ভাগ্নে শাঁটুলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালাম। সে তুম্বো গলায় বললে, ‘কিসের নববর্ষ, মামী?’
‘কেন রে, বাংলা নববর্ষ!’ গদ্গদ্ হয়ে বলি।
সে বললে, ‘হ্যাঃ!’
‘পয়লা বোশেখে করলি কি?’ হাল না ছেড়ে শোধাই।
সে কিছু উদাস সুরে বললে, ‘আর পয়লা বোশেখ! ওর মানেটা কি বল তো?’
‘মানে, মানে আর কি!’ তোতলে ফেলি আমি। ‘বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটা একটু ভালোভাবে কাটানো, আনন্দে কাটানো, এই তো!’
‘রাইট! তার মানে, এই ধরো বেশ জম্পেশ একটা ভুরি-ভোজ! কিছু মস্তি! একটা হেব্বি হিট মুভি, এই তো! তা এ বাড়িতে থেকে এসবের কিছুই পসিবল্ নয়।’
‘কেন?’
‘আর বোলো না! ইদানীং মা যা শুরু করেছে! আমডাল, আলুপোস্ত, মুসুর ডালের ঝাল বড়া সব তামাদি হয়ে গেছে পাত থেকে। বদলে পড়ছে পাস্তা স্পিনাচ্, স্প্যাগেতি ইন হট সেজুয়ান স্যস্, বিটার গোর্ড উইথ কোকোনট টেম্পুরা এই সব!’
‘তা খারাপ কি? শুনেই তো জিভে জল আসছে রে!’
‘কচু আহা! ঐ যে বলে না, খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে, কাল হল তার জাহাজ কিনে। যবে থেকে মা ঐ কি একটা মহিলা ম্যাগাজিনের ওয়ার্কশপে যাওয়া ধরেছে, রান্নার কেলাসগুলো আ্যটেণ্ড করে যখনই, তার পরে পরেই দেখি পাত থেকে উপে যাচ্ছে সোনালী করে ভাজা লম্বা ডাঁটাওয়ালা বেগুন, কষা পাঁঠার ঝোল, মৌরলার টক, শুক্তো, ঘণ্ট! বদলে পড়ছে মটনের ডাকবাংলো! চিকেনের চিড়িয়াঘর! মুসুমুসু মোমো! ছিলাম তক্কে তক্কে। পয়লা বোশেখের আগের দিন মার নতুন রান্না ভেটকি উইথ হ্বাইট চকোলেট স্যস দিয়ে সোনামুখ করে ভাত সাবড়ে মাকে ধরালাম টপ টু বটম একখানা অথেণ্টিক বং মেনু লিস্টি। বোশেখী স্পেশ্যাল! দেখেই মা চোখ উল্টে বললো, “তুই বাবা এসব ভজহরির কাছে খা-গে যা!”’
‘ভজহরি কে রে? নতুন রাঁধুনে পেলি না কি?’ নামের মাহাত্মে্য চমৎকৃত হই আমি।
উৎসাহে জল ঢেলে শাঁটুল বললে, ‘আরে মামী, পাড়ার শপিং মলের ফুড কোর্টে রেস্টুরাণ্ট, নাম তার ‘ভজহরির রান্না’! মার উপর খেপে গিয়ে বললাম — “ওয়াটস্ দিস্ মা! আজকাল একটু লুচি-ছোলার ডাল খেতেও তুমি বলো, পাড়ার ‘বৌদির রান্নাঘর’ থেকে গরমা গরম নিয়ে আয় না, শাঁটুল!” মা বললো, “বাঙালী রান্নার হ্যাপা আমার কোমর আর নিতে পারে না বাপু!” তখনই মাথায় এলো, ওহ্ ক্যালকাটায় কব্জি ডুবিয়ে সাঁটালে কেমন হয়! কোথায় ভজহরির রান্না আর কোথায় ওহ্ ক্যালকাটার খাস বং রান্না? তবে হ্যাঁ, ভজহরির এলেম আছে বটে। রোজ বিকেলে ফাইভ টু নাইন স্রেফ হাতে গড়া আটা রুটি বেলে বেলে তিন মাসে তিনতলা ম্যানসন তুলে নিয়েছে।’
‘বলিস কি!’ এটা নিউজ বটে!
শাঁটুল আলতো হেসে বললে, ‘হবে না? বাঙালীর বাড়িতে আর তুমি বেলন-চাকি পাবে না। লাস্ট ছিল পাড়ার গিরি ঠাকুমার বাড়িতে। ঠাকুমা টেঁসে গেলে ওর ছেলে গিয়ে ওটা মিউজিয়ামে দান করে এসেছে। কোলকাতায় এলে এবার যেও। হাতে করে ঘোরানো ডায়াল ফোন আর হাতে দম দেওয়া দেওয়াল ঘড়ির পাশে মানানসই হয়েছে হাত ঘোরালেই নাড়ু, স্যরি, রুটি খাওয়ার বেলন-চাকিটা।… তা যা বলছিলাম! বাবার কাছে চাইলাম হাজার দশেক। আঁতকে উঠে বললো, “কি করবি?” বললাম, “কি আবার, পয়লা বোশেখে খাবো!” ভিরমি খেয়ে এক হাট লোকের মাঝে বললো, “কি? আমার দশ হাজার টাকার হাগবি তুই?” আমি তো বাবার এরকম যা-তা একটা কথার পাঞ্চে নক্ আউট্! মা আমার ভোম্বলমার্কা মুখ দেখে অবশ্য অবস্থা সামলাবার জন্য বাবাকে “কাট্ বাঙালের কথা শোনো” বলে ধমক ধামক দিলো। কিন্তু আমার আর খাওয়ার প্রবৃত্তিই হল না, বুঝলে মামী! মনের দুঃখে মার রাঁধা স্টাফ্ড ক্যাবেজ ইন গার্লিক ডিপ্ আর অ্যাপেল ক্যারামেলের কেরামতি হজম করে চলে গেলাম ঘরে। মন শান্ত করতে মা সাপ্লাই দিল ‘ব্যামা ক্ষ্যাপার বাম চরণ’। বসে বসে তাই দেখলাম ডিভিডিতে।’
বেচারা বর্ষবরণের দিনটা বড় দাগা পেয়েছে তো! শাঁটুলের উৎসাহ ফেরাতে বললুম, ‘শাঁটুল, নববর্ষ মানেই কব্জি ঝোলে ঝালে ডুবিয়ে পেট পূজন নয় রে!’
সন্দেহের গলায় সে বললে, ‘তো? এখানে আর কি আছে করার?’
‘কেন, গঙ্গাঁর ধারে গিয়ে নতুন বছরের নতুন সূর্য্যের দিকে তাকানো যেতে পারে। নতুন অঙ্গীঁকার…’
‘খেপ্-পে-ছো?’ শাঁটুলের আর্ত চীৎকারে চমকে উঠি। ‘সূয্যির দিকে তাকাবো? সাড়ে চুয়াল্লিশ ডিগ্রীর ভাঁটার গোলা? মামী, তোমাদের এই তামসিক-তামাশার-তাড়না আমি আর নিতে পারছি না!’
শাঁটুলের ত বর্গীয় শব্দ বোমার আক্রমণে তোতলে বলি, ‘বাবা, শান্ত হ! আমি খাওয়াবো তোকে ওহ্ ক্যালকাটায়।’
সে ভাঙা গলায় বলে উঠল, ‘ওহ্ নো!’