেখছি!
আমি : মানুষের মুখের শেষ কথার বেশ কথা শুনে নিলাম শঙ্করদার মুখে। এই হল ভোটের ভটভটি । শুভরাত্রি বন্ধুরা। ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন এই আশায় — কাট্!

Facebook Comments


এই রকম নতুন গল্পের খবর ই-মেলে পেতে সাইন-আপ করুন এখনই!

Leave a Comment:

3 comments
Add Your Reply