Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.
ছেলেবেলায় ১লা এপ্রিল এগিয়ে এলেই তক্কে তক্কে থাকতাম, কেউ বোকা না বানাতে পারে। হয়তো সারাদিন বেশ তরতরিয়ে উতরে গেলাম, রাত্তিরে ঘুমুতে যাবার আগে নিয়মমাফিক টয়লেট পর্ব চুকাবো বলে ঢুকেছি, পেছন থেকে ভাইয়ের বাজখাঁই চীৎকার, ‘ছোড়দি, আরশুলা!’ ব্যস্, আর যায় কোথা – ‘নাচো না কথাকলি, নাচো কত্থক/ মণিপুরী কুচিপুড়ি দেখে যাবে লোক’। বোকা বনে মুখ চুমড়ে থাকতাম, সহ্য করতাম ভাইয়ের হো হো হাসির বেয়াড়াপনা!
পয়লা এপ্রিলের আগের দিন বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ গনেশ টকীজের কাছে বিবেকানন্দ সেতুর একটা বড় অংশ পুরো ভেঙে পড়লো রাস্তায়। ছুটিছাটার দিন নয়। রাস্তা ভরা যান। তাতে ভরা বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এক মূহুর্তে সব ভ্যানিশ্!
বামফ্রণ্ট সরকারের চৌত্রিশ বছরের জগদ্দল পাথরের মতো ভারী সরকারকে সরাতে আজকের মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, সেই কোলকাতাবাসী কয়েক লক্ষ টন ভারী বীমের তলায় চাপা পড়ে বেঘোরে প্রাণ দিলেন।
আমি টপ্ টু বটম্ একজন নিটোল অরাজনৈতিক মানুষ। কারণটা কিছুই নয়, আমি প্রেশারের রুগী। কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাবজেক্টে নাগরিক হিসেবে আমার কি কি কর্তব্য তার কুড়ি নম্বরের প্রশ্নপত্র এলেও দেশের শাসকদের কর্তব্যটুকু নোট করেনি কেউ। এই হবুচন্দ্রের রাজ্যে মন্ত্রীগুলোও এক একটি গবুচন্দ্র হবেন এ আর বিশেষ কি! এদের বাতচিৎ, রং ঢং বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারি না। কিন্তু এতো বড় একটা ঘটনা। পঞ্চেন্দ্রিয় উলটে বো্যমভোলা হয়ে থাকি কি করে! নিকট আত্মীয়রা ভৌতিক শরীরে জীবন্ত আছে পেত্যয় পেয়ে আজ কলম ধরতে কিছু হিম্মত পেলাম। এই কদিন ধরে প্রেশারের ওষুধ ঠুসে নিজেকে শান্ত রেখেছি, আর পারা যাচ্ছে না। বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে ঢুঁ মেরে মেরে যা দেখলাম, শুনলাম এবং বুঝলাম তাতে গতিক সুবিধের নয় মশাই। বামফ্রণ্ট জমানায় মহিলা বারকতক মাথায় বাড়ি খেয়েছিলেন না! তারই নিটোল ফল ফলছে আজ। ওনার এবং ওনার প্রতিনিধিদের এমনই খানকতক বাতচিৎ চিত্রনাট্যের আকারে তুলে ধরছি আপনাদের সামনে। আপনারাই বিচার করুন কার রাজত্বে আছি আমরা।
সংলাপ ১
সাংবাদিক: আপনি বলছেন এই ফ্লাইওভারের প্রোজেক্ট তৈরী হয়েছিল ২০০৮ সালে, বামফ্রণ্ট জমানায়, তাই এই দুর্ঘটনার দায় আপনাদের উপর বর্তায় না। এটা কেমন কথা? আজ আপনার পেট খারাপ হলে আপনি কি অন্নপ্রাশনের ভাতকে দুষবেন?
জনপ্রতিনিধি: প্রোজেক্টটা যখন ওদের সময়ে শুরু হয়েছিল তখন ওদেরই সব প্ল্যান-ফ্যান দেখার কথা।
সাংবাদিক: (নাছোড় সুরে) কিন্তু তারপর তো আপনারা পাওয়ারে এলেন। ৮ বছর ধরে এই ফ্লাইওভারের কাজ এগোয়নি। প্ল্যানটা আপনারাও দেখতে পারতেন, যে কিসের জন্য এটা আটকে আছে?
জনপ্রতিনিধি: আচ্ছা গেরো তো! দেখালে তো দেখবো! তখন সবে পাওয়ারে এসেছি। ভিখিরির দশা। একটা মালকড়ি ছেড়ে যায়নি বজ্জাতগুলো! ঘটিবাটি যোগাড় করতে তখন নাস্তানাবুদ, এসব দেখার সময় কোথায়? তাছাড়া তখন ফ্লাইওভারের ৬০% কাজ হয়ে গেছে। আর এমনি এমনি ওটা বন্ধ করে দেবো? পয়সা কি গাছে ফলে?
সাংবাদিক: হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু তখন প্ল্যানটা দেখলে এতগুলো লোকের প্রাণ তো যেতো না!
জনপ্রতিনিধি: (ভীষণ রাগকে ভেতরে চেপে, ভুরু কুঁচকে, ‘আপনি’ থেকে সটান ‘তুমি’তে) সে তোমার মত, আমার মত নয়। আর তাছাড়া আমি কে? বাংলার মানুষই তো সরকার! তারা মা-মাটি-মানুষ। আমি তো জনপ্রতিনিধি মাত্র!
সাংবাদিক: তো, আপনি বলতে চান মা-মাটি-মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য ফ্লাইওভারটা ভেঙে পড়ে গেল?
জনপ্রতিনিধি: হ্যাঁ, মানে ইয়ে, না! না! অ্যাই, নো মোর কোয়েশ্চেন্স!
সাংবাদিক: স্যর, স্যর!
জনপ্রতিনিধি: নো! মিনিস্টার উইল রিপ্লাই। নট্ মী!
সাংবাদিক: কিন্তু কেন স্যর?
জনপ্রতিনিধি: আমি জনপ্রতিনিধি মাত্র!
সংলাপ ২
হার হাইনেস পাওয়ারে আসার পর থেকে বামফ্রণ্টের ছায়ার সঙ্গেঁ যুদ্ধ করে করে সর্বাঙ্গেঁ ব্যথা করে ফেলেছেন। সর্বত্র উনি বামফ্রণ্টের সাজিশ খুঁজে পান। পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে ঘুরছে কোন চক্রান্তে, তার জবাবদিহি করতে উনি পারলে বামফ্রণ্টকে ফ্রণ্টে পেলে মুণ্ড চিবিয়ে খান। সে যাক —
সাংবাদিক: ম্যাডাম, এই যে দুর্ঘটনায় এতগুলো প্রাণ গেলো…
ম্যাডাম: এতগুলো? আপনি গিনতি করিয়েছেন কি? আপনি ছিলেন উখানে?
সাংবাদিক: (নিজের মনে — ‘এই রে, ঘটনা বড়বাজারে ঘটেছে বলে মালটা বড়বাজারিয়া ঢং-এ কথা বলছে মাইরি’) না ম্যাডাম! তবে আমাদের কাছে লেটেস্ট যা খবর এসেছে তাতে…
ম্যাডাম: এখনো অবধি মরেছে মাত্র ২০ জন। আহত হয়েছে অবিশ্যি বেশ কিছু। যারা মরে গেছে তারা তো গেছেই। ওদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা অমুকবাবু ডিটেলে বলবেন।
সাংবাদিক: সে ঠিক আছে, তবে উদ্ধারকাজে এত দেরী কেন? কত প্রাণ ঐ মোটা মোটা বীমের তলায় না জানি এখনো আটকে আছে, ম্যাম, আর আপনি বলছেন হত মাত্র ২০!
ম্যাডাম: একটা ৪০ টন কে্রন যে মোটা বীম তুলতে পারলো না সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায়, সেই বীম তুলে আপনি দেখেছেন হতের সংখ্যা?
সাংবাদিক: (আমতা আমতা সুরে) এর থেকে ভালো হতো না কি যদি সেনা নামিয়ে উদ্ধারকার্য্য চালু করে দিতেন? বীমের তলায় প্রাণগুলো হয়তো রক্ষা পেতো। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ এগুতো।
ম্যাডাম: (দাঁত কিড়মিড় লুকিয়ে) তখন থেকে কী বীম বীম করছেন, বলুন তো! অতগুলো বাস, ট্যাক্সি, লরি, রিক্সা সেগুলো?
সাংবাদিক: হ্যাঁ, তাই তো! সেগুলো কোথায়?
ম্যাডাম: (সাংবাদিকের নাকের ডগায় হাত দেখিয়ে) আছে, সব আছে। ফ্লাইওভারের তলায়।
সংলাপ ৩
এক নিরীহ ভিখিরি হার হাইনেসের বাড়ির সামনের রাস্তায় ভিক্ষে করতে করতে গাইছে: ‘সারদা রামকৃষ্ণ নামে বাণ ডেকেছে রে ভাই/ বিবেক-আনন্দের নামে প্রাণে প্রাণ দেওয়া চাই…’
রবার চটি ফট্ফট্ করতে করতে হার হাইনেস প্রচণ্ড হুঙ্কার দিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বসার ঘরে যতো সব খিদমতগার তোষামুদের দল বসে ছিলেন, চমকে উঠলেন। ‘মারব এক থাপ্পড়! এই গান গাওয়া হচ্ছে কেন আমি বুঝি না? সব সি.পি.এম-এর চক্রান্ত! এই, কে আছিস? এই ক্যাডারটাকে বের করে দে আমার বাড়ির সামনে থেকে!’
হতভম্ব ভিখিরিকে সবাই মিলে ‘এই যাও! যাও!’ বলে তাড়িয়ে দিলে।
কিছু পরে একটু মিশ্রির জল পান করে ম্যাডাম শান্ত হলেন। তখন জনৈক নিকট চ্যালা সন্ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — ‘কি ব্যাপার! আপনি ভগবানের নামে ওরকম রিঅ্যাক্ট করলেন কেন?’
ম্যাডাম গরম সুরে বললেন, ‘ভগবান? তুমি চালাকিটা বুঝতে পারছো না ওদের! আগে সারদা, তারপর বিবেকানন্দ। এখন আমার বাড়ি রামকৃষ্ণ ধামে এসে ত্র্যহস্পর্শের বাণ মেরে আমাকে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এসব, বুঝলে?’