Download this post in PDF format if your browser doesn’t display Bangla script properly.
আমার তো আর হেড আপিসের বড়বাবুর মতো স্পেশাল গোঁফজোড়া নেই, যার দৌলতে নিজেকে চেনাতে পারি। থাকার মধে্য ঘাড়ের সঙ্গেঁ বাঁধা ছিলো খুড়োর কল! সামনে ঝোলানো ছিলো কতো মেঠাই মণ্ডা। চপ-কাটলেট, খাজা-লুচি, মনের যেমন অভিরুচি। মন যতো বলতো খাব! খাব! মুখ চাইতো যেতে এগিয়ে। ব্যস্, আর যায় কোথা! লোভের টানে টানে জীবনের আধখানা রাস্তা দিলুম পলকে পার করে। লোভ কিসের? রসুন, সে কথায় আসছি ফিরে। তার আগে মনের ভারটুকু নামাই।
উৎসাহেতে ছিল না হুঁশ। কেবল চলেছিলুম ধেয়ে। হঠাৎ ভবিতব্যে গোঁত্তা খেয়ে থামতে হল। বুঝলুম মণ্ডা সকলের খাওয়ার জন্য নয়। খুড়োর কলখানা দিলুম ঘাড় থেকে নামিয়ে। এই বেশ হল। হালকা ফুরফুরে মনের জালনাটা খুলে বসি, তারপর শোনাই আপনাদের আমার গাজরের লোভে গাধা হয়ে ছোটার কাহিনী।
কথায় বলে, জন-জামাই ভাগনা/ তিন নয় আপনা। তা কতকটা সত্যই বটে! আমার ভাগনা শাঁটুল একদিন মাথায় বুনে দিলো সব্বোনেশে আশার বীজ। ‘মামি, তুমি লেখো!’
বললুম — ‘লিখব? কি?’
সে মাছি তাড়ার ভঙ্গীঁতে বললে — ‘তোমার ঐ দেড় কিলো আলু, পোয়াটাক ভিণ্ডি, ভিম বার, ঘর নেতানোর লাইজল-এর লিস্টি নয়। আসল লেখা লেখো! যে লেখায় এই ধেধ্বেড়ে পুরনো পৃথিবীটা নতুন ঠেকে লোকেদের চোখে। জীবনটা সিঁদূর লেপা বলিকাঠ নয়, আ্যমিউজিং পার্কের রোলার কোস্টার মনে হয়।’
আমার ঝুলন্ত ব্রিজের মতো চোয়াল দেখে বিরক্ত হল শাঁটুল। — ‘যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পর্য্যন্ত একাধারে রাঁধে-বাড়ে-চুল বাঁধে, এই লিখছে তো এই আঁকছে, এই “হেই সামহালো” বলে রাজ্যের দাঁড় টানছে তো এই ব্যাঞ্জো বাজাচ্ছে, এইরকম একটা ক্রিয়েটিভ রাজ্যের প্রজা হয়ে তুমি কিনা “দাদখানি চাল/ মুসুরি ডাল/ দুটো পাকা বেল/ সরিষার তেল/ চিনিপাতা দই/ ডিমভরা কই” করে জীবনটা কাটিয়ে দেবে? শেম্ শেম্!’

ভাগনার কথার চাপ সইতে না পেরে খুড়োর কলের ভার বয়ে বেড়ানোর সেই শুরু! স্বামীর কর্মক্ষেত্র নর্থপোলের মুণ্ডুদেশ ডেনমার্ক। আর বুড়ো মা আছে কোলকাতায়। দু জায়গায় দু পা রেখে সংসার সামলাই। ছুটকো ছাটকা লেখা ছাড়ি এদিক ওদিক। কভু সাড়া মেলে বছরে, দেড় বছরে। কভু মেলে না। দিনরাত গুনগুন করি, ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে।’ একদিন দেখি তোয়ালে জড়িয়েই কর্তা বাথরুম থেকে গটগটিয়ে বেরিয়ে এলেন।
— ‘তোমার এই বেদানার বালুচরে কি ফসল ফলছে জানি না। তবে আমার বালুচর খাঁ খাঁ। তুমি জানো যে টয়লেটে বই না পড়লে আমার মোশনস ডে সাকসেসফুল হয় না, অথচ তোমার ঐ গানের গুঁতোয় একটা লাইনও কনসেনট্রেট করতে পারছি না।’
মনের অভিজ্ঞতার তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিমগুলো টেবিলে বসে নাড়ি চাড়ি। দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভাবি, কি এমন ঘোড়ার ডিম যে প্রকাশের আলো পেলো না! ভাগনা স্তোক দেয়, — ‘ছাড়ো এসব ছিটকেমি। চলো, তোমার বই বের করি।’
আঁতকে বলি, ‘কিন্তু আমি, আমি!’
শাঁটুল সামলায় বাকিটা। — ‘শোনো, তোমার এখেনকার মেয়াদ আর ক’ মাস! তারপর তো দৌড়বে মামুর কাছে। কাল ফ্রাইডে। ধরে আনবো নওলকিশোরদাকে।’
‘সেডা আবার কে র্যা?’ — বৃদ্ধা মার প্রশ্ন।
শাঁটুল হাসে। — ‘প্রকাশক! প্রকাশক! তোমার মেয়ে ফেমাস্ হল বলে।’
এলো শুক্রবারের সন্ধে্য। সারাজীবন এদেশে কি ওদেশে রেঁধেবেড়ে কম লোক খাওয়ালুম না। কিন্তু এবারকার মতো মনে মন, প্রাণে প্রাণ গেঁথে রান্না কভু করিনি। দেখা গেলো নওলকিশোরবাবুর বুকভরা অসীম ক্ষমতা। মুহূর্তমধ্যে আমাদের ছোটখাটো বসার ঘরখানিকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেললেন। পুরুষহীন বাড়িতে ছাইদান কোথা! দেশলাইয়ের খাপেই দেদার ভস্ম ঢালতে লাগলেন। আর এক অদ্ভুত ব্যাপার! দু তিন মিনিটে মুহূর্মুহূ ফোনকল এলেই মুখে হাতচাপা দিয়ে মোজা পায়েই সোজা দেখি বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছেন। ফের বেরিয়েই চা-এর বিনীত হুকুম, এবং তৎসহ বক্তব্য — ‘বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী তো! ভাব ভাষা অলংকার জানা আছে নিশ্চয়ই?’
কিঞ্চিৎ গদগদ হয়ে বলি, ‘আজ্ঞে! সে বহুযুগের ওপার হতে…’
হাত দেখিয়ে থামিয়ে ফের বলেন, ‘ভাবতে হবে। এতো তো লেখা হচ্ছে! আবার আমি কেন?’
হাত কচলে বললুম, ‘তা তো ঠিকই, কিন্তু —‘
আবার স্টপ সাইন। — ‘পড়তে হবে। রুচিমান সাহিত্য। রাশিয়ান সাহিত্য জানা আছে কিছু? দস্তয়েভস্কি পড়া আছে?’
দেঁতো হাসি। — ‘আজ্ঞে না।’
‘হুম।’ কালোজামে এক কামড়। ‘দান্তে?’
জিভে দাঁতে ঠকাঠক লাগে। — ‘নো স্যার।’
‘হুমম্।’ কালোজামে অর্ধচন্দ্র কামড়। — ‘বোকোহারাম কি?’
‘মানে, বোকো মানে, হারাম…’ বোকার মতো তল খুঁজি প্রসঙ্গেঁর। আবার ফোন। আবার মোজা পায়ে টয়লেটে অন্তর্ধান।
গুমট মনে খাবার আনতে রান্নাঘরে ঢুকি। বুড়ো মা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘বারবার দেখতাসি বাথরুমে ঢুকতাসে। কি হইল কি?’
‘আঃ মা!’
মা চুপ হতেই চাপা গলা ভেসে এল কানে। — ‘আপনার ধৈর্য্য নেই কেন? নয়া বকরা অলমোস্ট ফিট। পার্টি শাঁসালো। ভিক্টিমের অবস্থা — আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান। খ্বিক খ্বিক খুক খুক… তবে হ্যাঁ, ডোণ্ট কল মি ফারদার। মোটা মাথার মাছ। খেলিয়ে তুলতে এনার্জি আর টাইম দুটোই যাবে।’ কাট্!
নেহাত ভাগনা তাই ভাগাতে পারলুম না তাকেও। মাসখানেক উদাস বাউল হয়ে রইলুম। শেষে আমার নিরন্তর কোঁ-কোঁ সইতে না পেরে কর্তা বললেন, ‘লেখালেখির ঢং ঢাং বন্ধ করছো কেন? কে বারণ করেছে? তোমার নিজের একটা ব্লগ করো। তারপর তোমার মনের যতো হাঁসজারু আইডিয়া আছে লিখে ফেলো! তবে হ্যাঁ, কতো লোকে পড়বে, না পড়বে, কি কমেণ্ট দেবে না দেবে, তা নিয়ে কোঁকাতে বোসো না। তোমার লেখার রং ঢং। তোমারই ডট কম্। লাল বাতি জ্বললে দোকান বন্ধ্!’